Friday, 20 June 2014

মানুষ চেনাল এভারেস্ট by ছন্দা গায়েন

মানুষ চেনাল এভারেস্ট


মার্চ মাস মেয়েদের মাস৷আজ রইল পদে পদে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে এক সাহসিনীর শিখর জয়ের কাহিনী৷ 

ছন্দা গায়েন

১৮ তারিখ সকাল ৭টায় উঠে পড়লাম এভারেস্টের চূড়ায়৷

এবার এগোলাম লোৎসের পথে৷২০ মে সেই শৃঙ্গও জয় হল৷লোৎসেতে পা পড়ল প্রথম ভারতীয় মহিলার৷ 

ভোর ৫টার সময় লোৎসের মাথা থেকে সূর্যোদয় দেখলাম, মনে হল এক টুকরো হীরকখণ্ডকে কেউ যেন দু হাতে তুলে ধরেছে৷

খেয়ালই করিনি যে মৃত্যু একেবারে কাছে এসে হাজির৷সম্বিৎ ফিরল এজেন্সির সঙ্গে যাওয়া পাসাং শেরপা যখন আমাকে আর দেবদাসদাকে আচমকা হাত ধরে একেবারে ঘুরিয়ে দিলেন৷দেখলাম, বরফের বিশাল চাঁইটা পিঠের রুকস্যাককে ছুঁয়ে চলে গেল৷অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে সেদিন বেঁচে গেলাম আমরা দুজনেই৷

২০১৩- ১৮ মে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার আগে যখন দেড়মাস ধরে আমরা প্র্যাকটিস পিডিশন করছিলাম, তখনই একদিন ক্যাম্প- থেকে ক্যাম্প-- ফেরার পথে তুষার ধ্বসের মুখে পড়ে যাওয়ার এই ঘটনাটা ঘটেছিল৷পাহাড়ে চড়ার আনন্দের পাশাপাশি পাহাড়ে ওঠার বিপদও তাই কম নয়৷

কিছুদিন আগেই তো বসম্ত সিংহরায় আর দেবাশিস বিশ্বাস ধওলাগিরি অভিযানে গিয়ে যেভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলেন, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়৷

ক্রিভাস, তুষার ধ্বস কখন-কোথায় ওত পেতে মৃত্যুর বার্তা নিয়ে হাজির হবে আগে থেকে বোঝা খুব অসম্ভব৷ 

বেসক্যাম্প থেকে পুরোটাই বরফের পথ৷বরফের ওই আস্তরণের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় পায়ের নিচের বরফ ফেটে হঠাৎ হঠাৎ তৈরি হয়ে যেতে পারে বরফের কুয়ো বা খাদ৷যার পোশাকি নাম ক্রিভাস৷যেখানে পড়লে আর বাঁচার উপায় নেই৷অনেকটা, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মুহূর্তের অসতর্কতায় ম্যানহোলে পড়ে যাওয়ার মতো আর কী! ওপর ওপর ঠাওর করা মুশকিল এর গভীরতা৷আবার অনুমান ছাড়া এই চত্বরে পা ফেলারও জো নেই৷অনুমানে তাই একটু ভুলচুক হলেই নিমেষে মৃত্যুর গহ্বরে তলিয়ে যেতে হবে৷

পঁচাত্তর বছর পরে খুঁজে পাওয়া ম্যালরির দেহ কিংবা এই সেদিন যার মৃতদেহ সরিয়ে আমার লোৎসে জয়, সেই জাপানি অভিযাত্রীর মৃত্যুর কারণ ক্রিভাস না তুষার ধ্বসে জানি না৷পাহাড়ে চড়তে গিয়ে আমি নিজেও একবার ঢুকে গিয়েছিলাম ক্রিভাসের কূপে৷যোগিন- অভিযানে গিয়ে কোমর অবধি ঢুকে গিয়েছিল বরফের কুয়োয়৷বরাতজোরে বেঁচ্ছেিলাম৷আইসত্রাক্সের সাহায্যে বরফ খুঁড়ে অনেক কষ্টে উঠতে হয়েছিল৷

এবার সৌভাগ্য যে, এভারেস্টের পথে ক্রিভাসের খপ্পরে পড়তে হয়নি৷তার হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি৷প্র্যাকটিস চলাকালীন ক্যাম্প- থেকে বেসক্যাম্পে ফেরার সময়৷

পাহাড়ের চূড়ায় অবশ্য এই সব আতঙ্ক সব সময়ই থাকে৷এমন কষ্ট, বিপদ সব লাঘব হয়ে যায় এভারেস্টের শীর্ষ জয়ের আনন্দে৷আমারও তাই হয়েছে৷

এভারেস্ট জয় এক লহমায় হাওড়ার কোনার বাগপাড়ার এক অতি সাধারণ মেয়েকে বিখ্যাত করে দিয়েছে৷আজ তা আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের একজনের কাছে রূপকথা বলেই মনে হয়৷কিন্তু এত কষ্টার্জিত সাফল্যের পরেও মনটা ভারী হয়ে ওঠে যখন সহ-অভিযাত্রীদের ঈর্ষা টের পাই৷পিছন থেকে ছুরি মারার সেই চেষ্টাও রয়েছে এই অভিযানে৷খ্যাতি বা রেকর্ড প্রাপ্তিই শুধু নয়, মানুষও চিনিয়েছে এভারেস্ট৷যা আমার চোখ খুলে দিয়েছে৷সহযাত্রীরা সকলেই যে বন্ধু নয়, হাড়ে হাড়ে তা টের পেয়েছি৷মুখ আর মুখোশের ফারাক এখন আমার কাছে স্পষ্ট৷

আমার সাফল্যকে ভাল চোখে দেখছেন না অনেকেই৷কিন্তু এভাবে আটকে রাখা যাবে না আমাকে৷লক্ষ্য থেকে সরে আসার মেয়ে আমি নই৷

লুকলা থেকেই ক্রমাগত শুরু হয়েছিল মানসিক র্যাগিং৷একসঙ্গে হাঁটছি, হঠাৎ হঠাৎ পা বাড়িয়ে বাধা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে টুসি৷১৬ মে অভিযান বাতিল করে ফিরে আসার পর খারাপ আবহাওয়ার কারণ দেখিয়ে এভারেস্ট অভিযানে পরের দিন যেতে নিষেধ করেছিলেন সহ-অভিযাত্রীরা অনেকেই৷তথাকথিত শুভানুধ্যায়ী সেই সব বন্ধু সহ-অভিযাত্রীদের উদ্দেশ্য ছিল আমাকে নিরুৎসাহিত করা৷ওদের কথা শুনে বসে থাকলে আমার এবারেস্ট জয়টাই এবার হত না৷এভারেস্ট এবং লোৎসে দুই শিখর অভিযানে একসঙ্গে যাওয়াটা অনেকেরই পছন্দ ছিল না৷আর এটা অনুমান করে, প্রথমে লোৎসে যাওয়ার পরিকল্পনা গোপনই রেখেছিলাম৷পরে এবারেস্ট লোৎসের জন্য আমার শেরপাকে দুটো আলাদা বিমা করতে দেখে টুসির শেরপা পরিকল্পনাটা জেনে যায়৷এস এম এসে খবরটা ছড়িয়ে যেতে তারপর আর বেশি সময় লাগেনি৷

একটা মেয়ের একসঙ্গে দুই শিখর জয়ের সাফল্যকে অনেকেই ভালভাবে নেননি, হয়ত একজন মহিলা বলেই৷এক কাশ্মীরি অভিযাত্রী লোৎসের ছবি দেখার নাম করে পেনড্রাইভ থেকে সব ছবি মুছে দিলেন৷কয়েকজন সহ-অভিযাত্রী আমার লোৎসের ছবিগুলি কোথায় রাখা আছে সেই নিয়ে গোপনে খোঁজখবর চালালেন৷যাকে পাঠালেন খবর নিতে, সে- সবকিছু ফাঁস করে দিল আমার কাছে৷

লোৎসের সাফল্যকে কেন চেপে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বুঝতে পারছি না৷এমনকি লোৎসে জয়ের সার্টিফিকেট যাতে না পাই, কলকাতা থেকে সেই চেষ্টাও নাকি করা হয়েছে বলে শুনেছি৷যদিও ওই সার্টিফিকেট এখন আমার হাতে এসে গেছে৷

অক্টোবর টাউন হলে রাজ্য যুবকল্যাণ দপ্তরের অধীন ওয়েস্ট বেঙ্গল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস ফাউন্ডেশন আমাদের সংবর্ধনা দিল৷শৃঙ্গ বিজয়ীদের পরিচয় জানানোর জন্য ঘোষক প্রত্যেকের পরিচয় জানতে চাইলেন৷সবার সঙ্গে আমিও এভারেস্ট লোৎসে দুই শৃঙ্গ জয়ের কথাই লিখিতভাবে ঘোষক মহাশয়ের কাছে জমা দিলাম৷কিন্তু অদ্ভুতভাবে ঘোষণার সময় লোৎসের অংশটুকু বাদ দিয়ে দেওয়া হল৷কাদের ইঙ্গিতে এমন হল? মঞ্চে তো ছিলেন ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারাই৷

আমাদেরই সহ-অভিযাত্রী মনিদীপা দত্ত সাউথকল অবধি গিয়েও এভারেস্টের শীর্ষে যেতে পারল না৷মণিদীপা সম্পূর্ণ সুস্হ থাকা সত্ত্বেও ওকে ফিরিয়ে দেওয়া হল৷ওদের দলের আরেক অভিযাত্রী দেবদাস নন্দীর শেরপা অসুস্হ হয়ে পড়েছিলেন৷ফিরে আসার কথা তাই দেবদাসদার৷কিন্তু দেবদাসদার অসুস্হ শেরপাকে দিয়ে নিচে নামিয়ে দেওয়া হল মণিদীপাকে৷আর দেবদাস নন্দীর জন্য মণিদীপার শেরপাকে সঙ্গী করে এভারেস্টের শীর্ষে উঠতে ছুটলেন দলের নেতা উজ্জ্বল রায়৷দলগতভাবে গেলে কোনও শেরপা নাকি কারও নিজস্ব নয়, এমন যুক্তিও সাজানো হল৷

বসম্ত সিংহরায়, দেবাশিস বিশ্বাসদের মতো সাফল্যের পালক এই বঙ্গে কারও নেই৷ফাউন্ডেশনের কর্তৃত্ব হাতে নিতে তাঁদের সমকক্ষ হওয়ার জন্য এভারেস্টের সার্টিফিকেট এবার খুব জরুরি ছিল উজ্জ্বল রায়ের৷মরিয়া উজ্জ্বলবাবুর এভারেস্টে পৌঁছতে তাই মণিদীপার চেয়ে দেবদাস নন্দীকে কেন বেশি প্রয়োজন ছিল, খোঁজ নিক সরকার৷

এভারেস্টের পথে

প্রচণ্ড হাওয়া বইছিল৷টুসির ফ্রস্ট বাইট হয়ে গিয়েছিল৷১৬ মে সাউথ কল পেরিয়েও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাই ফিরে আসতে বাধ্য হই৷সাউথকল থেকে শীর্ষে পৌঁছতে কম করে দশঘণ্টা এবং সবচেয়ে বেশি ষোলো ঘণ্টা সময় লাগে৷আমার দশ ঘণ্টা সময়ই লেগেছিল৷পরবর্তী সাতদিন আবহাওয়া প্রতিকূল থাকবে, পূর্বাভাস ছিল সেরকমই৷রাত দেড়টা নাগাদ ক্যাম্পে ফিরে আসা ছাড়া তাই উপায় ছিল না৷

১৬ তারিখ রওনা দেওয়ার আগে প্রায় দেড়মাস ধরে আমরা আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়ানোর জন্য প্র্যাকটিস পিডিশন করতাম৷এটা আসলে মূল পরীক্ষায় বসার আগে নকল মহড়া বা হোমওয়ার্ক করার মতো৷মহড়ার এই পথটা ছিল বেসক্যাম্প থেকে ক্যাম্প-, কখনও কখনও আবার ক্যাম্প- পর্যম্ত৷২৭ মার্চ কলকাতা ছাড়ার পর ৩০ মার্চ বিমানে চেপে লুকলা পৌঁছলাম৷এর পর শুধুই হাঁটা৷ দিনের এক দীর্ঘ পথ, মাঝে একদিন বিশ্রাম৷ দিনের মাথায় পৌঁছলাম বেসক্যাম্পে৷ক্যাম্পটা ছিল সলেখুম্বু গ্ল্যাসিয়ারের ওপর৷চলমান তুষার স্রোত বা হিমবাহগুলি অনেকটা নদীর মতো৷প্রবাহিত হয় খুব ধীরে ধীরে৷তাই খুব একটা বোঝা যায় না৷এই গ্ল্যাসিয়ারের ওপরেই তাঁবু খাঁটিয়ে, ম্যাট পেতে তৈরি করা হয়েছিল আমাদের আস্তানা৷এই ক্যাম্প বা শিবির তৈরিও কম সমস্যার নয়৷হাওয়ার প্রবল ঝাপটায় তাঁবু পাতাই দায় হয়৷অনেক সময় উড়েও যায়৷বেসক্যাম্পে আমাদের টয়লেটের ক্যাম্পটাই তো উড়ে গেল৷আবার সাউথকলে তো তাঁবু ভেঙে ফেটে একাকার৷পাহাড়ে তাঁবুগুলিই অভিযাত্রীদের ঘরবাড়ি হলেও, তার ওপরে বরফ পড়ে যখন স্তূপ গড়ে ওঠে, বিপদের হাতছানি থাকে তখনও৷কারণ, চাপা পড়ার ভয় থাকে৷তাই ভিতর থেকে ধাক্কা দিয়ে সেই বরফ নিয়মিত ঝেড়ে ফেলতে হয়৷কিন্তু তাঁবুর চারপাশে বরফ জমলে বাইরে বেরিয়ে পরিষ্কার না করলে উপায় থাকে না৷রাতবিরেতে প্রবল ঠান্ডার ঝাপটানি তখন শরীরকে কাবু করে দেয়৷

আর তাঁবুর ভেতরে বিশ্রাম বা ঘুম বলতে শুধুই তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকা৷কতদিন, কতরাত যে না ঘুমিয়ে কেটেছে, তার হিসেব নেই৷

এবারেস্ট একা নয়, তাকে ঘিরে রয়েছে আরও কিছু শৃঙ্গ৷কুমারী পিক, লোলা পিক, নুৎসে পিক৷এই পিকগুলির মধ্য দিয়ে খুম্বু আইসফলের ভিতর দিয়ে একটু একটু করে পথ করে এগোনো৷রাস্তা কোথাও কোথাও এতটাই সরু যে, অনেক সময় শুধুমাত্র গোড়ালির ওপর ভর দিয়েও হাঁটতে হয়৷এই পথচলা তাই একইসঙ্গে কষ্টসাধ্য এবং রোমাঞ্চকর৷আবার কঠিন এই পথ পেরিয়ে আসার অভিজ্ঞতাও একজন অভিযাত্রীর কাছে কম আনন্দের নয়৷

বেসক্যাম্প থেকে ক্যাম্প-, ক্যাম্প-, ক্যাম্প-৩৷তার পর সাউথ কল বা সামিট ক্যাম্প৷এর পর ব্যালকনি৷ব্যালকনির পরে সাউথ সামিট, হিলারি স্টেপ৷এবং শেষে সামিট৷এটাই এভারেস্টের শীর্ষবিন্দু৷অর্থাৎ অভীষ্টে পৌঁছনোর টার্গেট পয়েন্ট৷আমার অভিযানের পথটা ছিল এরকমই৷

১৬ তারিখ রাতে ফিরে আসার পরে আমি আবার পরের দিন ওই দুর্যোগের মধ্যেই শেরপাকে সঙ্গে নিয়ে রাত ৯টার সময় বেরিয়ে পড়লাম৷সহ-অভিযাত্রীরা নিষেধ করা সত্ত্বেও শুনিনি৷কারণ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস মেনে চললে সাতদিন অপেক্ষা করে বসে থাকতে হত৷পাহাড়ে ঘন ঘন আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়৷এই আবহাওয়ার উন্নতি হল তো পর মুহূর্তের আবার অবনতি৷পূর্বভাস তাই সব সময় একশো ভাগ মেলে না৷বেরিয়ে তো পড়লাম, কিন্তু ১৭ তারিখও প্রায় ১২০ কিলোমিটার বেগে হাওয়া বইছিল৷রোপের ওপরে বরফ জমে এমন অবস্হা হয়েছিল যে, ঠিকমতো জুমারিং করাও যাচ্ছিল না৷যাইহোক, শেষ অবধি ১৮ তারিখ সকাল ৭টায় উঠে পড়লাম এভারেস্টের চূড়ায়৷

প্রথম অসামরিক বাঙালি কন্যার এভারেস্ট আরোহণে তৈরি হল নতুন রেকর্ড৷

এবার এগোলাম লোৎসের পথে৷এটা এভারেস্টের পথের চেয়েও বেশি কঠিন৷২০ মে সেই শৃঙ্গও জয় হল৷তৈরি হল আরও একটা রেকর্ড. লোৎসেতে পা পড়ল প্রথম ভারতীয় মহিলার৷আর এত কম সময়ের ব্যবধানে দুই শৃঙ্গ জয় তো আজ বিশ্বরেকর্ড৷

ওপরটা কেমন

দুই শৃঙ্গের ওপরে যেখানে জাতীয় পতাকা ওড়ালাম, সেখানে রয়েছে ছোট্ট একটা সমতলভূমি৷বরফে ঢাকা সেই জায়গাটাতে খুব বেশি হলে ১০ থেকে ১৫ জন মানুষ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াতে পারে৷

এভারেস্টের মাথায় আছে চোরতেন বা বরফের একটা স্তম্ভ৷যা অনেকটা মন্দিরের মতো দেখতে৷দুটো লোহার দণ্ডও পোঁতা আছে সেখানে৷তার মাঝে একটা কাচের বাক্সে রাখা আছে বুদ্ধদেবের ছবি৷শীর্ষে পৌঁছনোর প্রমাণ হিসাবে এই চোরতেন এবং বুদ্ধদেবের ছবি তুলে নিয়ে আসেন অভিযাত্রীরা৷

দুই শৃঙ্গে ওপর থেকে দেখা যায় একদিকে চীন এবং অন্যদিকে নেপালকে৷

আমিও দেখলাম৷একবার ২৯,০২৯ ফিট এবং আরেকবার প্রায় ২৮,০০০ ফিট ওপর থেকে৷ভাবা যায়!

তুষারশুভ্র দুই চূড়ার মাথা থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘের পর মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে৷ভোর ৫টার সময় লোৎসের মাথা থেকে সূর্যোদয় দেখলাম, মনে হল এক টুকরো হীরকখণ্ডকে কেউ যেন দু হাতে তুলে ধরেছে৷

অত উঁচু থেকে মনে হয় পায়ের কাছে কোথাও যেন সূর্যটা ঘোরাঘুরি করছে৷অন্য শৃঙ্গগুলিকে সেখান থেকে টিলার মতো দেখতে লাগে৷মনে হয় যেন এক শৃঙ্গ থেকে অন্য শৃঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যাওয়া যায়৷দিগম্তরেখাটাকে মনে হয় ঠিক যেন উল্টানো বাটি৷

এভারেস্টে যাওয়ার পোকা নড়েছিল ২০১২ সালে, মনিরাং অভিযানে গিয়ে৷শেরপাদের কাছে এভারেস্ট নিয়ে সেবার অনেক কথা শুনি৷মনিরাং থেকে ফিরে আমার শিক্ষক বসম্ত সিংহরায়ের কাছে প্রথম এভারেস্টে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করি৷উনি খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন৷তারই ফলে এই অভিযান৷

এভারেস্টের মতোই কাঞ্চনজঙঘা নিয়েও আমার স্বপ্ন অনেকদিনের৷দার্জিলিঙের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে কোর্স করার সময় ক্যান্টিন থেকে রোজ কাঞ্চনজঙঘাকে দেখতাম৷এভাবে দেখতে দেখতে ওখানে পৌঁছনোর স্বপ্ন দেখার শুরু৷এবার তাই কাঞ্চনজঙঘা জয় করতে চাই৷কাঞ্চনজঙঘা (ওয়েস্ট)গ্গর ইয়ালুংখাঙ আমার পরবর্তী লক্ষ্য৷কাঞ্চনজঙঘা মেইনে অনেকেই উঠেছেন৷কিন্তু কাঞ্চনজঙঘা সেন্ট্রাল, কাঞ্চনজঙঘা ওয়েস্ট, কাঞ্চনজঙঘা নর্থ ইত্যাদি শৃঙ্গগুলিতে খুব বেশি মানুষের পা পড়েনি৷প্রায় এগারো-বারো বছর ইয়ালুংখাঙে কোনও অভিযানই হয়নি৷

কিন্তু অপেক্ষাকৃত অচেনা, অজানা, অনাবিষ্কৃত দুর্গম এই শৃঙ্গগুলিতে যেতে চাইলে কী হবে, ফাউন্ডেশনের নতুন কর্তাদের পরামর্শে সরকারের নতুন নিয়মের ফাঁস সেই ইচ্ছেকে গলা টিপে মারছে৷

এভারেস্টের চেয়ে কম উচ্চতার শৃঙ্গ, যেখানে আগে অভিযান হয়েছে, একক উদ্যোগে সেখানে গেলে এখন থেকে আর সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যাবে না৷নতুন নিয়মটা এরকমই৷আগে কিন্তু এমন অদ্ভুত নিয়ম ছিল না৷

সরকার, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস চাইছেন, পর্বতারোহীদের উৎসাহিত করতে কিন্তু ফাউন্ডেশনের নতুন পরামর্শদাতা, নতুন কর্মকর্তারা ভুল পরামর্শ দিয়ে বিপথে চালিত করছেন সরকারকে৷

লক্ষ্মী জোগাড়ের ঝক্কি

এভারেস্টই হোক বা কাঞ্চনজঙঘা, পাহাড়ে চড়ার খরচ অনেক৷ক্লাব বা দলের সঙ্গে না গিয়ে একার উদ্যোগে গেলে সেই খরচ আরও বাড়ে৷এবার যেমন সরকার থেকে লাখ টাকা সাহায্য করায় অনেকটাই সুবিধে হয়েছে৷

এভারেস্টে যাওয়ার খরচ ছিল ১৬ লাখ টাকা৷তার সঙ্গে আবার লোৎসের লাখ টাকা যোগ হয়েছিল৷কাঞ্চনজঙঘায় যাওয়ার খরচ প্রায় সাড়ে ৩৫ লাখ টাকা৷সরকার পাশে এসে না দাঁড়ালে যার পুরোটাই নিজের উদ্যোগে জোগাড় করতে হবে৷আবার ইয়ালুংখাঙে দীর্ঘদিন অভিযাত্রীরা যান না৷তাই দল করে যাওয়াটাও সমস্যার৷

ফাউন্ডেশনের নতুন নিয়ম আমার বিড়ম্বনা তাই আরও বাড়িয়ে দিল৷এবং এটাও স্পষ্ট, নিয়মের এই বেড়াজাল আমার উদ্যোগটাকে আটকে দেওয়ার জন্যই৷উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই এরকম একটা নিয়ম খাড়া করা হচ্ছে৷লক্ষ্মী জোগাড়ের ঝক্কিটা এবার অনেক বেশি কঠিন হয়ে গেল৷

পর্বতারোহী হব ভাবিনি

আমি যে কোনওদিন পর্বতারোহী হব, ছোটবেলায় সেটা ভাবিনি কখনও৷বিমলাদেবী প্রাইমারি স্কুল, ব্যাঁটরা বিধুভূষণ পাল চৌধুরি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার সময় খেলাধুলোয় বরাবরই প্রথম হতাম৷

পাহাড়ের নেশা শুরু আর্য বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে৷তখন ক্লাস টেন, মাধ্যমিক দেব৷স্কুলেই সুযোগ এল এন সি সি-তে যোগ দেওয়ার৷সেই সূত্রেই ট্রেক করতে গিয়েছিলাম শুশুনিয়াতে৷সেখান থেকে রক ক্লাইম্বিং শিখে আসার পর বরফের ওপর কীভাবে বাইতে হয়, সেটাও শেখার ইচ্ছে হল৷দার্জিলিঙের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে ট্রেনিং নিলাম, শুরু হল পর্বতারোহীর জীবন৷

ট্রেনিং পর্বেও বেশ কিছু রেকর্ড আছে৷যা আজও অক্ষত৷

আমার ক্লাব ক্রিক রো- ইনস্টিটিউট অব প্লোরেশন সান্দাকফুতে যে অভিযানের ব্যবস্হা করেছিল, সেখানেও মানেভ? থেকে সান্দাকফুর শীর্ষ পর্যম্ত বারো হাজার ফুটের বেশি দূরত্ব মাত্র সাড়ে ঘণ্টায় দৌড়ে অতিক্রম করে রেকর্ড করেছিলাম৷

আবার ২০০৮ সালের জুন একই দিনে উঠেছিলাম যোগিন- (৬৪৬৫ মিটার) যোগিন- (,১১৬ মিটার) দুই শৃঙ্গেই৷আমার সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন৷সীমাশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, মিতা ধর এবং উমে কুলসুম৷

পর্বতারোহী হওয়ার আগে জানতাম পাহাড়ের সান্নিধ্য পরিপূর্ণ নতুন মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে৷কিন্তু সেই ধারণাটা এবার ধাক্কা খেল৷ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও টানা হ্যাঁচড়া হয়েছে৷অভিযানে যাওয়ার সাতদিন আগে বিবাহ-বিচ্ছেদের নথি আসে আমার হাতে৷অবাক হয়ে দেখলাম, এভারেস্ট জয়ের খবরের সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়াতে সেই খবরও প্রকাশিত হল৷আমি বা আমার পরিবার সংবাদমাধ্যমের কাছে বিচ্ছেদের খবর নিয়ে এর আগে কোনও কথা বলিনি৷

তবে ভাল মানুষের সন্ধানও দিয়েছে এভারেস্ট৷যেমন তাশি শেরপা, টাকা বাকি রেখেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন৷চেনা গণ্ডির বাইরে ওঁর জিম্মায় থেকে নিজেকে -সুরক্ষিত মনে হয়নি কখন৷আর সেই জাপানি অভিযাত্রী! লোৎসে অভিযানের সময় যার মৃতদেহ সরিয়েই আমাকে শীর্ষে পৌঁছতে হয়েছিল৷লোৎসে শৃঙ্গের কুড়ি ফুট নিচে হেলে পড়েছিল দেহটা৷লোৎসে জয় করে নামার সময় শক্ত কাঠ হয়ে থাকা ওই শরীরটার ওপরে ভর দিয়েই তো আমি নামলাম৷ওই অভিযাত্রীর মতো আরও অনেক অভিযাত্রীরই মৃতদেহ পড়ে রয়েছে পাহাড়ে৷কাজের প্রতি নিষ্ঠা, ভালবাসা এবং লক্ষ্যে অবিচল থাকার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া এই মানুষগুলির প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে৷

চক্রাম্ত অবশ্য এখনও থামেনি৷লোৎসের সার্টিফিকেট মানতে চাইছে না ফাউন্ডেশন৷নানা অছিলায় লোৎসে জয়কে অস্বীকার করে চলেছে এখনও৷

কিন্তু এভাবে আর কতদিন, আমার সাফল্যকে চেপে রাখতে পারবেন কর্তারা?

অনুলিখন: কৌশিক বসু


No comments:

Post a Comment