Saturday, 21 June 2014

মারাদোনার শেষ ম্যাচ, বেকেনবাউয়ারের বিয়ের শুভেচ্ছা

মারাদোনার শেষ ম্যাচ, বেকেনবাউয়ারের বিয়ের শুভেচ্ছা

, Ei Samay

অমিত সেন

জার্মানির লিপজিগে আর্জেন্তিনা-মেক্সিকোর বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ দেখছি গ্যালারিতে বসে৷ ৯০ মিনিট পর্যন্ত ম্যাচ ড্র৷ গোটা গ্যালারি উত্তেজনায় ফুটছে৷ আমরাও ব্যতিক্রম নই৷ ঠিক সেই সময়ই ভয়ঙ্কর চিন্তাটা মাথায় ঢোকাল আমার কলকাতার বন্ধু৷ বলল, 'ম্যাচ তো অতিরিক্ত সময়ে চলে গেল৷ তারপর টাইব্রেকারও হতে পারে৷ বাড়ি ফিরব কী করে?' এই পরিস্থিতিতে এমন ভাবনা বোধহয় আমরা কলকাতার লোকেরাই ভাবতে পারি!

ওর এটা বলার কারণও আছে৷ ম্যাচটা আমরা দেখতে এসেছিলাম বার্লিন থেকে৷ সে বার বার্লিনই ছিল আমাদের বেস ক্যাম্প৷ এসেছিলাম বাসে৷ মনে আছে, বাস চালক যখন শুনলেন, আমরা খেলা দেখতে যাচ্ছি, টিকিটের পয়সা নিলেন না৷ কিন্ত্ত ফেরার কথা ছিল ট্রেনে৷ টিকিটও কাটা ছিল৷ রাত এগারোটায় শেষ ট্রেন ছিল৷ কিন্ত্ত খেলা যখন শেষ হল, তখনই প্রায় এগারোটা বাজে৷ তা-ও অতিরিক্ত সময়ে রদরিগেস গোল করে দিয়েছিল বলে ম্যাচ টাইব্রেকারে যায়নি৷ ট্রেন পাব না, জেনেও স্টেশনে এসেছিলাম৷ এসে দেখলাম, এই ম্যাচের জন্য টাইম টেবল বদলে ফেলা হয়েছে৷ স্টেশনে দাঁড়িয়ে সুন্দরী জার্মানিরা জানিয়ে দিচ্ছেন, কোন ট্রেন কখন ছাড়বে৷ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম আমরা৷

ঘটনাটা শুরুতেই বললাম কারণ, এ বার ব্রাজিল যাওয়ার আগেই মোট চারটে বিশ্বকাপ দেখা হয়ে গিয়েছে৷ সেই আমেরিকা থেকে শুরু৷ মাঝে কোরিয়া-জাপানটা শুধু যেতে পারিনি৷ এতগুলো দেশে বিশ্বকাপ দেখলেও বলব, মন জয় করেছিল জার্মানি৷ আমি যেখানেই যাই, পরিকাঠামো নিয়ে খুব মাথা ঘামাই৷ এটা আমার কাজের মধ্যেও পড়ে৷ সে দিক সেরা জার্মানি৷ বিশ্বকাপের মতো বড় আসর কী ভাবে চালাতে হয়, প্রতি মুহূর্তে শিখেছি৷

তা ছাড়া জার্মানিকে ভালোবাসার আরও একটা কারণ আছে৷ এখানেই জীবনের অন্যতম সেরা একটা ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলাম৷ কোনও দিন ভুলব না৷ ঘটনাটা হামবুর্গে৷ ঘুরতে-ঘুরতে হঠাত্‍ দেখা হয়ে গিয়েছিল পিটার ভেলাপ্পানের সঙ্গে৷ ভেলাপ্পান তখন এএফসির সেক্রেটারি৷ আমাকে দেখেই বললেন, 'বিশ্বকাপে যখন এসেছে, শুধু ফুটবল দেখেই সন্ত্তষ্ট থেক না৷ ফিফার হসপিটালিটি কী দেখে যাও৷ আমার অফিসে এস, পাস দিচ্ছি৷' ফিফার হসপিটালিটি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, সেটা বলাই বাহুল্য৷ কিন্ত্ত আমার গল্প সেটা নয়৷

ভেলাপ্পনের সঙ্গেই ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম৷ বক্সে যেখানে বসেছিলাম, পিছনে তাকিয়ে চোখ তো কপালে৷ দেখি, বসে রয়েছেন ফিফা সভাপতি শেপ ব্লাটার৷ রয়েছেন বেকেনবাউয়ার৷ তখনকার উয়েফা প্রেসিডেন্ট সুইডেনের লেনার্ট জোহানসন৷ ভেলাপ্পনের সঙ্গে গিয়ে কথা বলেছিলাম ওঁদের সঙ্গে৷ ভারত থেকে শুধু খেলা দেখতে এসেছি শুনে ওঁরা তো অবাক৷

ওখানে বসেই দেখলাম, প্রায় সবাই এসে বেকেনবাউয়ারকে কী একটা বলছেন৷ মজা করছেন, অভিনন্দনও জানাচ্ছেন৷ তিনি লাজুক-লাজুক মুখে হাসছেন৷ বুঝতে না পেরে ভেলাপ্পনকে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, 'আরে জানো না? বেকেনবাউয়ার সদ্য বিয়ে করেছেন৷ তৃতীয় বিয়ে৷ তাই সবাই মজা করছে৷' কী করি? আমিও তখন অভিনন্দন জানিয়ে এলাম৷

শুধু এটাই নয়৷ বিশ্বকাপে আরও একটা সেরা ঘটনার সাক্ষী আমি৷ ৯৪-এ প্রথমবার আমেরিকা বিশ্বকাপে নাইজেরিয়া-আর্জেন্তিনা ম্যাচ গ্যালারিতে বসে দেখেছিলাম৷ কে জানত, বিশ্বকাপে ওটাই দিয়েগো মারাদোনার শেষ ম্যাচ হবে! তারপরেই সেই বিশ্ব কাঁপানো ডোপ কেলেঙ্কারি৷ মারাদোনা নেই, এটা যেন কেউ ভাবতেই পারছিল না৷ শুধু আর্জেন্তিনা সমর্থকরাই নয়, মন খারাপ হতে দেখেছিলাম অন্য দেশের সমর্থকদেরও৷

আবার সেই আমিই গর্বিত, কারণ কোচ হিসেবে মারাদোনার প্রথম ম্যাচও গ্যালারিতে বসে দেখেছি, গত বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকায়৷ এই বিশ্বকাপ আরও একটা কারণে মনে থাকবে৷ নিজেরা গাড়ি চালিয়ে ঘুরেছিলাম গোটা দেশ৷ তা প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার তো হবেই৷ তিনটে গাড়ি ভাড়া করেছিলাম৷ একটা চালাতাম আমি৷ গাড়ি চালিয়ে এত আনন্দ কোনও দিন পাইনি৷

আর একটা জিনিসও অবাক করেছিল আমায়৷ দক্ষিণ আফ্রিকায় অন্য দেশের যত মানুষ রয়েছে, তাঁরা সবাই মাঠে গিয়ে নিজের দেশ নয়, চিত্‍কার করত দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে৷ সে ইংল্যান্ডের লোকই হোক বা জার্মানি৷ যে দেশে থাকছে-খাচ্ছে, তার প্রতি বেইমানি করতে পারেনি৷

এটাই বোধহয় বিশ্বকাপের মাহাত্ম্য!
(লেখক কিং ফিশার ইস্টবেঙ্গলের অন্যতম ডিরেক্টর)

No comments:

Post a Comment