মারাকানা স্টেডিয়ামের বহিরঙ্গেই কৌলীন্যের একটা গা ছমছমে ব্যাপার আছে! ফুটবল ভালবাসার সিম কার্ড নিয়ে আসুন বা না আসুন, একটা নেটওয়ার্ক সিস্টেমে ঢুকবেই যে, এটা ফুটবল শাসকের দুনিয়া! মধ্য মেধার নয়।
পরাধীন দেশের ভারতীয় ক্রিকেটাররা এক সময় বারংবার লর্ডস বিপর্যয়ের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলতেন, এমনিতেই সাহেবদের বিরুদ্ধে হীনমন্যতায় ভুগি। আর ওই মাঠে গেলে পরিবেশ আরও দমিয়ে দেয়। মারাকানা হল সেই পরিবেশ যাকে ইংরেজ সাংবাদিক এক কথায় লিখবেন ‘ইমপোজিং’। গেটের বাইরে একটা কুড়ি ফুট মতো উঁচু মূর্তি। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের বাইরে ববি মুরেরও এ রকম একটা মূর্তি আছে। কিন্তু এটা যেন আরও সশব্দ। হিডেরাল্ডো বেলিনির স্ট্যাচু ওটা। এ বছরই যিনি মারা গিয়েছেন।
মারাকানার হোম টিম ড্রেসিংরুম যাঁর নামে, সেই গ্যারিঞ্চা নন।
মারাকানার অতিথি টিম ড্রেসিংরুম যাঁর নামে, সেই পেলেও নন।
তবু বেলিনির মূর্তি বসার কারণ, তিনি ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক। চার বছর পরেও ব্রাজিল আবার বিশ্বকাপ জেতে। ওই মূর্তির তলায় চ্যাম্পিয়ন টিমের প্লেয়ারদের নামগুলো খোদাই করা। সেটা এক নজরে দেখলেই ব্রাজিল ফুটবল সভ্যতার প্রতি সপ্রশংস সম্ভ্রম জাগবে। কী কী সব নাম! কিন্তু আসল ধাক্কাটা বেলিনির ছবিতে। এক হাতে জুলে রিমে কাপটা শূন্যে তুলে দেওয়া। কার্যতই ছুড়ে দেওয়া। পেলেরা সুইডেনে জেতার আঠাশ বছর আগে বিশ্বকাপ শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার আগে কোনও ক্যাপ্টেন নাকি ও ভাবে শূন্যে জুলে রিমে ট্রফি তোলেনি।
মূর্তি হয়েও অদ্ভুত একটা তাচ্ছিল্য আছে বেলিনির শরীরী ভাষায় যে, এটা ব্রাজিল ফুটবল সীমান্তে ঢুকছ। এটা আমাদের সংরক্ষিত এলাকা। কোনও মগের মুলুক নয়। যা বলব, সে ভাবে চলবে। আরও এগারোটা জায়গায় তো ব্রাজিল জুড়ে খেলা হচ্ছে। কিন্তু মারাকানা হল মারাকানা। পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে জনবহুল স্টেডিয়াম আর তার চেয়েও অসীম গুরুত্বপূর্ণ, ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের গর্ভগৃহ!
বিশ্বকাপের ড্র তৈরির সময় কে জানত, সেই মারাকানায় নেইমারদের খেলা না পড়ে আবির্ভাব ঘটবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের ফুটবল সম্রাটের! বিশ্বকাপ বিপর্যয়ে পরপর দু’বার রক্তাক্ত আর আক্রান্ত হতে হতে এটা কি লিওনেল মেসির পোয়েটিক জাস্টিস যে, বিশ্বমঞ্চে তাঁর রাজ্যাভিষেকের ঐতিহাসিক প্রথম দৃশ্যের জন্য ফুটবল দেবতা মারাকানাকেই সরিয়ে রেখেছিলেন!
প্রতিপক্ষ বসনিয়া, সেটা নিছকই একটা নিয়মরক্ষার ব্যাপার। কোনও না কোনও টিমকে হতে হত, তাই বসনিয়া। মারাকানার বাইরে যে ভিড়টাকে হলুদ আর নীল জার্সি মিলে সকাল থেকে আর্জেন্তিনা টিমের আগমন অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি, তাদের আর বাকি বিশ্বের চিন্তায় একটাই মিল—  দু’দলের বাকি একুশ জন নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। মারাকানার বাইরে শুধু দশ নম্বর নীল-সাদা জার্সিতে লোক। আর এক সমর্থক দিয়েগো মারাদোনা সেজেও দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু তারও জিজ্ঞাসাটা কমন।
রাজ্যাভিষেকের প্রথম দৃশ্য কতটা জমকালো করতে পারবেন লিওনেল মেসি?
কাল রাত্তিরে একটা সময় মনে হচ্ছিল, বিশ্বকাপের রং বুঝি কমলা হয়ে গেল। তিকিতাকার তো গ্রহণ হলই, সম্ভবত মনোযোগ সরে গেল ব্রাজিলে মেসির আবির্ভাবী কাপ ম্যাচ নিয়েও। সালভাদোরে স্প্যানিশ আর্মাডা কমলা আভায় পুড়ে যাওয়া নিয়ে শনিবার দিনভরও বিস্তর চর্চা চলল, সন্দেহ নেই। ফিফার লোকেরা রিওয় বসে বলছিলেন, খেলার আগে সালভাদোর প্রশাসন নাকি বলেছিল গোল-পিছু শহরে এক হাজার একশোটা গাছ লাগাবে। প্রতিশ্রুতি রাখতে তাদের এখন ৬৬০০ নতুন গাছ বসাতে হচ্ছে। খবর হিসেবে চটকদার এবং শিরোনাম-যোগ্য। এ দিনই আবার ইংল্যান্ড-ইতালির মতো অন্যতম ডার্বি ম্যাচ।
তবু তিনি, লিওনেল মেসি আলোচনা থেকে কিছুতেই মুক্ত নন। পরের রাশিয়া বিশ্বকাপে তাঁর বয়স হবে ৩০। ওই বয়সে একটা টিম টেনে নিয়ে যাওয়াটা আধুনিক ফুটবলের অ্যামফিথিয়েটারে কার্যত অসম্ভব। সবাই এবং অবশ্যই মেসি নিজে একটা সারসত্য জানেন। হয় এ বারই, নয়তো কখনও নয়!
ছয় বার লা লিগা জেতা আছে মেসির। তিনটে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন। চার বার পেয়েছেন ব্যালন ডি’অর। এমনকী অলিম্পিক সোনাও। কিন্তু ঠিক ঊনত্রিশ দিন বাদে মারাকানায় যা বিতরণ হবে, সেই বিশ্বকাপ পদকটা নেই তাঁর! আর তিনি তো নিজেই বলেছেন, সব থেকেও ওটা না থাকলে মারাদোনার সরণিতে ওঠা যাবে না। পেলেতেও নয়!
তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিআর সেভেনকে নিয়েও নিরন্তর আলোচনা। কিন্তু এত বেশি সংখ্যায় ফুটবল সমর্থক নিশ্চয়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় হিট করে গবেষণা করছে না, রোনাল্ডো জেতাতে পারবেন কি না পর্তুগালকে? মেসির কাছে ওটা চাই-ই! যা দেখে বেলো হরাইজন্তের বেস ক্যাম্পে আর্জেন্তিনীয় কোচ বলেছেন, “আমার আশ্চর্য লাগে, লোকে কেন ভুলে যায় লিও এক জন মানুষ? ওর একটা পেনাল্টি মিস মানে এমন প্রতিক্রিয়া হবে যেন পৃথিবীকে ভিনগ্রহের মানুষ আক্রমণ করেছে।”
মেসিকে টিমের ক্যাপ্টেন বানিয়ে দিয়েছেন সাবেয়া। তাঁকে যত পারছেন ঠান্ডা, নিজের মতো রেখে দিয়েছেন। সাবেয়া-মেসি কম্বিনেশন নীল-সাদা স্ট্রাইপের হয়ে কাজও করছে। পূর্বতন কোচেরা যেখানে ৬১ ম্যাচে তাঁর কাছে ১৭ গোল পেয়েছেন, সেখানে সাবেয়ার আমলে ২৫ ম্যাচে ২১ গোল করে ফেলেছেন মেসি।
আর্জেন্তিনা টিমে একটা প্রথা আছে, ক্যাপ্টেনকে ম্যাচের আগে টিম-টক দিতে হয়। শুনলাম মেসি বেশির ভাগ দিনই বেশি কিছু বলতে চান না। একটা ম্যাচের আগে নাকি এমনও বলেন যে, চলো পিচে নেমে পড়ি। কিন্তু নতুন জমানায় তিনি নাকি খুব মেজাজেই আছেন। টিমমেট আগেরোকে নিয়ে সর্বক্ষণ আড্ডা মারছেন। রিল্যাক্সড থাকছেন যথাসম্ভব। যদিও গোটা ফুটবলদুনিয়ার এমন চাপ তাঁর ওপর যে, একটা সময় হয়তো রিওর প্রবাদপ্রতিম ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার স্ট্যাচুর দিকে তাকিয়ে বলতে হবে, প্রভু আমার চাপ কমিয়ে দাও।
মারাকানার মতোই রিওয় রাজ্যাভিষেক যুদ্ধ শুরু হওয়াটাও যেন কবিত্বের ন্যায়বিচার। ব্রাজিলের আত্মা মানে আসলে রিওর আত্মা! অসাধারণ সব নৈসর্গিক দৃশ্য। সফেন সমুদ্র। কেবল কার। অপরূপ সব পাহাড়। ৯৮ ফুট উঁচু আর ৯২ ফুট চওড়া ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার। কিন্তু যিশুর ওই মূর্তির ফাঁকে ফাঁকেই তো সব ফাবেলা। যাকে বলে এখানকার বস্তি। রিও শহরের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বস্তি। এই দেখলেন আকাশছোঁয়া অট্টালিকা। তার পাশেই আবার এমন সরু গলি যা উত্তর কলকাতাকেও হার মানিয়ে দেবে। পর্যটকদের এই শহরে তাই বারবার সাবধান করে দেওয়া হয়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আবিষ্ট হয়েও পুরোপুরি সম্মোহিত হবেন না। কারণ কোপাকাবানা বিচেই হোক কি শহরের অভিজাত বিল্ডিং— বিপদ কিন্তু সব সময় এক ইঞ্চি দূরেই থাকতে পারে! রিও তাই শুধু অসামান্য সুন্দর নয়। শুধু হাড় হিম করে দেওয়া বিপদসঙ্কুলও নয়। সুতোর মাঝামাঝি। সুনীলের যে একটা লেখা ছিল না— ভয়ঙ্কর সুন্দর!
লিওনেল মেসির অবস্থানও তো এই মুহূর্তে তাই! এক ভয়ঙ্কর সুন্দর নগরীতে এক ভয়ঙ্কর টেনশনের মধ্যে যুদ্ধজয় শুরু করতে চাওয়া ফুটবল সম্রাট।
ব্লেম ইট অন মেসি? ব্লেম ইট অন রিও? না, এমনটাই বোধহয় হওয়ার ছিল!