ফ্রান্স বিশ্বকাপের গ্যালারিতে তৈরি হত ‘মোহনবাগান জোন’
, Ei Samay
অঞ্জন মিত্র
দিয়েগো মারাদোনা সাসপেন্ড৷ বিশ্বকাপে আর নেই তিনি৷ আচমকা এসেছিল খবরটা৷ সেই এক খবরেই আমার যাবতীয় উত্সাহ-উদ্দীপনা শেষ!
১৯৯৪৷ প্রথম বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়ার উত্তেজনায় ফুটছি৷ ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে তৈরি৷ আমেরিকার প্লেনের টিকিট, বিশ্বকাপে পরের দিকের ম্যাচ টিকিট সব হাতে এসে গিয়েছে৷ তখনই শুনলাম, মারাদোনা নেই! প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঠিক করে ফেলেছিলাম, ধুস, তা হলে আর যাব না৷ মারাদোনাকেই যদি না দেখতে পাই, বিশ্বকাপ দেখে আর লাভ কী? বাদ সাধল আমার স্ত্রী আর মেয়ে৷ বলেছিল, 'সব যখন হয়েই গিয়েছে, যাবে না কেন?' বলতে গেলে, ওদের ধাক্কাতেই পা দিলাম আমেরিকায়৷ আমার প্রথম বিশ্বকাপে৷
তারপর আর কোনওদিন 'না' বলার স্পর্ধা হয়নি৷ পরপর পাঁচটা বিশ্বকাপ৷ পাঁচটা ফাইনাল মাঠে বসে দেখা৷ সঙ্গে সেমিফাইনালও, কোয়ার্টার ফাইনালও৷ এ এমন এক ম্যাজিক, একবার গেলে নেশা লেগে যাবে৷ মন খারাপ৷ শরীর খারাপের জন্য এ বার ব্রাজিল যেতে পারছি না৷ কলকাতায় থাকতে হচ্ছে৷ মন খারাপ হলে ভাবছি, আমেরিকা, ফ্রান্স, কোরিয়া-জাপান, জার্মানি এবং দক্ষিণ আফ্রিকা--পাঁচ-পাঁচটা ফুটবলের বিশ্বযুদ্ধে ছিলাম, এটাই বা কম কী?
আমেরিকা বিশ্বকাপের কথায় ফিরে যাই৷ ওখানে গিয়ে যা করেছিলাম, মনে হয় শুধু মাত্র তার জন্যই আমাদের ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীরা আমায় মনে রাখবেন৷ আবিষ্কার করলাম, টিকিট নিয়ে কী পরিমাণ কালোবাজারি করতেন ফেডারেশনের কিছু কর্তা৷ হাতে-নাতে ধরেছিলাম৷ কী যে নোংরামি চলত, বলে বোঝানো যাবে না৷ চোখের সামনে দেখেছি, ফিফার দেওয়া টিকিট চড়া দামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে৷ বিক্রি করে মাঠে যাওয়ার নাম করে ঘরে বসে আছে৷ নিজেদের পেটোয়া লোক ছাড়া কেউ টিকিটই পেত না৷
আমার প্রতিবাদী মন বলেছিল, এর শেষ দেখে ছাড়ব৷ ফিরে এসে রাজ্যসভা-লোকসভায় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলিয়েছিলাম৷ লোকসভায় এই ইস্যু নিয়ে ঝড় তুলেছিলেন রাম জেঠমালানি৷ আমার উদ্যোগে সব রাজ্য সংস্থা দাবি করল, বিশ্বকাপের টিকিট ওদেরও দিতে হবে৷ ফেডারেশন কর্তাদের তখন 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি' অবস্থা৷ সমাধান হয়েওছিল৷ পরের ফ্রান্স বিশ্বকাপে টিকিট বন্টনে স্বচ্ছ্বতা এল৷ মোহনবাগান ক্লাবকে প্রায় কুড়িটা টিকিট দেওয়া হয়েছিল৷ টাকা দিয়ে কেনা যেত সেই টিকিট৷ সেই টিকিটে বিশ্বকাপ দেখতে গিয়েছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী৷ সব খরচা দিয়ে আমাদের তখনকার কোচ অমল দত্তকে নিয়ে গিয়েছিলাম৷ পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমেন মিত্র-- কাকে টিকিট দিইনি?
ফ্রান্স বিশ্বকাপেই ঘটেছিল সেই মজার ঘটনা৷ প্রতি বিশ্বকাপেই আমি প্রচুর মোহনবাগানের জার্সি নিয়ে যেতাম৷ নিজে তো পরতামই, সঙ্গে যাঁরা যেতেন, সবাইকে দিতাম৷ মনে আছে, ফ্রান্সের স্টেডিয়ামে লাইন দিয়ে পাশাপাশি বসতাম আমরা৷ সবার গায়ে সবুজ-মেরুন জার্সি৷ একদম 'মোহনবাগান জোন' তৈরি হয়ে যেত৷ অনেকেই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, 'আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? এটা কোন ক্লাবের জার্সি?' গর্ব করে বলতাম, 'আমরা ভারতের লোক৷ এটা ভারতের জাতীয় ক্লাব মোহনবাগানের জার্সি৷' অবাক হতাম, জাতীয় ক্লাব শুনে সেই জার্সিও চাইতেন অনেকে৷
এখানেই ভুলব না সেই রাত৷ ফ্রান্স চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রাত৷ গোটা রাত জেগে কাটিয়েছিলাম৷ দেখেছিলাম, বিশ্বজয়ের আনন্দ কাকে বলে৷ পরের দিন খোলা বাসে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল জিদানদের৷ সেখানেও হাজির আমরা৷ তার আগে কোয়ার্টার ফাইনাল বিশাল মিছিল করেছিল ব্রাজিল সমর্থকরা৷ সেই মিছিলে হেঁটেছিলাম আমরাও৷ মনে আছে, ব্রাজিল সমর্থকরা আমাদের খাইয়ে-দাইয়ে ছেড়েছিল৷ আর সেই ব্রাজিলই যখন ফাইনালে হারল, ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি৷
জার্মানি বিশ্বকাপে আমার স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম৷ ওখানেই সবচেয়ে খারাপ ঘটনার সামনে পড়েছিলাম৷ দোষ ওদের নয়৷ আমাদেরই৷ ময়দানের এক কর্তার উদ্যোগে যে ট্রাভেল এজেন্ট সংস্থার সঙ্গে আমরা গিয়েছিলাম, তারা ঠকিয়েছিল আমাদের৷ টাকা নিয়েও কিছুই করেনি৷ ভারতীয় দূতাবাস থেকে তদন্ত পর্যন্ত হয়েছিল৷ অনেকেই দেশে ফিরে এসেছিলেন ভয়ে৷ কিন্ত্ত আমাদের বাঁচিয়ে ছিলেন ফ্রান্সে থাকা বিখ্যাত মুখাভিনয় শিল্পী পার্থপ্রতিম মজুমদার৷ আমার মেয়ে ঝুম্পাই জার্মানি থেকে ফ্রান্সে গিয়ে ডলার নিয়ে এসেছিল ওঁর কাছ থেকে৷ যে হোটেলে ছিলাম, তারাও বলেছিল, আপনারা থাকুন, ডলার পরে দেবেন৷
না হলে যে কী হত!
(লেখক মোহনবাগান সচিব)
দিয়েগো মারাদোনা সাসপেন্ড৷ বিশ্বকাপে আর নেই তিনি৷ আচমকা এসেছিল খবরটা৷ সেই এক খবরেই আমার যাবতীয় উত্সাহ-উদ্দীপনা শেষ!
১৯৯৪৷ প্রথম বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়ার উত্তেজনায় ফুটছি৷ ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে তৈরি৷ আমেরিকার প্লেনের টিকিট, বিশ্বকাপে পরের দিকের ম্যাচ টিকিট সব হাতে এসে গিয়েছে৷ তখনই শুনলাম, মারাদোনা নেই! প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঠিক করে ফেলেছিলাম, ধুস, তা হলে আর যাব না৷ মারাদোনাকেই যদি না দেখতে পাই, বিশ্বকাপ দেখে আর লাভ কী? বাদ সাধল আমার স্ত্রী আর মেয়ে৷ বলেছিল, 'সব যখন হয়েই গিয়েছে, যাবে না কেন?' বলতে গেলে, ওদের ধাক্কাতেই পা দিলাম আমেরিকায়৷ আমার প্রথম বিশ্বকাপে৷
তারপর আর কোনওদিন 'না' বলার স্পর্ধা হয়নি৷ পরপর পাঁচটা বিশ্বকাপ৷ পাঁচটা ফাইনাল মাঠে বসে দেখা৷ সঙ্গে সেমিফাইনালও, কোয়ার্টার ফাইনালও৷ এ এমন এক ম্যাজিক, একবার গেলে নেশা লেগে যাবে৷ মন খারাপ৷ শরীর খারাপের জন্য এ বার ব্রাজিল যেতে পারছি না৷ কলকাতায় থাকতে হচ্ছে৷ মন খারাপ হলে ভাবছি, আমেরিকা, ফ্রান্স, কোরিয়া-জাপান, জার্মানি এবং দক্ষিণ আফ্রিকা--পাঁচ-পাঁচটা ফুটবলের বিশ্বযুদ্ধে ছিলাম, এটাই বা কম কী?
আমেরিকা বিশ্বকাপের কথায় ফিরে যাই৷ ওখানে গিয়ে যা করেছিলাম, মনে হয় শুধু মাত্র তার জন্যই আমাদের ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীরা আমায় মনে রাখবেন৷ আবিষ্কার করলাম, টিকিট নিয়ে কী পরিমাণ কালোবাজারি করতেন ফেডারেশনের কিছু কর্তা৷ হাতে-নাতে ধরেছিলাম৷ কী যে নোংরামি চলত, বলে বোঝানো যাবে না৷ চোখের সামনে দেখেছি, ফিফার দেওয়া টিকিট চড়া দামে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে৷ বিক্রি করে মাঠে যাওয়ার নাম করে ঘরে বসে আছে৷ নিজেদের পেটোয়া লোক ছাড়া কেউ টিকিটই পেত না৷
আমার প্রতিবাদী মন বলেছিল, এর শেষ দেখে ছাড়ব৷ ফিরে এসে রাজ্যসভা-লোকসভায় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলিয়েছিলাম৷ লোকসভায় এই ইস্যু নিয়ে ঝড় তুলেছিলেন রাম জেঠমালানি৷ আমার উদ্যোগে সব রাজ্য সংস্থা দাবি করল, বিশ্বকাপের টিকিট ওদেরও দিতে হবে৷ ফেডারেশন কর্তাদের তখন 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি' অবস্থা৷ সমাধান হয়েওছিল৷ পরের ফ্রান্স বিশ্বকাপে টিকিট বন্টনে স্বচ্ছ্বতা এল৷ মোহনবাগান ক্লাবকে প্রায় কুড়িটা টিকিট দেওয়া হয়েছিল৷ টাকা দিয়ে কেনা যেত সেই টিকিট৷ সেই টিকিটে বিশ্বকাপ দেখতে গিয়েছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী৷ সব খরচা দিয়ে আমাদের তখনকার কোচ অমল দত্তকে নিয়ে গিয়েছিলাম৷ পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমেন মিত্র-- কাকে টিকিট দিইনি?
ফ্রান্স বিশ্বকাপেই ঘটেছিল সেই মজার ঘটনা৷ প্রতি বিশ্বকাপেই আমি প্রচুর মোহনবাগানের জার্সি নিয়ে যেতাম৷ নিজে তো পরতামই, সঙ্গে যাঁরা যেতেন, সবাইকে দিতাম৷ মনে আছে, ফ্রান্সের স্টেডিয়ামে লাইন দিয়ে পাশাপাশি বসতাম আমরা৷ সবার গায়ে সবুজ-মেরুন জার্সি৷ একদম 'মোহনবাগান জোন' তৈরি হয়ে যেত৷ অনেকেই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, 'আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? এটা কোন ক্লাবের জার্সি?' গর্ব করে বলতাম, 'আমরা ভারতের লোক৷ এটা ভারতের জাতীয় ক্লাব মোহনবাগানের জার্সি৷' অবাক হতাম, জাতীয় ক্লাব শুনে সেই জার্সিও চাইতেন অনেকে৷
এখানেই ভুলব না সেই রাত৷ ফ্রান্স চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রাত৷ গোটা রাত জেগে কাটিয়েছিলাম৷ দেখেছিলাম, বিশ্বজয়ের আনন্দ কাকে বলে৷ পরের দিন খোলা বাসে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল জিদানদের৷ সেখানেও হাজির আমরা৷ তার আগে কোয়ার্টার ফাইনাল বিশাল মিছিল করেছিল ব্রাজিল সমর্থকরা৷ সেই মিছিলে হেঁটেছিলাম আমরাও৷ মনে আছে, ব্রাজিল সমর্থকরা আমাদের খাইয়ে-দাইয়ে ছেড়েছিল৷ আর সেই ব্রাজিলই যখন ফাইনালে হারল, ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি৷
জার্মানি বিশ্বকাপে আমার স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম৷ ওখানেই সবচেয়ে খারাপ ঘটনার সামনে পড়েছিলাম৷ দোষ ওদের নয়৷ আমাদেরই৷ ময়দানের এক কর্তার উদ্যোগে যে ট্রাভেল এজেন্ট সংস্থার সঙ্গে আমরা গিয়েছিলাম, তারা ঠকিয়েছিল আমাদের৷ টাকা নিয়েও কিছুই করেনি৷ ভারতীয় দূতাবাস থেকে তদন্ত পর্যন্ত হয়েছিল৷ অনেকেই দেশে ফিরে এসেছিলেন ভয়ে৷ কিন্ত্ত আমাদের বাঁচিয়ে ছিলেন ফ্রান্সে থাকা বিখ্যাত মুখাভিনয় শিল্পী পার্থপ্রতিম মজুমদার৷ আমার মেয়ে ঝুম্পাই জার্মানি থেকে ফ্রান্সে গিয়ে ডলার নিয়ে এসেছিল ওঁর কাছ থেকে৷ যে হোটেলে ছিলাম, তারাও বলেছিল, আপনারা থাকুন, ডলার পরে দেবেন৷
না হলে যে কী হত!
(লেখক মোহনবাগান সচিব)
No comments:
Post a Comment