Thursday, 15 August 2019

কে চাপে রাখতেন? মজিদের মুখে সুব্রত

কে চাপে রাখতেন? মজিদের মুখে সুব্রত

গায়ে সেই ১২ নম্বর জার্সি। বলটা পা দিয়ে যখন আলতো গড়িয়ে দিলেন, গ্যালারিতে জুড়ে চিৎকার, 'ম...জি...দ!' হাত নাড়লেন সে দিকে তাকিয়ে। মজিদের মনের মধ্যে তখন নিশ্চয়ই অনেক স্মৃতির ঝড়।

কে চাপে রাখতেন? মজিদের মুখে সুব্রত
অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

এ ভাবেই বোধহয় খুলে যায় স্মৃতির জানালা। আবার ইস্টবেঙ্গল মাঠে পা পড়ল মজিদ বিসকারের। প্রায় তিন যুগ পর। বৃষ্টি ভেজা বিকেলের সবুজ ঘাস যেন প্রাণ পেল তাঁর পায়ের স্পর্শে।

গায়ে সেই ১২ নম্বর জার্সি। বলটা পা দিয়ে যখন আলতো গড়িয়ে দিলেন, গ্যালারিতে জুড়ে চিৎকার, 'ম...জি...দ!' হাত নাড়লেন সে দিকে তাকিয়ে। মজিদের মনের মধ্যে তখন নিশ্চয়ই অনেক স্মৃতির ঝড়। তার বার দু'য়েক মাঠের কাছে এসেও ফিরে গিয়েছেন মজিদ। সমর্থক-মিডিয়ার প্রবল উৎসাহ-ধাক্কাধাক্কিতে নামতেই পারলেন না মাঠে। শেষে পুলিশ ডাকতে হল। তাঁদের মাধ্যমে প্রিয় মাঠে পা পড়ল মজিদের।

সোমবারের দুপুর। সাড়ে তিনটে হবে। আকাশ কালো করে নামল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। তার মধ্যেই ময়দানের বটতলা দিয়ে ঠিক ইস্টবেঙ্গল তাঁবুর সামনে এসে থামল গাড়িটা। দরজা খুলে নেমে এলেন সাদা চুলের যে ভদ্রলোক, ময়দানের ওই বটতলা তাঁর বড় চেনা। বড় আপন। বহু ঘটনা, উত্থান-পতনের সাক্ষী। বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে ফিরে পেয়ে দীর্ঘ গাছগুলোও যেন ঝোড়ো হাওয়ায় মাথা ঝুঁকিয়ে জানাল কুর্নিশ। আরও আশ্চর্যের যেটা, ওই রকম প্রবল বৃষ্টিতে ভিজেও মজিদের জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে অজস্র তরুণ মুখ। যাঁরা হয়তো মজিদের খেলার সময় জন্মই নেননি। তবু অদ্ভুত এক আবেগে ছুটে আসা, বেতাজ বাদশার অমোঘ আকর্ষণে!


কত বছর পর আবার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে পা দিলেন মজিদ বিসকার? নিজেই বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন। অবাক হয়ে দেখছিলেন বদলে যাওয়া ক্লাব তাঁবু। গ্যালারি। বললেনও, 'প্রায় সব কিছুই বদলে গিয়েছে। বদলায়নি শুধু মাঠ আর গোলের তিনটে কাঠি। ইস্টবেঙ্গল আজও গোল করে যাচ্ছে।'

বন্ধু জামশিদ নাসিরি বা সঙ্গে আসা ভাইপো এবং দুই বন্ধুর গায়ে ছিল ইস্টবেঙ্গলের লাল-হলুদ শতবর্ষের জার্সি। শুধু মজিদের গায়ে তাঁর সেই প্রিয় ১২ নম্বর। তা-ও আশির দশকের ক্লাব জার্সির ডিজাইনে। তাঁকে ঘিরে প্রবল চিৎকার, হুড়োহুড়ি। প্রেস কনফারেন্সের ঘরে ভিড় ঠেলে ঢুকতেই পারছিলেন না মজিদ। শুরুতেই অবশ্য সঞ্চালক বলে দিয়েছিলেন, কোনও ব্যক্তিগত এবং বিতর্কিত প্রশ্ন না করতে। তবে মজিদকে দেখে মনে হল, সেই অতীত ভুলেছেন তিনি। মনে রাখতে চান শুধু কলকাতার ফুটবল জীবনকেই। বললেন, 'ইরানে বসে ইস্টবেঙ্গলের খবর রাখার চেষ্টা করতাম। সে ভাবে পেতাম না। আসলে কলকাতা আমার কাছে চিরকালই স্পেশ্যাল। তবে এমন উন্মাদনা হবে ভাবিনি। প্লেনে বসেও ভাবছিলাম, হয়তো দু'একজন কর্তা আমায় নিতে আসবেন। কিন্তু মাঝরাতে যা দেখলাম, আমি অভিভূত!'

মজিদ মানেই ফুটবলের অজস্র স্মৃতি। সেরা ম্যাচ বাছলেন দার্জিলিং গোল্ড কাপের ফাইনাল। বললেন, 'মোহনবাগান দু'গোলে জিতছিল। আমাদের সমর্থকরা প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়েছিল। তারপর সেই ম্যাচ আমরা ৩-২ জিতেছিলাম। আমি গোল না করলেও তিনটে গোলই আমার পাস থেকে হয়েছিল। সেই ম্যাচটা ভুলিনি। ঠিক যে ভাবে ভুলিনি, রোভার্স ফাইনালের গোলটা। ভাস্কর মহামেডানের গোলে ছিল। ওকে গোল দিতে ভালো লেগেছিল। ম্যাচটা ১-১ হয়। আমরা যুগ্মবিজয়ী হয়েছিলাম। ওটাই আমার জীবনের সেরা গোল।'

আর প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার? 'সুব্রত-সুব্রত', মোহনবাগানের বাবলুর নামটা বলতে এক মুহূর্ত ভাবলেন না মজিদ। বললেন, 'খুব টাফেস্ট ডিফেন্ডার ছিল।' তাঁর সঙ্গে খেলা বহু ফুটবলারের নাম মনে রেখেছেন আজও। গড়গড় করে বলে যাচ্ছিলেন, 'হাবিব, মনোরঞ্জন দারুণ। সুধীর ছিল খুব ভালো ডিফেন্ডার। হরজিন্দর সিং, প্রেমনাথ ফিলিপসকেও মনে আছে।'

কলকাতা ছেডে় কেন ফিরে গিয়েছিলেন ইরানে? প্রশ্ন শুনে মজিদ ঘুরিয়ে বললেন, 'ওই সময় আমাদের দেশে অনেক সমস্যা চলছিল। আমি ফিরে গিয়ে নিজের শহরে ছোটদের খেলা শেখাতাম।' নিজের ফেলে আসা জীবনের জন্য আক্ষেপ হয় না? মজিদের দার্শনিক উত্তর, 'আমি যতটুকু দেওয়ার ফুটবলকে দিয়েছি। আমি যা দিয়েছি, দর্শকদের ভালোবাসায় সেটা ফিরেও পেয়েছি। আমার কোনও আক্ষেপ নেই।'

১৯৮০-র ১৬ অগস্টের সেই ঘটনাও ভোলেননি মজিদ। স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বলে যাচ্ছিলেন, 'খেলার সময় দেখছিলাম, গ্যালারিতে একটা প্রবল নড়াচড়া হচ্ছে। তখন কিছু বুঝিনি। রাতে লর্ড সিনহা রোডের ফ্ল্যাটে ফিরেছি, দেখলাম আমাদের দু-একজন সমর্থক। কাছেই হাসপাতাল ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করাতে ওরা বলেছিল, আপনি জানেন না, আজ তো খেলায় ১৬ জন মারা গিয়েছি। সে দিন যা দুঃখ পেয়েছিলাম, আজও ভুলিনি।'

১২ নম্বর জার্সি বেছেছিলেন কেন? মজিদের মজা, 'জামশিদ এসে ৯ নিয়েছিল। আমি ১২ পছন্দ করলাম। সেটা দেখে খাবাজি বলেছিল, তা হলে আমি ১২+৯, ২১ নম্বর পরব। সেই থেকে ১২-ই রয়ে গেল গায়ে। আজও।'

এত ভালোবাসার পরেও কলকাতা বা ইস্টবেঙ্গলে আসতে শুরুতে যে মন চায়নি মজিদের, জানালেন সেটাও। 'আমি বারবার না করছিলাম। মনা ফোন করেছিল। জামশিদ করল। আমি 'না-না' করে যাচ্ছিলাম। তারপর আমার এক আত্মীয় মধ্যস্থতা করল। আসলে আমি ভাবিনি, এত বছর পরেও এই শহর আমাকে মনে রেখেছে।' মজিদ বিসকার বদলেছেন। কিন্তু তাঁর জন্য কলকাতার ভালোবাসা আজও অটুট। সেই চল্লিশ বছর আগের মতোই! 

No comments:

Post a Comment