ফেলিক্সকে ক্লোদোয়াল্দোর সেই ধমকটা ভুলিনি
, Ei Samay
জিসি দাস
দেখতে দেখতে ৪৪ বছর পার৷ তবু কেন যেন মনে হয়, এই তো সে দিন! ব্রাজিলের তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জিতে জুলে রিমে ট্রফি দখলের দিনক্ষণ, প্রতিটা মুহূর্ত যেন এখন চোখের সামনে ভাসছে৷
২১ জুন ১৯৭০ সাল৷ মেক্সিকোর লোতেল আবানার (হোটেল হাভানার) ঘরে ঘুমটা ভাঙতে একটু বেলাই হয়ে গিয়েছিল৷ আসলে আগের রাতে উত্তেজনা, আবেগে ঘুমোতেই পারিনি৷ জীবনে প্রথমবার মাঠে বসে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখব৷ এটা ভেবেই রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল৷ ভোরের দিকে তাই একটু চোখ লেগে গিয়েছিল৷ ঘুম ভাঙতে দেখি সৃষ্টিছাড়া কান্ড৷ তুমুল বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে হোটেলের কাঁচের জানলা৷ কী করে মাঠে যাব, কী করে ব্রাজিল-ইতালি ফাইনাল খেলা দেখব, এটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম৷ তখন মেক্সিকো সিটির আজতেকা স্টেডিয়ামে গ্যালারির ছাদ ছিল না৷ ফলে সারাক্ষণ ভিজতেই হবে এটা ধরে নিয়ে মাঠে বেরিয়ে পড়লাম সাত তাড়াতাড়ি৷
স্টেডিয়ামে ঢোকার সময় বৃষ্টি থামল৷ মেক্সিকোয় প্রায় দু'মাস ধরে থাকার সুবাদে স্টেডিয়ামের কর্মী থেকে শুরু করে ব্রাজিলের সাংবাদিকদের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল৷ পর্তুগিজ কিছুটা জানি বলে ওঁদের কাছেরও হয়ে গিয়েছিলাম৷ তখন নিরাপত্তা নিয়ে এখনকার মতো বাড়াবাড়িও ছিল না৷ ফলে ব্রাজিল দলের টিমবাস যেখানে এসে থামবে, তার খুব কাছেই দাঁড়াতে পেরেছিলাম৷ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর ব্রাজিলের বাস এল৷ বাস থেকে এক এক করে জাগালো, পেলে, রিভেলিনো, তোস্তাও, জোয়ার্জিনহোরা নেমে এলেন৷ সবার শেষে নেমে যখন আমাদের সামনে দিয়ে হাত ধরাধরি করে যাচ্ছেন গোলকিপার ফেলিক্স ও মিডফিল্ডার ক্লোদোয়াল্দো, তখন শুনলাম ফেলিক্স স্পষ্ট বলছেন, 'যাক, ফাইনালে যখন উঠেছি, তখন রূপোটা অন্তত পাচ্ছি৷' যা শুনে প্রচন্ড ধমকে উঠলেন ক্লোদোয়াল্দো৷ 'আমরা আজ কিন্ত্ত সেকেন্ড হতে নামছি না৷ জিততেই নামছি৷ মাথায় রেখো, তুমি মাঠে নেমে কোনও দিকে তাকাবে না৷ শুধু তোমার নজর থাকবে বলটায়৷ তাহলে গোল খাবে না৷'
১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আটটা বিশ্বকাপ কভার করেছি৷ আটটা ইউরো কাপও করেছি৷ সঙ্গে তিনটে কোপা আমেরিকা৷ ভারতের আর কোনও সাংবাদিকের এত টুর্নামেন্ট করার অভিজ্ঞতা নেই৷ খুব কাছ থেকে পেলে, মারাদোনা, প্লাতিনি, জিদানদের মতো মহাতারকাদের খেলা দেখার সুযোগ পেয়েছি৷ কিন্ত্ত ব্রাজিলের ক্লোদোয়াল্দো আমার মনের মণিকোঠায় একটা জায়গা করে নিয়েছিলেন সেই ১৯৭০ থেকেই৷ ৯ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর চায়ের দোকানে কাজ করতেন তিনি৷ আর রাতে চার্চের বিলি করা রাতের খাবার খেয়ে দিন কাটত তাঁর৷ পরে তাঁর খেলা দেখে সান্তোস ক্লাবের কোচ লুলা তাঁকে তুলে নিয়ে যান ক্লাবে৷ স্টেডিয়ামের ঘরে রাত কাটিয়েই ক্লোদোয়াল্দো বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়েছিলেন৷ পরে ইনিই সান্তোসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন৷ এই সান্তোসে নেইমারের উত্থানের পিছনেও রয়েছেন ক্লোদোয়াল্দো৷
১৯৭০ সালের ওই ফাইনালে অসাধারণ ফুটবল খেলেছিলেন ক্লোদোয়াল্দো৷ ব্রাজিলের চতুর্থ গোল করেন কার্লোস আলবার্তো৷ কিন্ত্ত এই গোলের বলটা বাড়ান ওই ক্লোদোয়াল্দো৷ নিজের ডিফেন্স থেকে চারজনকে ড্রিবল করে নিয়ে গিয়ে৷
১৯৭৮ সালে এক অদ্ভূত পরিস্থিতিতে দিয়েগো মারাদোনাকে প্রথম দেখি৷ বিশ্বকাপ দেখতে যাচ্ছিলাম৷ বুয়েনস আইরেসের বিমানে কয়েকজনের সঙ্গে আমার ঝামেলা হয়, ওরা ডলার দাবি করায়৷ বুয়েনস আইরেস বিমান বন্দরে ছেলেগুলো যখন আমার সঙ্গে ঝামেলা হচ্ছে, আমাকে বাঁচান এক অচেনা ভদ্রলোক৷ তিনি আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্স যুব দলের কোচ হুয়ান বাসেরো৷ পরিচয় হতে তিনিই আমায় ওঁর পুনতাকালার বাড়ি নিয়ে যান৷ পরের দিন পাশের একটা স্টেডিয়ামে নিয়ে আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্স টিমের ট্রেনিংয়ে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলেন এক ঝাঁকড়া চুলের ফুটবলারকে৷ বলেছিলেন, অনেক দূর যাবে ছেলেটা৷ ওই ছেলেই মারাদোনা৷
শেষবার বিশ্বকাপ করতে গেলাম ফ্রান্সে, ১৯৯৮ সালে৷ মনে আছে, ফাইনালের আগে ব্রাজিলের ট্রেনিং ক্যাম্পে গিয়ে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল৷ দেখেছিলাম রোনাল্দোর সঙ্গে টেকনিক্যাল কো অর্ডিনেটর জিকোর কথা কাটাকাটি হচ্ছে৷ ১৯৭০ সাল হলে হয়তো খুব কাছে গিয়ে ব্যাপারটা শুনে ফেলা যেত৷ কিন্ত্ত ২৮ বছর পর সাংবাদিকদের কাজটা অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছিল৷ বুঝতে পারিনি, কী কথা চলছে৷ ওই ঝামেলা দেখছেন সাংবাদিকরা, এটা উপলব্ধি হতেই ব্রাজিলের নিরাপত্তা কর্মীরা আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল৷ ঠিক কী হয়েছিল বুঝতে না পারলেও এটা বুঝেছিলাম রোনাল্দোর আচরণে ব্যাপক চটেছেন জিকো৷ পরে এর প্রভাবও পড়ল৷ ফাইনালের আগে মাঠে নামা নিয়ে ব্যাপক নাটক করল রোনাল্দো৷ নেমেও জঘন্য ফুটবল খেলল৷ ব্রাজিল হারল ০-৩৷
আফসোস হয়, যদি সে দিন রোনাল্দো-জিকোর ঝামেলাটা বুঝতে পারতাম, তা হলে ফাইনালে ব্রাজিলের হারের আগেই একটা এক্সক্লুসিভ খবর পাঠাতে পারতাম৷ (লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক)
দেখতে দেখতে ৪৪ বছর পার৷ তবু কেন যেন মনে হয়, এই তো সে দিন! ব্রাজিলের তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জিতে জুলে রিমে ট্রফি দখলের দিনক্ষণ, প্রতিটা মুহূর্ত যেন এখন চোখের সামনে ভাসছে৷
২১ জুন ১৯৭০ সাল৷ মেক্সিকোর লোতেল আবানার (হোটেল হাভানার) ঘরে ঘুমটা ভাঙতে একটু বেলাই হয়ে গিয়েছিল৷ আসলে আগের রাতে উত্তেজনা, আবেগে ঘুমোতেই পারিনি৷ জীবনে প্রথমবার মাঠে বসে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখব৷ এটা ভেবেই রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল৷ ভোরের দিকে তাই একটু চোখ লেগে গিয়েছিল৷ ঘুম ভাঙতে দেখি সৃষ্টিছাড়া কান্ড৷ তুমুল বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে হোটেলের কাঁচের জানলা৷ কী করে মাঠে যাব, কী করে ব্রাজিল-ইতালি ফাইনাল খেলা দেখব, এটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম৷ তখন মেক্সিকো সিটির আজতেকা স্টেডিয়ামে গ্যালারির ছাদ ছিল না৷ ফলে সারাক্ষণ ভিজতেই হবে এটা ধরে নিয়ে মাঠে বেরিয়ে পড়লাম সাত তাড়াতাড়ি৷
স্টেডিয়ামে ঢোকার সময় বৃষ্টি থামল৷ মেক্সিকোয় প্রায় দু'মাস ধরে থাকার সুবাদে স্টেডিয়ামের কর্মী থেকে শুরু করে ব্রাজিলের সাংবাদিকদের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল৷ পর্তুগিজ কিছুটা জানি বলে ওঁদের কাছেরও হয়ে গিয়েছিলাম৷ তখন নিরাপত্তা নিয়ে এখনকার মতো বাড়াবাড়িও ছিল না৷ ফলে ব্রাজিল দলের টিমবাস যেখানে এসে থামবে, তার খুব কাছেই দাঁড়াতে পেরেছিলাম৷ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর ব্রাজিলের বাস এল৷ বাস থেকে এক এক করে জাগালো, পেলে, রিভেলিনো, তোস্তাও, জোয়ার্জিনহোরা নেমে এলেন৷ সবার শেষে নেমে যখন আমাদের সামনে দিয়ে হাত ধরাধরি করে যাচ্ছেন গোলকিপার ফেলিক্স ও মিডফিল্ডার ক্লোদোয়াল্দো, তখন শুনলাম ফেলিক্স স্পষ্ট বলছেন, 'যাক, ফাইনালে যখন উঠেছি, তখন রূপোটা অন্তত পাচ্ছি৷' যা শুনে প্রচন্ড ধমকে উঠলেন ক্লোদোয়াল্দো৷ 'আমরা আজ কিন্ত্ত সেকেন্ড হতে নামছি না৷ জিততেই নামছি৷ মাথায় রেখো, তুমি মাঠে নেমে কোনও দিকে তাকাবে না৷ শুধু তোমার নজর থাকবে বলটায়৷ তাহলে গোল খাবে না৷'
১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আটটা বিশ্বকাপ কভার করেছি৷ আটটা ইউরো কাপও করেছি৷ সঙ্গে তিনটে কোপা আমেরিকা৷ ভারতের আর কোনও সাংবাদিকের এত টুর্নামেন্ট করার অভিজ্ঞতা নেই৷ খুব কাছ থেকে পেলে, মারাদোনা, প্লাতিনি, জিদানদের মতো মহাতারকাদের খেলা দেখার সুযোগ পেয়েছি৷ কিন্ত্ত ব্রাজিলের ক্লোদোয়াল্দো আমার মনের মণিকোঠায় একটা জায়গা করে নিয়েছিলেন সেই ১৯৭০ থেকেই৷ ৯ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর চায়ের দোকানে কাজ করতেন তিনি৷ আর রাতে চার্চের বিলি করা রাতের খাবার খেয়ে দিন কাটত তাঁর৷ পরে তাঁর খেলা দেখে সান্তোস ক্লাবের কোচ লুলা তাঁকে তুলে নিয়ে যান ক্লাবে৷ স্টেডিয়ামের ঘরে রাত কাটিয়েই ক্লোদোয়াল্দো বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়েছিলেন৷ পরে ইনিই সান্তোসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন৷ এই সান্তোসে নেইমারের উত্থানের পিছনেও রয়েছেন ক্লোদোয়াল্দো৷
১৯৭০ সালের ওই ফাইনালে অসাধারণ ফুটবল খেলেছিলেন ক্লোদোয়াল্দো৷ ব্রাজিলের চতুর্থ গোল করেন কার্লোস আলবার্তো৷ কিন্ত্ত এই গোলের বলটা বাড়ান ওই ক্লোদোয়াল্দো৷ নিজের ডিফেন্স থেকে চারজনকে ড্রিবল করে নিয়ে গিয়ে৷
১৯৭৮ সালে এক অদ্ভূত পরিস্থিতিতে দিয়েগো মারাদোনাকে প্রথম দেখি৷ বিশ্বকাপ দেখতে যাচ্ছিলাম৷ বুয়েনস আইরেসের বিমানে কয়েকজনের সঙ্গে আমার ঝামেলা হয়, ওরা ডলার দাবি করায়৷ বুয়েনস আইরেস বিমান বন্দরে ছেলেগুলো যখন আমার সঙ্গে ঝামেলা হচ্ছে, আমাকে বাঁচান এক অচেনা ভদ্রলোক৷ তিনি আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্স যুব দলের কোচ হুয়ান বাসেরো৷ পরিচয় হতে তিনিই আমায় ওঁর পুনতাকালার বাড়ি নিয়ে যান৷ পরের দিন পাশের একটা স্টেডিয়ামে নিয়ে আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্স টিমের ট্রেনিংয়ে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলেন এক ঝাঁকড়া চুলের ফুটবলারকে৷ বলেছিলেন, অনেক দূর যাবে ছেলেটা৷ ওই ছেলেই মারাদোনা৷
শেষবার বিশ্বকাপ করতে গেলাম ফ্রান্সে, ১৯৯৮ সালে৷ মনে আছে, ফাইনালের আগে ব্রাজিলের ট্রেনিং ক্যাম্পে গিয়ে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল৷ দেখেছিলাম রোনাল্দোর সঙ্গে টেকনিক্যাল কো অর্ডিনেটর জিকোর কথা কাটাকাটি হচ্ছে৷ ১৯৭০ সাল হলে হয়তো খুব কাছে গিয়ে ব্যাপারটা শুনে ফেলা যেত৷ কিন্ত্ত ২৮ বছর পর সাংবাদিকদের কাজটা অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছিল৷ বুঝতে পারিনি, কী কথা চলছে৷ ওই ঝামেলা দেখছেন সাংবাদিকরা, এটা উপলব্ধি হতেই ব্রাজিলের নিরাপত্তা কর্মীরা আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল৷ ঠিক কী হয়েছিল বুঝতে না পারলেও এটা বুঝেছিলাম রোনাল্দোর আচরণে ব্যাপক চটেছেন জিকো৷ পরে এর প্রভাবও পড়ল৷ ফাইনালের আগে মাঠে নামা নিয়ে ব্যাপক নাটক করল রোনাল্দো৷ নেমেও জঘন্য ফুটবল খেলল৷ ব্রাজিল হারল ০-৩৷
আফসোস হয়, যদি সে দিন রোনাল্দো-জিকোর ঝামেলাটা বুঝতে পারতাম, তা হলে ফাইনালে ব্রাজিলের হারের আগেই একটা এক্সক্লুসিভ খবর পাঠাতে পারতাম৷ (লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক)
No comments:
Post a Comment