রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: প্রিয় দাদুর কথা শুনলে আজও ফুঁপিয়ে ওঠেন তিনি। তিরাশির বৃদ্ধের গলা কেঁপে যায়, চোখ ভিজে যায় অজান্তে। ভারতজোড়া লাল-হলুদ সমর্থকের কাছে সুরেশ চৌধুরি প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁকে লোকে চেনে, জানে। কিন্তু তিরাশির বৃদ্ধের কাছে সুরেশ চৌধুরি শুধুই স্নেহবৎসল পিতামহ যিনি তাঁকে শৈশবে ঘোড়া কিনে দিয়েছিলেন।
[আরও পড়ুন: শতবর্ষে ইস্টবেঙ্গলের স্পর্ধার ১০ মাইলস্টোন জানলে আপনারও গর্ব হবে]
স্মৃতি বড় বিদ্রোহ করে আজ। তিরাশি বছরের দেবেশ চৌধুরি এখন সব কিছু ঠিকঠাক মনে করতে পারেন না। দীর্ঘ জরা-ব্যাধি শরীরের প্রায় সব শক্তি কেড়ে নিয়েছে। ছিনিয়ে নিয়েছে স্মৃতিশক্তিও। পাশ থেকে সহধর্মিনী সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন প্রৌঢ় দেবেশকে, “বারবার এত কাঁদছ কেন? সব গুছিয়ে বলো। দাদু তোমাকে এত ভালবাসত। মনে নেই, ঘোড়া কিনে দিয়েছিল তুমি চড়বে বলে?” ‘দাদুর ভালবাসা’ শব্দবন্ধ শুনে ঈষৎ সম্বিৎ ফেরে যেন। দেবেশ আচমকা বলতে শুরু করেন, “এই যে বাড়িটা দেখছেন, এর নিচেরই একটা ঘরে ইস্টবেঙ্গল প্লেয়াররা থাকতেন ক্লাব তৈরির সময়। দাদু তাঁদের খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে জামাকাপড়, যৎসামান্য অর্থে সব কিছুরই ব্যবস্থা করেছিলেন।” খুব বেশি দিন সুরেশ চৌধুরিকে দেখার সু়যোগ হয়নি পৌত্র দেবেশের। ন’দশ বছর বয়স যখন, দাদু প্রয়াত হন। “ছেলেবেলায় দারুণ যে ইস্টবেঙ্গল নিয়ে কথা হত, তা নয়। তবে এটা ঠিক যে ছোট থেকে তন্ত্রীতে ঢুকে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল।”
“আমাদের বাড়ির পিছনেই জোড়াবাগান ক্লাব। সেখানে ১৯২০ সালে একজন প্লেয়ার ছিলেন নসা সেন। উনি খুব প্রিয় ছিলেন দাদুর,” স্মৃতির সরণি ধরে হাঁটতে শুরু করেন দেবেশ। “ সেই সময় জোড়াবাগান ক্লাব থেকে একদিন নসা সেনকে বাদ দেওয়া হয়। দাদু তখন জোড়াবাগানের ভাইস প্রেসিডেন্ট। নসা সেনকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে জোড়াবাগান থেকে ইস্তফা দেন দাদু। তার পর নসা সেনকে নিয়ে চলে যান কুমোরটুলিতে। ওখানে একজনের সঙ্গে আলোচনা করে দাদু ঠিক করেন যে, নতুন ক্লাব গড়বেন। নাম ঠিক হয়, ইস্টবেঙ্গল!”
লাল-হলুদের প্রথম সব কিছুর কাহিনিও বড় রোমাঞ্চকর। জার্সি বাছাই থেকে শুরু করে টাকা জোগাড়, সব কিছু। শোনা গেল, ধর্মতলার এক দোকান থেকে জার্সি বাছাই হয়েছিল ইস্টবেঙ্গলের। সুরেশ চৌধুরির একটা রং দেখামাত্র পছন্দ হয়ে গিয়েছিল, লাল-হলুদ। কিন্তু যতগুলো জার্সির প্রয়োজন ছিল, প্রথমে তা পাওয়া যায়নি। “দোকানে গিয়ে বাকি জার্সির অর্ডার দিয়ে এসেছিলেন দাদু। আর ইস্টবেঙ্গল প্লেয়ারদের থাকা—খাওয়া, টাকাপয়সা জোগাড়, সব কিছুই দাদু করেছিলেন পারিবারিক সম্পত্তির নিজের ভাগ দিয়ে,” বলছিলেন দেবেশ। একশো বছর পর ব্যক্তি সুরেশ চৌধুরির অবয়বও তো দৃশ্যমান হয়, পৌত্রের জবানবন্দিতে। সঙ্গীতপ্রিয় সুরেশ চৌধুরি। মহানুভব সুরেশ চৌধুরি। শোনা গেল, বাঁশি বাজাতে খুব ভালবাসতেন লাল-হলুদের প্রতিষ্ঠাতা। যাঁকে রাজা উপাধি দিতে চেয়েছিল ব্রিটিশ রাজ। সুরেশ চৌধুরি নেননি। বলে দেন, ‘আমাকে নয়। উপাধি আমার দাদা সতীশ চৌধুরিকে দিন। ব্রিটিশরাজ রাজা উপাধি দিতে চায়নি। সতীশ চৌধুরিকে দিয়েছিল রায়বাহাদুর উপাধি।
ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষে কেমন লাগছে? প্রতিষ্ঠাতার পৌত্রের সোজা সাপ্টা জবাব, “জ্যোতিষ গুহর সময় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব দেখার মতো ছিল। গটগট করে মাঠে ঢুকে পড়তেন। সেই আমল আর কোথায় এখন? সেই প্রাণ কোথায়?” বৃহস্পতিবারের শতবর্ষ অনুষ্ঠানে যাবেন না? উত্তরে হাহাকার ভেসে আসে, “জানি না পারব কি না। শরীর দেবে কি না।”
No comments:
Post a Comment