মার্চ মাস মেয়েদের মাস৷ আজ রইল পদে পদে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে এক সাহসিনীর শিখর জয়ের কাহিনী৷
ছন্দা গায়েন
১৮ তারিখ সকাল ৭টায় উঠে পড়লাম এভারেস্টের চূড়ায়৷
এবার এগোলাম লোৎসের পথে৷ ২০ মে সেই শৃঙ্গও জয় হল৷ লোৎসেতে পা পড়ল প্রথম ভারতীয় মহিলার৷
ভোর ৫টার সময় লোৎসের মাথা থেকে সূর্যোদয় দেখলাম, মনে হল এক টুকরো হীরকখণ্ডকে কেউ যেন দু হাতে তুলে ধরেছে৷
খেয়ালই করিনি যে মৃত্যু একেবারে কাছে এসে হাজির৷ সম্বিৎ ফিরল এজেন্সির সঙ্গে যাওয়া পাসাং শেরপা যখন আমাকে আর দেবদাসদাকে আচমকা হাত ধরে একেবারে ঘুরিয়ে দিলেন৷ দেখলাম, বরফের বিশাল চাঁইটা পিঠের রুকস্যাককে ছুঁয়ে চলে গেল৷ অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে সেদিন বেঁচে গেলাম আমরা দুজনেই৷
২০১৩-র ১৮ মে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার আগে যখন দেড়মাস ধরে আমরা প্র্যাকটিস এ‘পিডিশন করছিলাম, তখনই একদিন ক্যাম্প-২ থেকে ক্যাম্প-১-এ ফেরার পথে তুষার ধ্বসের মুখে পড়ে যাওয়ার এই ঘটনাটা ঘটেছিল৷ পাহাড়ে চড়ার আনন্দের পাশাপাশি পাহাড়ে ওঠার বিপদও তাই কম নয়৷
কিছুদিন আগেই তো বসম্ত সিংহরায় আর দেবাশিস বিশ্বাস ধওলাগিরি অভিযানে গিয়ে যেভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলেন, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়৷
ক্রিভাস, তুষার ধ্বস কখন-কোথায় ওত পেতে মৃত্যুর বার্তা নিয়ে হাজির হবে আগে থেকে বোঝা খুব অসম্ভব৷
বেসক্যাম্প থেকে পুরোটাই বরফের পথ৷ বরফের ওই আস্তরণের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় পায়ের নিচের বরফ ফেটে হঠাৎ হঠাৎ তৈরি হয়ে যেতে পারে বরফের কুয়ো বা খাদ৷ যার পোশাকি নাম ক্রিভাস৷ যেখানে পড়লে আর বাঁচার উপায় নেই৷ অনেকটা, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মুহূর্তের অসতর্কতায় ম্যানহোলে পড়ে যাওয়ার মতো আর কী! ওপর ওপর ঠাওর করা মুশকিল এর গভীরতা৷ আবার অনুমান ছাড়া এই চত্বরে পা ফেলারও জো নেই৷ অনুমানে তাই একটু ভুলচুক হলেই নিমেষে মৃত্যুর গহ্বরে তলিয়ে যেতে হবে৷
পঁচাত্তর বছর পরে খুঁজে পাওয়া ম্যালরির দেহ কিংবা এই সেদিন যার মৃতদেহ সরিয়ে আমার লোৎসে জয়, সেই জাপানি অভিযাত্রীর মৃত্যুর কারণ ক্রিভাস না তুষার ধ্বসে জানি না৷ পাহাড়ে চড়তে গিয়ে আমি নিজেও একবার ঢুকে গিয়েছিলাম ক্রিভাসের কূপে৷ যোগিন-১ অভিযানে গিয়ে কোমর অবধি ঢুকে গিয়েছিল বরফের কুয়োয়৷ বরাতজোরে বেঁচ্ছেিলাম৷ আইসত্রাক্সের সাহায্যে বরফ খুঁড়ে অনেক কষ্টে উঠতে হয়েছিল৷
এবার সৌভাগ্য যে, এভারেস্টের পথে ক্রিভাসের খপ্পরে পড়তে হয়নি৷ তার হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি৷ প্র্যাকটিস চলাকালীন ক্যাম্প-১ থেকে বেসক্যাম্পে ফেরার সময়৷
পাহাড়ের চূড়ায় অবশ্য এই সব আতঙ্ক সব সময়ই থাকে৷ এমন কষ্ট, বিপদ সব লাঘব হয়ে যায় এভারেস্টের শীর্ষ জয়ের আনন্দে৷ আমারও তাই হয়েছে৷
এভারেস্ট জয় এক লহমায় হাওড়ার কোনার বাগপাড়ার এক অতি সাধারণ মেয়েকে বিখ্যাত করে দিয়েছে৷ আজ তা আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের একজনের কাছে রূপকথা বলেই মনে হয়৷ কিন্তু এত কষ্টার্জিত সাফল্যের পরেও মনটা ভারী হয়ে ওঠে যখন সহ-অভিযাত্রীদের ঈর্ষা টের পাই৷ পিছন থেকে ছুরি মারার সেই চেষ্টাও রয়েছে এই অভিযানে৷ খ্যাতি বা রেকর্ড প্রাপ্তিই শুধু নয়, মানুষও চিনিয়েছে এভারেস্ট৷ যা আমার চোখ খুলে দিয়েছে৷ সহযাত্রীরা সকলেই যে বন্ধু নয়, হাড়ে হাড়ে তা টের পেয়েছি৷ মুখ আর মুখোশের ফারাক এখন আমার কাছে স্পষ্ট৷
আমার সাফল্যকে ভাল চোখে দেখছেন না অনেকেই৷ কিন্তু এভাবে আটকে রাখা যাবে না আমাকে৷ লক্ষ্য থেকে সরে আসার মেয়ে আমি নই৷
লুকলা থেকেই ক্রমাগত শুরু হয়েছিল মানসিক র্যাগিং৷ একসঙ্গে হাঁটছি, হঠাৎ হঠাৎ পা বাড়িয়ে বাধা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে টুসি৷ ১৬ মে অভিযান বাতিল করে ফিরে আসার পর খারাপ আবহাওয়ার কারণ দেখিয়ে এভারেস্ট অভিযানে পরের দিন যেতে নিষেধ করেছিলেন সহ-অভিযাত্রীরা অনেকেই৷ তথাকথিত শুভানুধ্যায়ী সেই সব বন্ধু সহ-অভিযাত্রীদের উদ্দেশ্য ছিল আমাকে নিরুৎসাহিত করা৷ ওদের কথা শুনে বসে থাকলে আমার এবারেস্ট জয়টাই এবার হত না৷ এভারেস্ট এবং লোৎসে দুই শিখর অভিযানে একসঙ্গে যাওয়াটা অনেকেরই পছন্দ ছিল না৷ আর এটা অনুমান করে, প্রথমে লোৎসে যাওয়ার পরিকল্পনা গোপনই রেখেছিলাম৷ পরে এবারেস্ট ও লোৎসের জন্য আমার শেরপাকে দুটো আলাদা বিমা করতে দেখে টুসির শেরপা পরিকল্পনাটা জেনে যায়৷ এস এম এসে খবরটা ছড়িয়ে যেতে তারপর আর বেশি সময় লাগেনি৷
একটা মেয়ের একসঙ্গে দুই শিখর জয়ের সাফল্যকে অনেকেই ভালভাবে নেননি, হয়ত একজন মহিলা বলেই৷ এক কাশ্মীরি অভিযাত্রী লোৎসের ছবি দেখার নাম করে পেনড্রাইভ থেকে সব ছবি মুছে দিলেন৷ কয়েকজন সহ-অভিযাত্রী আমার লোৎসের ছবিগুলি কোথায় রাখা আছে সেই নিয়ে গোপনে খোঁজখবর চালালেন৷ যাকে পাঠালেন খবর নিতে, সে-ই সবকিছু ফাঁস করে দিল আমার কাছে৷
লোৎসের সাফল্যকে কেন চেপে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বুঝতে পারছি না৷ এমনকি লোৎসে জয়ের সার্টিফিকেট যাতে না পাই, কলকাতা থেকে সেই চেষ্টাও নাকি করা হয়েছে বলে শুনেছি৷ যদিও ওই সার্টিফিকেট এখন আমার হাতে এসে গেছে৷
৫ অক্টোবর টাউন হলে রাজ্য যুবকল্যাণ দপ্তরের অধীন ওয়েস্ট বেঙ্গল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস ফাউন্ডেশন আমাদের সংবর্ধনা দিল৷ শৃঙ্গ বিজয়ীদের পরিচয় জানানোর জন্য ঘোষক প্রত্যেকের পরিচয় জানতে চাইলেন৷ সবার সঙ্গে আমিও এভারেস্ট ও লোৎসে দুই শৃঙ্গ জয়ের কথাই লিখিতভাবে ঘোষক মহাশয়ের কাছে জমা দিলাম৷ কিন্তু অদ্ভুতভাবে ঘোষণার সময় লোৎসের অংশটুকু বাদ দিয়ে দেওয়া হল৷ কাদের ইঙ্গিতে এমন হল? মঞ্চে তো ছিলেন ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারাই৷
আমাদেরই সহ-অভিযাত্রী মনিদীপা দত্ত সাউথকল অবধি গিয়েও এভারেস্টের শীর্ষে যেতে পারল না৷ মণিদীপা সম্পূর্ণ সুস্হ থাকা সত্ত্বেও ওকে ফিরিয়ে দেওয়া হল৷ ওদের দলের আরেক অভিযাত্রী দেবদাস নন্দীর শেরপা অসুস্হ হয়ে পড়েছিলেন৷ ফিরে আসার কথা তাই দেবদাসদার৷ কিন্তু দেবদাসদার অসুস্হ শেরপাকে দিয়ে নিচে নামিয়ে দেওয়া হল মণিদীপাকে৷ আর দেবদাস নন্দীর জন্য মণিদীপার শেরপাকে সঙ্গী করে এভারেস্টের শীর্ষে উঠতে ছুটলেন দলের নেতা উজ্জ্বল রায়৷ দলগতভাবে গেলে কোনও শেরপা নাকি কারও নিজস্ব নয়, এমন যুক্তিও সাজানো হল৷
বসম্ত সিংহরায়, দেবাশিস বিশ্বাসদের মতো সাফল্যের পালক এই বঙ্গে কারও নেই৷ ফাউন্ডেশনের কর্তৃত্ব হাতে নিতে তাঁদের সমকক্ষ হওয়ার জন্য এভারেস্টের সার্টিফিকেট এবার খুব জরুরি ছিল উজ্জ্বল রায়ের৷ মরিয়া উজ্জ্বলবাবুর এভারেস্টে পৌঁছতে তাই মণিদীপার চেয়ে দেবদাস নন্দীকে কেন বেশি প্রয়োজন ছিল, খোঁজ নিক সরকার৷
এভারেস্টের পথে
প্রচণ্ড হাওয়া বইছিল৷ টুসির ফ্রস্ট বাইট হয়ে গিয়েছিল৷ ১৬ মে সাউথ কল পেরিয়েও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাই ফিরে আসতে বাধ্য হই৷ সাউথকল থেকে শীর্ষে পৌঁছতে কম করে দশঘণ্টা এবং সবচেয়ে বেশি ষোলো ঘণ্টা সময় লাগে৷ আমার দশ ঘণ্টা সময়ই লেগেছিল৷ পরবর্তী সাতদিন আবহাওয়া প্রতিকূল থাকবে, পূর্বাভাস ছিল সেরকমই৷ রাত দেড়টা নাগাদ ক্যাম্পে ফিরে আসা ছাড়া তাই উপায় ছিল না৷
১৬ তারিখ রওনা দেওয়ার আগে প্রায় দেড়মাস ধরে আমরা আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়ানোর জন্য প্র্যাকটিস এ‘পিডিশন করতাম৷ এটা আসলে মূল পরীক্ষায় বসার আগে নকল মহড়া বা হোমওয়ার্ক করার মতো৷ মহড়ার এই পথটা ছিল বেসক্যাম্প থেকে ক্যাম্প-১, কখনও কখনও আবার ক্যাম্প-২ পর্যম্ত৷ ২৭ মার্চ কলকাতা ছাড়ার পর ৩০ মার্চ বিমানে চেপে লুকলা পৌঁছলাম৷ এর পর শুধুই হাঁটা৷ ৭ দিনের এক দীর্ঘ পথ, মাঝে একদিন বিশ্রাম৷ ৮ দিনের মাথায় পৌঁছলাম বেসক্যাম্পে৷ ক্যাম্পটা ছিল সলেখুম্বু গ্ল্যাসিয়ারের ওপর৷ চলমান তুষার স্রোত বা হিমবাহগুলি অনেকটা নদীর মতো৷ প্রবাহিত হয় খুব ধীরে ধীরে৷ তাই খুব একটা বোঝা যায় না৷ এই গ্ল্যাসিয়ারের ওপরেই তাঁবু খাঁটিয়ে, ম্যাট পেতে তৈরি করা হয়েছিল আমাদের আস্তানা৷ এই ক্যাম্প বা শিবির তৈরিও কম সমস্যার নয়৷ হাওয়ার প্রবল ঝাপটায় তাঁবু পাতাই দায় হয়৷ অনেক সময় উড়েও যায়৷ বেসক্যাম্পে আমাদের টয়লেটের ক্যাম্পটাই তো উড়ে গেল৷ আবার সাউথকলে তো তাঁবু ভেঙে ফেটে একাকার৷ পাহাড়ে তাঁবুগুলিই অভিযাত্রীদের ঘরবাড়ি হলেও, তার ওপরে বরফ পড়ে যখন স্তূপ গড়ে ওঠে, বিপদের হাতছানি থাকে তখনও৷ কারণ, চাপা পড়ার ভয় থাকে৷ তাই ভিতর থেকে ধাক্কা দিয়ে সেই বরফ নিয়মিত ঝেড়ে ফেলতে হয়৷ কিন্তু তাঁবুর চারপাশে বরফ জমলে বাইরে বেরিয়ে পরিষ্কার না করলে উপায় থাকে না৷ রাতবিরেতে প্রবল ঠান্ডার ঝাপটানি তখন শরীরকে কাবু করে দেয়৷
আর তাঁবুর ভেতরে বিশ্রাম বা ঘুম বলতে শুধুই তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকা৷ কতদিন, কতরাত যে না ঘুমিয়ে কেটেছে, তার হিসেব নেই৷
এবারেস্ট একা নয়, তাকে ঘিরে রয়েছে আরও কিছু শৃঙ্গ৷ কুমারী পিক, লোলা পিক, নুৎসে পিক৷ এই পিকগুলির মধ্য দিয়ে খুম্বু আইসফলের ভিতর দিয়ে একটু একটু করে পথ করে এগোনো৷ রাস্তা কোথাও কোথাও এতটাই সরু যে, অনেক সময় শুধুমাত্র গোড়ালির ওপর ভর দিয়েও হাঁটতে হয়৷ এই পথচলা তাই একইসঙ্গে কষ্টসাধ্য এবং রোমাঞ্চকর৷ আবার কঠিন এই পথ পেরিয়ে আসার অভিজ্ঞতাও একজন অভিযাত্রীর কাছে কম আনন্দের নয়৷
বেসক্যাম্প থেকে ক্যাম্প-১, ক্যাম্প-২, ক্যাম্প-৩৷ তার পর সাউথ কল বা সামিট ক্যাম্প৷ এর পর ব্যালকনি৷ ব্যালকনির পরে সাউথ সামিট, হিলারি স্টেপ৷ এবং শেষে সামিট৷ এটাই এভারেস্টের শীর্ষবিন্দু৷ অর্থাৎ অভীষ্টে পৌঁছনোর টার্গেট পয়েন্ট৷ আমার অভিযানের পথটা ছিল এরকমই৷
১৬ তারিখ রাতে ফিরে আসার পরে আমি আবার পরের দিন ওই দুর্যোগের মধ্যেই শেরপাকে সঙ্গে নিয়ে রাত ৯টার সময় বেরিয়ে পড়লাম৷ সহ-অভিযাত্রীরা নিষেধ করা সত্ত্বেও শুনিনি৷ কারণ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস মেনে চললে সাতদিন অপেক্ষা করে বসে থাকতে হত৷ পাহাড়ে ঘন ঘন আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়৷ এই আবহাওয়ার উন্নতি হল তো পর মুহূর্তের আবার অবনতি৷ পূর্বভাস তাই সব সময় একশো ভাগ মেলে না৷ বেরিয়ে তো পড়লাম, কিন্তু ১৭ তারিখও প্রায় ১২০ কিলোমিটার বেগে হাওয়া বইছিল৷ রোপের ওপরে বরফ জমে এমন অবস্হা হয়েছিল যে, ঠিকমতো জুমারিং করাও যাচ্ছিল না৷ যাইহোক, শেষ অবধি ১৮ তারিখ সকাল ৭টায় উঠে পড়লাম এভারেস্টের চূড়ায়৷
প্রথম অসামরিক বাঙালি কন্যার এভারেস্ট আরোহণে তৈরি হল নতুন রেকর্ড৷
এবার এগোলাম লোৎসের পথে৷ এটা এভারেস্টের পথের চেয়েও বেশি কঠিন৷ ২০ মে সেই শৃঙ্গও জয় হল৷ তৈরি হল আরও একটা রেকর্ড. লোৎসেতে পা পড়ল প্রথম ভারতীয় মহিলার৷ আর এত কম সময়ের ব্যবধানে দুই শৃঙ্গ জয় তো আজ বিশ্বরেকর্ড৷
ওপরটা কেমন
দুই শৃঙ্গের ওপরে যেখানে জাতীয় পতাকা ওড়ালাম, সেখানে রয়েছে ছোট্ট একটা সমতলভূমি৷ বরফে ঢাকা সেই জায়গাটাতে খুব বেশি হলে ১০ থেকে ১৫ জন মানুষ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াতে পারে৷
এভারেস্টের মাথায় আছে চোরতেন বা বরফের একটা স্তম্ভ৷ যা অনেকটা মন্দিরের মতো দেখতে৷ দুটো লোহার দণ্ডও পোঁতা আছে সেখানে৷ তার মাঝে একটা কাচের বাক্সে রাখা আছে বুদ্ধদেবের ছবি৷ শীর্ষে পৌঁছনোর প্রমাণ হিসাবে এই চোরতেন এবং বুদ্ধদেবের ছবি তুলে নিয়ে আসেন অভিযাত্রীরা৷
দুই শৃঙ্গে ওপর থেকে দেখা যায় একদিকে চীন এবং অন্যদিকে নেপালকে৷
আমিও দেখলাম৷ একবার ২৯,০২৯ ফিট এবং আরেকবার প্রায় ২৮,০০০ ফিট ওপর থেকে৷ ভাবা যায়!
তুষারশুভ্র দুই চূড়ার মাথা থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘের পর মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে৷ ভোর ৫টার সময় লোৎসের মাথা থেকে সূর্যোদয় দেখলাম, মনে হল এক টুকরো হীরকখণ্ডকে কেউ যেন দু হাতে তুলে ধরেছে৷
অত উঁচু থেকে মনে হয় পায়ের কাছে কোথাও যেন সূর্যটা ঘোরাঘুরি করছে৷ অন্য শৃঙ্গগুলিকে সেখান থেকে টিলার মতো দেখতে লাগে৷ মনে হয় যেন এক শৃঙ্গ থেকে অন্য শৃঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যাওয়া যায়৷ দিগম্তরেখাটাকে মনে হয় ঠিক যেন উল্টানো বাটি৷
এভারেস্টে যাওয়ার পোকা নড়েছিল ২০১২ সালে, মনিরাং অভিযানে গিয়ে৷ শেরপাদের কাছে এভারেস্ট নিয়ে সেবার অনেক কথা শুনি৷ মনিরাং থেকে ফিরে আমার শিক্ষক বসম্ত সিংহরায়ের কাছে প্রথম এভারেস্টে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করি৷ উনি খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন৷ তারই ফলে এই অভিযান৷
এভারেস্টের মতোই কাঞ্চনজঙঘা নিয়েও আমার স্বপ্ন অনেকদিনের৷ দার্জিলিঙের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে কোর্স করার সময় ক্যান্টিন থেকে রোজ কাঞ্চনজঙঘাকে দেখতাম৷ এভাবে দেখতে দেখতে ওখানে পৌঁছনোর স্বপ্ন দেখার শুরু৷ এবার তাই কাঞ্চনজঙঘা জয় করতে চাই৷ কাঞ্চনজঙঘা (ওয়েস্ট)গ্গর ইয়ালুংখাঙ আমার পরবর্তী লক্ষ্য৷ কাঞ্চনজঙঘা মেইনে অনেকেই উঠেছেন৷ কিন্তু কাঞ্চনজঙঘা সেন্ট্রাল, কাঞ্চনজঙঘা ওয়েস্ট, কাঞ্চনজঙঘা নর্থ ইত্যাদি শৃঙ্গগুলিতে খুব বেশি মানুষের পা পড়েনি৷ প্রায় এগারো-বারো বছর ইয়ালুংখাঙে কোনও অভিযানই হয়নি৷
কিন্তু অপেক্ষাকৃত অচেনা, অজানা, অনাবিষ্কৃত দুর্গম এই শৃঙ্গগুলিতে যেতে চাইলে কী হবে, ফাউন্ডেশনের নতুন কর্তাদের পরামর্শে সরকারের নতুন নিয়মের ফাঁস সেই ইচ্ছেকে গলা টিপে মারছে৷
এভারেস্টের চেয়ে কম উচ্চতার শৃঙ্গ, যেখানে আগে অভিযান হয়েছে, একক উদ্যোগে সেখানে গেলে এখন থেকে আর সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যাবে না৷ নতুন নিয়মটা এরকমই৷ আগে কিন্তু এমন অদ্ভুত নিয়ম ছিল না৷
সরকার, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস চাইছেন, পর্বতারোহীদের উৎসাহিত করতে কিন্তু ফাউন্ডেশনের নতুন পরামর্শদাতা, নতুন কর্মকর্তারা ভুল পরামর্শ দিয়ে বিপথে চালিত করছেন সরকারকে৷
লক্ষ্মী জোগাড়ের ঝক্কি
এভারেস্টই হোক বা কাঞ্চনজঙঘা, পাহাড়ে চড়ার খরচ অনেক৷ ক্লাব বা দলের সঙ্গে না গিয়ে একার উদ্যোগে গেলে সেই খরচ আরও বাড়ে৷ এবার যেমন সরকার থেকে ৫ লাখ টাকা সাহায্য করায় অনেকটাই সুবিধে হয়েছে৷
এভারেস্টে যাওয়ার খরচ ছিল ১৬ লাখ টাকা৷ তার সঙ্গে আবার লোৎসের ৬ লাখ টাকা যোগ হয়েছিল৷ কাঞ্চনজঙঘায় যাওয়ার খরচ প্রায় সাড়ে ৩৫ লাখ টাকা৷ সরকার পাশে এসে না দাঁড়ালে যার পুরোটাই নিজের উদ্যোগে জোগাড় করতে হবে৷ আবার ইয়ালুংখাঙে দীর্ঘদিন অভিযাত্রীরা যান না৷ তাই দল করে যাওয়াটাও সমস্যার৷
ফাউন্ডেশনের নতুন নিয়ম আমার বিড়ম্বনা তাই আরও বাড়িয়ে দিল৷ এবং এটাও স্পষ্ট, নিয়মের এই বেড়াজাল আমার উদ্যোগটাকে আটকে দেওয়ার জন্যই৷ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই এরকম একটা নিয়ম খাড়া করা হচ্ছে৷ লক্ষ্মী জোগাড়ের ঝক্কিটা এবার অনেক বেশি কঠিন হয়ে গেল৷
পর্বতারোহী হব ভাবিনি
আমি যে কোনওদিন পর্বতারোহী হব, ছোটবেলায় সেটা ভাবিনি কখনও৷ বিমলাদেবী প্রাইমারি স্কুল, ব্যাঁটরা বিধুভূষণ পাল চৌধুরি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার সময় খেলাধুলোয় বরাবরই প্রথম হতাম৷
পাহাড়ের নেশা শুরু আর্য বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে৷ তখন ক্লাস টেন, মাধ্যমিক দেব৷ স্কুলেই সুযোগ এল এন সি সি-তে যোগ দেওয়ার৷ সেই সূত্রেই ট্রেক করতে গিয়েছিলাম শুশুনিয়াতে৷ সেখান থেকে রক ক্লাইম্বিং শিখে আসার পর বরফের ওপর কীভাবে বাইতে হয়, সেটাও শেখার ইচ্ছে হল৷ দার্জিলিঙের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে ট্রেনিং নিলাম, শুরু হল পর্বতারোহীর জীবন৷
ট্রেনিং পর্বেও বেশ কিছু রেকর্ড আছে৷ যা আজও অক্ষত৷
আমার ক্লাব ক্রিক রো-র ইনস্টিটিউট অব এ‘প্লোরেশন সান্দাকফুতে যে অভিযানের ব্যবস্হা করেছিল, সেখানেও মানেভ? থেকে সান্দাকফুর শীর্ষ পর্যম্ত বারো হাজার ফুটের বেশি দূরত্ব মাত্র সাড়ে ৬ ঘণ্টায় দৌড়ে অতিক্রম করে রেকর্ড করেছিলাম৷
আবার ২০০৮ সালের ৯ জুন একই দিনে উঠেছিলাম যোগিন-১ (৬৪৬৫ মিটার) ও যোগিন-৩ (৬,১১৬ মিটার) দুই শৃঙ্গেই৷ আমার সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন৷ সীমাশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, মিতা ধর এবং উমে কুলসুম৷
পর্বতারোহী হওয়ার আগে জানতাম পাহাড়ের সান্নিধ্য পরিপূর্ণ ও নতুন মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে৷ কিন্তু সেই ধারণাটা এবার ধাক্কা খেল৷ ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও টানা হ্যাঁচড়া হয়েছে৷ অভিযানে যাওয়ার সাতদিন আগে বিবাহ-বিচ্ছেদের নথি আসে আমার হাতে৷ অবাক হয়ে দেখলাম, এভারেস্ট জয়ের খবরের সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়াতে সেই খবরও প্রকাশিত হল৷ আমি বা আমার পরিবার সংবাদমাধ্যমের কাছে বিচ্ছেদের খবর নিয়ে এর আগে কোনও কথা বলিনি৷
তবে ভাল মানুষের সন্ধানও দিয়েছে এভারেস্ট৷ যেমন তাশি শেরপা, টাকা বাকি রেখেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ চেনা গণ্ডির বাইরে ওঁর জিম্মায় থেকে নিজেকে অ-সুরক্ষিত মনে হয়নি কখন৷ আর সেই জাপানি অভিযাত্রী! লোৎসে অভিযানের সময় যার মৃতদেহ সরিয়েই আমাকে শীর্ষে পৌঁছতে হয়েছিল৷ লোৎসে শৃঙ্গের কুড়ি ফুট নিচে হেলে পড়েছিল দেহটা৷ লোৎসে জয় করে নামার সময় শক্ত কাঠ হয়ে থাকা ওই শরীরটার ওপরে ভর দিয়েই তো আমি নামলাম৷ ওই অভিযাত্রীর মতো আরও অনেক অভিযাত্রীরই মৃতদেহ পড়ে রয়েছে পাহাড়ে৷ কাজের প্রতি নিষ্ঠা, ভালবাসা এবং লক্ষ্যে অবিচল থাকার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া এই মানুষগুলির প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে৷
চক্রাম্ত অবশ্য এখনও থামেনি৷ লোৎসের সার্টিফিকেট মানতে চাইছে না ফাউন্ডেশন৷ নানা অছিলায় লোৎসে জয়কে অস্বীকার করে চলেছে এখনও৷
কিন্তু এভাবে আর কতদিন, আমার সাফল্যকে চেপে রাখতে পারবেন কর্তারা?
অনুলিখন: কৌশিক বসু
|
|
No comments:
Post a Comment