সান্তোস ক্লাব মিউজিয়ামের ভেতরে কর্মীরা এখন এডিনহোকে নিয়ে প্রকাশ্যে মস্করায় মেতেছেন। বিচের কাছেই একটা বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন তাঁর বিশ্ববিখ্যাত বাবা। সেখানে তাঁকে পাওয়ার অবশ্য কোনও উপায় নেই। মাদক পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে ক’দিন আগেই তেত্রিশ বছরের জেল হয়েছে পেলে-পুত্রের!
তিয়াত্তর বছর বয়সে এসে এই প্রথম বার পেলে নিজেও যে বিশ্বকাপ-বিতর্কে আক্রান্ত। এরিনা করিন্থিয়ান্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্রাজিলীয় দর্শক বরাবরের মতো তাঁকে বরণ করে নেবে কি? নিশ্চিন্ত থাকার উপায় নেই।
কিন্তু নিজের ভিটেয়?
এডিসন আরান্তেস দ্য নাসিমেন্তো আজও অফুরান। সাময়িক দুর্যোগের এই ঘনঘটাতেও নিজের পাড়া তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি। কোনও দিন ছাড়বে বলেও মনে হয় না। বুধবার সাও পাওলো থেকে আশি কিলোমিটার দূরের এই বন্দর শহরে চক্কর দিয়ে মনে হল— বাকি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট যিনিই হোন, এই মহল্লায় আজও পেলেই রাজা! এটা নিখাদ পেলে-সভ্যতা!
মিউজিয়ামকে এরা লেখে মেমোরিয়াল। সেই সান্তোস মেমোরিয়ালের ভিতর পনেরো বছরের কিশোরের দাঁত বার করা একটা ছবি আছে। সে বারই তার প্রথম সান্তোসে আসা। আর মাঠের ঠিক টঙে আর একটা দাঁত বার করা ছবি। তফাতের মধ্যে প্রথমটা সান্তোস জার্সিতে। দ্বিতীয়টা ক্রেডিট কার্ডের মডেল হয়ে।
পেলেকে পশ্চিমি প্রেস বলে থাকে, ‘ওয়াকিং বিল বোর্ড।’ খেলা ছাড়ার সাঁইত্রিশ বছর পরেও বিজ্ঞাপন জগতে তিনি অপ্রতিরোধ্য চুম্বক। পেলের নামে ঘড়ি আছে। পারফিউম আছে। অ্যাপস রয়েছে। সপ্তাহখানেক আগে শুধু তাঁর ছবি দিয়ে হাজার পাতার বেশি যে পর্তুগিজ বইটা বেরিয়েছে, সেটা সান্তোস লাইব্রেরিতে পড়ে থাকতে দেখলাম। কিন্তু পেলের লেটেস্ট বই হল, নিজের আরও একটা আত্মজীবনী। ‘হোয়াই সকার ম্যাটার্স’। সপ্তাহখানেক আগে নিউইয়র্কের বইয়ের দোকানে পেলে যখন সেটা সই করতে গিয়েছিলেন, শিয়ালদহ স্টেশনের অফিস টাইমের মতো অবস্থা হয়। লোকে চার ঘণ্টা ধরে লাইন দিয়ে ছিল। শেষমেশ যখন সামনে যেতে পেরেছে, কেউ নির্বাক হয়ে গিয়েছে। কেউ কেঁদে ফেলেছে। কেউ স্রেফ হাত ধরে বসে পড়েছে।
ভিলা বালমিরো-র টঙের বিজ্ঞাপনে পেলেকে অবশ্য বিজ্ঞাপনী মেজাজের বলে মনে হচ্ছে না। এটা যেন নিছকই অনেক উপর থেকে একটা অনুমোদন— এখানে যা কিছু ক্রেডিট সব আমি। যা কিছু ডেবিট সেটাও। এই মহল্লায় আমার আঙুল না হেললে কোনও কিছুই হেলবে না।
পৃথিবীর আর কোন মাঠে কোনও ক্রীড়াবিদের দু’-দু’টো ব্রোঞ্জ মূর্তি পাশাপাশি বসেছে? একটা কম বয়সের আবক্ষ। আর একটা ফুল লেংথ। গোলের পরে তাঁর উল্লাসের চেনা ভাবভঙ্গি সমেত। বিশ্বের আর কোনও অ্যাথলিট জীবিত বা মৃত অবস্থায় গ্যালারিতে নিজের জন্য সংরক্ষিত এনক্লোজারও পায়নি। যা সান্তোস ক্লাব দিয়েছে তার সম্পদকে।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে আজই নামছে দল। তার আগে ফুটবলে
মজেছে ব্রাজিলের খুদে। বুধবার রিও ডি জেনেইরোর কাছে। ছবি: এএফপি।
আলাদা একটা সুপার ভিভিআইপি ব্লক ভিলা বালমিরোয় নির্দিষ্ট রয়েছে পেলের জন্য। যখনই খেলা দেখতে আসেন এনক্লোজার খুলে দেওয়া হয়। অন্য সময়? বুধবার কোস্টা রিকা প্র্যাকটিস করছিল সান্তোস মাঠে। গ্যালারিতে হাজারখানেক কোস্টা রিকান সমর্থক দুলে দুলে গাইছে, ওলে, ওলে, ওলে। কিন্তু মাঝখানের ওই সম্ভ্রান্ত জায়গাটার কাছাকাছি যাওয়ার উপায় নেই। ওটা সম্রাটের এলাকা!
এরই মধ্যে কোস্টা রিকা কোচ ডেকে পাঠিয়েছেন এই এলাকার প্রাক্তন ব্রাজিলীয় তারকা ক্লডোয়াল্ডোকে। সত্তরের সেই ব্রাজিলীয় দলের অন্যতম সদস্য ক্লডোয়াল্ডো। ফাইনালে শেষ গোলটা ওভারল্যাপে আসা আলবার্তোকে দিয়ে করিয়েছিলেন পেলে। ইউটিউব খুললে দেখা যাবে, তার আগে চার জন ইতালীয়কে ড্রিবল করতে করতে বলটা বাক্সে পাঠিয়েছিলেন ক্লডোয়াল্ডো।
এই মাঠে নেইমার দ্য সিলভাকেও নিয়মিত দেখেছেন ক্লডোয়াল্ডো। কী বলবেন? “খুব ভাল। আশা করব ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ দিতে ওর বড় ভূমিকা থাকবে।” ছোট উত্তর। পর্তুগিজ থেকে তর্জমা করে দিলেন স্থানীয় তরুণ। আর পেলে? ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেও চোখ জ্বলে উঠল ক্লডোয়াল্ডোর। “সর্বকালের সবচেয়ে কমপ্লিট প্লেয়ার। সান্তোসে ওর সঙ্গে আট বছর খেলেছি। জাতীয় দলে দু’বছর। নিজেকে ধন্য মনে হয় সেই অভিজ্ঞতার জন্য!”
ভিলমা নামক এক মহিলা সান্তোস সমর্থকের দেখা পেলাম। অর্ধশতাব্দী ধরে সান্তোস টিমের সঙ্গে ঘুরছেন। নেইমার পরিবার এঁর খুব ঘনিষ্ঠ। মোবাইলে নেইমার সিনিয়র-জুনিয়রের সঙ্গে এক গাদা ছবিও দেখালেন। কথায় কথায় অনুযোগ বেরিয়ে এল, নেইমারের জন্য কিছু করেননি পেলে। কিন্তু স্মৃতিতে-ঔজ্জ্বল্যে-মননে পেলে বলতে অজ্ঞান। বিশ্বকাপ বিতর্কে অন্তত এই অঞ্চলে যে পেলের ভোটব্যাঙ্কে হাত পড়েনি, ভিলমার মুখের আভাটাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
দু’জন উৎসাহী তো বিস্ফোরক কথা বলে গেলেন যে, “আমরা সান্তোসকে সমর্থন করি। ব্রাজিলকে নয়।” কেন? “ব্রাজিল টিম দেশের হয়ে খেলার চেয়ে বিদেশি ক্লাবে কে কত টাকার চুক্তি করবে, তা নিয়েই মত্ত থাকে।” তা হলে আপনারা কার সমর্থক? দু’জনেই বললেন, “আর্জেন্তিনার। ওরা পুরনো ব্রাজিলের মতো খেলে।”
অবিশ্বাস্য! নেইমার যতই বার্সেলোনা চলে যান, এ মাঠেরই তো আবিষ্কার। বিশ্বকাপের ভরা বাজারে ভিলা বালমিরো-র তো তাঁকে নিয়ে আচ্ছন্ন থাকা উচিত। নেইমার থাকেনও সান্তোস থেকে মাত্র এক ঘণ্টা দূরত্বের গারুজাতে। তখনই মনে হল, ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে দিলেও সান্তোস মুলুকে নেইমার সিংহাসনের দাবিদার হতে পারবেন না। হাজারের উপর গোল শুধু নয়। সান্তোসে পেলের চৌম্বকক্ষেত্র আসলে আরও একটা জায়গায়— অবসর নেওয়া পর্যন্ত ক্লাবের প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য! ইউরোপীয় ক্লাব থেকে লক্ষ লক্ষ ডলারের অফার এসেছে। কিন্তু ব্রাজিলের প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, “পেলে হল জাতীয় সম্পদ। জাতীয় সম্পদ কখনও দেশের বাইরে যায় না।”
অবসর নিয়ে পেলে ক’বছর কসমসে খেলেছিলেন। ভিলা বালমিরোয় তাঁর শেষ ম্যাচ কলকাতায় সাতাত্তরের সেপ্টেম্বরে ইডেনে খেলে আসার মাত্র ক’মাসের মধ্যেই। সে দিন একটা অর্ধ খেলেছিলেন কসমসের হয়ে। একটা সান্তোসের।
অথচ সান্তোস মাঠটা সাইজে সিসিএফসির চেয়ে কিছু বড় হবে। পেলের আমলে হাজার দশেক লোক ধরত। এখন ভেতরটা অনেক বাড়িয়েও বিশাল কিছু নয়। বাইরে গাড়ি ঠেলে ভুট্টা বিক্রি হচ্ছে। উল্টো দিকের বাড়িগুলো কোনওটা মধ্যবিত্ত। কোনওটা নিম্নবিত্ত। অর্ধেক বাড়িতে ডিশ অ্যান্টেনা চোখে পড়ল না। কেব্ল সংযোগও হয়তো নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে এ রকমই রং চটে যাওয়া ট্রেস কোরাকাস শহরে জন্ম পেলের। সান্তোসে আসেন কয়েক বছর পর।
এ হেন মধ্যবিত্ত মহল্লায় মাঠের উল্টো দিকের দোকানটা কিন্তু বেশ ঝকমকে। ওপরে লেখা ‘কেবল এরোরো দো পেলে’। নীচের নেমপ্লেটে— ডিডি। দোকানটা কি পেলে আর ডিডির সম্মানে? কিন্তু ডিডি তো সান্তোসে খেলতেন না!
দ্রুত আবিষ্কার করা গেল, ডিডি কোনও ফুটবলার নন। দোকানের মালিক। এটা সেলুন। পেলের নামাঙ্কিত। কারণ পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি এই সেলুনে চুল কাটেন। গত মার্চে শেষ এসেছিলেন। সারা পৃথিবীতে পেলেকে নিয়ে যত গবেষণা আর লেখালিখি হয়, তার অনিবার্য অঙ্গ ডিডি-নাপিতের সাক্ষাৎকার।
এটাও রূপকথা। চার জন সিকিউরিটি যাঁর সঙ্গে সর্বত্র ঘোরে, যাঁর পৃথিবীর চারটে শহরে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে, তিনি পাড়ার খোলা সেলুনে এত বছর ধরে চুল কেটে আসছেন!
তা ডিডি কী ভাবছেন? এই যে পেলেকে দেশের লোক গালমন্দ করছে?
কিছু না। মাথা ঝাঁকালেন। দোভাষী বললেন, “ও বলছে, কিছুতেই কিছু হবে না। পেলে পেলে হয়েই থাকবে!”
প্রথম সান্তোসে এসে পেলে যেখানে থাকতেন, সেই ইউরিডিস দ্য কুনহার বাড়িটা এখন অ্যাপার্টমেন্ট হয়ে গিয়েছে। ডিডি পথনির্দেশ দেওয়ার পরেও ভাষা সমস্যায় সেটা খুঁজে বার করা গেল না। শুধু এটা জানা গেল, এর কাছাকাছি খুব শিগগিরিই পেলের আর একটা জাদুঘর বসছে। পেলে বরাবর বলার চেষ্টা করেছেন, “এই তো দিব্যি বেঁচে আছি। চলছি ফিরছি। আমি মিউজিয়াম হতে চাই না।” কিন্তু তাঁর নিজের সভ্যতা তাঁর আদেশ অমান্য করতে যাচ্ছে।
এ শহরে আসতে একটা বিশাল সুড়ঙ্গ পড়ে। দৈর্ঘ্য শুনলাম তিন হাজার মিটার। সান্তোস ফেরত সেই সুড়ঙ্গে পৌঁছে আরও বেশি করে মনে হতে লাগল, পেলের জীবনটাও তো টানেলে শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল!
একটা মফস্সল শহরের ক্লাবে উত্থিত প্রতিভা। সে তো কতই হয়! প্রতিভা ওঠে, আবার নিজের নিয়মে ঝরে যায়। যারা ঝরে না, তারা অনিবার্য ভাবে বের হয়ে আসে কাছের বড় শহরে। তবেই না জীবনে অন্ধকার থেকে আলোর ছিটে গায়ে পড়ে!
অস্ট্রেলিয়ার বাউরালে ব্র্যাডম্যানের গ্রামের বাড়ি এ রকমই বন্দিত। জার্মানির ব্রুলে স্টেফি গ্রাফের জন্য দেখে এসেছি এ রকমই সমাদরের লাল কার্পেট। কিন্তু ব্র্যাডম্যান টিনএজেই আশ্রয় নিয়েছিলেন সিডনিতে। স্টেফি ফ্রাঙ্কফুর্টে।
পেলে কিন্তু জীবনের মহাযুদ্ধ জিতেছেন ভিটেমাটি আঁকড়ে থেকে। না গিয়েছেন ইউরোপ। না রিও। না সাও পাওলো। তৃতীয় বিশ্বের অজ পাড়াগাঁ, যেখানে স্টেডিয়ামের বাইরেটা রং না করায় অতীত দিনের মতোই সাদা-কালো থেকে গিয়েছে। সত্যিই তো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট সময়। না ছিল মোবাইল। না ছিল ইন্টারনেট। না ছিল আজকের মতো বিমান ব্যবস্থা (সান্তোসকে একাধিক বার জাহাজে করেও খেলতে যেতে হয়েছে)। না ছিল আজকের মতো বাণিজ্য, বিমা আর স্পোর্টস মেডিসিনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
ব্রাজিল দেশটাই তৃতীয় বিশ্ব। তার পুঁচকে বন্দর শহর থেকে উঠে আসা একটা ছেলে বছরের পর বছর প্রথম বিশ্বের যাবতীয় আস্ফালন আর প্রযুক্তি থামিয়ে দিয়েছে। উন্নত সভ্যতার চ্যালেঞ্জকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উনিশ বছর রাজ করেছে! জাদুঘর কী বোঝাবে তার? জিন থেরাপিতেই বা কী ব্যাখ্যা হবে?
বললাম তো পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম লিখেছে, ‘চলমান বিলবোর্ড’। সান্তোসে তিন ঘণ্টা কাটিয়ে একটাই উপযুক্ত অভিব্যক্তি পাচ্ছি।
চলমান অশরীরী!