ভ্যাটিকানের রাস্তায় মোহনবাগান জার্সিতে প্রিয়-সুব্রত
, Ei Samay
বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়া মানেই অজস্র রঙিন কাহিনী, অজস্র চরিত্র, অজস্র নাটক৷ খেলার সময়ে শুরু হয়েছে বিশ্বকাপের গল্প৷ লিখবেন বিশ্বকাপ দেখে আসা বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা৷ আজ লিখেছেন সাংবাদিক জয়ন্ত চক্রবর্তী
সালটা ছিল ১৯৭৮৷ সেই প্রথম ভারতের মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলা দেখলেন৷ তার আগে আন্তর্জাতিক ফুটবল দেখা তো দূরে থাক, সে ভাবে খবরাখবরও পাওয়া যেত না৷ ১৯৭৮ সালে অবশ্য টেলিভিশন দু-একটা ম্যাচ ছাড়া আর কোনও ম্যাচের লাইভ টেলিকাস্ট করেনি৷ কিন্ত্ত তাতেই হইচই পড়ে গিয়েছিল ফুটবল ভক্তদের মধ্যে৷
কলকাতার ফুটবলে তখন দাপটে রাজ করছে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব৷ এই সব ক্লাবের তারকারা রীতিমতো হিরো অনেকেরই কাছে৷ কিন্ত্ত টেলিভিশনে বিশ্বকাপের খেলা দেখার পর এই হিরো ওয়ারশিপের ব্যাপারটিতে কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগল৷ মনে আছে, আর্জেন্তিনার সুপারস্টার মারিও কেম্পেসের খেলা দেখে উত্তাল হয়ে গিয়েছিল কলকাতা, নাকি গোটা বাংলাই! সুদর্শন এই ফুটবলারের ডাউন দ্য লাইন দৌড় আর গোল করার দক্ষতা দেখে সম্মোহিত হয়েছিলাম একটি সংবাদপত্রের ট্রেনি জার্নালিস্ট আমিও৷ রাত জেগে ম্যাচ দেখার উন্মাদনাটাই ছিল আলাদা৷ তখন কি ভেবেছিলাম, ঠিক বারো বছর পরে রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সে আমার কয়েক হাত দূরে বসে আর্জেন্তিনার একটি কাগজের জন্য বিশ্বকাপ কভার করবেন আমাদেরই সেই হিরো মারিও কেম্পেস?
১৯৯০ সালে ইতালিয়া-৯০ কভার করার সুযোগটি আচম্বিতে এসে গেল আমার কাছে৷ তখন যে খবরের কাগজে কাজ করতাম, সেই কাগজের নিউজ এডিটর আমাকে ডেকে বললেন, ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও৷ তোমাকে ইতালিতে বিশ্বকাপ কভার করতে যেতে হবে৷ নিজের গায়ে চিমটি কেটে পরখ করেছিলাম, জেগে আছি না ঘুমিয়ে আছি? তার আগে অবশ্য বিদেশে ফুটবল করতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল৷ ১৯৮৪ সালে খবরের কাগজের কনিষ্ঠতম সাংবাদিক হিসেবে আমাকে কেন যে সিঙ্গাপুরে এশিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ কভার করতে পাঠানো হয়েছিল তা বোধগম্য হয়নি৷ ১৯৮৮ সালে সাংবাদিকতার বৃত্তি নিয়ে ঘুরে এসেছি জার্মানি, ইংল্যান্ডেও৷ জার্মানিতে থাকার সময় কভার করেছি ইউরোপিয়ান কাপও৷ কিন্ত্ত তা বলে একেবারে বিশ্বকাপ, গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ?
কিন্ত্ত 'যাব' বললেই তো আর বিশ্বকাপ কভার করা যায় না৷ হাজার বায়নাক্কা৷ ফিফার কাছ থেকে অ্যাক্রিডিটেশন পেতে হবে৷ বিদেশি মুদ্রার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমোদন পেতে হবে৷ অর্থাত্ সাত মণ তেল পুড়লে তবে রাধা নাচবে৷ মুশকিল আসান হয়ে দেখা দিলেন তদানীন্তন অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি৷ প্রিয়দার বদান্যতায় সব বাধাই টপকে গেলাম৷ তারপর কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিমানে সোজা রোম৷ একদম লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এয়ারপোর্ট৷
এয়ারপোর্ট থেকেই চক্ষু চড়কগাছ৷ বিরাট বিরাট বিলবোর্ড৷ কোথাও ফিফার অ্যাম্বাসেডর পেলে স্বাগত জানাচ্ছেন বিশ্বকাপ অতিথিদের, কোথাও আবার দিয়েগো মারাদোনার বিরাট কাটআউট৷ কলকাতার এক ছাপোষা যুবক যেন ফুটবলের মহাসিন্ধুতে৷ বিমানবন্দরেই ফিফার স্কাউট আলিয়ানা নামের একটি মেয়ে আমার কাছে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড চাইল৷ ও হরি! কার্ড পাব কোথায়? আমার তো অ্যাক্রিডিটেশনই হয়নি৷ প্রিয়দা একটা চিঠি ফিফার মিডিয়া ডিরেক্টর গুইদো তোগননির নামে৷ সেই চিঠি তাঁকে দেখালে নাকি আমার অ্যাক্রিটিডেশন কার্ড হবে৷ আলিয়ানাকে সে কথা বলতে সে বিস্তর মাথাটাথা নেড়ে তার সেল ফোনে কাকে যেন ধরল৷ তার পর হাসিমুখে তাকিয়ে বলল, অলিম্পিক স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টারে চলে যাও৷ তোমার কার্ড রেডি৷
বলে তো দিল৷ যাব কীভাবে? বিদেশে আগে গিয়ে বুঝেছি ট্যাক্সিতে চড়লেই পকেট সাফ৷ কিন্ত্ত পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে৷ অতএব কপাল ঠুকে উঠেই পড়লাম ট্যাক্সিতে৷ ওয়ার্ল্ড কাপের মিডিয়া সেন্টার বলতেই ট্যাক্সি ড্রাইভার বুঝে গেল৷ আমাকে পৌঁছেও দিল অলিম্পিক স্টেডিয়ামে৷ আর শুরু হয়ে গেল আমার বিশ্বদর্শন৷ একহাতে স্যুটকেশ, অন্য হাতে পাসপোর্ট নিয়ে আমি দাঁড়ালাম মিডিয়া সেন্টার নামক এক মহাদেশের সামনে৷ এর আগে ইউরোপিয়ান কাপের মিডিয়া সেন্টার দেখেছি৷ কিন্ত্ত বিশ্বকাপের মিডিয়া সেন্টারের সঙ্গে তার কোনও তুলনাই হয় না৷ কী নেই মিডিয়া সেন্টারে? ব্যাঙ্ক, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, পানশালা, ফিটনেস ট্রেনিং সেন্টার আর সারি সারি ওয়ার্ক স্টেশন৷ বত্রিশটি দেশ বিশ্বকাপ খেলে, কিন্ত্ত বিশ্বকাপ কভার করতে আসেন দেড়শোরও বেশি দেশের সাংবাদিক৷ তাই মিডিয়া সেন্টারটাকেই মনে হয় এক টুকরো পৃথিবী৷
মিডিয়া সেন্টারের ভিতর আবার আলাদা আলাদা অফিস৷ রয়টার্সের বিশাল অফিসে কর্মব্যস্ততা, এএফপির অফিসে রীতিমতো হইচই৷ ওয়াশিংটন পোস্ট বা নিউইয়র্ক টাইমসের অফিসে ২৮ ঘণ্টা সাংবাদিকদের ভিড়৷ অন্য দিকে বিশ্বের প্রথম সারির সব টিভি সংস্থার অফিস ও স্টুডিও৷ যা দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ৷ সেন্টারে ঢুকেই সন্ধানী চোখে দেখে নিলাম ভারতীয় সাংবাদিকরা এককোণে টিমটিম করে জ্বলছে৷ ওখানে কয়েকজন কলকাতার সাংবাদিকের সঙ্গেও দেখা হল৷ ব্যস, ওটাই হয়ে আমাদের ইন্ডিয়ান কর্নার৷ রোজই আমরা মিডিয়া সেন্টারে ওই জায়গায় গিয়ে বসতাম৷ ফোটো জার্নালিস্ট অমিয় তরফদার একদিন ওই জায়গায় একটা ভারতের তেরঙা পতাকা লাগিয়ে দিলেন৷ তারপর থেকেই ওই জায়গাটা বিশ্বকাপ কভার করতে আসা সব ভারতীয়র কাছে হয়ে দাঁড়াল আল্টিমেট ডেস্টিনেশন৷
সে বার বিশ্বকাপে মারাদোনাকে ঘিরে কম হইচই হয়নি৷ বিশেষ করে ইতালির ড্রাগ মাফিয়াদের সঙ্গে মারাদোনার ঝামেলা তো ইন্টারন্যাশনাল হেডলাইনস হয়েছিল৷ তবে আজকের এই প্রতিবেদনে ১৯৯০-এর খেলা কেমন হয়েছিল সেই বর্ণনায় না গিয়ে কয়েকটা ছোট ঘটনা শুনিয়ে দিই৷ রোমের ভ্যাটিকানে এক সন্ধ্যায় দু'জনকে মোহনবাগান জার্সি পরে ঘুরতে দেখে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ছুটে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম ওই দু'জন আর কেউ নন, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ও বর্তামে রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়৷ ইতালির ভিয়া বেনিত্তোর একটি স্কোয়ারে ফোয়ারার চারটি মুখে আমাজন, নাইল, টাইগ্রিসের সঙ্গে গঙ্গার নাম শুনে শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম৷ নাপোলিতে ইতালি-আর্জেন্তিনা ম্যাচ দেখতে যাওয়ার সময় বাংলাদেশের সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরিকে দিব্যি ল্যাং মেরে এক মাফিয়ার ছোটভাই তাঁকে আবার তুলে রেসকিউ করে কীভাবে পকেট মেরেছিল তা দেখে চোখ কপালে উঠেছিল৷
আর কী করে সেই বৃদ্ধার কথা ভুলব? যিনি কাপিতাল হোটেলের সামনে একটি কিয়স্কে দাঁড়িয়ে চার ডলারে মুরগি ভাজা বিক্রি করতেন৷ যাঁকে 'চিকেন' কথাটা বোঝাতে আমায় মুরগির মতো কঁক কঁক করে ডাকতে হয়েছিল৷ আর তিনি 'পোলি' 'পোলি' বলে মুরগি ব্যাপারটা বুঝেছেন বলতে চেয়েছিলেন৷ এই বৃদ্ধাকে ভুলব না৷ কারণ আর্জেন্তিনার কাছে ইতালি হারার পর নাপোলি থেকে রাতে যখন ফিরছি, তখন কিয়স্কে বসে সেই বৃদ্ধা করুণস্বরে বলেছিলেন, 'আজ ইতালি হারায় দেশের শোকের দিন৷ কেউ একটাও 'পোলি' কেনেনি৷ তোমাদের দু' ডলারে 'পোলি' দিচ্ছি৷'
স্তব্ধ, শোকাহত রোমের রাজপথে সে দিন কোনও রূপসী ছিল না৷ ছিল সেই বৃদ্ধার হতাশ মুখের রেখা৷ এই হল বিশ্বকাপ৷ কারও কাছে ধর্ম, কারও কাছে আত্মা৷
সালটা ছিল ১৯৭৮৷ সেই প্রথম ভারতের মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলা দেখলেন৷ তার আগে আন্তর্জাতিক ফুটবল দেখা তো দূরে থাক, সে ভাবে খবরাখবরও পাওয়া যেত না৷ ১৯৭৮ সালে অবশ্য টেলিভিশন দু-একটা ম্যাচ ছাড়া আর কোনও ম্যাচের লাইভ টেলিকাস্ট করেনি৷ কিন্ত্ত তাতেই হইচই পড়ে গিয়েছিল ফুটবল ভক্তদের মধ্যে৷
কলকাতার ফুটবলে তখন দাপটে রাজ করছে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব৷ এই সব ক্লাবের তারকারা রীতিমতো হিরো অনেকেরই কাছে৷ কিন্ত্ত টেলিভিশনে বিশ্বকাপের খেলা দেখার পর এই হিরো ওয়ারশিপের ব্যাপারটিতে কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগল৷ মনে আছে, আর্জেন্তিনার সুপারস্টার মারিও কেম্পেসের খেলা দেখে উত্তাল হয়ে গিয়েছিল কলকাতা, নাকি গোটা বাংলাই! সুদর্শন এই ফুটবলারের ডাউন দ্য লাইন দৌড় আর গোল করার দক্ষতা দেখে সম্মোহিত হয়েছিলাম একটি সংবাদপত্রের ট্রেনি জার্নালিস্ট আমিও৷ রাত জেগে ম্যাচ দেখার উন্মাদনাটাই ছিল আলাদা৷ তখন কি ভেবেছিলাম, ঠিক বারো বছর পরে রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামের প্রেস বক্সে আমার কয়েক হাত দূরে বসে আর্জেন্তিনার একটি কাগজের জন্য বিশ্বকাপ কভার করবেন আমাদেরই সেই হিরো মারিও কেম্পেস?
১৯৯০ সালে ইতালিয়া-৯০ কভার করার সুযোগটি আচম্বিতে এসে গেল আমার কাছে৷ তখন যে খবরের কাগজে কাজ করতাম, সেই কাগজের নিউজ এডিটর আমাকে ডেকে বললেন, ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও৷ তোমাকে ইতালিতে বিশ্বকাপ কভার করতে যেতে হবে৷ নিজের গায়ে চিমটি কেটে পরখ করেছিলাম, জেগে আছি না ঘুমিয়ে আছি? তার আগে অবশ্য বিদেশে ফুটবল করতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল৷ ১৯৮৪ সালে খবরের কাগজের কনিষ্ঠতম সাংবাদিক হিসেবে আমাকে কেন যে সিঙ্গাপুরে এশিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ কভার করতে পাঠানো হয়েছিল তা বোধগম্য হয়নি৷ ১৯৮৮ সালে সাংবাদিকতার বৃত্তি নিয়ে ঘুরে এসেছি জার্মানি, ইংল্যান্ডেও৷ জার্মানিতে থাকার সময় কভার করেছি ইউরোপিয়ান কাপও৷ কিন্ত্ত তা বলে একেবারে বিশ্বকাপ, গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ?
কিন্ত্ত 'যাব' বললেই তো আর বিশ্বকাপ কভার করা যায় না৷ হাজার বায়নাক্কা৷ ফিফার কাছ থেকে অ্যাক্রিডিটেশন পেতে হবে৷ বিদেশি মুদ্রার জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমোদন পেতে হবে৷ অর্থাত্ সাত মণ তেল পুড়লে তবে রাধা নাচবে৷ মুশকিল আসান হয়ে দেখা দিলেন তদানীন্তন অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি৷ প্রিয়দার বদান্যতায় সব বাধাই টপকে গেলাম৷ তারপর কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিমানে সোজা রোম৷ একদম লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এয়ারপোর্ট৷
এয়ারপোর্ট থেকেই চক্ষু চড়কগাছ৷ বিরাট বিরাট বিলবোর্ড৷ কোথাও ফিফার অ্যাম্বাসেডর পেলে স্বাগত জানাচ্ছেন বিশ্বকাপ অতিথিদের, কোথাও আবার দিয়েগো মারাদোনার বিরাট কাটআউট৷ কলকাতার এক ছাপোষা যুবক যেন ফুটবলের মহাসিন্ধুতে৷ বিমানবন্দরেই ফিফার স্কাউট আলিয়ানা নামের একটি মেয়ে আমার কাছে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড চাইল৷ ও হরি! কার্ড পাব কোথায়? আমার তো অ্যাক্রিডিটেশনই হয়নি৷ প্রিয়দা একটা চিঠি ফিফার মিডিয়া ডিরেক্টর গুইদো তোগননির নামে৷ সেই চিঠি তাঁকে দেখালে নাকি আমার অ্যাক্রিটিডেশন কার্ড হবে৷ আলিয়ানাকে সে কথা বলতে সে বিস্তর মাথাটাথা নেড়ে তার সেল ফোনে কাকে যেন ধরল৷ তার পর হাসিমুখে তাকিয়ে বলল, অলিম্পিক স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টারে চলে যাও৷ তোমার কার্ড রেডি৷
বলে তো দিল৷ যাব কীভাবে? বিদেশে আগে গিয়ে বুঝেছি ট্যাক্সিতে চড়লেই পকেট সাফ৷ কিন্ত্ত পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে৷ অতএব কপাল ঠুকে উঠেই পড়লাম ট্যাক্সিতে৷ ওয়ার্ল্ড কাপের মিডিয়া সেন্টার বলতেই ট্যাক্সি ড্রাইভার বুঝে গেল৷ আমাকে পৌঁছেও দিল অলিম্পিক স্টেডিয়ামে৷ আর শুরু হয়ে গেল আমার বিশ্বদর্শন৷ একহাতে স্যুটকেশ, অন্য হাতে পাসপোর্ট নিয়ে আমি দাঁড়ালাম মিডিয়া সেন্টার নামক এক মহাদেশের সামনে৷ এর আগে ইউরোপিয়ান কাপের মিডিয়া সেন্টার দেখেছি৷ কিন্ত্ত বিশ্বকাপের মিডিয়া সেন্টারের সঙ্গে তার কোনও তুলনাই হয় না৷ কী নেই মিডিয়া সেন্টারে? ব্যাঙ্ক, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, পানশালা, ফিটনেস ট্রেনিং সেন্টার আর সারি সারি ওয়ার্ক স্টেশন৷ বত্রিশটি দেশ বিশ্বকাপ খেলে, কিন্ত্ত বিশ্বকাপ কভার করতে আসেন দেড়শোরও বেশি দেশের সাংবাদিক৷ তাই মিডিয়া সেন্টারটাকেই মনে হয় এক টুকরো পৃথিবী৷
মিডিয়া সেন্টারের ভিতর আবার আলাদা আলাদা অফিস৷ রয়টার্সের বিশাল অফিসে কর্মব্যস্ততা, এএফপির অফিসে রীতিমতো হইচই৷ ওয়াশিংটন পোস্ট বা নিউইয়র্ক টাইমসের অফিসে ২৮ ঘণ্টা সাংবাদিকদের ভিড়৷ অন্য দিকে বিশ্বের প্রথম সারির সব টিভি সংস্থার অফিস ও স্টুডিও৷ যা দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ৷ সেন্টারে ঢুকেই সন্ধানী চোখে দেখে নিলাম ভারতীয় সাংবাদিকরা এককোণে টিমটিম করে জ্বলছে৷ ওখানে কয়েকজন কলকাতার সাংবাদিকের সঙ্গেও দেখা হল৷ ব্যস, ওটাই হয়ে আমাদের ইন্ডিয়ান কর্নার৷ রোজই আমরা মিডিয়া সেন্টারে ওই জায়গায় গিয়ে বসতাম৷ ফোটো জার্নালিস্ট অমিয় তরফদার একদিন ওই জায়গায় একটা ভারতের তেরঙা পতাকা লাগিয়ে দিলেন৷ তারপর থেকেই ওই জায়গাটা বিশ্বকাপ কভার করতে আসা সব ভারতীয়র কাছে হয়ে দাঁড়াল আল্টিমেট ডেস্টিনেশন৷
সে বার বিশ্বকাপে মারাদোনাকে ঘিরে কম হইচই হয়নি৷ বিশেষ করে ইতালির ড্রাগ মাফিয়াদের সঙ্গে মারাদোনার ঝামেলা তো ইন্টারন্যাশনাল হেডলাইনস হয়েছিল৷ তবে আজকের এই প্রতিবেদনে ১৯৯০-এর খেলা কেমন হয়েছিল সেই বর্ণনায় না গিয়ে কয়েকটা ছোট ঘটনা শুনিয়ে দিই৷ রোমের ভ্যাটিকানে এক সন্ধ্যায় দু'জনকে মোহনবাগান জার্সি পরে ঘুরতে দেখে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ছুটে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম ওই দু'জন আর কেউ নন, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ও বর্তামে রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়৷ ইতালির ভিয়া বেনিত্তোর একটি স্কোয়ারে ফোয়ারার চারটি মুখে আমাজন, নাইল, টাইগ্রিসের সঙ্গে গঙ্গার নাম শুনে শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম৷ নাপোলিতে ইতালি-আর্জেন্তিনা ম্যাচ দেখতে যাওয়ার সময় বাংলাদেশের সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরিকে দিব্যি ল্যাং মেরে এক মাফিয়ার ছোটভাই তাঁকে আবার তুলে রেসকিউ করে কীভাবে পকেট মেরেছিল তা দেখে চোখ কপালে উঠেছিল৷
আর কী করে সেই বৃদ্ধার কথা ভুলব? যিনি কাপিতাল হোটেলের সামনে একটি কিয়স্কে দাঁড়িয়ে চার ডলারে মুরগি ভাজা বিক্রি করতেন৷ যাঁকে 'চিকেন' কথাটা বোঝাতে আমায় মুরগির মতো কঁক কঁক করে ডাকতে হয়েছিল৷ আর তিনি 'পোলি' 'পোলি' বলে মুরগি ব্যাপারটা বুঝেছেন বলতে চেয়েছিলেন৷ এই বৃদ্ধাকে ভুলব না৷ কারণ আর্জেন্তিনার কাছে ইতালি হারার পর নাপোলি থেকে রাতে যখন ফিরছি, তখন কিয়স্কে বসে সেই বৃদ্ধা করুণস্বরে বলেছিলেন, 'আজ ইতালি হারায় দেশের শোকের দিন৷ কেউ একটাও 'পোলি' কেনেনি৷ তোমাদের দু' ডলারে 'পোলি' দিচ্ছি৷'
স্তব্ধ, শোকাহত রোমের রাজপথে সে দিন কোনও রূপসী ছিল না৷ ছিল সেই বৃদ্ধার হতাশ মুখের রেখা৷ এই হল বিশ্বকাপ৷ কারও কাছে ধর্ম, কারও কাছে আত্মা৷
No comments:
Post a Comment