রাইকার্ডের থুতু এবং রাজপথে রক্তবন্যা
, Ei Samay
রূপক সাহা
'ফুটবল ইজ ওয়ার'৷ প্রকাশ্যে এই কথাটা প্রথম যে কোচ বলেছিলেন, তাঁর নাম রিনাস মিশেলস৷ আমরা সবাই জানি, তিনি টোটাল ফুটবলের জনক৷ 'ফুটবল হল যুদ্ধ', ডাচ কোচের মুখে এই কথাটা শুনে সারা বিশ্ব চমকে উঠেছিল৷ ব্রাজিলীয়দের কাছে ফুটবল হল ধর্ম৷ জার্মানদের কাছে, জাত্যাভিমান৷ ইতালীয়রা মনে করেন, ফুটবল বিনোদন ছাড়া আর কিছু নয়৷ কিন্ত্ত, ডাচরা তো ফুটবলকে আর্ট বলে মানেন৷ তা হলে মিশেলস হঠাত্ যুদ্ধংদেহি মনোভাব দেখালেন কেন?
ইতালি বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে সত্যিই বুঝিনি৷ দু'বছর আগে, ১৯৮৮ সালে মিশলসের নেদারল্যান্ডস ইউরো কাপে জিতেছিল৷ রুদ খুলিত, মার্কো ফান বাস্তেন, রোনাল্ড কোমান, ইয়ান ভাউটার্স, জোরাল্ড ভানেনবার্গ--- তারকার ছড়াছড়ি সেই দলে৷ প্রায় সেই টিম নিয়েই সে বার ইতালি গিয়েছিল নেদারল্যান্ডস, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্যে৷ তার আগে তখনকার যুগোস্লাভিয়ার জাগ্রেব শহরে ডাচরা কিছু দিন প্র্যাক্টিস করেছিল৷ সেখান থেকে খুলিত এসি মিলান ক্লাবে তাঁর সতীর্থ ইতালির মিডফিল্ডার কার্লো আন্সেলোত্তিকে (এখন রিয়াল মাদ্রিদের কোচ) চিঠি লিখেছিলেন, 'বন্ধু আশা করি, ফাইনালে রোমের অলিম্পিকো স্টেডিয়ামে তোমাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হবে৷' মনে আছে, সেই চিঠি বড় করে ছাপা হয়েছিল, ইতালির ক্রীড়া দৈনিক গাজেত্তা দে লা স্পোর্তস-এ৷
ইতালিতে ডাচরা প্রথম রাউন্ডের তিনটে ম্যাচ খেলেছিল, রোম থেকে অনেক দূরে পালের্মো আর কালিয়ারিতে৷ খুলিতদের খেলা নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও, সুযোগ হয়ে ওঠেনি৷ দ্বিতীয় রাউন্ডে মিলানে ডাচ টিম মুখোমুখি পশ্চিম জার্মানির৷ ওই একই দিনে ঘণ্টা দুয়েক আগে তুরিনে খেলা ব্রাজিল আর আর্জেন্তিনার৷ ঠিক করতে পারছিলাম না, কোন ম্যাচটা কভার করতে যাব৷ কাগজগুলো নেদারল্যান্ডস-পশ্চিম জার্মানি ম্যাচ নিয়েই বেশি হইচই করছিল৷ বলা হচ্ছিল, বিশ্বকাপ খেলা হলেও, এটা আসলে মিলান ডার্বি৷ কেন না, খুলিত, বাস্তেন আর রাইকার্ড তখন খেলতেন এসি মিলানে৷ আর জার্মানির লোথার ম্যাথাউস, আন্দ্রে ব্রেহমে আর য়ুরগেন ক্লিন্সমান ইন্তার মিলানে৷ এই ডার্বি ম্যাচে এই ছ'জনকে কোনও না কোনও কারণে, কখনও এক সঙ্গে খেলতে দেখা যায়নি৷ সেই জন্য মিলানের জুইসেপ্পে মেজ্জা স্টেডিয়ামের পঁচাত্তর হাজার আসন পুরো টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল৷
মন বলল, মিলানেই যাওয়া উচিত৷ ভাগ্যিস গিয়েছিলাম! না হলে একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা হত না৷ চব্বিশ বছর কেটে গিয়েছে, এখনও সেই দিনটার কথা ভুলিনি৷ সেই প্রথম দেখলাম, ফুটবল স্টেডিয়ামে লিফটের ব্যবস্থাও থাকে দর্শকদের জন্য! গ্যালারিতে কমলা রংয়ের আধিক্যই ছিল বেশি৷ ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে তুরিন থেকে খবর এল, ব্রাজিল ০-১ হেরে গিয়েছে আর্জেন্তিনার কাছে৷ প্রচুর চান্স পেয়েও নাকি গোল করতে পারেনি কারেকারা৷ আর সারা খেলায় মাত্র একটা সুযোগ পেয়েই, তা কাজে লাগিয়েছেন মারাদোনা৷ গোল করিয়েছেন কানিজিয়াকে দিয়ে৷ ব্রাজিল আর বিশ্বকাপে নেই ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্ত্ত সেই বিষণ্ণতা কেটে গেল ডাচ-জার্মানদের খেলা শুরু হওয়ার পর৷ মিনিট কুড়ি বেশ খেলা হচ্ছিল৷ তার পরই মুগ্ধতার রেশ কেটে গেল৷ হঠাত্ দেখি, রাইকার্ড কড়া ট্যাকেল করলেন রুডি ফোলারকে৷ জমিতে পড়ে গেলেন ফোলার৷ উঠে দাঁড়িয়ে তিনি কী যেন বললেন রাইকার্ডকে৷ দু'জনে পরস্পরের দিকে তেড়ে গেলেন৷ এর পরই রেফারি দৌড়ে গিয়ে হলুদ কার্ড দেকালেন রাইকার্ডকে৷ প্রেস বক্সে কে যেন বললেন, 'এই রে, রাইকার্ডের সেকেন্ড ইয়েলো হয়ে গেল৷ এই ম্যাচটা জিতলেও কোয়ার্টার ফাইনালে খেলতে পারবে না৷' বিস্ময়ের তখনও কিছু বাকি ছিল৷ দেখলাম, একটু পরে দু'জনকেই রেফারি লাল কার্ড দেখালেন!
ঘটনাটা ঘটেছিল প্রেস বক্সের ঠিক উল্টো দিকে৷ আমরা... অপাংক্তেয় ভারতীয় সাংবাদিকরা যেখানে বসেছিলাম, সেখানকার ডেস্কে টিভি সেট ছিল না৷ ফলে বুঝতে পারছিলাম না, দু'জনের মধ্যে ঠিক কী হয়েছে৷ ফোলার আর রাইকার্ড কী এমন গুরুতর অপরাধ করলেন যে, রেফারি মার্চিং অর্ডার দিলেন? দু'জনে কিন্ত্ত চুপচাপ মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷ তার পরই প্রেস বক্সে ডাচ আর জার্মান সাংবাদিকদের মধ্যে শুরু হল তুমুল ঝগড়া৷ উপরে উঠে গিয়ে টিভি রিপ্লেতে দেখলাম, রাইকার্ড থুতু ছেটালেন ফোলারের মাথায়৷ এক বার নয়, দু'বার৷ দেখে জার্মান সাংবাদিকরা ভীষণ উত্তেজিত৷ তাঁদের বক্তব্য, দোষ তো করেছেন রাইকার্ড৷ তা হলে রেফারি ফোলারকে লাল কার্ড দেখালেন কেন? অন্য দিকে, ডাচ সাংবাদিকরা বলতে লাগলেন, ফোলার নিশ্চয় বর্ণবিদ্বেষী কোনও মন্তব্য করেছেন৷ না হলে রাইকার্ডের মতো ভদ্র ফুটবলার মেজাজ গরম করতে পারেন না৷ শুনে আমি ধন্দে পড়ে দেলাম৷ ভাবতেই পারিনি, বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে থুতু ছেটানোর মতো নিন্দনীয় ঘটনা থাকতে পারে৷
ডাচ সাংবাদিকদের সন্দেহের যথেষ্ট কারণও ছিল৷ সুরিনামি বাবা আর ডাচ মায়ের সন্তান, গায়ের রং কালো বলে প্রায়ই তখন বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য শুনতে হত রাইকার্ড ও খুলিতকে৷ ফোলার সত্যিই সেই অপরাধটি করেছিলেন কি না, তা জানার উপায় ছিল না৷ হাফ টাইমে গোলশূন্য৷ তখন মনে হচ্ছিল, রাইনাস মিশেলস ঠিকই বলেছিলেন, 'ফুটবল হল যুদ্ধ৷' জাতি বৈরিতা উস্কে দেয়৷ ডাচদের কথাবার্তায় সে দিন বুঝতে পেরেছিলাম, কেউ জার্মানদের পছন্দ করেন না৷ বিশেষ করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার ইউরোপের যে দেশগুলোর উপর অত্যাচার করেছিলেন সেই দেশের লোকেরা৷ যুদ্ধের সময় নেদারল্যান্ডস প্রায় পাঁচ বছর পদানত ছিল জার্মানির৷ পঁয়তাল্লিশ বছর পরও, হিটলারের ভূত বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে তাড়া করে বেড়াচ্ছে ডাচদের৷
কেন এঁরা ঝগড়া করছেন, জানতে চাওয়ায় ইতালির এক সাংবাদিক আমাকে সে দিন বলেছিলেন, 'ওদের (ডাচ-জার্মানদের) মধ্যে তিক্ততার শুরু, দু'বছর আগে হামবুর্গে ইউরো কাপের সেমিফাইনালে৷ বাস্তেনের গোলে নেদারল্যান্ডস সেই প্রথম পশ্চিম জার্মানিকে হারায়৷ ডাচদের সে দিন মনে হয়েছিল, হিটলারের আগ্রাসনের বদলা নেওয়া গিয়েছে৷ এই যে রোনাল্ড কোমানকে দেখছেন, হামবুর্গে খেলার পর ও জার্সি বদলাবদলি করেছিল ওলাফ থনের সঙ্গে৷ কিন্ত্ত খানিক পরেই জার্মান গ্যালরির সামনে গিয়ে ও এমন ভঙ্গি করেছিল, যেন জার্মানির জার্সিটা চেয়ে নিয়েছে টয়লেট পেপার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য৷ তবে মাঠে সে দিন জার্মানরাও খুব খারাপ আচরণ করেছিল ডাচদের সঙ্গে৷'
কথাটা সত্যি কি না, তা জানতে চেয়েছিলাম আমার বন্ধু, জার্মান সাংবাদিক লুকের কাছে৷ খুব সিরিয়াস টাইপের ছেলে৷ ও বলেছিল, 'আজ যা ঘটল, তার জন্য আমরা দায়ী নই৷ দায়ী আমাদের পূর্বপুরুষরা (পড়ুন হিটলার)৷' যাই হোক, এত বিশদে যাচ্ছি না, মিলানের ম্যাচে সে দিন ইউরো কাপে হারের বদলা নিয়েছিল জার্মানি ২-১ গোলে জিতে৷ মাঠ থেকে বেরিয়ে ট্রামে উঠে আমি আর লুকে রেল স্টেশনের দিকে যাচ্ছি৷ রোমে ফিরব৷ দেখলাম, রাস্তায় মারপিট হচ্ছে ডাচ আর জার্মান সমর্থকদের মধ্যে৷ রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে৷ শিউরে উঠেছিলাম ওই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে৷ বারবার মনে হচ্ছিল, মিশেলস কি তা হলে ঠিক কথা বলেছিলেন? 'ফুটবল ইজ ওয়ার?' আমরা তো বরাবর জেনে এসেছি, ফুটবল হল যুদ্ধ, তবে অস্ত্র ছাড়া৷
(লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক)
'ফুটবল ইজ ওয়ার'৷ প্রকাশ্যে এই কথাটা প্রথম যে কোচ বলেছিলেন, তাঁর নাম রিনাস মিশেলস৷ আমরা সবাই জানি, তিনি টোটাল ফুটবলের জনক৷ 'ফুটবল হল যুদ্ধ', ডাচ কোচের মুখে এই কথাটা শুনে সারা বিশ্ব চমকে উঠেছিল৷ ব্রাজিলীয়দের কাছে ফুটবল হল ধর্ম৷ জার্মানদের কাছে, জাত্যাভিমান৷ ইতালীয়রা মনে করেন, ফুটবল বিনোদন ছাড়া আর কিছু নয়৷ কিন্ত্ত, ডাচরা তো ফুটবলকে আর্ট বলে মানেন৷ তা হলে মিশেলস হঠাত্ যুদ্ধংদেহি মনোভাব দেখালেন কেন?
ইতালি বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে সত্যিই বুঝিনি৷ দু'বছর আগে, ১৯৮৮ সালে মিশলসের নেদারল্যান্ডস ইউরো কাপে জিতেছিল৷ রুদ খুলিত, মার্কো ফান বাস্তেন, রোনাল্ড কোমান, ইয়ান ভাউটার্স, জোরাল্ড ভানেনবার্গ--- তারকার ছড়াছড়ি সেই দলে৷ প্রায় সেই টিম নিয়েই সে বার ইতালি গিয়েছিল নেদারল্যান্ডস, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্যে৷ তার আগে তখনকার যুগোস্লাভিয়ার জাগ্রেব শহরে ডাচরা কিছু দিন প্র্যাক্টিস করেছিল৷ সেখান থেকে খুলিত এসি মিলান ক্লাবে তাঁর সতীর্থ ইতালির মিডফিল্ডার কার্লো আন্সেলোত্তিকে (এখন রিয়াল মাদ্রিদের কোচ) চিঠি লিখেছিলেন, 'বন্ধু আশা করি, ফাইনালে রোমের অলিম্পিকো স্টেডিয়ামে তোমাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হবে৷' মনে আছে, সেই চিঠি বড় করে ছাপা হয়েছিল, ইতালির ক্রীড়া দৈনিক গাজেত্তা দে লা স্পোর্তস-এ৷
ইতালিতে ডাচরা প্রথম রাউন্ডের তিনটে ম্যাচ খেলেছিল, রোম থেকে অনেক দূরে পালের্মো আর কালিয়ারিতে৷ খুলিতদের খেলা নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও, সুযোগ হয়ে ওঠেনি৷ দ্বিতীয় রাউন্ডে মিলানে ডাচ টিম মুখোমুখি পশ্চিম জার্মানির৷ ওই একই দিনে ঘণ্টা দুয়েক আগে তুরিনে খেলা ব্রাজিল আর আর্জেন্তিনার৷ ঠিক করতে পারছিলাম না, কোন ম্যাচটা কভার করতে যাব৷ কাগজগুলো নেদারল্যান্ডস-পশ্চিম জার্মানি ম্যাচ নিয়েই বেশি হইচই করছিল৷ বলা হচ্ছিল, বিশ্বকাপ খেলা হলেও, এটা আসলে মিলান ডার্বি৷ কেন না, খুলিত, বাস্তেন আর রাইকার্ড তখন খেলতেন এসি মিলানে৷ আর জার্মানির লোথার ম্যাথাউস, আন্দ্রে ব্রেহমে আর য়ুরগেন ক্লিন্সমান ইন্তার মিলানে৷ এই ডার্বি ম্যাচে এই ছ'জনকে কোনও না কোনও কারণে, কখনও এক সঙ্গে খেলতে দেখা যায়নি৷ সেই জন্য মিলানের জুইসেপ্পে মেজ্জা স্টেডিয়ামের পঁচাত্তর হাজার আসন পুরো টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল৷
মন বলল, মিলানেই যাওয়া উচিত৷ ভাগ্যিস গিয়েছিলাম! না হলে একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা হত না৷ চব্বিশ বছর কেটে গিয়েছে, এখনও সেই দিনটার কথা ভুলিনি৷ সেই প্রথম দেখলাম, ফুটবল স্টেডিয়ামে লিফটের ব্যবস্থাও থাকে দর্শকদের জন্য! গ্যালারিতে কমলা রংয়ের আধিক্যই ছিল বেশি৷ ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে তুরিন থেকে খবর এল, ব্রাজিল ০-১ হেরে গিয়েছে আর্জেন্তিনার কাছে৷ প্রচুর চান্স পেয়েও নাকি গোল করতে পারেনি কারেকারা৷ আর সারা খেলায় মাত্র একটা সুযোগ পেয়েই, তা কাজে লাগিয়েছেন মারাদোনা৷ গোল করিয়েছেন কানিজিয়াকে দিয়ে৷ ব্রাজিল আর বিশ্বকাপে নেই ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্ত্ত সেই বিষণ্ণতা কেটে গেল ডাচ-জার্মানদের খেলা শুরু হওয়ার পর৷ মিনিট কুড়ি বেশ খেলা হচ্ছিল৷ তার পরই মুগ্ধতার রেশ কেটে গেল৷ হঠাত্ দেখি, রাইকার্ড কড়া ট্যাকেল করলেন রুডি ফোলারকে৷ জমিতে পড়ে গেলেন ফোলার৷ উঠে দাঁড়িয়ে তিনি কী যেন বললেন রাইকার্ডকে৷ দু'জনে পরস্পরের দিকে তেড়ে গেলেন৷ এর পরই রেফারি দৌড়ে গিয়ে হলুদ কার্ড দেকালেন রাইকার্ডকে৷ প্রেস বক্সে কে যেন বললেন, 'এই রে, রাইকার্ডের সেকেন্ড ইয়েলো হয়ে গেল৷ এই ম্যাচটা জিতলেও কোয়ার্টার ফাইনালে খেলতে পারবে না৷' বিস্ময়ের তখনও কিছু বাকি ছিল৷ দেখলাম, একটু পরে দু'জনকেই রেফারি লাল কার্ড দেখালেন!
ঘটনাটা ঘটেছিল প্রেস বক্সের ঠিক উল্টো দিকে৷ আমরা... অপাংক্তেয় ভারতীয় সাংবাদিকরা যেখানে বসেছিলাম, সেখানকার ডেস্কে টিভি সেট ছিল না৷ ফলে বুঝতে পারছিলাম না, দু'জনের মধ্যে ঠিক কী হয়েছে৷ ফোলার আর রাইকার্ড কী এমন গুরুতর অপরাধ করলেন যে, রেফারি মার্চিং অর্ডার দিলেন? দু'জনে কিন্ত্ত চুপচাপ মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷ তার পরই প্রেস বক্সে ডাচ আর জার্মান সাংবাদিকদের মধ্যে শুরু হল তুমুল ঝগড়া৷ উপরে উঠে গিয়ে টিভি রিপ্লেতে দেখলাম, রাইকার্ড থুতু ছেটালেন ফোলারের মাথায়৷ এক বার নয়, দু'বার৷ দেখে জার্মান সাংবাদিকরা ভীষণ উত্তেজিত৷ তাঁদের বক্তব্য, দোষ তো করেছেন রাইকার্ড৷ তা হলে রেফারি ফোলারকে লাল কার্ড দেখালেন কেন? অন্য দিকে, ডাচ সাংবাদিকরা বলতে লাগলেন, ফোলার নিশ্চয় বর্ণবিদ্বেষী কোনও মন্তব্য করেছেন৷ না হলে রাইকার্ডের মতো ভদ্র ফুটবলার মেজাজ গরম করতে পারেন না৷ শুনে আমি ধন্দে পড়ে দেলাম৷ ভাবতেই পারিনি, বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে থুতু ছেটানোর মতো নিন্দনীয় ঘটনা থাকতে পারে৷
ডাচ সাংবাদিকদের সন্দেহের যথেষ্ট কারণও ছিল৷ সুরিনামি বাবা আর ডাচ মায়ের সন্তান, গায়ের রং কালো বলে প্রায়ই তখন বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য শুনতে হত রাইকার্ড ও খুলিতকে৷ ফোলার সত্যিই সেই অপরাধটি করেছিলেন কি না, তা জানার উপায় ছিল না৷ হাফ টাইমে গোলশূন্য৷ তখন মনে হচ্ছিল, রাইনাস মিশেলস ঠিকই বলেছিলেন, 'ফুটবল হল যুদ্ধ৷' জাতি বৈরিতা উস্কে দেয়৷ ডাচদের কথাবার্তায় সে দিন বুঝতে পেরেছিলাম, কেউ জার্মানদের পছন্দ করেন না৷ বিশেষ করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার ইউরোপের যে দেশগুলোর উপর অত্যাচার করেছিলেন সেই দেশের লোকেরা৷ যুদ্ধের সময় নেদারল্যান্ডস প্রায় পাঁচ বছর পদানত ছিল জার্মানির৷ পঁয়তাল্লিশ বছর পরও, হিটলারের ভূত বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে তাড়া করে বেড়াচ্ছে ডাচদের৷
কেন এঁরা ঝগড়া করছেন, জানতে চাওয়ায় ইতালির এক সাংবাদিক আমাকে সে দিন বলেছিলেন, 'ওদের (ডাচ-জার্মানদের) মধ্যে তিক্ততার শুরু, দু'বছর আগে হামবুর্গে ইউরো কাপের সেমিফাইনালে৷ বাস্তেনের গোলে নেদারল্যান্ডস সেই প্রথম পশ্চিম জার্মানিকে হারায়৷ ডাচদের সে দিন মনে হয়েছিল, হিটলারের আগ্রাসনের বদলা নেওয়া গিয়েছে৷ এই যে রোনাল্ড কোমানকে দেখছেন, হামবুর্গে খেলার পর ও জার্সি বদলাবদলি করেছিল ওলাফ থনের সঙ্গে৷ কিন্ত্ত খানিক পরেই জার্মান গ্যালরির সামনে গিয়ে ও এমন ভঙ্গি করেছিল, যেন জার্মানির জার্সিটা চেয়ে নিয়েছে টয়লেট পেপার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য৷ তবে মাঠে সে দিন জার্মানরাও খুব খারাপ আচরণ করেছিল ডাচদের সঙ্গে৷'
কথাটা সত্যি কি না, তা জানতে চেয়েছিলাম আমার বন্ধু, জার্মান সাংবাদিক লুকের কাছে৷ খুব সিরিয়াস টাইপের ছেলে৷ ও বলেছিল, 'আজ যা ঘটল, তার জন্য আমরা দায়ী নই৷ দায়ী আমাদের পূর্বপুরুষরা (পড়ুন হিটলার)৷' যাই হোক, এত বিশদে যাচ্ছি না, মিলানের ম্যাচে সে দিন ইউরো কাপে হারের বদলা নিয়েছিল জার্মানি ২-১ গোলে জিতে৷ মাঠ থেকে বেরিয়ে ট্রামে উঠে আমি আর লুকে রেল স্টেশনের দিকে যাচ্ছি৷ রোমে ফিরব৷ দেখলাম, রাস্তায় মারপিট হচ্ছে ডাচ আর জার্মান সমর্থকদের মধ্যে৷ রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে৷ শিউরে উঠেছিলাম ওই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে৷ বারবার মনে হচ্ছিল, মিশেলস কি তা হলে ঠিক কথা বলেছিলেন? 'ফুটবল ইজ ওয়ার?' আমরা তো বরাবর জেনে এসেছি, ফুটবল হল যুদ্ধ, তবে অস্ত্র ছাড়া৷
(লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক)
No comments:
Post a Comment