Thursday, 15 August 2019

রয়েড স্ট্রিটের সেই চাইনিজ রেস্তোরাঁ ভোলেননি মজিদ

রয়েড স্ট্রিটের সেই চাইনিজ রেস্তোরাঁ ভোলেননি মজিদ

৩৯ বছর আগে প্রথম যখন মজিদের মুখোমুখি হয়েছিলাম পার্ক স্ট্রিটের কাছে নটরাজ বিল্ডিংয়ে, সেই সময়ের থেকে ওর চেহারায় স্বভাবতই অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সময়ের পলিমাটি ওর লাবণ্যে চিড় ধরাতে পারেনি।

রয়েড স্ট্রিটের সেই চাইনিজ রেস্তোরাঁ ভোলেননি মজিদ
জয়ন্ত চক্রবর্তী

'কলকাতা এয়ারপোর্টে নেমে বুঝতে পারলাম শহরটা একদম বদলে গিয়েছে। এ রকম এয়ারপোর্ট তো সে সময়ে ছিল না! গভীর রাতে হোটেলে পৌঁছনোর পথে কতগুলো ফ্লাইওভার হয়ে যে এলাম, তার হিসেবে রাখতে পারলাম না। শহরটা ঝাঁ চকচকে হয়ে গিয়েছে। সব বদলে গিয়েছে, বদলায়নি শুধু ইস্টবেঙ্গলের সেই আবেগ। সেই একই রকম জয়ধ্বনি। সেই একই রকম প্রাণবন্ত দর্শক-সমর্থক। ভীষণ মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই ১৯৮০ সালের দিনগুলোর কথা।'

সোমবার মজিদ বিসকর যখন আমায় এই কথাগুলো বলছিল, তখন ওর ঠোঁটে লেগেছিল সেই অনাবিল হাসি, যার জন্য আমার একটি লেখায় ওকে ধর্মেন্দ্রর ছায়া বলে উল্লেখ করেছিলাম। ৩৯ বছর আগে প্রথম যখন মজিদের মুখোমুখি হয়েছিলাম পার্ক স্ট্রিটের কাছে নটরাজ বিল্ডিংয়ে, সেই সময়ের থেকে ওর চেহারায় স্বভাবতই অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সময়ের পলিমাটি ওর লাবণ্যে চিড় ধরাতে পারেনি। দীর্ঘ তিন যুগ পরে দেখা। কিন্তু প্রথম দেখাতেই যে আলিঙ্গনটি করল তাতে ছিল উষ্ণতা। ছিল অনেক দিন পর এক বন্ধুকে ফিরে পাওয়ার আকুতি।

বন্ধুই তো। পেশাদার সাংবাদিক ছিলাম বটে, কিন্তু মজিদের কাছের বন্ধু হয়ে যেতে হয়েছিল পেশার কারণেই। ইনকাম ট্যাক্সের অসঙ্গতি নিয়ে কলকাতায় আসা তিন ইরানি ফুটবলার মজিদ-জামশিদ-খাবাজির এখানে থাকাই অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। ইস্টবেঙ্গল কর্তা অরুণ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ওদের আয়কর সমস্যা নিয়ে একটা প্রতিবেদন লিখতে। লেখাটার জন্য মজিদের মুখোমুখি হওয়ার দরকার ছিল। তাই ১৯৮০ সালে এক বিকেলে মজিদ-জামশিদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। প্রতিবেদনটির জন্য নয়, তবে অন্য কোনও কারণে মজিদদের ইনকাম ট্যাক্স সমস্যা মিটে গিয়েছিল। কিন্তু আমি ওর বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। তাই ওই মজিদের স্টারডম দেখেছি খুব কাছ থেকে। একবার মজিদের সঙ্গে বিরিয়ানি খেতে ধর্মতলার এক নামী রেস্তারাঁয় গিয়েছিলাম। বিরিয়ানির দাম তো দিতেই হয়নি, বরং রেস্তোরাঁর মালিক মজিদের হাতে কয়েক প্যাকেট বিরিয়ানি ধরিয়ে দিয়েছিলেন রাতে খাওয়ার জন্য। সেই সব দিনের কথা মনে পড়ে? মজিদ বলল, 'সবটা না হলেও কিছুটা তো মনে আছে। আচ্ছা রয়েড স্ট্রিটের ছোট্ট চাইনিজ লি রেস্তোরাঁটি কি আর আছে?' নিতান্ত অপারগ হয়ে জবাব দিই, অনেক দিন ও দিকে যাওয়া হয় না। তাই জানি না আছে কিনা।


স্মৃতি সতত সুখের নয়। মজিদকে ঘিরে অনেক স্মৃতিই আছে যা এখন আর মনে করাতে চাই না। সোমবার ইস্টবেঙ্গলের সাংবাদিক সম্মেলনে আসার সময় মজিদ আমাকে বলে দিয়েছিল, 'শুনলাম সাংবাদিক সম্মেলন তুমি পরিচালনা করবে, তুমি সাংবাদিক বন্ধুদের বলে দিও, ওরা যেন আমাকে ব্যক্তিগত কোনও প্রশ্ন না করে। প্রশ্ন যেন ফুটবল নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকে।' বুঝলাম মজিদ তার পুরোনো খারাপ সময়ের দিনগুলো নিয়ে আর নাড়াঘাঁটা করতে চায় না। তারপর ও উল্টে আমাকেই প্রশ্ন করল, 'আচ্ছা সে দিন রাতে আমায় যে অসংখ্য মানুষ রিসিভ করতে এসেছিল, ওরা তো আমার খেলা দেখেনি। তাহলে এল কেন? আমি তো ভেবেছিলাম, আমাকে রিসিভ করতে ইস্টবেঙ্গলের দু'একজন কর্তাই থাকবেন।' আমি জবাবে বলি, তুমি আসলে মিথ হয়ে গিয়েছ। তোমার খেলা দেখেনি, তোমার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনে আজও তারা সম্মোহিত হয়। তাই তোমাকে দেখতে এখনও মানুষের ঢল নামে। মজিদের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে ছিল একদা তার ছায়াসঙ্গী জামশিদ নাসিরি। তাকে দেখিয়ে মজিদকে প্রশ্ন করি, তোমরা ছিলে খামের গায়ে ডাকটিকিটের মতো। সেই জামশিদের সঙ্গে যখন এখানে প্রথম দেখা হল তখন কী মনে হল? জামশিদের গায়ে একটা টোকা মেরে মজিদ বলল, 'ও আমার থেকে ৬ বছরের ছোট। খোরাম শহরে আমরা এক সঙ্গে খেলেছি। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়তে এসেছিলাম। এক সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলে খেলেওছি। তবে এটা বলতে পারি, ও ছোট ভাই হয়েও বড় দাদা হিসেবে আমাকে আগলে রেখেছিল। তাই দুই ভাইয়ের মিলন হলে যেমন হয়, তেমনই আনন্দ হয়েছিল। দু'জনেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। ইচ্ছে করছিল তিন দশক আগে আমরা যে সব রেস্তোরাঁয় খেতাম, যে মেসে থাকতাম তা দেখতে যেতে। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়।'

মজিদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে পড়ে যাচ্ছিল, ইলিয়ট রোডের ট্রাম রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ছেঁড়া জিনস আর মলিন টি শার্ট পরা যুবককে। মাথার চুল অবিন্যস্ত, কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বল দৃষ্টি। সেই উজ্জ্বল দৃষ্টি আজও রয়েছে। তবে কোনও মলিনতা আর নেই এখনকার মজিদের মধ্যে। যেন এক অদৃশ্য ইরেজার দিয়ে সেই সব খারাপ স্মৃতি মুছে দিয়েই ও এসেছে 'বাদশা'র মেজাজেই। 

No comments:

Post a Comment