Thursday, 15 August 2019

শহরে ফুটবল বাদশা (On Majid Bishkar)

সৌমিত্র কুমার রায়: হাতে গোলাপের মালা নিয়ে মাঝরাত থেকে ঠায় বিমানবন্দরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক অনুরাগী। ঘণ্টা তিনেক অপেক্ষার পর রবিবার ভোররাতে ব্যাজার মুখে মালা হাতে নিয়েই বাড়ির পথে হঁাটা লাগালেন। স্বপ্নের নায়কের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় আফশোস করছিলেন মজিদ বাসকারের অনুরাগী। 
সুযোগ পাবেনই বা কী করে? মজিদকে ঘিরে উন্মাদনা ভোররাতেও। ময়দানের আশির বাদশাকে ঘিরে উদ্বেল ইস্টবেঙ্গল জনতা।
প্রিয় শহরে ফিরতে পেরে আপ্লুত ময়দানের সর্বকালের সেরা বিদেশি ফুটবলারও। তঁাকে স্বাগত জানাতে শনিবার রাত ১১টা থেকে বিমানবন্দরে ভিড় জমাতে শুরু করেছিলেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা। কারও হাতে লাল–হলুদ পতাকা, কারও হাতে তেরঙা। ‘মজিদ–মজিদ’ ধ্বনিতে মুখরিত চারিদিক। নিরাপত্তা ব্যবস্থা কড়া ছিল। শনিবার রাত আড়াইটে নাগাদ গগনভেদী চিৎকারটা আরও বাড়ল। শুনে মনে হতে পারত, মজিদ যেন ডার্বিতে গোল করেছেন। আসলে তখন সবে কলকাতার রানওয়ে ছুঁল কাতার এয়ারওয়েজের বিমান। বাইরের ডিসপ্লে বোর্ডে সেটা জ্বলজ্বল করতেই ইস্টবেঙ্গল জনতা আরও উত্তেজিত। জ্বলে উঠল মোবাইলের টর্চগুলো। তর সইছিল না। কতক্ষণে বাইরে আসবেন মজিদ? অবশেষে ভোররাত সাড়ে ৩টের কিছু পরে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ!
পরনে সাদা টি–শার্ট, অফ হোয়াইট ট্রাউজার্স। ডান হাতে মোবাইল। বিমানবন্দরের বাইরে ইস্টবেঙ্গল জনতাকে দেখে মজিদের মুখে তখন সরল–স্বর্গীয় হাসি। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। সমর্থকরা তখনও বোধহয় বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বয়স ষাট পেরিয়েছে। তবু শিরদাঁড়া টানটান। লাউঞ্জের বাইরে বেরনোর ঠিক আগের মুহূর্তে হাত নাড়লেন। সম্ভবত বোঝাতে চাইলেন, তিনি এখনও জনতার বাদশা। 
বাদশাই বটে। ৩২ বছর পর তিলোত্তমায় এসে দেখলেন তঁার জনপ্রিয়তায় এতটুকু আঁচড় কেউ কাটতে পারেনি। বললেন, ‘কলকাতার মানুষ এখনও আমাকে এত ভালবাসেন দেখে অবাক হলাম। এই সমর্থকদের টানেই আবার এই শহরে এসেছি।’
মজিদকে গাড়িতে তোলার সাহস দেখাতে পারলেন না দায়িত্বরত সিআইএসএফ এবং বিধাননগর পুলিশ। ফের ভেতরে ঢুকে গেলেন। কিন্তু, তঁার নজর ছিল বিমানবন্দরের বাইরে ইস্টবেঙ্গল জনতার দিকে। তঁার জন্যই রবিবার ভোররাতের বিমানবন্দর সাক্ষী রইল আবেগের বিস্ফোরণের।
হোটেলে পৌঁছন ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ। তারপর টানা বিশ্রাম। হোটেলে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মধ্যাহ্নভোজে মাছের কালিয়া খেয়েছেন। মজিদ যখন লাঞ্চ করছিলেন, হোটেলের লবিেত ঘুরপাক খাচ্ছিলেন তঁার এজেন্ট। তিনি বললেন, ‘কলকাতায় খুব গরম। পুরনো শহরে এসে মজিদ দারুণ খুশি।’ এই শহর মজিদকে সবকিছু দিয়েছে। কলকাতায় এসে তিনিও নস্টালজিক। সেই ইস্টবেঙ্গল মাঠ। যেখানে আজ বিকেলে সাংবাদিক বৈঠক করার কথা।
আশির দশকে তঁার পায়ের ফুটবল জাদুতে মোহিত হয়েছিলেন সেই সময়ের ফুটবলভক্তরা। ফুটবলের শহরে এসে ফুটবলে পা ছোঁয়াবেন না, তা কী করে হয়। বিকেলে হোটেল থেকে বেরিয়ে মজিদের গাড়ি ছুটল সিসিএফসি ক্লাবে। ওখানে ছিলেন বন্ধু জামশিদ নািসরি। তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে এক প্রদর্শনী ম্যাচের আয়োজন হয়েছিল। মাঠের সাইড লাইনে বসে ম্যাচ দেখতে দেখতে কফিতে চুমুক দিচ্ছিলেন আর বন্ধু জামশিদের থেকে হালহকিকত জেনে নিচ্ছিলেন। এক অনুরাগী মজিদকে আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে জামশিদকে বলেন, ‘উনি আমার স্বপ্নের ফুটবলার ছিলেন।’ যা শুনে মুচকি হেসে মজিদ বলে উঠলেন, ‘আমিও বাংলাটা জানি।’ হো হো করে হেসে উঠলেন জামশিদ। কফি শেষ করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তৎক্ষণাৎ তঁার দিকে এগিয়ে এলেন জামশিদও। তারপর দু’জনে মাঠের মধ্যে গেলেন। বলটা মজিদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। দু’পায়ে বল নাচানো শুরু। তরুণ ফুটবলাররা হাততালির ঝড় তুললেন। মজিদও তখন যেন ফিরে গিয়েছেন পিছনের দিনগুলোতে। 
১৯৮০ থেকে ইস্টবেঙ্গলে চুটিয়ে খেলার পর মহমেডানেও সই করেছিলেন। সাদা–কালো কর্তারা চান মজিদকে সংবর্ধিত করতে। তবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। মহমেডানের সংবর্ধনার প্রসঙ্গে মজিদ বলেন, ‘ওরাও আমাকে মনে রেখেছে তাহলে!’ তিনি যে মজিদ বাসকার, ময়দানের ফুটবল যতদিন থাকবে, বাদশার মুকুট তঁারই থাকবে। সেটা আবারও প্রমাণ করলেন।‌

No comments:

Post a Comment