বহু দিন এ ভাবে পুলিশের দাঁতখিঁচুনি খাইনি। হাতে কাগজের কাপে দুধ, আকন্দের মালা। স্নান-টান সেরে ওই দুটি জিনিস কিনে লোকের ধাক্কা খেতে খেতে কোনও ক্রমে ঢুকেছি বিশ্বনাথ মন্দিরের গর্ভগৃহে। ভক্তদের ভিড়ে ছয়লাপ, রুপোর বেদিতে বসানো শিবলিঙ্গটি স্পর্শ করে উঠতে না উঠতেই পুলিশের তাড়া, ‘চলিয়ে, চলিয়ে।’ তাড়াতাড়ি বেরোতে গিয়ে পুলিশের বিরক্তি, ‘আরে, দুধ ঢাললেন না, মালাও দিলেন না।’ বললাম, ‘এগুলি বিশ্বনাথের নয়।’ খাকি উর্দি ফের খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘কোত্থেকে জোটে! পাগল কাহাঁকা!’
বাবা বিশ্বনাথ এ যাত্রায় আমার উদ্দেশ্য নন। এই চত্বরেই মন্দির-অফিসের পাশে অভিমুক্তেশ্বর মন্দির। এই মন্দিরে শিবলিঙ্গটির নাম বিশ্বনাথ, ওই মন্দিরে অভিমুক্তেশ্বর। পৌঁছে দেখি, শুনশান। পাশে বিশ্বনাথ যখন ভিড়ে উপচে পড়ছেন, এখানে মেরেকেটে দু’তিন জন ভক্ত ও পূজারী। অথচ, স্কন্দপুরাণে কাশীখণ্ডের ৩৯ অধ্যায়ের ৭৭ নম্বর শ্লোক: ‘সবাই বিশ্বস্রষ্টা বিশ্বেশ্বরকে পুজো করে, কিন্তু বিশ্বেশ্বর নিজে মুক্তি ও পার্থিব সুখের জন্য এই অভিমুক্তেশ্বর লিঙ্গের আরাধনা করেন।’ এই কারণে সংস্কৃতে কাশী এবং বারাণসী ছাড়া জনপদটির অন্য নাম ছিল: অভিমুক্ত।
অভিমুক্ত বোঝা গেল, বরুণা এবং অসি নদীর সঙ্গমে অবস্থিত বারাণসী নামটিও পরিষ্কার। পুরাণ ঘেঁটে কাশী নামটির উৎসও পেলাম। সংস্কৃতে কাশ মানে, দীপ্তি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ প্রথম অর্থ এটিই দিয়েছেন। পরে কাশরোগ, কাশফুল ইত্যাদি। দীপ্তিময় প্রথম অর্থ থেকেই বিকাশ, প্রকাশ ইত্যাদি শব্দের উদ্ভব। বিকাশক্ষেত্র, বিকাশপুরুষদের সঙ্গে কাশীর একেবারে আভিধানিক সম্পর্ক!
দশাশ্বমেধ নয়, মন্দিরে ঢুকেছি মণিকর্ণিকা ঘাটে স্নান সেরে। স্কন্দপুরাণের পাতায় পাতায় প্রশস্তি, ‘সব পবিত্র তীর্থে স্নানের চেয়েও মণিকর্ণিকায় স্নানের পুণ্য বেশি, ওই ঘাটে স্নান সেরেই বিশ্বেশ্বরকে দর্শন করতে হবে।’ এর পাশে দশাশ্বমেধ ঘাট নিয়ে মাত্র একটি অধ্যায়। সেখানে জ্যৈষ্ঠ মাসে ও দশহরা তিথিতে স্নান সেরে ব্রহ্মেশ্বর লিঙ্গ দর্শন বিধেয়।
অতএব, একটা কথা পরিষ্কার। আজ দশাশ্বমেধ ঘাটের যে গুরুত্ব, সেখানেই স্নান সেরে বিশ্বনাথের গলি দিয়ে মন্দিরে যেতে হবে, সন্ধ্যাবেলায় গঙ্গারতি করতে হবে— এ সব হল আধুনিক হিন্দুত্ব। প্রাচীন ধ্রুপদী হিন্দুর কাছে দশাশ্বমেধ এত গুরুত্ব  পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। দশাশ্বমেধ ঘাটে যাতায়াতের রাস্তাটি সোজা চলে গিয়েছে যানজট-আক্রান্ত গোধূলিয়া মোড়ে। এখানে গোদাবরী নামে ছোট্ট একটি নালা গঙ্গায় মিশত, লোকের মুখে মুখে সেটি হয়েছিল গোধূলিয়া। এখন গোধূলিয়া মোড়ের আগে বেনিয়াবাগ নামের জায়গাটিতে ছিল বেণী নদী। ইংরেজ আমলে এই সব নদী বুজিয়ে রাস্তা তৈরি হল। তখনই দশাশ্বমেধের গুরুত্ব বাড়ল, মণিকর্ণিকার পরিচিতি হল স্রেফ শ্মশানঘাট।
গোধূলিয়া মোড় থেকে রিকশা নিয়ে ময়দাগিন হয়ে মচ্ছোদরী পার্কের দিকে গিয়েছিলাম। শহরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা ময়দাগিনে একদা মন্দাকিনী নামে ছোট্ট এক নদী ছিল। সেই মন্দাকিনীই অপভ্রংশে ময়দাগিন। মচ্ছোদরী পার্কেও ছিল মৎস্যোদরী নদী। বর্ষার গঙ্গা বরুণা নদী বেয়ে পিছন দিকে মৎস্যোদরীতে এসে পড়ত। ‘গঙ্গা যখন মৎস্যোদরীতে মেশে, সব তীর্থ সেখানে অধিষ্ঠান করে,’ জানাচ্ছে কাশীখণ্ডের ৬৯ নম্বর অধ্যায়ের ১৩৯তম শ্লোক। ব্রিটিশ শাসকের পরিকল্পিত নগরায়ণ ও উন্নয়নের খাতিরে ১৮২২ সালে এই ছোট নদীগুলি বুজিয়ে দেওয়া হয়। কাশী শহর আপনাকে প্রতি পদে বুঝিয়ে দেবে, দশাশ্বমেধ ঘাট হয়ে বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়ার একরৈখিক বয়ানটি ঔপনিবেশিকতার অবদান। ধ্রুপদী স্কন্দপুরাণের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।
ধ্রুপদী ঐতিহ্যটি কী রকম? লোকবিশ্বাস, কাশী পৃথিবীর মধ্যে থেকেও বাইরে, শিবের ত্রিশূলের ডগায়। ত্রিশূলের তিনটি ডগা: উত্তরে ওঙ্কারেশ্বর, মাঝে বিশ্বনাথ ও দক্ষিণে কেদারেশ্বর। কাশীখণ্ডের ৭৩ ও ৭৪ নম্বর অধ্যায় জুড়ে ওঙ্কারেশ্বরের মহিমা কীর্তন। বলা হচ্ছে, এটিই কাশীর প্রথম লিঙ্গ। তপস্যারত ব্রহ্মার সামনে প্রণবধ্বনিতে এই শিবলিঙ্গ প্রকাশিত হয়। মচ্ছোদরী পার্ক ছাড়িয়ে আরও উত্তরে সালেমপুরা নামে ঘিঞ্জি মুসলিম মহল্লা। ট্যুরিস্টরা এ দিকে আসেন না। স্থানীয় মুসলমানরাই নিয়ে গেলেন, ‘ওঙ্কারেশ্বর? চলুন, দেখিয়ে দিচ্ছি।’ মাঠের মাঝে, ছিমছাম মন্দির।
দক্ষিণে কেদারেশ্বর মন্দিরে সরাসরি পৌঁছনো যায় কেদারঘাট থেকে। কেদারেশ্বরের লিঙ্গটি এক দলা মণ্ডের মতো দেখতে, মাথায় আড়াআড়ি দাগ। শিবলিঙ্গ মণ্ডের মতো কেন? কাশীখণ্ডের ৭৭ নম্বর অধ্যায়ে জানা গেল, রাজা মান্ধাতা খিচুড়ি খাচ্ছিলেন, খিচুড়ির দলা থেকে উঠে শিব তাঁকে দর্শন দেন। অন্ন থেকেও শিব উঠে আসেন? আলবাত! উপনিষদে অন্নই ব্রহ্ম। কেদারেশ্বর মন্দির থেকে মদনপুরার মধ্য দিয়ে শর্টকাট করে বড় রাস্তায়। বেনারসি শাড়ি বোনার জন্য মদনপুরার মুসলমান তাঁতিরা বিখ্যাত।
ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকের স্কন্দপুরাণে উল্লেখিত মন্দিরগুলি আজও কাশীর মুসলিম মহল্লায় অটুট। ব্যস্ত ময়দাগিন এলাকার এক মসজিদে রয়েছে পুরাণ-উদ্ধৃত কৃত্তিবাসেশ্বর শিবলিঙ্গ। শিবরাত্রির দিন ওই মসজিদে হিন্দুদের অবারিত দ্বার। শুনতে শুনতে ফের স্কন্দপুরাণ মনে পড়ল, ‘অন্য জায়গায় রাজা হয়ে জন্মানোর চেয়ে কাশীতে ম্লেচ্ছজন্মও সৌভাগ্যের।’
ব্রাহ্মণ থেকে ম্লেচ্ছ, সবাইকে স্বীকার করা— এখানেই পুরাণ, ইতিহাসের বৃহত্তর হিন্দুধর্ম। কাশীতে আওরঙ্গজেবের আগে কুতবউদ্দিন আইবক থেকে সুলতানা রিজিয়া, ফিরোজ শাহ তুঘলক অনেকেই মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি করেছিলেন, কিন্তু মুসলিম আমলেও মন্দিরগুলি ফের নতুন করে গড়ে উঠেছিল। আজও কাশীর রাস্তায় এক দরগার দায়িত্বে পুরুষানুক্রমিক ভাবে এক হিন্দু পরিবার।
ইংরেজ আমলে তৈরি দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে বিশ্বনাথ মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা এই জনসংস্কৃতিকে দেখতে পায়নি। বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে আওরঙ্গজেবের জ্ঞানবাপী মসজিদ তৈরিই সেখানে একমাত্র বয়ান। অথচ, পুরাণের সঙ্গে আজকের কাশীকে মিশিয়ে দেখলে চমকে উঠতে হয়। আওরঙ্গজেব কাশীর নাম পাল্টে মহম্মদাবাদ করেছিলেন, টেকেনি। মসজিদের নাম আজও বয়ে নিয়ে চলেছে পুরাণ, উপকথার সংস্কৃত ঐতিহ্য: জ্ঞানবাপী। কাশীখণ্ডের ৩৩ নম্বর অধ্যায়: ঈশান আড়চোখে লিঙ্গটি দেখলেন। পুরাকালে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে কে বড় বলে যখন তর্ক হচ্ছিল, তখন এই লিঙ্গ প্রকাশিত হয়েছিল। লিঙ্গটিকে স্নান করানোর ইচ্ছা হল। তখনও ভগীরথ পৃথিবীতে গঙ্গাকে আনেননি। ঈশান ত্রিশূল দিয়ে মাটি খুঁড়তেই, স্ফটিকস্বচ্ছ ঠান্ডা জলের ধারা। শিব মানে জ্ঞান। তাই কূপের নাম জ্ঞানবাপী। ইংরেজি শিক্ষা আমাদের মন্দির মসজিদ দাঙ্গা সেকুলারিজম শিখিয়েছে। শেখায়নি, কাশীর বিতর্কিত মসজিদ আজও তার নামে নিয়ে চলেছে সংস্কৃত পুরাণের ঐতিহ্য। সংস্কৃত নামের মসজিদ ভারতে দ্বিতীয়টি আছে কি? বিশ্বনাথ মন্দির আর জ্ঞানবাপী মসজিদের মাঝে লোহার বেড়া, এ কে ৪৭ হাতে কম্যান্ডোই সব নয়।
এমনিতে পুরাণ, স্মৃতিশাস্ত্র একটু পড়ার পর আধুনিক পাঠকের বিরক্তি জাগতে বাধ্য। ঘুরিয়েফিরিয়ে এক গল্প, প্রায় রাজনৈতিক প্যামফ্লেট। স্কন্দপুরাণে ব্রহ্মা, নারায়ণ, সূর্য, সকলে শিবের ভক্ত। বিষ্ণুপুরাণ বা দেবীভাগবত হলে নিঃসন্দেহে অন্য রকম হত। কিন্তু এই শৈব প্যামফ্লেটেও এক জায়গায়, কাশী শহরকে বলা হল নির্বাণশ্রী। অবশ্যই বৌদ্ধ প্রভাব!
আর এক জায়গায় গঙ্গার সহস্রটি নাম। শিবের জটা বেয়ে আসা নদীর নামগুলি ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন বৈষ্ণব সাধক রামানন্দ, কবির ও সন্ত রবিদাসের গুরু। গঙ্গাস্নানে পুণ্যের কথা প্যামফ্লেটে থাকাই স্বাভাবিক। ২৭ নম্বর অধ্যায়ে ১৫৫তম শ্লোক জানাল, গঙ্গাস্নানে বাক-ইন্দ্রিয়ের পাপও ধুয়ে যায়। বাক-ইন্দ্রিয়ের পাপ? মিথ্যে বলা, কটু কথা, পরনিন্দা, অপ্রাসঙ্গিক বকরবকর। প্রাক্-ঔপনিবেশিক হিন্দুধর্মে জাতপাতের পাশাপাশি একটি গণতান্ত্রিক বয়ানও ছিল। আমরা খোঁজ রাখিনি।
বিশ্বনাথ থেকে অভিমুক্তেশ্বর, কৃত্তিবাসেশ্বর, কেদারেশ্বর... কাশীর প্রতিটি শিবলিঙ্গই লিঙ্গ-রাজনীতির নতুন এক গণতান্ত্রিক বয়ান আজ আমাদের সামনে নিয়ে আসছে। এমনিতে শিবলিঙ্গ বললে আজকাল অনেক নারীবাদীই মুখ বেঁকান: ‘যত্তো সব অবসিন ব্যাপার!’ কাশীখণ্ড যেন এঁদের কথার পাল্টা উত্তর দেয়, ‘লিঙ্গ মানে শিবের লিঙ্গ নয়। শিব স্বয়ং লিঙ্গরূপে প্রকাশিত হন।’ শিবলিঙ্গ কখনও খাড়া ওঠে না, নীচে একটি ত্রিভুজাকার ‘পীঠ’ থাকে। এই পীঠের আর এক নাম শক্তি। মানে, নারী এবং পুরুষ একত্র। অর্ধনারীশ্বরের যৌন পরিচিতি। সংস্কৃত ‘লি’ ধাতুর অর্থ: বাস করা। পৃথিবীতে সব কিছুর বাসস্থান লিঙ্গের উপরে। তার বাইরে কেউ নয়। এলজিবিটি আন্দোলনের দিনেও এ নিয়ে ভাবব না?
স্কন্দপুরাণে বর্ণিত কাশীক্ষেত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য কী? টানা ষাট বছর ধরে প্রবল খরা। পৃথিবীকে বাঁচাতে ব্রহ্মার অনুরোধে রূপাঞ্জয় ঋষি বারাণসীর রাজত্বভার নিলেন। তাঁর শর্ত একটিই। দেবতাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে। অতঃপর মন্দার পর্বতে শিবের হাহুতাশ: ‘ইস, কাশীর স্পর্শে কবে যে ফের শীতল হব!’ একটি শহর নিয়ে দেবাদিদেবের কামার্ত আকুলিবিকুলি। অতঃপর ব্রহ্মা, বিষ্ণু, সূর্য যাঁদেরই কাশীতে পাঠান শিব, তাঁরা সেখানে রয়ে যান। শেষে হরগৌরীর আগমন। মানে, কাশী দেবতাদের হাতে গড়া শহর নয়। মানুষের তৈরি, কিন্তু দেবতারাও তার বিরহে আকুল। সেখান থেকে আর স্বর্গে ফেরেন না।
কাশীর ট্রাজেডি একটিই। মানুষের তৈরি শহর, অভিমুক্তেশ্বর, জনতার সংস্কৃতি, তৃতীয় লিঙ্গ ইত্যাদির কথা হিন্দুত্ববাদীরা জানান না। যাঁদের জানানোর কথা ছিল, সেই তথাকথিত সেকুলার এবং বামপন্থীরাও ধাঁচার বাইরে বেরোন না, পুরাণ এবং তীর্থমাহাত্ম্য সবই নস্যাৎ করে দেন। দুই দলই চিরাচরিত গণ্ডিতে আটক। গঙ্গার ঘাট আর বিশ্বনাথ মন্দির বনাম জ্ঞানবাপী মসজিদ। এই গণ্ডি ভাঙতে প্রাক্-ঔপনিবেশিক চিন্তার সূত্রগুলি জরুরি।

ঋণ স্বীকার: দ্য স্কন্দ পুরাণ: দশম ও একাদশ খণ্ড। অনুবাদ: জি ভি টাগরে। মোতিলাল বানারসীদাস প্রকাশিত