Sunday, 15 June 2014

Baba-ke Niye Lekha by Kabir Sumon

বাবাকে নিয়ে লেখা কোনো আধুনিক বাংলা গান আমি শুনিনি। মাকে নিয়ে লেখা বাংলা গান শুনেছি অবশ্য। একটি গান, ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ তো অনেকেই শুনেছেন, গেয়েছেন। লিখেছিলেন বোধহয় পবিত্র মিত্র, সুর করেছিলেন ও প্রথম রেকর্ডে গেয়েছিলেন সুধীরলাল চক্রবর্তী।
বাবাকে নিয়ে লেখা একটি ইংরেজি গান একবার শুনেছিলাম। মা মারা যাবার পর বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে – ‘বাবা, তুমি কেঁদো না’।
অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম – বাবাকে নিয়ে একটি গান লিখব। বাবাই তো আমার প্রথম সঙ্গীতগুরু। বাংলা গান কিভাবে গাইতে হবে তা তিনিই আমাকে শেখাতে চেষ্টা করেছেন। তেমনি, আমার সামনে বিচিত্র সঙ্গীতের জগৎটাও খুলে দিয়েছিলেন তিনিই। শুধু বাংলা গান শেখানোই নয়, নানা ধরণের গান বাজনা শুনতে শিখিয়েছিলেন তিনি আমাকে।
একদিকে তিনি কঠোর সঙ্গীতশিক্ষক। গান গাইতে গিয়ে পান থেকে চুণ খসার জো নেই। একই লাইন বারবার গাওয়ানো, একই সুরের টুকরো বারবার তোলানো, একই গান সমানে গাইয়ে গাইয়ে হদ্দ করিয়ে দেওয়া – এই ছিল তাঁর স্বভাব।
তাঁর সামনে বসে একটা পুরো গান একটানা গেয়ে যাওয়ার সুযোগ প্রথম জীবনে কমই পেয়েছি, থেকে থেকেই থামিয়ে দিতেন। ভুল শুধরে দিতেন। রেয়াজে ফাঁকি দিলে যে বকুনি দিতেন, তার জের আজও রয়ে গিয়েছে। তানপুরাটাও ভয় পেয়ে যেত বোধহয়।
এই চরম কঠোর সংগীতগুরুই, আবার অনাবিল ঔদার্য নিয়ে একাধার থেকে রাজ্যের গান বাজনা শোনাতেন আমাদের গ্রামোফোন রেকর্ড বাজিয়ে বাজিয়ে। সেখানে কোন ছুৎমার্গ, গোঁড়ামি, কাঠিন্য ছিল না। সেখানে ছিল না কোনো নিষেধ। সেখানে বিরাজ করত প্রাণ খুলে, কান খুলে গান বাজনা শোনার মুক্ত আনন্দ।
যে ভালোবাসা দিয়ে বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবের ঠুংরি রেকর্ড বাজাতেন, সেই একই ভালোবাসা দিয়ে তিনি কিনে আনতেন হয়তো ‘বরসার কি রাত’ ছবির একটি কাওয়ালির রেকর্ড। চোখ বুঝে প্রায় ধ্যানমগ্ন হয়ে শুনতেন দুটোই। আমরাও শুনে নিতাম এ সুযোগে।
পান্না ভট্টাচার্যের শ্যামাসঙ্গীত, দিলীপকুমার রায়ের গাওয়া কোনো গান, পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া ‘চৈত্র দিনে ঝরাপাতার পথে’ বেগম আখতারের গাওয়া গালিবের গজল, কী সাবলীলভাবে হাতে ধরত ইহুদী মেনুহীনের বাজানো কোনো ভায়োলিন, সোণাটার, পল রোবসনের ভল্গা নদীর গানের।
এই গানপাগল মানুষটাই আবার একটি বিরাট গাছের মতো আগলে রাখলেন, ছায়া দিয়ে গেলেন সংসারটিকে। বাজারের থলিটা তাঁর হাত থেকে কেড়ে নেবার সাধ্য কার? গল্প করতেন বুড়ো বয়েসে – বাজারের আলুওয়ালা, সবজিওয়ালারাই তাঁর বন্ধু। মনের ভুলে টাকা ফেলে আসলেন হয়তো বাজারে। পরের দিন সবজিওয়ালাই তাঁকে ধরে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিলেন। বুড়ো মানুষদের আজকাল আর কে তেমন পাত্তা দেয়! বাবা গল্প করতেন – বাজারের লোকগুলো তিনি একদিন বাজারে না গেলে তবু জিজ্ঞাসা করেন – ‘শরীর ভালো আছে তো? কাল আসেন নি কেনো?’
ঠিক এই মানুষটাকে আমি ধরতে চাইছিলাম আমার গানে। একজন সাধারণ বাবা, যাঁর বয়স হয়ে গিয়েছে, যিনি বৃদ্ধ হলেন – বাজারের আটপৌরে থলি হাতে, ডাল ভাত আলুচচ্চড়ির প্রাত্যহিকতায়, একটু ভালো চা খুঁজে এনে পরম তৃপ্তিতে এক কাপ চা খাওয়ার সাধারণ ইচ্ছেটুক নিয়ে – অথচ যাঁর সারা অস্তিত্ব জুড়ে শুধু গানবাজনা।
লিখতে আরম্ভ করলাম ১৯৯১ সালের শেষের দিকে। বাবাকে নিয়ে লিখতে লিখতে গানটা দেখলাম নিজের খেয়ালে চলে যেতে চাইছে আমার ছেলেবেলা, কৈশোরের গান শোনার স্মৃতিগুলোর দিকে। বড়ে গোলাম আলি খান, আখতারবাঈ, দিলীপকুমার, পঙ্কজ মল্লিক, আমীর খান সাহেব, ইহুদী মেনুহিন, পল রোবসন – এরাও কি আমার বাবা নন?
গানটি লিখছি কয়েক মাস ধরে। সুর করতে বসে প্রথম দুটি লাইনের সুর যেন নিজের থেকেই চলে এল। ‘সাপাট তানের মতোই বন্য বারেবারে’ পর্যন্ত সুর করে গিয়েছি একটানা। প্রথম দিকে শুদ্ধ কল্যাণ রাগের ছোঁয়া এসে গিয়েছিল, – ‘দম ফুরানো কলের গানে’ থেকে ভাবনাচিন্তা করেই সুরের চলন ও চরিত্রটা পালটে দিলাম। তাল হয়ে গেলো আট মাত্রা থেকে ছয় মাত্রা। খরজ দিলাম পালটে। প্রায় কেতাবী পদ্ধতিতে এবার মধ্যমটাকে করে দিলাম ষড়জ সুর। তারপর অবশ্য সমানে পরিবর্তিত খরজে রাখি নি গানটিকে। একটু বাদে বাদেই সুরকে ফিরিয়ে এনেছি মূল সুরের মোকামে।
তিনি বৃদ্ধ হলেন
বনষ্পতির ছায়া দিলেন সারাজীবন।
এই বুড়ো গাছের পাতায় পাতায়
সবুজ কিন্তু আজো মাতায়
সুঠাম ডালে,
ডালই বলো ভাতই বলো
গান বাজে তাঁর গৃহস্থালীর তালে তালে।
ওহে ও গেরস্থ
ভীষন ব্যাস্ত
একটু ভালো চা পাওয়া যায় কোন দোকানে
ওহে সবজীওয়ালা বন্ধু তোমার
সবুজ বেচা মানুষ আসে তোমার টানে
ওহে প্রতিদিনের বাজার যাওয়া
থলি হাতেই কেটে গেল সারাজীবন।
ছিল ছেলেবেলার রামঠ্যাঙানি
কথায় কথায় চোখ রাঙানি
নানা কারণ
ছিল ইংরেজি বই পড়তে বসা
দুপর বেলা অংক কষা
খেলা বারণ।
ছিল রেয়াজ বিনে রামবকুনি
তানপুরারও ধুকপুকুনি
চারটি তারে
সেই বকুনিটাও গানের জন্য
সাপাট তানের মতোই বন্য
বারেবারে।
দম-ঘোরানো কলের গানে
ছেলেবেলার আকাশপানে
বড়ে গোলাম
আখতারিবাঈ তাঁরই পাশে
গানকে যারা ভালোবাসে
তাঁদের সেলাম।
ছিল দিলীপকুমার রায়ের কণ্ঠ
সমস্ত সুর হন্তদন্ত
হারমোনিয়াম,
মেনুহিনের বেহালা আর
আমীর খানের কণ্ঠ অপার-
তোমায় সেলাম।
ছিল কলম্বিয়ার বাঘের ছাপ্পা
কুকুর শোনে বাংলা টপ্পা
চোঙা মুখে,
ছিল পঙ্কজ মল্লিকের গলা
অন্ধকারে একলা চলা
মনের সুখে।
ছিল রোবসন আর ভল্গা নদী
গুণ টেনে যায় নিরবধি
রুশকি মাঝি
ছিল বেটোফেনের সোনাটা আর
সালাম নাজাকাতের কণ্ঠে
আতসবাজি।
ছিল নির্মলেন্দু চৌধুরী তার
গলার আওয়াজ মুক্ত দেদার
নদীর মতো,
ছিল পান্নালালের শান্ত মিঠে
গলায় বুকে বাস্তুভিটে
শান্তি পেতো।
এই বনস্পতির ছায়ায় ব’সে
শুনেছি গান দেঁড়ে ক’ষে
পরম পাওয়া,
এই বনস্পতিই গান শেখাল
তরঙ্গতে এলোমেলো
নৌকো বাওয়া।
দ্যাখো বইছে এখন বয়সকালে
পাতায় পাতায় এবং ডালে
কালের ওজন
তিনি বৃদ্ধ হলেন বৃদ্ধ হলেন
আমায় ছেড়ে বুড়ো হলেন
আমার সুজন।

No comments:

Post a Comment