লাল-নীল-সবুজ পুলিশের কাণ্ড ফ্রাঙ্কফুর্টের গ্যালারিতে
, Ei Samay
সুব্রত দত্ত
এক দল ফুটবল গুন্ডা গ্যালারিতে তুমুল অসভ্যতা করছে, আর তাদের থামাতে সবুজ অ্যাপ্রন পরা বেশ কিছু পুলিশ কাকুতি-মিনতি করছে! জন্মেও এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখিনি৷
এই দৃশ্যই দেখতে হয়েছিল ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে৷ ফ্রাঙ্কফুর্টে সে দিন কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল-ফ্রান্স৷ ম্যাচ দেখার আগ্রহ ছিলই, তবে আমি বেশি উত্সুক ছিলাম বিশ্বকাপ ম্যাচের সংগঠনিক ও প্রশাসনিক দিকটা দেখার জন্যও৷ কিন্ত্ত মাঠে ঢুকে ওই ফুটবল গুন্ডাদের আচরণ ও তাদের থামাতে পুলিশের ভূমিকা দেখে অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম৷
দেখেছিলাম তিন রকম পোশাকের পুলিশ৷
এক দল মদ্যপ বিশাল চেহারার লোক গ্যালারির অনেকটা অংশ জুড়ে দাপাচ্ছিল৷ কেউ মন দিয়ে খেলা দেখলে তার গায়ে বিয়ার ছিটিয়ে দিচ্ছিল৷ কেউ প্রতিবাদ করলে ঘাড়ে পড়ে অহেতুক কোঁতকা মারছিল৷ মেয়েদের দিকে তাকিয়ে অশ্লীলভাবে মুখে আওয়াজ করছে৷ সবুজ অ্যাপ্রন পরা পুলিশরা যখন তাদের থামাতে পারল না, তখন গ্যালারিতে উঠে এল নীল অ্যাপ্রনের পুলিশ৷ এই পুলিশ একটু কড়া৷ গুন্ডাদের ধমক টমক দেওয়ায় তারা সাময়িকভাবে থামল বটে, কিন্ত্ত একটু পরেই ফের স্বমূর্তিতে৷ এ বারই দেখলাম চমকটা৷ গ্যালারি বেয়ে উঠে এল লাল অ্যাপ্রনের পুলিশ৷ গুন্ডাগুলোকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে প্রায় টুঁটি চেপে ধরে চ্যাংদোলা করে গ্যালারি থেকে নিয়ে চলে গেল৷ কোনও ঝামেলা ছাড়াই৷
তিন রংয়ের পুলিশ দেখতে দেখতে মন চলে যাচ্ছিল যুবভারতীতে৷ আমাদের কলকাতার স্টেডিয়ামে কোনও ঝামেলা হলেই পুলিশ হুড়মুড়িয়ে গ্যালারিতে উঠে লাঠিচার্জ করতে থাকে৷ তাতে ঝামেলাবাজরা যত না মার খায়, তার থেকে নিরীহ মানুষেরই হাত-পা ভাঙে, মাথা ফাটে বেশি৷ গ্যালারি জুড়ে আতঙ্ক ছড়ায়৷ খেলা দেখার মজাটাই মাটি হয়ে যায়৷ কিন্ত্ত ফ্রাঙ্কফুর্টের গ্যালারিতে আতঙ্ক ছড়াল না, খেলা দেখার মজাও মাটি হল না৷ শুধু প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিল পুলিশ তিন রকম পদ্ধতিতে৷ প্রথমে অনুরোধ, পরে নির্দেশ৷ এবং শেষে ঠিক দোষীকে চিহ্নিত করে মাঠের বাইরে বার করে দেওয়া৷
আসলে বিশ্বকাপ করার ক্ষেত্রে ফিফার নানাবিধ নির্দেশের মধ্যে বেশি গুরুত্ব পায় দর্শক স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার ব্যাপারটা৷ মনে পড়ছে ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের কথা৷ এই দেশে প্রতিটা পদক্ষেপে চুরি-ছিনতাই ও প্রাণনাশ আশঙ্কা ছিল৷ পথেঘাটে মেয়ে-লুঠেরারা ছিল সাঙ্ঘাতিক৷ কিন্ত্ত মাঠের মধ্যে কখনও নিরাপত্তার অভাব বোধ করতেন না দর্শকরা৷ অনেক রাতেও স্টেডিয়ামের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলে মনে হত, নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে এসে গিয়েছি৷ জার্মানি বলুন বা দক্ষিণ আফ্রিকা, সব জায়গাতেই গ্যালারিতে বলে খেলা দেখাটা আমাদের এখানে মাল্টিপ্লেক্সে বসে সিনেমা দেখার মতোই সুখের, স্বস্তির৷
বিশ্বকাপের ভিআইপি গ্যালারিতে বসে খেলা দেখার সূত্রে আরও একটা কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে৷ সেটা হল দর্শকদের উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা৷ আমি ভারতের বিভিন্ন ফুটবল মাঠ তো বটেই প্রচুর ক্রিকেট মাঠে ভিআইপি বক্সে বসে খেলা দেখার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এখানে যাঁরা ভিআইপি হন, তাঁরা মাঠে এসেও 'রামগরুড়ের ছানা' হয়ে থাকেন৷ যেন ম্যাচ দেখে উচ্ছ্বাস দেখানো বা নাচানাচি করে ফেললে ভিআইপিত্ব নষ্ট হয়ে যাবে৷ কিন্ত্ত জার্মানি, আফ্রিকার ভিআইপি বক্সে দেখেছি বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, আমলারা তো বটেই, ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট, এমন কী রাষ্ট্রনায়করাও খেলা দেখতে দেখতে শিশুর মতো হয়ে যান৷ প্লাতিনি, বেকেনবাউয়ারের মতো বরেণ্যরাও এর ব্যতিক্রম নন৷ তিনি ভিআইপি, এটা ম্যাচ দেখতে দেখতে সকলে ভুলে যান৷ কেউ নাচেন, কেউ গান গান, কেউ আনন্দে কেঁদেও ভাসান৷ আবার পাশে বসা মহিলা দর্শককে জড়িয়ে কেউ আবেগে চুমুও খান৷ থাকে শুধু আবেগ-উচ্ছ্বাস আর দিলখোলা আনন্দ৷
দুটো বিশ্বকাপের সংগঠন ও প্রশাসন দেখে আসার পর আমি আমাদের দেশের ফুটবল সংগঠন ও প্রশাসনকে তাদের তুলনায় ২৫ শতাংশের বেশি নম্বর দিতে পারছি না৷ আশা করছি ২০১৭ সালের যুব বিশ্বকাপে আমরা ৬০ শতাংশ জায়গায় পৌঁছতে পারব৷ আমাদের এখনই কাজ শুরু করা দরকার৷ এআইএফএফের দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমরা সে কাজটা শুরু করতে পারিনি নানা আইনি জটিলতায়৷ ভয় হয়, যদি আমরা এই তিন বছরের মধ্যে কাজটা করতে না পারি, তাহলে আগামী দিনে ভারতীয় হিসেবে বিশ্ব ফুটবলমহলে মুখ দেখাতে পারব না৷ (লেখক সর্বভারতীয় ফুটবল সংস্থার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট)
এক দল ফুটবল গুন্ডা গ্যালারিতে তুমুল অসভ্যতা করছে, আর তাদের থামাতে সবুজ অ্যাপ্রন পরা বেশ কিছু পুলিশ কাকুতি-মিনতি করছে! জন্মেও এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখিনি৷
এই দৃশ্যই দেখতে হয়েছিল ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে৷ ফ্রাঙ্কফুর্টে সে দিন কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল-ফ্রান্স৷ ম্যাচ দেখার আগ্রহ ছিলই, তবে আমি বেশি উত্সুক ছিলাম বিশ্বকাপ ম্যাচের সংগঠনিক ও প্রশাসনিক দিকটা দেখার জন্যও৷ কিন্ত্ত মাঠে ঢুকে ওই ফুটবল গুন্ডাদের আচরণ ও তাদের থামাতে পুলিশের ভূমিকা দেখে অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম৷
দেখেছিলাম তিন রকম পোশাকের পুলিশ৷
এক দল মদ্যপ বিশাল চেহারার লোক গ্যালারির অনেকটা অংশ জুড়ে দাপাচ্ছিল৷ কেউ মন দিয়ে খেলা দেখলে তার গায়ে বিয়ার ছিটিয়ে দিচ্ছিল৷ কেউ প্রতিবাদ করলে ঘাড়ে পড়ে অহেতুক কোঁতকা মারছিল৷ মেয়েদের দিকে তাকিয়ে অশ্লীলভাবে মুখে আওয়াজ করছে৷ সবুজ অ্যাপ্রন পরা পুলিশরা যখন তাদের থামাতে পারল না, তখন গ্যালারিতে উঠে এল নীল অ্যাপ্রনের পুলিশ৷ এই পুলিশ একটু কড়া৷ গুন্ডাদের ধমক টমক দেওয়ায় তারা সাময়িকভাবে থামল বটে, কিন্ত্ত একটু পরেই ফের স্বমূর্তিতে৷ এ বারই দেখলাম চমকটা৷ গ্যালারি বেয়ে উঠে এল লাল অ্যাপ্রনের পুলিশ৷ গুন্ডাগুলোকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে প্রায় টুঁটি চেপে ধরে চ্যাংদোলা করে গ্যালারি থেকে নিয়ে চলে গেল৷ কোনও ঝামেলা ছাড়াই৷
তিন রংয়ের পুলিশ দেখতে দেখতে মন চলে যাচ্ছিল যুবভারতীতে৷ আমাদের কলকাতার স্টেডিয়ামে কোনও ঝামেলা হলেই পুলিশ হুড়মুড়িয়ে গ্যালারিতে উঠে লাঠিচার্জ করতে থাকে৷ তাতে ঝামেলাবাজরা যত না মার খায়, তার থেকে নিরীহ মানুষেরই হাত-পা ভাঙে, মাথা ফাটে বেশি৷ গ্যালারি জুড়ে আতঙ্ক ছড়ায়৷ খেলা দেখার মজাটাই মাটি হয়ে যায়৷ কিন্ত্ত ফ্রাঙ্কফুর্টের গ্যালারিতে আতঙ্ক ছড়াল না, খেলা দেখার মজাও মাটি হল না৷ শুধু প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিল পুলিশ তিন রকম পদ্ধতিতে৷ প্রথমে অনুরোধ, পরে নির্দেশ৷ এবং শেষে ঠিক দোষীকে চিহ্নিত করে মাঠের বাইরে বার করে দেওয়া৷
আসলে বিশ্বকাপ করার ক্ষেত্রে ফিফার নানাবিধ নির্দেশের মধ্যে বেশি গুরুত্ব পায় দর্শক স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার ব্যাপারটা৷ মনে পড়ছে ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের কথা৷ এই দেশে প্রতিটা পদক্ষেপে চুরি-ছিনতাই ও প্রাণনাশ আশঙ্কা ছিল৷ পথেঘাটে মেয়ে-লুঠেরারা ছিল সাঙ্ঘাতিক৷ কিন্ত্ত মাঠের মধ্যে কখনও নিরাপত্তার অভাব বোধ করতেন না দর্শকরা৷ অনেক রাতেও স্টেডিয়ামের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলে মনে হত, নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে এসে গিয়েছি৷ জার্মানি বলুন বা দক্ষিণ আফ্রিকা, সব জায়গাতেই গ্যালারিতে বলে খেলা দেখাটা আমাদের এখানে মাল্টিপ্লেক্সে বসে সিনেমা দেখার মতোই সুখের, স্বস্তির৷
বিশ্বকাপের ভিআইপি গ্যালারিতে বসে খেলা দেখার সূত্রে আরও একটা কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে৷ সেটা হল দর্শকদের উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা৷ আমি ভারতের বিভিন্ন ফুটবল মাঠ তো বটেই প্রচুর ক্রিকেট মাঠে ভিআইপি বক্সে বসে খেলা দেখার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এখানে যাঁরা ভিআইপি হন, তাঁরা মাঠে এসেও 'রামগরুড়ের ছানা' হয়ে থাকেন৷ যেন ম্যাচ দেখে উচ্ছ্বাস দেখানো বা নাচানাচি করে ফেললে ভিআইপিত্ব নষ্ট হয়ে যাবে৷ কিন্ত্ত জার্মানি, আফ্রিকার ভিআইপি বক্সে দেখেছি বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, আমলারা তো বটেই, ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট, এমন কী রাষ্ট্রনায়করাও খেলা দেখতে দেখতে শিশুর মতো হয়ে যান৷ প্লাতিনি, বেকেনবাউয়ারের মতো বরেণ্যরাও এর ব্যতিক্রম নন৷ তিনি ভিআইপি, এটা ম্যাচ দেখতে দেখতে সকলে ভুলে যান৷ কেউ নাচেন, কেউ গান গান, কেউ আনন্দে কেঁদেও ভাসান৷ আবার পাশে বসা মহিলা দর্শককে জড়িয়ে কেউ আবেগে চুমুও খান৷ থাকে শুধু আবেগ-উচ্ছ্বাস আর দিলখোলা আনন্দ৷
দুটো বিশ্বকাপের সংগঠন ও প্রশাসন দেখে আসার পর আমি আমাদের দেশের ফুটবল সংগঠন ও প্রশাসনকে তাদের তুলনায় ২৫ শতাংশের বেশি নম্বর দিতে পারছি না৷ আশা করছি ২০১৭ সালের যুব বিশ্বকাপে আমরা ৬০ শতাংশ জায়গায় পৌঁছতে পারব৷ আমাদের এখনই কাজ শুরু করা দরকার৷ এআইএফএফের দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমরা সে কাজটা শুরু করতে পারিনি নানা আইনি জটিলতায়৷ ভয় হয়, যদি আমরা এই তিন বছরের মধ্যে কাজটা করতে না পারি, তাহলে আগামী দিনে ভারতীয় হিসেবে বিশ্ব ফুটবলমহলে মুখ দেখাতে পারব না৷ (লেখক সর্বভারতীয় ফুটবল সংস্থার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট)
No comments:
Post a Comment