Saturday, 21 June 2014

পাতোদের জন্য শোকগাথা নেই ব্রাজিলে

পাতোদের জন্য শোকগাথা নেই ব্রাজিলে

, Ei Samay

রূপায়ণ ভট্টাচার্য

রিও দে জেনেইরো: গাড়ির জানলা দিয়ে যতদূর চোখ যায়, আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম একটা মুখ দেখার জন্য৷

কোপাকাবানার রাত জাগা সৈকতের সাজানো স্টলগুলোর গায়ে৷ মারাকানা স্টেডিয়াম লাগোয়া রাস্তাগুলোর হোর্ডিংয়ে৷ ক্রাইস্ত দে রিদিমারের ঠিক নীচের পাহাড়ের দীর্ঘ দুটি টানেলের ধারেকাছে৷নেই সেই মুখ৷ মধুবনী চিত্রকলাকে মনে করিয়ে দেওয়া, রিওর রাস্তার সেই বিশ্বখ্যাত দেওয়াল লিখনগুলোতেও নেই তো!

হাসবে আর বড় দাঁত, উচ্চকিত মাড়ির আলোয় কুত্‍সিততম মুখ হয়ে উঠবে সুন্দর৷ নাহ, সেই মুখ সারা দিন খুঁজেও পেলাম না ব্রাজিল ফুটবলের সেরা নগরে৷

ঝুপ করে যেন কোথায় হাওয়াই হয়ে গিয়েছেন রোনাল্দিনহো৷ এসি মিলান স্পনসরদের সৌজন্যে একবারের জন্য দেখা দিয়েছেন কাকা৷ কথা বলেছেন৷ কিন্ত্ত রোনাল্দিনহো... মাঝে মাঝে দু'একটা টুইট, বেশ৷ সেই কবে তাঁর বাড়ি বিশ্বকাপের সময় ভাড়া দেওয়ার টুইট করে খবর হয়েছিলেন৷ সেই শেষ৷

বিশ্বকাপের আগে, কী বলব, ও ভাবে লেখাটা ঠিক হবেও কিনা বুঝতে পারছি না, মৃত্যু মিছিল যেন শুরু হয়েছে ব্রাজিলে৷

মৃত্যুমিছিলই৷ গত এক বছরে মারা গিয়েছেন ১৯৫৮র বিশ্বজয়ী ব্রাজিল দলের চার স্তম্ভ৷ জুলাইয়ে দালমা সান্তোস৷ অগস্টে জিলমার ও দে সর্দি৷ নভেম্বরে গ্যারিঞ্চার একমাত্র বন্ধু ফুটবলার নিলতন সান্তোস৷ ক'দিন আগে রক্তবমি হয়ে মারা গেলেন গ্যারিঞ্চার মতো পানাসক্ত, চুয়াত্তর বিশ্বকাপের তারকা মারিনহো চাগাস৷ রিওতে পা দিয়েই শুনলাম, হেলিকপ্টার ভেঙে মারা গিয়েছেন রোনাল্ডিনহোর শহরের ক্লাব ইন্তারনাশিওনালের ফুটবলার ফের্নান্দাও৷ বিশ্ব ক্লাব কাপ জেতা ফের্নান্দাওকে অনেকে বলত, ইন্তারনাশিওনালের সর্বকালের ফুটবলার৷

কত বয়স হয়েছিল আর! ছত্রিশ মাত্র৷

আর বিশ্বকাপের দেশে পা রাখার পরে মনে হচ্ছে, এই অনন্ত মৃত্যুমিছিলে নাম লিখে ফেলেছেন আরও কমবয়সী মুখ৷ বিশ্বকাপের টিম থেকে বাদ পড়ার পরে৷

রোনাল্দিনহো, কাকা, রোবিনহো, আলেসান্দ্রো পাতো... এই নামগুলো কমবেশি সবাই জানে৷ কিন্ত্ত বাকিরা? পাওলো এনরিকে গান্সো, লুকাস মোরা, লুকাস লেভা, লিয়ান্দ্রো দামিয়াও, ফেলিপে লুইস, জাদসন৷

বিশ্বকাপের তীব্র হাওয়ায়, বিক্ষোভ ও সমর্থনের ভাগাভাগির আলোচনায় কারও জন্যই শোকগাথা নেই৷ তবু এঁদের মধ্যে গান্সো ও পাতোর হারিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে বেদনার৷ চার বছর আগের বিশ্বকাপে কোচ দুঙ্গাকে সবচেয়ে কথা শুনতে হয়েছিল গান্সোকে বাদ দেওয়ার জন্য৷ গান্সো তখন কাকার বিকল্প৷ কাকার মতো তাঁর খেলার স্টাইল৷ নেইমারের চেয়ে দু'বছরের বড়৷ এখানে সাংবাদিকদের কাছে শুনলাম, ২০১৪ বিশ্বকাপের ড্রয়ের সময় দেশের প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ ছবি তুলেছিলেন তিন জনের সঙ্গে৷ নেইমার, গান্সো ও লুকাস মোরা৷ এখন কোথায় নেইমার, কোথায় বাকিরা?

লুকাস তবু প্যারিস সাঁ জাঁর হয়ে গোটা বিশ্বকে দেখাতে পারবেন নিজেকে৷ আতলেতিকো মাদ্রিদে খেলেই ইউরোপে জনপ্রিয় হবেন মিরান্দা বা ফেলিপে লুই৷ কিন্ত্ত নেইমারের পর সান্তোসের সেরা ফসল, 'নতুন কাকা' গান্সো পরের পর চোটে বিপর্যস্ত৷ এখন খেলেন সাও পাওলোতে৷ পাতোর মতোই খবর থেকে হারিয়ে গিয়েছেন৷ বিশ্বাসই হয় না, শেষ কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলের দশ নম্বরের জার্সির মালিক ছিলেন গান্সো৷

পাতোও সেই সাও পাওলোতে৷ খেলার সুযোগ পান না৷ সাত বছর এ সি মিলানে খেলার সময় এমন স্টারডম পেয়েছিলেন যে সিলভিও বার্লুসকোনির মেয়ে তাঁর সঙ্গে ডেট করেছিলেন৷ গান্সোর হারিয়ে যাওয়ার কারণ চোট হলে, পাতোর অধঃপতনের কারণ নৈশজীবন৷ কখনও ব্রাজিলিয়ান অভিনেত্রী স্তেফানি ব্রিতোকে কোপাকাবানায় হইহই করে বিয়ে করেছেন৷ কোনওদিন মিস ব্রাজিল দেবোরার সঙ্গে ডেট করেছেন৷ মাত্র চব্বিশেই হারিয়ে যাওয়ার মুখে৷

এখানে এসে শুনলাম, বিশ্বকাপ নিয়ে নানা মার্কেটিংয়ের মধ্যে হুন্ডাই আর ফক্সওয়াগন গাড়ির কর্তাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে৷ ১ জুলাই থেকে ১৩ জুলাইয়ের মধ্যে যাঁরা গাড়ি কিনবেন, ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতলে তাঁদের ওয়ারেন্টি পিরিয়ড ৫ থেকে ৬ বছর হয়ে যাবে! ফক্সওয়াগন কর্তারা যা দেখে ক্ষিপ্ত৷ তাঁদের হয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, আমাদের কার পার্টনার ফক্সওয়াগন থাকতে আমাদের ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টিতে হাত দেয় কী করে হুন্ডাই?

এত এত বিজ্ঞাপন-তাতে নেইমারেরই দখল৷ সাও পাওলোর এই দুই প্রতিভাবান ফুটবলারের কোনও দাম নেই৷ বিশ্বকাপের হাওয়ায় আড়ালে চলে গিয়েছেন এ দেশের দুই প্রবীণতম ফুটবল ব্যক্তিত্ব৷ ব্রাজিল ফুটবলকে বিশ্বের আলোয় আনার অন্যতম কারিগরের দেশের মাঠের বিশ্বকাপেই অন্ধকারে৷ জনসমক্ষে নেই বহুদিন৷ ২৪ বছর ফিফার একচ্ছত্র সম্রাট, ৯৮ বছরের খোয়াও হাবেলাঞ্জ এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন হাসপাতালে৷ ব্লাটারের আগে ফিফার চাবিকাঠি ছিল তাঁরই৷ আর আজই দীর্ঘদিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরলেন দু'বারের বিশ্বজয়ী কোচ ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফুটবলার মারিও জাগালো৷ ছেলে বলছেন, বাবার অন্য কোথাও না হোক, অন্তত মারাকানায় সব খেলা দেখতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে৷

জাগালোর ইচ্ছেপূরণ হোক৷ ফুটবলার ও কোচ মিলিয়ে তাঁর মতো বিশ্বকাপে সাফল্য ব্রাজিলে কার আছে? কিন্ত্ত ফুটবলের বিস্তীর্ণ রাজপথের পাশে বিশ্বকাপের দেশে ফাবেলার মতো বিষণ্ণতা জাগিয়ে যাচ্ছে বছর চব্বিশের গান্সো ও পাতোর হারিয়ে যাওয়া৷

কোপাকাবানা, ইপানেমা-রিওর দুই বিশ্বখ্যাত সৈকতে সমুদ্রের ঢেউ হারিয়ে গিয়েও ফিরে আসছে৷ যা হয়৷ যা হয়ে থাকে৷ গান্সো ও পাতোর কী হবে? ঢেউ হয়ে ফিরে আসবেন?

No comments:

Post a Comment