সুরজিৎ সেনগুপ্ত: ১৯৮০ সাল। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের তৎকালীন কর্মকর্তারা বাঙালি প্লেয়ারদের দল থেকে তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। কিছু প্লেয়ারকে তো বলে দেওয়াও হয়েছিল যে, তাদের আর দরকার নেই।
নিরুপায় হয়ে আমরা কয়েকজন প্লেয়ার একসঙ্গে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডান স্পোর্টিং–এ চলে গিয়েছিলাম।
আমাদের ছেড়ে আসা জায়গায় কলকাতার কিছু প্লেয়ারকে নিল ইস্টবেঙ্গল। এ ছাড়াও তিনজন বিদেশি এসে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দিল। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরান থেকে পড়তে এসেছিল তিনজন— মজিদ, জামশিদ আর খাবাজি। এই তিনজনই ছিল ফুটবলার। খোঁজ পেয়ে ইস্টবেঙ্গল তিনজনকেই সই করাল। তারা কেমন প্লেয়ার, সে সম্পর্কে কারওরই কোনও ধারণা ছিল না। দলের সঙ্গে অনুশীলন শুরু করার পর ধীরে ধীরে বোঝা গেল কে কেমন। খাবাজি খেলত মিডফিল্ডে। আর জামশিদ আর মজিদ খেলত স্ট্রাইকারে।
কিছুদিন পরে বোঝা গেল খাবাজি আর জামশিদ মোটামুটি সাধারণ মানের ফুটবলার। কিন্তু মজিদের অনুশীলন দেখেই অনুমান করা যাচ্ছিল, সে অসাধারণ। আমি মহমেডানের হয়ে দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেই হাঁটুতে আঘাত পেলাম। হাঁটুতে অপারেশন করতে হল। আহত অবস্থায় বাড়িতে বসেই শুনতে পাচ্ছিলাম এবং কাগজে পড়ছিলাম মজিদের কথা।
যেদিন ওকে প্রথম খেলতে দেখলাম, সেদিন প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বল নিয়ে দৌড়বার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল, মজিদ একজন আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার। বল নিয়ে দৌড়বার স্টাইল, ড্রিবলিং, শুটিং— সবই ছিল অসাধারণ!
খুব অল্প দিনের মধ্যেই মজিদ হয়ে উঠল ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের নয়নের মণি। যতই মজিদকে দেখছিলাম তত অনুতাপ হচ্ছিল। শুধু ভাবতাম, যদি ইস্টবেঙ্গল ছাড়তে বাধ্য না হতাম, তাহলে মজিদের সঙ্গে একই দলে লাল–হলুদ জার্সি গায়ে খেলতে পারতাম। মজিদের নিখুঁত পাস করার যে দক্ষতা, তার সুবাদেই জামশিদ একের পর এক গোল পাচ্ছিল। মনে হত, আমি থাকলে অবশ্যই প্রচুর গোল করতাম ওর পাস থেকে। মজিদের সঙ্গে না খেলতে পারার আফশোসটা থেকেই গেছে।
মজিদ ইস্টবেঙ্গলের হয়ে যখন দ্বিতীয় বছর খেলছে, তখন থেকেই অবশ্য ধীরে ধীরে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠতে থাকে। বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে মাদকের অভ্যাস তৈরি হয় ওর। এসব কথা শুনতে শুনতে বারবার ভাবতাম, ইস্টবেঙ্গল ছাড়তে বাধ্য না হলে মজিদকে কিছুতেই এত উচ্ছৃঙ্খল হতে দিতাম না।
এভাবেই সময় কাটছিল মজিদের। খেলার মাঠই ছিল তার একমাত্র মুক্তির জায়গা। জামশিদ বন্ধু হিসেবে মজিদকে অনেকবার সামলাতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর একসময় ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডান স্পোর্টিং–এ যোগ দেয় মজিদ। আমি যদিও মাত্র একবছর মহমেডানে খেলেই মোহনবাগানে চলে গিয়েছিলাম। ফলে মজিদের সঙ্গে একই দলে খেলার সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি। আমি অবসর নিয়ে নেওয়ায় মজিদের বিরুদ্ধেও খেলার সুযোগ সেভাবে হয়নি।
শেষপর্যন্ত ১৯৮৬ সালে মজিদের বিপক্ষে খেলার সুযোগ ঘটে।
কলকাতা ময়দানের খেলা থেকে অবসর নিয়ে শুধু অফিসের হয়ে খেলছিলাম। আর মাঝে মাঝে প্রদর্শনী ম্যাচ। তখন সুভাষ ভৌমিক কোচ হিসেবে কেরিয়ার তৈরির চেষ্টা করছিল। ওর কোচিং জীবনের শুরুটা খুব আশানুরূপ হয়নি। ’৮৬ সালে ও কোচ হল জর্জ টেলিগ্রাফের। আর আমায় এসে অনুরোধ করে জর্জের হয়ে খেলার জন্য। প্রাথমিকভাবে খুবই আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু সুভাষ নাছোড়বান্দা। রাজি করিয়েই ছাড়ল।
সে বছর জর্জ টেলিগ্রাফ দু’বার মহমেডান স্পোর্টিং–এর মুখোমুখি হয়— একবার প্রথম লিগে। আরেকবার ফিরতি লিগে। মজিদ তখন খেলছে মহমেডানে। মাদকের কবল থেকে বেরিয়ে এসে আবার খেলায় মন দিয়েছে। প্রথম লিগে যখন মজিদের বিপক্ষে খেলার সুযোগ এল, তখন মনে মনে ভাবলাম, টক্কর হবে সেয়ানে সেয়ানে।
সে ম্যাচ শেষ হয়েছিল অমীমাংসিত অবস্থায়। সেকেন্ড হাফে একটা বল বুকে রিসিভ করে ভলি মেরেছিল মজিদ। বলটা ক্রসপিসে লেগে ফিরে এসেছিল। কিন্তু পরের দিন খবরের কাগজের শিরোনামে ছিল মজিদেই।
ফিরতি লিগে অবশ্য আমরা মহমেডানকে পরাস্ত করতে সক্ষম হই। এখন এটা বলতে ভাল লাগছে এইজন্য যে, এখনও পর্যন্ত কলকাতায় যেসব বিদেশি খেলে গেছে, জামশিদ–এমেকা–চিমা–ওকোরো–ব্যারেটোদের কথা মাথায় রেখেই বলছি, তাদেরর মধ্যে মজিদ–ই সেরা।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের শতবর্ষে সেই মজিদই আসছে কলকাতায়। শনিবার গভীর রাতেই ওর শহরে এসে নামার কথা। ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও থাকবে ও। সেই সব অনুষ্ঠানে আমিও থাকব। আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা হবে মজিদের। ও আমায় চিনতে পারবে কিনা জানি না। তবে আমাদের মজিদকে চিনে নিতে কোনও অসুবিধে হবে না। শুনেছি দেশে কোচিং করায়। কিন্তু আরও একটা মজিদ কি ও তৈরি করতে পারবে? মনে তো হয় না!
নিরুপায় হয়ে আমরা কয়েকজন প্লেয়ার একসঙ্গে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডান স্পোর্টিং–এ চলে গিয়েছিলাম।
আমাদের ছেড়ে আসা জায়গায় কলকাতার কিছু প্লেয়ারকে নিল ইস্টবেঙ্গল। এ ছাড়াও তিনজন বিদেশি এসে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দিল। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরান থেকে পড়তে এসেছিল তিনজন— মজিদ, জামশিদ আর খাবাজি। এই তিনজনই ছিল ফুটবলার। খোঁজ পেয়ে ইস্টবেঙ্গল তিনজনকেই সই করাল। তারা কেমন প্লেয়ার, সে সম্পর্কে কারওরই কোনও ধারণা ছিল না। দলের সঙ্গে অনুশীলন শুরু করার পর ধীরে ধীরে বোঝা গেল কে কেমন। খাবাজি খেলত মিডফিল্ডে। আর জামশিদ আর মজিদ খেলত স্ট্রাইকারে।
কিছুদিন পরে বোঝা গেল খাবাজি আর জামশিদ মোটামুটি সাধারণ মানের ফুটবলার। কিন্তু মজিদের অনুশীলন দেখেই অনুমান করা যাচ্ছিল, সে অসাধারণ। আমি মহমেডানের হয়ে দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেই হাঁটুতে আঘাত পেলাম। হাঁটুতে অপারেশন করতে হল। আহত অবস্থায় বাড়িতে বসেই শুনতে পাচ্ছিলাম এবং কাগজে পড়ছিলাম মজিদের কথা।
যেদিন ওকে প্রথম খেলতে দেখলাম, সেদিন প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বল নিয়ে দৌড়বার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল, মজিদ একজন আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার। বল নিয়ে দৌড়বার স্টাইল, ড্রিবলিং, শুটিং— সবই ছিল অসাধারণ!
খুব অল্প দিনের মধ্যেই মজিদ হয়ে উঠল ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের নয়নের মণি। যতই মজিদকে দেখছিলাম তত অনুতাপ হচ্ছিল। শুধু ভাবতাম, যদি ইস্টবেঙ্গল ছাড়তে বাধ্য না হতাম, তাহলে মজিদের সঙ্গে একই দলে লাল–হলুদ জার্সি গায়ে খেলতে পারতাম। মজিদের নিখুঁত পাস করার যে দক্ষতা, তার সুবাদেই জামশিদ একের পর এক গোল পাচ্ছিল। মনে হত, আমি থাকলে অবশ্যই প্রচুর গোল করতাম ওর পাস থেকে। মজিদের সঙ্গে না খেলতে পারার আফশোসটা থেকেই গেছে।
মজিদ ইস্টবেঙ্গলের হয়ে যখন দ্বিতীয় বছর খেলছে, তখন থেকেই অবশ্য ধীরে ধীরে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠতে থাকে। বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে মাদকের অভ্যাস তৈরি হয় ওর। এসব কথা শুনতে শুনতে বারবার ভাবতাম, ইস্টবেঙ্গল ছাড়তে বাধ্য না হলে মজিদকে কিছুতেই এত উচ্ছৃঙ্খল হতে দিতাম না।
এভাবেই সময় কাটছিল মজিদের। খেলার মাঠই ছিল তার একমাত্র মুক্তির জায়গা। জামশিদ বন্ধু হিসেবে মজিদকে অনেকবার সামলাতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর একসময় ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডান স্পোর্টিং–এ যোগ দেয় মজিদ। আমি যদিও মাত্র একবছর মহমেডানে খেলেই মোহনবাগানে চলে গিয়েছিলাম। ফলে মজিদের সঙ্গে একই দলে খেলার সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি। আমি অবসর নিয়ে নেওয়ায় মজিদের বিরুদ্ধেও খেলার সুযোগ সেভাবে হয়নি।
শেষপর্যন্ত ১৯৮৬ সালে মজিদের বিপক্ষে খেলার সুযোগ ঘটে।
কলকাতা ময়দানের খেলা থেকে অবসর নিয়ে শুধু অফিসের হয়ে খেলছিলাম। আর মাঝে মাঝে প্রদর্শনী ম্যাচ। তখন সুভাষ ভৌমিক কোচ হিসেবে কেরিয়ার তৈরির চেষ্টা করছিল। ওর কোচিং জীবনের শুরুটা খুব আশানুরূপ হয়নি। ’৮৬ সালে ও কোচ হল জর্জ টেলিগ্রাফের। আর আমায় এসে অনুরোধ করে জর্জের হয়ে খেলার জন্য। প্রাথমিকভাবে খুবই আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু সুভাষ নাছোড়বান্দা। রাজি করিয়েই ছাড়ল।
সে বছর জর্জ টেলিগ্রাফ দু’বার মহমেডান স্পোর্টিং–এর মুখোমুখি হয়— একবার প্রথম লিগে। আরেকবার ফিরতি লিগে। মজিদ তখন খেলছে মহমেডানে। মাদকের কবল থেকে বেরিয়ে এসে আবার খেলায় মন দিয়েছে। প্রথম লিগে যখন মজিদের বিপক্ষে খেলার সুযোগ এল, তখন মনে মনে ভাবলাম, টক্কর হবে সেয়ানে সেয়ানে।
সে ম্যাচ শেষ হয়েছিল অমীমাংসিত অবস্থায়। সেকেন্ড হাফে একটা বল বুকে রিসিভ করে ভলি মেরেছিল মজিদ। বলটা ক্রসপিসে লেগে ফিরে এসেছিল। কিন্তু পরের দিন খবরের কাগজের শিরোনামে ছিল মজিদেই।
ফিরতি লিগে অবশ্য আমরা মহমেডানকে পরাস্ত করতে সক্ষম হই। এখন এটা বলতে ভাল লাগছে এইজন্য যে, এখনও পর্যন্ত কলকাতায় যেসব বিদেশি খেলে গেছে, জামশিদ–এমেকা–চিমা–ওকোরো–ব্যারেটোদের কথা মাথায় রেখেই বলছি, তাদেরর মধ্যে মজিদ–ই সেরা।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের শতবর্ষে সেই মজিদই আসছে কলকাতায়। শনিবার গভীর রাতেই ওর শহরে এসে নামার কথা। ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও থাকবে ও। সেই সব অনুষ্ঠানে আমিও থাকব। আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা হবে মজিদের। ও আমায় চিনতে পারবে কিনা জানি না। তবে আমাদের মজিদকে চিনে নিতে কোনও অসুবিধে হবে না। শুনেছি দেশে কোচিং করায়। কিন্তু আরও একটা মজিদ কি ও তৈরি করতে পারবে? মনে তো হয় না!
No comments:
Post a Comment