Saturday, 21 June 2014

লোকসভায় ধ্বনি উঠল, জয় হরিচাঁদ

লোকসভায় ধ্বনি উঠল, জয় হরিচাঁদ

, Ei Samay

গৌতম হোড় 

নয়াদিল্লি: পাঠশালার বার্ষিক অনুষ্ঠানে যেমন সম্প্রীতির নাচ-গান হয়, সাংসদদের শপথেও হুবহু সেই ছবি৷ একের পর এক সাংসদ শপথ নিচ্ছেন৷ মন্দ্রস্বরে নানা ভাষায় শপথ বাক্য লোকসভার কোণে কোণে আছড়ে পড়ছে৷ বনগাঁর সাংসদ কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর তো শপথের পর 'হরিচাঁদের জয়, গৌরচাঁদের জয়' বলে ধ্বনি দিয়ে উঠলেন৷ এক মহিলা সাংসদ 'ঈশ্বরের নামে' নামে শপথ নিয়ে কী জানি কেন, স্বামী এবং শ্বশুরের নামও বিনম্র শ্রদ্ধায় আওড়ে ফেললেন৷ পতিব্রতা হওয়ার সুবর্ণ মওকা হাতছাড়া করেননি তিনি৷ গুজরাটের এক সাংসদ ঘরে ঢোকার মুখে গভীর অনুরাগে দু'পাক নেচে নিলেন৷ ভোজপুরি সুপারস্টার মনোজ তিওয়ারি গাইলেন দু'কলি গান৷ নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের বিচিত্র মিলন৷ অখণ্ড কীর্তন বা কাওয়ালি হল না এই যা ! 

সাংসদদের গায়ে বিশুদ্ধ নিজ বেশ৷ ঝাড়গ্রামের তৃণমূল সাংসদ উমা সোরেন সাঁওতালি ভাষায় শপথ নিলেন৷ সাঁওতালি রীতিতে শাড়ি পরেছিলেন উমা৷ তাতে আঁকা ঘাসফুল৷ লেখা মা মাটি মানুষ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় শপথ নিয়ে 'জয় হিন্দ, বন্দে মাতরম' তো বললেনই, সঙ্গে যোগ করলেন 'বাংলার জয় হোক'৷ বোলপুরের অনুপম হাজরা আরও দু'কদম এগিয়ে৷ বললেন, 'আমি বাঙালি, আমি গর্বিত'৷ শুধু এঁরাই নন, ছত্রপতি শিবাজি ও বালাসাহেব ঠাকরের নামে জয়ধ্বনি দিয়েছেন চন্দ্রকান্ত খেড়ে, আনন্দরাও আরসুল, বিনায়ক রাউত, অরবিন্দ সাওন্তের মতো মহারাষ্ট্রের সাংসদরা৷ 

শপথ অনুষ্ঠানে প্রথম চমক সুষমা স্বরাজের৷ হিন্দি বা ইংরাজি নয়, শপথ নিলেন সংস্কৃতে৷ উমা ভারতী, হর্ষবর্ধনও যেন সংস্কৃতেই সাবলীল৷ প্রোটেম স্পিকার কমল নাথ বৃহস্পতিবার প্রথম শপথবাক্য পাঠ করান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে৷ দ্বিতীয় সাংসদ হিসাবে শপথবাক্য পাঠ করেন লালকৃষ্ণ আদবানি৷ তৃতীয় সনিয়া গান্ধী৷ সনিয়া যখন শপথ নিচ্ছেন, তখন সে দিকে তাকিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী৷ শপথ নিয়েই সনিয়া মোদীর দিকে দু-পা এগিয়ে নমস্কার করলেন৷ মোদীও জানালেন প্রতিনমস্কার৷ বুধবার যখন মোদী ও সনিয়া শুভেচ্ছা বিনিময় করেছিলেন, তখন সেটা ছিল লোকসভার অধিবেশন বসার আগে৷ তাই সেটা লোকসভা টিভির ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি হয়নি৷ কিন্ত্ত এ দিন শুভেচ্ছা বিনিময় ফ্রেমবন্দি হল৷ সনিয়া-মোদী নমস্কার বিনিময় যখন হচ্ছে, তখন মানেকা গান্ধী গম্ভীর ভাবে ফাইল দেখছেন৷ পরে মানেকা শপথ নিয়ে যখন সই করতে যাচ্ছেন, তখন নমস্কার বিনিময় দূরের কথা, সনিয়ার দিকে ফিরেও তাকালেন না৷ নেহরু গান্ধী পরিবারের দুই বউয়ের আকচাআকচি যথারীতি স্বমহিমায়৷ 

সুরেন্দ্রনগরের বিজেপি সাংসদ দেবজিভাই ফতেপুরা মাথায় গেরুয়া পাগড়ি পরে একেবারে গুজরাতের বিশেষ পোশাক ঝাব্বায় সংসদে এসেছিলেন৷ সংসদে ঢোকার আগে টিভি ক্যামেরার অনুরোধে তিনি বেশ কয়েকপাক গুজরাটি নাচ নাচলেন৷ ভোজপুরি সুপারস্টার মনোজ তিওয়ারি সম্ভবত একমাত্র সাংসদ, যিনি কাগজ না-দেখে পুরো শপথবাক্য নিখুঁত ভাবে বললেন৷ স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করার অভ্যেস তিনি ছাড়েননি৷ আন্দামান নিকোবরের বঙ্গসন্তান সাংসদ বিষ্ণুপদ রায় হিন্দিতে শপথ নিলেও এসেছিলেন একেবারে ধুতি-পাঞ্জাবির খাঁটি বাঙালি পোশাকে৷ ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছিলেন আদবানি এবং কীর্তি আজাদও৷ 

বস্ত্তত রাজস্থানি, গুজরাটি, বাঙালি, সাঁওতালি, হিমাচলি, পাঞ্জাবি পোশাকের রঙে লোকসভা ছিল রীতিমতো রঙিন৷ বিজেপির প্রচুর সাংসদ গেরুয়া রঙের পোশাক পরে এসেছিলেন৷ প্রথমে মন্ত্রী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা শপথ নেন৷ তার পর রাজ্য ধরে ধরে সাংসদদের ডাকা হয়৷ তাই ওয়েস্ট বেঙ্গল বা পশ্চিমবঙ্গের নাম সব শেষে আসে৷ অবশ্য তার অনেক আগে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথ হয়ে গিয়েছে৷ তিনি শপথবাক্য পাঠ করেন হিন্দিতে৷ তাঁর নির্বাচনকেন্দ্রে প্রচুর হিন্দিভাষী৷ হয়তো তাঁদেরই জন্য সুদীপের হিন্দিপ্রেম৷ ইংরাজিতে শপথ নিলেন মুনমুন সেন, সৌগত রায়, সুগত বসু, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা৷ আর বাংলাকে বেছে নিয়েছিলেন কাকলি ঘোষ দস্তিদার, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, তাপস পাল, শতাব্দী রায়, ইদ্রিশ আলি, সুব্রত বক্সি, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, রত্না দে নাগ, সন্ধ্যা রায়, শুভেন্দু অধিকারী, শিশির অধিকারীরা৷ 

বিজেপিতেও প্রচুর তারকা সাংসদ৷ তাঁরা অবশ্য হিন্দিতেই শপথ নিয়েছেন৷ কিরণ খের বলছিলেন, 'আমি পাঞ্জাবিতেও শপথ নিতে পারতাম৷ কিন্ত্ত হিন্দিতেই নিলাম৷ ঠিক করে নিয়েছিলাম, ইংরাজিতে নেব না৷' মোদী এবং সনিয়াও হিন্দিতেই শপথ নিয়েছেন৷ মোদী তো এখন বিদেশি অতিথিদের সঙ্গেও হিন্দিতেই কথা বলছেন৷ সঙ্গে থাকছেন ইন্টারপ্রেটার বা অনুবাদক৷ এর সঙ্গে একটা রেকর্ডও তৈরি হয়ে গেল৷ ৫৩৯ জন সাংসদের মধ্যে ৫১০ জনই বৃহস্পতিবার শপথ নিয়ে নিয়েছেন৷ এত জন সাংসদ একসঙ্গে এর আগে কখনও শপথ নেননি৷ বেশ একটা স্বদেশি ভাব উঠেছে লোকসভায়৷ কতদিন থাকবে কে জানে!

No comments:

Post a Comment