Saturday, 21 June 2014

ইতালিয়ান ছেলেটি বলল, আপনি কোন দেশের

ইতালিয়ান ছেলেটি বলল, আপনি কোন দেশের

, Ei Samay

বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়া মানেই অজস্র রঙিন কাহিনী৷ অজস্র চরিত্র, অজস্র ঘটনা টুর্নামেন্টের ব্যাপ্তিকে আরও বিস্তৃত করে দেয়৷ আজ থেকে খেলার সময়ে শুরু হল বিশ্বকাপের গল্প৷ লিখবেন বিশ্বকাপ দেখে আসা বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা৷ আজ লিখেছেন সাংবাদিক রূপক সাহা

আর একটা বিশ্বকাপ এসে গেল৷ আমাদের দেশে এ বারও লাখ লাখ মানুষ টিভিতে খেলা দেখবেন৷ কেউ মনে মনে সাপোর্ট করবেন ব্রাজিলকে, কেউ আর্জেন্তিনা অথবা স্পেনকে৷ এই প্রবল উত্‍সাহ অবশ্য ভারতীয় ফুটবলের কোনও উপকারে আসবে না৷ আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যাব৷ তিনটে বিশ্বকাপ ফুটবলে হাজির থেকেছি৷ মাঠের ভিতর ও বাইরে বহু আনন্দময় মুহূর্ত উপভোগ করেছি৷ আবার দুঃখজনক স্মৃতিও প্রচুর৷ তারই মধ্যে একটা সামান্য ঘটনার কথা উল্লেখ না করে থাকতে পারছি না৷ প্রথম গিয়েছিলাম ১৯৯০ সালে ইতালির বিশ্বকাপে৷ সেমিফাইনালের আগে এক দিন রোমে আমরা চার ভারতীয় সাংবাদিক--- কলকাতার অ্যান্ডি ও'ব্রায়েন, ভুবনেশ্বরের সন্দীপ মিশ্র, দিল্লির মোহন পিচোর্তি ও আমি পিয়াত্‍জা নাভোনায় একটা রোডসাইড রেস্তোরাঁয় খেতে ঢুকেছি৷ যে ছেলেটি খাবারের অর্ডার নিতে এল, আমাদের বুকে প্রেস কার্ড ঝোলানো রয়েছে দেখে সে হঠাত্‍ ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, 'আপনারা কি মুন্দিয়েল দেখতে এসেছেন?'

ছেলেটির নাম এখন আর মনে নেই৷ বয়স তিরিশের নীচে৷ সাধারণ ইতালীয়রা ইংরেজি জানলেও বলতে চান না৷ ছেলেটি বলছে দেখে আমরা একটু অবাকই হলাম৷ মুন্দিয়েল মানে বিশ্বকাপ৷ বললাম, 'হঁ্যা, আমরা বিশ্বকাপ ফুটবল কভার করতে এসেছি৷'

ছেলেটি খুব উত্‍সাহের সঙ্গে বলল, 'আমিও ফুটবল খুব ভালোবাসি৷ আমি এখনকার লাত্‍সিও ক্লাবের সাপোর্টার৷ রোজ সিরি এ-র খেলা দেখি৷ আমার বউ ইংল্যান্ডের মেয়ে৷ ও বেশি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ভক্ত৷ তা, আপনারা কোন দেশ থেকে এসেছেন?' ফরসা, নীল চোখের অ্যান্ডি ও'ব্রায়েন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের৷ ওর ঠাকুরমা ছিলেন আইরিশ৷ মজা করে ও বলল, 'আমি আর্য়াল্যান্ড থেকে৷'

শুনে ছেলেটি আক্ষেপ করে বলল, 'ইস, আপনাদের টিমটা কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালির কাছে হেরে গেল৷ দুঃখ করবেন না৷ আমার বউ অবশ্য আর্য়াল্যান্ডকে সাপোর্ট করেছিল৷ কিন্ত্ত, ওকে আগেই বলে দিয়েছিলাম, লং বল গেম খেলে বেশি দূর এগোনো যায় না৷' অযাচিত ভাবে ছেলেটা আরও বলতে লাগল, আইরিশ দলের কোচ জ্যাকি চার্লটন কী কী ভুল করেছেন৷ একটা লম্বু স্ট্রাইকারকে অ্যাটাকে রেখে কেন ম্যাচ জেতা যায় না৷ লম্বু স্ট্রাইকার মানে নীল কুইন... ছয় ফুট চার ইঞ্চি লম্বা৷

মজা পেয়ে আমরা সবাই হাসতে শুরু করলাম৷ একটু পরে খাবার নিয়ে এসে টেবলে সাজিয়ে দেওয়ার সময় ছেলেটা মোহন পিচোর্তিকে জিজ্ঞেস করল, 'আপনি কোন দেশ থেকে?'

গায়ের রং কালো, আসলে মালয়ালি৷ মানানসই হওয়ার জন্য মোহন বলল, 'ক্যামেরুন থেকে৷'

শুনে ছেলেটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ বলল, 'আপনাদের টিম তো এ বার দারুণ খেলল৷ দিয়েগোর (মারাদোনা) টিমকেও হারিয়ে দিয়েছে৷ আমার কিন্ত্ত রজার মিল্লার খেলা খুব ভালো লাগল৷ তবে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে আপনাদের কোচ ওঁকে হাফ টাইমের পর নামালেন কেন, বুঝতে পারলাম না৷ আমার তো মনে হয়, শুরু থেকে মিল্লাকে খেলালে হয়তো আপনারা ইংল্যান্ডকে হারাতেও পারতেন৷ আচ্ছা, লিনেকার যে পেনাল্টি থেকে জয়ের গোল করলেন, সেটা কি আদৌও পেনাল্টি ছিল?

বিশ্বকাপের সব ম্যাচ দেখা কোনও সাংবাদিকের পক্ষে সম্ভব নয়৷ মোহন পিচোর্তিও ইংল্যান্ড-ক্যামেরুন ম্যাচ দেখতে যায়নি৷ গোঁজামিল দেওয়ার মতো করে ও বলল, 'আমার মনে হয়, না৷'

পরক্ষণেই মোক্ষম প্রশ্ন, 'আপনাদের দেশে এত ভালো ভালো সব প্লেয়ার... ওমাম বিয়িক, কানা বিয়িক, স্টিফেন টাট্ট, সিরিল মাকানাকি৷ এঁরা ইতালির ক্লাবে খেলতে আসেন না কেন? গেজেত্তা দে লা স্পোর্তসে পড়লাম, 'আপনাদের দেশটা নাকি এত গরীব যে, ফুটবলারদের বাড়িতে টিভি পর্যন্ত নেই?'

পাছে আর কোনও অপ্রিয় প্রশ্ন করে, মোহন পিচোরতি তাই খাওয়ায় মন দিল৷ কিন্ত্ত ছেলেটা নাছোড়বান্দা৷ কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল, বিশ্ব ফুটবলের অনেক খবর রাখে৷ রাখবে নাই বা কেন? সেই সময় ইতালি লিগ বিশ্বের সেরা৷ কোথায় যেন পড়েছিলাম, ইতালির নানা ক্লাবে নাকি সেই মরসুমে এমন সত্তর জন খেলেছেন, যাঁরা বিভিন্ন দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলছেন৷ আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছি, এমন সময় চারটে বিয়ারের বোতল নিজে থেকে এনে দিয়ে ছেলেটা বলল, এই নিন, আমার তরফ থেকে উপহার৷ প্রার্থনা করুন, এ বার যেন ইতালি চতুর্থ বিশ্বকাপটা জেতে৷'

চলে যাওয়ার আগে সন্দীপ মিশ্রের দিকে তাকিয়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, 'আপনি কোন দেশের?'

ভুবনেশ্বরের সন্দীপ মিশ্রও পিছু হটার ছেলে নয়৷ মজা করার জন্য বানিয়ে বানিয়ে ও বলল, 'আমি ফ্রান্সের৷ লা কলিঙ্গ'র রিপোর্টার৷ আমি মসিয়েঁ সান দীপ মাশার৷' শুনে আমি হাসি চেপে রাখতে পারলাম না৷ কিন্ত্ত, ছেলেটা সব বিশ্বাস করে নিচ্ছে৷ সরল চোখে বলল, 'আমি আপনাদের প্লাতিনির খুব বড় ফ্যান৷ উনি এখানে জুভেন্তাস ক্লাবে খেলেন৷ আপনাদের ফ্রান্স টিমটা এ বার মুন্দিয়েলে খেলতে পারল না৷ খুব খারাপ লাগছে৷ মুন্দিয়েলে ওঁকে খুব মিস করছি৷'

আমাকে কিন্ত্ত কিছুই জিজ্ঞেস করল না ছেলেটা৷ নিশ্চিন্ত হলাম, যাক, আমাকে অন্তত মিথ্যে কথা বলতে হবে না৷ খাওয়া শেষ করে আমরা চার জন যখন বেরিয়ে আসছি, ছেলেটা আমাকে বলল, 'ফাইনালে যদি আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়, তা হলে জেনে রাখুন আমরাই জিতব৷'

ঠিক বুঝতে পারলাম না, ছেলেটা আমাকে কোন দেশের বলে ধরে নিয়েছে৷ 'অশ্বত্থামা হত ইতি গজ'র মতো করেই বললাম, 'আগে ইতালি ফাইনালে উঠুক, তার পর দেখা যাবে৷'

ছেলেটা বলল, যদি ফাইনালে না ওঠে, তা হলে আপনি এই রেস্তোরাঁয় আসবেন৷ ফাইনালের দুটো টিকিট আমার কাছে আছে৷ টিকিট দুটো আপনাকে দিয়ে দেব৷ সে দিন মাঠেই যাব না৷'

ছেলেটা পাগল নাকি! রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম৷ পোশাক বদলানোর সময় হঠাত্‍ই আমি আবিষ্কার করলাম, রেস্তোরাঁর ছেলেটা আমাকে কোন দেশের লোক বলে ধরে নিয়েছিল৷ আসলে কয়েক দিন আগে আমার এক ব্রাজিলীয় বন্ধু আমাকে ব্রাজিলের একটা জার্সি উপহার দিয়েছিল৷ সেটা সে দিনই গায়ে দিয়ে বেরিয়েছিলাম৷ জার্সিটা গা থেকে খোলার সময় এক দিকে যেমন হাসি পাচ্ছিল, অন্য দিকে দুঃখবোধও হচ্ছিল৷ সত্যি কথা বলতে কী, ভারতীয় হিসেবে হীনমন্যতায় ভুগি না৷ বরং গর্ববোধ করি৷

কিন্ত্ত, সে দিনই টের পেয়েছিলাম, একটা জার্সি একটা দেশের মানুষের চোখে আর একটা দেশের মানুষকে কতখানি সম্মানের জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে৷ হায়, কবে সে কথা বুঝবেন আমাদের দেশের ফুটবল কর্তারা! যদি বুঝতে পারতেন, তা হলে বিশ্বকাপে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে আমাদের শুনতে হত না, একশো দশ কোটি মানুষের দেশ আপনাদের৷ বিশ্বকাপের জন্য এগারো জনের একটা দল তৈরি পারেন না!

No comments:

Post a Comment