একটা ছোট সেন্টার টেবল। তার পাশে ছড়ানো-ছেটানো কয়েকটি সোফা।
দেওয়ালে একটা ল্যান্ডস্কেপ ঝুলছে। গোটা ঘরটিতে আর কোনও আসবাবের চিহ্নমাত্র নেই।
টিউব লাইট জ্বলছে। সেন্টার টেবলের ওপর একটা ডিশে রক্তবর্ণের কয়েকটা আপেল আর ডাঁশা পেয়ারা।
ফল কাটার ছুরি দিয়ে নিপুণ হাতে আপেলের খোসা ছাড়িয়ে কয়েকটি খণ্ডে আপেলটিকে কেটে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে মজিদ বলল, ‘‘নিন, খেয়ে নিন।’’
১৯৮০ সালের এক পড়ন্ত বিকেল। পার্ক স্ট্রিটের কাছে নটরাজ বিল্ডিং-এর এক ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুমে বসে আপেল খাচ্ছি মজিদ বাসকার আর জামশিদ নাসিরির সঙ্গে।
দিনটা আজও মনে পড়ে।
রবিবার। আমার সাংবাদিক জীবনের সেটা প্রত্যুষ। পেশাদার সাংবাদিকের মতো কোনও কিছু দেখে বিস্মিত না হওয়ার মতো কাঠিন্য তখনও রপ্ত করতে পারিনি।
নটরাজ বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাটে মজিদের সুঠাম স্বাস্থ্য আর রূপের ছটা দেখে বিস্মিতই হয়েছিলাম।
মাঠের মধ্যে যে পেশাদার ফুটবলারকে দেখেছি, এ যেন তার থেকে একটু আলাদা।
কেন জানি না, সেই রবিবার মজিদকে খুব কাছে দেখার পর আমার বারবার বলিউডের হি-ম্যান ধর্মেন্দ্রর কথা মনে পড়ছিল।
দু’জনের চেহারার সাদৃশ্যটা আমার চোখকে টেনেছিল। এর পর যত বার মজিদকে কাছে থেকে দেখেছি, তত বারই আমার ধর্মেন্দ্রর কথা মনে হয়েছে।
অনেক দিন পরে মজিদকে কথাটা বলেছিলাম। মজিদ তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিল।
ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যাই ১৯৮০-র সেই বিকেলে।
আগ্রাসী মজিদ, ইস্টবেঙ্গল বনাম মহমেডান স্পোর্টিং রোভার্স কাপ ফাইনাল, ১৯৮০, ছবি: নিখিল ভট্টাচার্য
আসলে খবরটা আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন গড়ের মাঠের এক ফুটবল কর্তাই। মজিদ আর জামশিদ কলকাতায় খেলতে এসেই আয়করের ঝামেলায় ফেঁসেছে। ওরা আয়কর ফাঁকি দিয়েছে। ইনকাম ডিপার্টমেন্ট ওদের চিঠি ধরিয়েছে।
খবর হিসেবে বেশ ভাল।
মজিদ, জামশিদ তখন ভিনি-ভিসি-ভিডি করে ফেলেছে। ফেডারেশন কাপে হিন্দুস্থান এয়ারোনটিক্স লিমিটেড কিংবা হ্যালের বিরুদ্ধে (নাকি আইটিআই ছিল!) লাল-হলুদ জার্সি গায়ে মাঠের মধ্যেই ফুল ফুটিয়েছে দুজনেই। কলকাতা আমোদিত ও প্রাণোদিত হয়েছে এই দুই ইরানি ফুটবলারের খেলা দেখে।
মজিদ আবার বিশ্বকাপার। ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলে ইরানের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দিয়েছে সে। জামশিদ ১৯৭৭ সালে কোকাকোলা ইউথ কাপে ইরানের হয়ে খেলেছে। কলকাতা তখনও এত কাছ থেকে কোনও বিশ্বকাপারকে দেখেনি।
১৯৭৭ সালে কসমস ক্লাবের হয়ে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে ব্রাজিলের পেলে এসেছিলেন, কিন্তু তা তো মাত্র কয়েক দিনের জন্য।
ধরাছোঁয়ার মধ্যে একজন বিশ্বকাপার। যাঁকে ইস্টবেঙ্গল মাঠে প্র্যাকটিস করতে দেখা যাচ্ছে। বিকেলে মাঠে খেলতে দেখা যাচ্ছে। খেলার শেষে হলুদ-কালো ট্যাক্সি করে হুশ করে বেরিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।
মজিদে ক্রমশ মজেছে কলকাতা। এই সময়ে এঁদের নিয়ে ইনকাম ট্যাক্স সমস্যার কপি লোকেরা তো গপগপ করে গিলবে। তাই নটরাজ বিল্ডিং-এ আমি মজিদ-জামশিদের মুখোমুখি।
যত সহজে এই মুখোমুখি হওয়ার কথা বললাম, ব্যাপারটা ততটা সহজ ছিল না। এক ঝাঁক তারকা ফুটবলার ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইস্টবেঙ্গলের স্কাউটরা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মজিদ আর জামশিদকে নিয়ে আসেন।
ফেড কাপে মজিদ-জামশিদের খেলা ইস্টবেঙ্গল জনতাকে বুঝিয়ে দেয় যে, ছেড়ে যাওয়া ফুটবলারদের জন্য তাঁদের আর আপসোস করতে হবে না। তাদের মসিহা এসে গেছে।
আর সেই মসিহা যে মজিদ, তা বুঝে নিতে ফুটবল অভিজ্ঞদেরও অসুবিধে হয়নি।
অ্যাটাকিং মিড ফিল্ডার। কিন্তু যার খেলায় আছে চমকপ্রদ স্কিলের বিচ্ছুরণ আর গেম মেকার হয়ে ওঠার আশ্চর্য সব গুণের সমাহার, যা মজিদকে অনন্য করে তুলেছে।
স্বভাবতই ইস্টবেঙ্গল তখন মজিদ-জামশিদকে কার্যত অতন্দ্র প্রহরায় রেখেছে। কারণ মোহনবাগানে তখনও বিদেশি ফুটবলার খেলানোর ছাড়পত্র না থাকলেও মহমেডান স্পোর্টিং সুযোগ পেলেই বাজপাখির ভূমিকা নেয়।
আজকের মহমেডানকে দেখে সে দিনের মহমেডান স্পোর্টিংকে অবশ্য তুলনা করা যাবে না। সে দিনের মহমেডান স্পোর্টিং ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের মতোই আগ্রাসী। এক নিঃশ্বাসে এরফান তাহের র্যান্ডেরিয়ান, ইব্রাহিম আলি মোল্লা, গোলাম মুস্তাফা মামার মতো দুর্ধর্ষ সব কর্মকর্তা কাম ফুটবল ক্যাচার তখন মহমডানে।
এই সব কারণে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব মজিদের জন্য খুঁজে নিয়েছিল অভিজাত এলাকার অ্যাপার্টমেন্ট— নটরাজ বিল্ডিং।
নীচে সিকিওরিটির লোকজন, ডোরম্যান ইত্যাদির ফাঁক গলে ওপরে ওঠা প্রায় আজকের দিনে পাঁচতারা হোটেলে সিকিওরিটির বাধা কাটিয়ে বিরাট কোহলির ঘরে পৌঁছনোর মতো ব্যাপার।
অতএব শরণাপন্ন হলাম ইস্টবেঙ্গল কর্তা অরুণ ভট্টাচার্যর। বেশ দিলখোলা, কিন্তু ডিপ্লোম্যাটিক মানুষ। মজিদ-জামশিদের তখনকার গডফাদার এই অরুণদাই।
পর পর ক’দিন হত্যে দিয়ে পড়ে রইলাম অরুণ ভট্টাচার্যের সিআইটি রোডের ফ্ল্যাটে।
অবশেষে এক শনিবারের বিকেলে অরুণদার হৃদয়ের বরফ গলল। বললেন, ‘‘কাল বিকেলের দিকে যেয়ো। আমি ওদের বলে রাখব।’’
সেই ‘কাল বিকেল’টাই এই রবিবারে বিকেল।
মাঠের বাইরে, টেন্টের বাইরে এই প্রথম মজিদ-জামশিদের মুখোমুখি। তখন কি জানতাম, এই মজিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠবে আমার মতো পেশাদার এক সাংবাদিকের। জানতাম কি, মজিদের বহু আনটোল্ড স্টোরির সাক্ষী হতে হবে!
সেই রবিবার মজিদ-জামশিদ আমার কথা খুব মন দিয়ে শুনেছিল। জামশিদ তবু একটু-আধটু ইংরেজি তখন বলতে পারত। মজিদও বলত। তবে, একদম থেমে থেমে এবং আস্তে আস্তে। কিন্তু ইংরেজিটা বুঝত।
আমার প্রশ্নের উত্তরে মজিদ-জামশিদ মোটা মোটা বেশ কয়েকটা ফাইল নিয়ে এল। তাতে ওদের ইনকাম ট্যাক্স দেওয়ার যাবতীয় বিবরণ। আমি নোটবুকে সমস্ত তথ্য কপি করে নিয়েছিলাম। সোমবারের খবরের কাগজের প্রথম পাতায় খবরটা বেরিয়েছিল।
মজিদ –জামশিদের ইনকাম ট্যাক্সে কোনও ফাঁকি ছিল না। ব্যাপারটা ছিল নিছকই এক চক্রান্ত।
কেউ কেউ খবরটা পড়ে মজিদ-জামশিদের মনোবল ভাঙার জন্য গঙ্গাপারের একটি ফুটবল ক্লাবের দিকে আঙুল নির্দেশ করেছিলেন।
আজ এত দিন পরে বলতে দ্বিধা নেই, চক্রান্ত হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের ভেতর থেকেই।
মজিদের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত এক শ্রেণির কর্মকর্তা কাঁকড়ার ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
মনে রাখতে হবে, ৮০-র দশক সেটা। কলকাতায় তখন মল কালচার জন্ম নেয়নি। ট্যাক্সির মিটার ডাউন ৮টাকা। বাসে ট্রামে ৬০ পয়সায় টিকিট পাওয়া যায়। ৫০ পয়সায় এক কাপ চা মেলে। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে কলকাতায় ক্যাবারে বন্ধ করেছে। ট্রিঙ্কাসে কিংবা গ্রেট ইস্টার্নের ম্যাক্সিমে স্বল্পবসনা সুন্দরীদের আর নৃত্য বিভঙ্গে পাওয়া যায় না। ওবেরয় গ্র্যান্ডের পিঙ্ক এলিফ্যান্টে শুধু নাইট ক্লাবের আস্বাদন। কিছু দিন আগেই পার্ক স্ট্রিটের পানশালায় গান গাওয়া ছেড়ে স্টেজ শোয়ে এসে গিয়েছেন ঊষা আয়ার মানে উষা উত্থুপ।
কলকাতা তখন মজে আছে ফুটবলে। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল-মহমেডানের তারকা ফুটবলাররা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মব্ড হয়ে যায়।
দুপুর গড়াতে না গড়াতে তখন গড়ের মাঠ লোকারণ্য হয়ে যায়। মহামেডান ম্যাচ হারলে রেড রোডে অবধারিত ভাবে গাড়ির কাঁচ ভাঙে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ড্র করলে কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটে।
এই সময় মজিদের মতো একজন বিশ্বকাপারের আগমন।
কলকাতা লুফে নিল এই ইরানি ডুয়োকে। মজিদ অনেক বেশি প্রতিভাবান, তুলনায় জামশিদ কেজো ফুটবলার।
মজিদ যদি হয় ক্যানভাসে তুলি দিয়ে আঁকার মতো এক শিল্পী, জামশিদ তা হলে অত্যন্ত দক্ষ এক প্লাম্বার।
তবে দু’জনে একে অপরের পরিপূরক। একজনকে বাদ দিয়ে অন্য জনের কথা ভাবা যায় না।
অনেক দিন পরে এক আলোচনায় মজিদের সতীর্থ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যকে জিনেদান জিদানের সঙ্গে মজিদ বাসকারের তুলনা করতে শুনেছিলাম। যা শুনে জামশিদ আমাকে বলেছিল, সে মজিদের সঙ্গে জাভির তুলনা করতে ভালবাসবে। জামশিদ বলেছিল, জিদান যে দিন ফর্মে থাকবে ওর নিয়ন্ত্রণ, স্কিল আর গেম মেকিং দেখা ছেড়ে অন্য কারও দিকে দৃষ্টি যাবে না। কিন্তু জাভির ফর্মের দিনে গোটা দলটাই পাপড়ি মেলে ফুলের মতো হবে। মজিদ তাই জাভি।
মজিদ-জামশিদ যখন আশির দশকের শুরুতেই ইস্টবেঙ্গেল আসে, তখন যে খুব হইচই হয়েছিল, তা বলা যাবে না। নিঃশব্দে দু’জনকে বিমানে কলকাতায় উড়িয়ে এনেছিলেন ইস্টবেঙ্গল কর্তারা।
তখন মিডিয়ার, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এত রমরমা ছিল না। তাই, দু-তিনটি সংবাদপত্রেই মজিদ-জামশিদের কলকাতায় আসার কথা প্রকাশিত হয়েছিল।
ইস্টবেঙ্গল কর্তারাও ব্যাপারটিকে খুব বেশি ‘হাইপ’ দিতে চাননি। কারণ সেই সময়ে বিদেশ থেকে কোনও খেলোয়াড় এলে কর্মকর্তারাও অ্যাসিড টেস্টের সামনে পড়তেন।
বিদেশি ফুটবলারের সাফল্যের ওপর নির্ভর করত কর্মকর্তার ক্লাবে কদর। অনেক সময়ই বিদেশি ফুটবলারের ব্যর্থতায় গ্যালারি থেকে দুয়ো উড়ে আসত কর্মকর্তাদের দিকে।
নাইজেরিয়া থেকে আসা ডেভিড উইলিয়ামকে কেন্দ্র করে ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না। ডেভিড উইলিয়ামসের আচরণ এবং মাঠের বাইরের জীবনযাত্রা রীতিমতো সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। তাই স্বভাবতই মজিদ বাসকার-জামশিদ নাসিরি সম্পর্কে তাঁরা একটু নীরব থাকাই সমীচীন বলে মনে করেছিলেন।
তবে মজিদের প্রতিভার বিচ্ছুরণ এতটাই ছিল যে প্র্যাকটিসে তাদের ক’দিন দেখেই কোচ তো বটেই গ্যালারির দর্শকদেরও বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, এত দিনে সাচ্চা হিরে এসে পৌঁছেছে ইস্টবেঙ্গলে।
সেই সময়টায় ফুটবলের দলবদলকে কেন্দ্র করে যে উন্মাদনার সৃষ্টি হত, তার তুলনা বোধহয় আর কোনও উন্মাদনার সঙ্গেই করা যায় না। তিন ক্লাবের রেষারেষিতে দলবদলের ১৫টি দিন রক্তারক্তি, সংঘর্ষ, উত্তেজনা কোনও কিছুই বাদ যেত না।
ইস্টবেঙ্গেলের প্রথম বছরেই মজিদ-জামশিদের খেলা দেখে মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কর্মকর্তারা প্রায় হাতের তালু চাটতে আরম্ভ করেছিলেন।
সেই সময় মোহনবাগানের জবরদস্ত কর্তা, ফুটবল রিক্রুটার, গজু বসু আমাকে বলেছিলেন, আমাদের ক্লাবে যদি বিদেশি খেলানোর রেওয়াজ থাকত, তা হলে মজিদকে পাঁজাকোলা করে ধরে নিয়ে আসতাম আর সমর্থকদের বলতাম, গ্যালারির ওপর থেকে পুষ্পবৃষ্টি করতে।
যেহেতু মোহনবাগান তখনও বিদেশি খেলোয়াড় নেয় না, টুটু বসু-অঞ্জন মিত্ররা মোহনবাগান ক্লাবের গোঁড়ামি আর অচলায়তন ভাঙেননি, তাই শৈলেন মান্নাদের সম্পর্কে নিশ্চিন্ত ছিলেন ইস্টবেঙ্গল কর্তারা।
কিন্তু মহমেডান তাদের মাথাব্যথার কারণ হত। আর সেই কারণেই তাঁরা দলবদলের মরসুমে মজিদ-জামশিদকে কড়া পাহারায় ডেসপ্যাচ করে দিতেন হয় দিল্লিতে, নয়তো মুম্বইয়ে। সেখানেও কড়া পাহারা বরাদ্দ ছিল মজিদ-জামশিদের জন্য।
কিন্তু তা সত্ত্বেও কী অদ্ভুত কায়দায় ১৯৮২ সালে মজিদ-জামশিদকে যে ভাবে ছিনিয়ে নিল মহমেডান স্পোর্টিং তা আলফ্রেড হিচককের রহস্য কাহিনিকেও হার মানায়।
দলবদলের প্রায় ৭ মাস আগে থেকে মজিদ-জামশিদের ফ্ল্যাটে প্রায় প্রতি রাতেই পৌঁছে যেত বিরিয়ানির প্যাকেট, সঙ্গে মাটন রেজালা, রয়্যাল-এর চাঁপ। কে যে এই প্যাকেট দিয়ে যেত তার হদিশ মজিদরা পেত না। ফ্যানেদের কীর্তি ভেবে প্রায় প্রতি রাতেই মোগলাই খাবারে জারিত হত তারা।
এর পরে আসতে লাগল দামি দামি উপহারের প্যাকেট। তখনকার দামি বলতে—স্যুট লেংথ, চমৎকার চমৎকার জামা, নানা ধরনের জুতো।
মহমেডানের এক কর্মকর্তার বড় দোকান ছিল নিউ মার্কেটে। সেখান থেকেই উপহারগুলি পাঠানো হত।
অবশেষে এক দিন উপহারের সঙ্গেই এল একটি কার্ড।
তাতে লেখা, মহমেডানে খেলবে কি? মহমেডান তোমাদের জন্য গোলাপের পাপড়ি বিছিয়ে রেখেছে।
১৯৮২ সালে যে দিন মজিদরা মহামেডানে সই করল সেদিনটার কথা আজও মনে পড়ে। মহামেডান সমর্থকরা বিশাল গাড়ির কনভয় নিয়ে মজিদ-জামশিদকে সই করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন আইএফএ-র অস্থায়ী ক্যাম্পে। সঙ্গে ছিল রিভলবারধারী সিকিওরিটি। ফেটেছিল বোমা, সন্ধ্যায় মহামেডান তাঁবু ভরে উঠেছিল আতসবাজির রোশনাইতে।
সই করে ফেরার সময়ে মজিদ এক বার তাকিয়েছিল তার পুরনো ক্লাবের দিকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ বলেন, ওই সময় মজিদের চোখটা নাকি একটু ঝাপসা হয়েছিল। হতেই পারে। মজিদের মনটা যে অত্যন্ত নরম ছিল, তা আর কে না জানে?
মজিদ যে কী, তাই কি কেউ বুঝতে পারল?
আমার তো মনে হয়, এই বিশ্বে মোস্ট মিসআন্ডারস্টুড ফুটবলারদের যদি একটা তালিকা করা যায়, তা হলে মজিদের নম্বর বেশ উঁচুর দিকেই থাকবে।
১৯৭৯ সালে ইরানের সেই বহু আলোচিত বিপ্লবের পর দিশেহারা ছাত্রসমাজ যখন এদেশ ওদেশ করে বেড়াচ্ছে, পড়াশুনোর জন্য আশ্রয় নিচ্ছে বিদেশে, তখনই ইরানের খোরাম শহরের বাসিন্দা মজিদ-জামশিদ ভারতের জব্বলপুরে চলে আসে পড়াশুনোর উদ্দেশে।
খোরাম শহরটি দক্ষিণ ইরানে। রাজধানী তেহরান থেকে বেশ দূরে। অনেকটা আমাদের রায়গঞ্জ কিংবা বালুরঘাটের মতো।
মধ্যবিত্ত মানসিকতার এই শহরের ছেলে মজিদের কাছে জব্বলপুর ছিল বিস্ময়। সেখান থেকে আরেক ইরানি ফুটবলার মেহমুদ খাবাজিকে অনুসরণ করে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে মজিদরা।
খাবাজি, মজিদ, জামশিদ সমৃদ্ধ আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় অল্প দিনের মধ্যেই ভারতের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হল। ডুরান্ড কিংবা ডিসিএম-এ তাদের খেলা নজরে পড়ল ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের।
বাকিটা ইতিহাস।
মজিদ যখন কলকাতায় আসে তখন ওর বয়স ২৩। জামশিদের ২০। ২১ বছর বয়সেই মজিদ ইরানের জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপে খেলতে গিয়েছিল।
ইরান ফুটবল ফেডারেশনের ছাপানো একটি কাগজ একবার মজিদ আমাকে দেখিয়েছিল, যেখানে ওঁর ছবির পাশে নামটা লেখা ছিল— মজিদ বিশকার। এই মজিদ বিশকার ভারতে এসে কী ভাবে ‘মজিদ বাসকর’ হয়ে গেল সেই রহস্যটা মজিদেরও অজানা ছিল।
সম্ভবত ইংরেজি কাগজের সাংবাদিকরাই বিশকারকে ‘বাসকার’ করে দিয়েছিলেন। তবে মজিদ বাসকার নামেই স্বচ্ছন্দ ছিল অসম্ভব প্রতিভাবান এই ফুটবলার।
কতটা প্রতিভা ছিল মজিদের?
সেই সময়ে ওর সঙ্গে একই দলে যারা খেলেছে এবং যারা বিপক্ষে খেলেছে তাঁদের কথা শোনাই।
প্রথমে সুব্রত ভট্টাচার্য।
তখন ’৮৬, ছবি: অশোক চক্রবর্তী
কোনও দিন মজিদ আর সুব্রত একসঙ্গে খেলেনি। তাই ‘অফ দ্য ফিল্ড’ ওদের কোনও সম্পর্কও ছিল না। আর মজিদ এমনিতে এতটাই অন্তর্মুখী ছিল, যে সুব্রতর সঙ্গে ওর কোনও ধরনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। কিন্তু আজও কী শ্রদ্ধা মজিদকে নিয়ে ওঁর!
সুব্রতর দেখা এ দেশে সবচেয়ে বড় মাপের বিদেশি ফুটবলার মজিদই। সোনি নর্ডি, বেরোটো, এমেকা বা চিমার কথা মনে রেখেও সুব্রত মজিদকেই সবার উপরে জায়গা দেয়।
বলল, ‘‘ওর স্টাইল অব পাসিং, আর্ট অব ফুটবল আর ওর মতো পারফেকশন অব শ্যুটিং আর কারও মধ্যে দেখিনি। এই ধরনের খেলোয়াড়কে দেখার জন্যই তো লোকে মাঠে আসে। অত্যন্ত ক্লিন ফুটবল খেলত মজিদ। কোনও সময় ওকে ফাউল করতে দেখতাম না। আমি বরং অনেক বার ওকে ট্যাকল করেছি। কড়া ট্যাকল। ফাউল হয়েছে। তাতে কোনও সময় ও উষ্মা প্রকাশ করতে দেখিনি। ওর ঠোঁটে ওই সময় একটা উপেক্ষার হাসি থাকত। তাছাড়া এমন আনপ্রেডিকটেবল ফুটবলার খুব কম দেখিছি। অফ দ্য বল ও যে ফুটবলটা খেলত, সেটা সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছি। একটা টুর্নামেন্ট মনে পড়ে। সম্ভবত, ‘সেইট নাগজি ট্রফি’। একটা গোল করেছিল ও। মহমেডানের হয়ে। এখনও চোখ বুজলে দেখতে পাই।’’
পরের জন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য।
ওর মতেও, যে সমস্ত বিদেশি খেলোয়াড়রা ভারতে খেলেছে, তার মধ্যে এক নম্বরে রাখতে চায় মজিদকেই।
বলল, ‘‘১৯৮০ সালে প্রথম যখন দেখি, তখন আন্তর্জাতিক ফুটবলার দেখার অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু মজিদকে দেখে বুঝতে পারি আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলাররা কেমন হয়। অসাধারণ ড্রিবলিঙের ক্ষমতা ছিল। কিন্তু অনাবশ্যক ড্রিবল করত না। গ্যালারি-শো বলে ওর কোনও ব্যাপারই ছিল না। দলের প্রয়োজনে নিজের খেলার ছকটাকে বদলাত। নিজে গোল করত, অন্যকে দিয়েও গোল করাত। নিঃস্বার্থ ফুটবল যাকে বলে, ও সেটাই খেলত। একটা ম্যাচ মনে পড়ে। তখন জামশিদের খুব গোলের খরা চলছে। খেলাটাতে একটা সময় মজিদ প্রায় গোল করার মতো অবস্থায় চলে গেছে। মারলেই গোল। অথচ ও কী করল, একটা ফাইনাল পাস দিল জামশিদকে। জামশিদ গোল করল। ওর খরা কাটল। যথার্থ টিমম্যান বলতে যা বোঝায়, ও ছিল তাই। আর একটা অদ্ভুত ফিলিংস ছিল ওর। দলের যে কোনও খেলোয়াড় চোট পেলে, সব চেয়ে যে লোকটা তার কাছে ছুটে যেত, সেটা মজিদ।’’
এর পর ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়।
পক্ষে, বিপক্ষে দু’ভাবেই খেলেছে ভাস্কর ওর সঙ্গে। সখ্য ছিল না। কিন্তু দু’জনের মধ্যে অদ্ভুত একটা সমীহজাগানো শ্রদ্ধা কাজ করত। ভাস্করের কাছে অবশ্য মজিদ সবচেয়ে সেরা বিদেশি নয়।
ভাস্কর বলল, ‘‘ওয়ান অব দ্য বেস্ট। গেম মেকার বা স্কিমার হিসেবে মজিদের মুন্সিয়ানা দেখবার মতো ছিল। বলা ধরা বা ছাড়ার ব্যাপারে ওর টাইমিং প্রায় ক্রিকেটে তেন্ডুলকার যেমন। ৮০-৮১ সালে মজিদ সেই সময় যে ফুটবলটা খেলেছে সেটা দেখা ছিল চোখের আরাম। আমি তখন মহমেডানে। দিল্লিতে একটা ম্যাচের কথা মনে পড়ে। মজিদের একটা শট বাঁক খেয়ে জালে জড়িয়ে গেল। বুঝতেই পারিনি। শট নেওয়ার আগেও ধরতে পারিনি, অমন একটা ডেডলি শট আসতে চলেছে। মজিদের অত তাড়াতাড়ি খেলা শেষ হয়ে যাওয়াটা শুধু ওর নয়, ভারতীয় ফুটবলেরই ক্ষতি করেছে।’’
মনে রাখতে হবে, মজিদ যখন কলকাতায় খেলতে আসে তখন আন্তর্জাতিক ফুটবলের বন্ধ জানলা শুধু কলকাতায় কেন ভারতেও খুলে যায়নি। ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে দূরদর্শনে দুটি সেমিফাইনাল আর ফাইনাল দেখে গোটা কলকাতা তখন মারিও ক্যাম্পেসের ভক্ত।
এর পর পরই মজিদের কলকাতায় আবির্ভাব এবং ছন্দোবদ্ধ টাচ ফুটবল দিয়ে দর্শকদের মন জয় করা, আমি এ ব্যাপারে নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি, এখনও পর্যন্ত ভারতে যত জন বিদেশি খেলে গেছে মজিদ তাদের মধ্যে সেরা। চিমা ওকেরি কিংবা হোসে ব্যারেটোর কথা মাথায় রেখেও নির্দ্বিধায় এ কথা বলতে পারি।
শুধু কি খেলার মাঠ? মাঠের বাইরেও মজিদের মতো বর্ণময় চরিত্র আমি খুব কম দেখছি।
আপাত শান্ত, কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট মজিদের মধ্যে অতলান্তিক গভীরতা ছিল। কিন্তু অতলান্তিকে ঝড় উঠলে তা যেমন দুর্নিবার, মজিদও কখনও কখনও মাঠের বাইরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠত। একসঙ্গে ‘আনপ্রেডিকটেবল’ও।
তখনও মজিদের ততটা অন্তরঙ্গ হয়ে উঠিনি। মাঠে মজিদের অসাধারণ সব খেলার রিপোর্টিং করছি। আর মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে অফিসে ফিরছি।
খবরের কাগজের অফিসেও মজিদকে নিয়ে তীব্র আলোড়ন— এমন মাপের ফুটবলার কলকাতায় এসেছে কি?
এই রকমই এক রাতে অগ্রজ সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য হঠাৎই স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টে এসে বললেন, ‘‘কাল তোদের ১০ গোল দেব। মানে তোদের মতো স্পোর্টস রিপোর্টারদের।...’’
অনিলদার সঙ্গে বয়েসের ফারাক অনেকখানি। কনিষ্ঠতম রিপোর্টার আমি।
অনিলদা তখন দুঁদে সাংবাদিক। তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে ওঠাবসা। ডেকার্স লেনের ফ্ল্যাটে থাকেন। সেই আশির দশকেই গাড়ি করে অফিসে আসেন। একটু আধটু ক্রিকেট মাঠে যান। তাও টেস্ট ম্যাচে। তিনি আবার কি স্পোর্টস রিপোর্টিং করবেন?
অনিলদা বললেন, ‘‘আজ আর বাড়ি যাবি না। আমার সঙ্গে রাতে বেরোবি।’’
অনিলদার হুকুম শিরোধার্য। স্টার সাংবাদিক বলে কথা! পুলিশের ট্রান্সফারেও নাকি অনিলদার হাত থাকে।
রাত ১২টা নাগাদ অনিলদার গাড়িতে উঠলাম আমি এবং আমাদের চিত্র সাংবাদিক।
অনিলদা বললেন, ‘‘আমাদের গন্তব্য মসজিদ বাড়ি স্ট্রিট, মানে আরও সাফ বলা যাক— কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লি সোনাগাছি।’’
এই রাতে সোনাগাছিতে আবার কী খবর?
আমাদের গাড়ি সোনাগাছির প্রবেশদ্বারের একটি পেট্রোল পাম্পের পাশ দিয়ে ঢুকে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল।
আগে থেকেই সেখানে ছিল পুলিশের ভ্যান ও একটি জিপ। সোনাগাছিতে ওরা রেইড করবে।
চিত্র সাংবাদিক আমাকে বললেন, ‘‘এমন তো রোজই হয়, এখানে আবার খবর কী হবে?’’
অনিলদা মুচকি হাসছেন।
একটু পরেই পুলিশের তাড়ায় দুড়দাড় করে পালাতে লাগল বেশ কিছু মানুষ। অস্ফুট আলোয় দেখলাম, দুজন পুলিশ সুদর্শন এক যুবককে ধরে আনছে, তার পা টলছে। হাঁটার শক্তি প্রায় নেই।
আবছা আলোতেও আমার চিনতে ভুল হল না— মজিদ বাসকার!
পৃথিবী দুলে উঠলেও বোধ হয় এতটা বিস্মিত হতাম না। মাঠ কাঁপানো ফুটবলার সোনাগাছিতে? পুলিশের হাতে ধরা পড়ল মজিদ বাসকার?
সেই রাতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। মজিদের স্টমাক ওয়াশ করা হয়। কার কিংবা কাদের হস্তক্ষেপে জানি না, মজিদকে সেই রাতে অ্যারেস্ট করা হয়নি। পুলিশের জিপে বরং পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল তার ফ্ল্যাটে।
পর দিন সকালে আমাদের কাগজে ফলাও করে প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘আঁখো দেখা হাল’, অসাধারণ সেই স্কুপ— সোনাগাছিতে পুলিশের জালে মজিদ বাসকার।
মজিদ তখন এতটাই বিখ্যাত যে গোটা কলকাতা জুড়ে আলোড়ন উঠল।
সে দিন বিকেলেই আবার ইস্টবেঙ্গেলের ছোট একটি ম্যাচ। ইস্টবেঙ্গলের কোচ তখন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। মজিদকে তিনি সে দিন মাঠে নামালেন না।
হাফ টাইমে জনতার রোষ আছড়ে পড়ল কাগজের ওপর। ইট-পাটকেলের অবিরাম বর্ষণ প্রেসবক্সে।
বহু দিন পর এক বার মজিদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সেই রাতের কথা। মজিদ এড়িয়ে গিয়েছিল।
ওর হাবভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম প্রসঙ্গটা সে ভুলতে চায়।
মজিদের ফুটবল জীবন তখন মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো দীপ্র। সেই সময় সে প্রেমে পড়ে তার থেকে বয়সে বড় বিখ্যাত এক মহিলার।
কলকাতার অতি বিখ্যাত এক স্পোর্টিং পরিবারের সদস্যা সেই মহিলাও মজিদের খ্যাতি, রূপে, বন্যতায় তাঁর সারল্যে, ঝকঝকে হাসিতে ভেসে যান।
প্রেম কবে আর অনুশাসন মেনে চলেছে? অচিরেই ওদের নিয়ে কলকাতার ককটেল সার্কেলে, ক্লাবের মেঠো চর্চাতেও গুঞ্জনের ঝড় উঠল।
কিন্তু ঝড়ের পর যে অনাবিল প্রশান্তি আসে তা আর এল কই?
প্রাথমিক মুগ্ধতার আবেশ এবং আকর্ষণ কাটতেই ভদ্রমহিলা বুঝলেন— আনপড়, অসংস্কৃত, আভিজাত্যের পালিশহীন মজিদ আর যাই হোক, তাঁর জীবনসঙ্গী হতে পারে না। ধীরে ধীরে তিনি দূরে সরে যেতে লাগলেন।
আর মজিদের পতন শুরু হল।
নানা ধরনের নেশায় আসক্ত হল মজিদ। বিয়ারের নেশা তার বরাবরই। এর সঙ্গে প্রথমে যুক্ত হল নানা ধরনের হার্ড ড্রিংকস। মাদকেও পেল মজিদকে। মারিজুয়ানা, হাসিস। কিছু না পেলে আফিম।
মজিদের পারফর্ম্যান্সে তার প্রভাব পড়তে লাগল। মহমেডান স্পোর্টিং-এ গিয়েও তরবারির মতো ঝলসে উঠত যে ফুটবলার, সে ধীরে ধীরে ম্লান হতে লাগল।
এক বর্ষামুখর দুপুরে পার্ক স্ট্রিটে কাঁচ ঢাকা এক রেস্তোরাঁয় আমার সামনে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে শিশুর মতো অঝোর ধারায় কেঁদেছিল মজিদ। বাইরের বর্ষা আর চোখের ধারা তখন মিলেমিশে একাকার।
১৯৯০ সালে মজিদের এই অবস্থা দেখে জামশিদ নাসিরি মজিদের বাবা-মাকে খোরাম শহরে চিঠি লিখে ওকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে।
মজিদ যখন স্বমহিমায় ভাস্বর, তখন ওকে এক বার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘তোমার মধ্যে এত বৈপরীত্য কেন? এক দিকে এত সুভদ্র, এত নরম মনের মানুষ, এত ভাল এক জন ফুটবলার, অথচ অন্য দিকে সেই তুমিই চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল!’’
সে দিনই আমায় মজিদ শুনিয়েছিল রক্ষণশীল, এক্কেবারে গৃহস্থ খোরাম শহরের মধ্যবিত্ত মানসিকতার জীবন থেকে কলকাতার সাবলীল রঙিন জগতে তার পা দেওয়ার কাহিনি।
মজিদ সুদর্শন হওয়া সত্ত্বেও ইরানের কোনও নীল নয়না সুন্দরী তার প্রেমে পড়েনি। ভারতে এসে সে প্রথম বহির্বিশ্বের সন্ধান পায়। স্বাদ পায়। প্রচুর টাকা হাতে পেয়ে জীবনের ভারসাম্য হারায়। তাকে যতটুকু যা বাঁচিয়ে রেখেছিল, সেটা ফুটবলই।
তার পর ডুমস ডে’র মতো সেই দিনগুলি। মজিদ ক্রমশ রোগা হতে লাগল। নেশার দাস হয়ে পড়ল। কোটর থেকে শুধু চোখ দুটো জেগে থাকত।
আমাদের বাগবাজারের কাগজের অফিস তখন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে চলে এসেছে। মজিদ প্রায় সন্ধেতেই আমাদের অফিসে হানা দিত আমার কাছ থেকে দশটা টাকা নেওয়ার জন্য।
ফুটবল থেকে বিদায় নিয়েছে মজিদ বাসকার। কিংবা ফুটবলই ছেড়ে গেছে তাকে। মহমেডান সমর্থকদের কাছে হাত পেতে টাকা ভিক্ষা নিতেও কুণ্ঠা নেই তার। পরনে ছেঁড়া জিনস, গায়ে শতচ্ছিন্ন তালি মারা স্পোর্টস শার্ট। মাথায় যেটুকু চুল আছে, তেল না পেয়ে তাও জট পাকিয়ে গেছে। রয়েড স্ট্রিটের একটা খুপরি ঘরে তখন থাকে ফুটবলের বিদায়ী রাজপুত্র।
প্রায় বস্তিবাসীর মতো জীবন।
মজিদকে সে সময় মাঝে মাঝেই নিয়ে যেতাম রয়েড স্ট্রিটের একটা ছোট্ট চাইনিজ রেস্তোরাঁয়।
প্রায়দিনই কিছু খেতে চাইত না।
কিন্তু যে দিন খেত, সে দিন গপ গপ করে ওর চিকেন চাউমিন খাওয়া দেখতে দেখতে চোখের কোণটা যেন কেমন শির শির করত আমার।
যেন এক গজদন্তখচিত মিনারকে ভগ্নস্তূপে পরিণত হতে দেখছি!
মজিদের কলকাতায় থাকার শেষ দিকটায় বহু মানুষের কাছে সে ‘আনওয়ান্টেড’ হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে বহু প্রাক্তন ফুটবলারও ছিলেন।
মজিদকে দেখলে তাঁরা পালিয়ে যেতেন। আড়ালে আশ্রয় নিতেন। মজিদ সেটা বুঝত।
এক দিন ওই চাইনিজ রেস্তোরাঁয় বসেই আমাকে বলেছিল, একজন ফুটবলারের ফর্ম থাকতে থাকতেই তার মৃত্যু হওয়া ভাল। লোকে তা হলে তাকে মনে রাখে।
মৃত্যুই তো হয়েছিল মজিদের। কায়িক না হলেও মানসিক মৃত্যু।
ওই সময় হঠাৎ-হঠাৎই দু’চারদিনের জন্য উধাও হয়ে যেত মজিদ। এক বার শুনলাম শিলিগুড়িতে ট্রানজিস্টারের দোকান দিয়েছে সে। আরেকবার শুনলাম, ও নাকি বাচ্চাদের কোচিং করাচ্ছে।
এরকম হতে-হতেই মজিদ এক দিন ভ্যানিশ হয়ে গেল।
অনেক খোঁজখবরের পর শুনলাম মজিদ নাকি ইরানেই চলে গেছে। এই তো কিছু দিন আগে এও শুনলাম, ইরানের ফোর্থ ডিভিশনের একটি ক্লাবের কোচ হয়েছে ও।
ওর মৃত্যুর খবরও তো ভেসে এসেছিল এক বার। জানি না মজিদ বাসকার এখন কী করছে।
কিন্তু ওর ছবিটা যতবারই চোখের সামনে ভাসে, ওর উত্থান, পতনের সময়গুলোর কথা যখনই মনে পড়ে তখন শুধু এটুকুই বলতে ইচ্ছে করে— ভাল থেকো, মজিদ। ভাল থেকো।
মাঝে মধ্যে অদ্ভুত এক জিজ্ঞাসা মাথার মধ্যে ঘোরে, অন্ধ কবি হোমার যদি বেঁচে থাকতেন, তা হলে কি মজিদ বাসকারকে নিয়ে কোনও রচনা লিখতেন?
এমন ট্র্যাজিক হিরো আর কে কবে কোথায় দেখেছে!