সময়টা সত্তর দশকের শুরু। অমর্ত্য সেন তখন লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স-এ শিক্ষকতা করছেন। ওঁর ছাত্র, কৌশিক বসু, এই সময়ের নামকরা অর্থনীতিবিদ, বসেছিলেন ওঁর ঠিক সামনেই। একটা ইন্টারন্যাশনাল ফোন করতে হবে অমর্ত্য সেনকে। সেই সময় আন্তর্জাতিক ফোন ট্রাঙ্ক কল করে করতে হত।
‘কল’ করার সময় অপারেটর কিছুতেই ওঁর ‘সেন’ পদবিটা বুঝতে পারছিলেন না। বারবার তিনি ভুল উচ্চারণ করছেন। বার কয়েক অমন ব্যর্থ চেষ্টার পর অমর্ত্য সেন তাঁকে বললেন, ‘‘সেন... এস ফর সামবডি, ই ফর এভরিবডি, এন ফর নোবডি।’’ হঠাৎ করে তিনি ব্যাপারটা অমন করে ব্যাখ্যা করলেন।
এই ঘটনাটি আমি শুনেছি কৌশিক বসুর কাছে। নব্বই দশকে যখন আমি কর্নেল ইউনিভার্সিটি-র ছাত্র, উনি ছিলেন আমার পিএইচডি- পরামর্শদাতাদের একজন। এই অবাক করা ঘটনাটি লক্ষণীয় ভাবে অমর্ত্যদাকে মানুষ হিসেবে চিনিয়ে দেয়। একটা কথা, বাঙালিদের পড়াশোনোর জগতে, বছর বছর ধরে সিনিয়রকে ‘দাদা’ বলে ডাকার একটা ঐতিহ্য আছে। আমার অবশ্য ওঁকে দাদা ডাকতে খুব অস্বস্তি হয়। বিশেষত বয়সের ফারাকটার কারণে, কিন্তু এটাই চলে হয়ে এসেছে। ওঁর বৌদ্ধিক প্রাজ্ঞতা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তার বাইরে অমর্ত্যদা অত্যন্ত রসিক এবং অসম্ভব সহানুভূতিশীল।
উনি সত্যিই একজন ‘সামবডি’ (কেউ একজন), যাঁর উপস্থিতি সবখানে। তার পাশাপাশি, ওঁর মনুষ্যত্বর জন্য ওঁকে সবার আগে সাধারণ একজন মানুষের মতো লাগে—‘এভরিবডি’। শেষমেশ, ওঁর বিনয়, ওঁর অমন আকাশছোঁয়া কৃতিত্বর পরেও, ওঁকে ‘নোবডি’ (কেউ না) করে রাখে। ‘সেন’ সত্যিই এক মূর্তিমান অস্তিত্ব।
ওঁর ওপর যখন তথ্যচিত্র করছিলাম তখন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের ওঁর মাস্টার্স লজ-এ ছিলাম। ওই সময় শান্তিনিকেতনে ওঁর বাড়ি ‘প্রতীচী’-তেও থেকেছি।
তখন দেখেছি, দু’জায়গাতেই উনি কী রকম একই ভাবে স্বছন্দ। আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে এই ব্যাপারটা আমি নিজের চোখে কাছ থেকে দেখতে পেরেছি।
কেমব্রিজে ওঁর স্ত্রী এমা (রথশিল্ড) আর অমর্ত্যদা দুজনেই খুব অতিথিপরায়ণ ছিলেন। আমার বরং একটু অস্বস্তি হত। ওই রাজকীয় ব্যবস্থা, ওই জাঁকজমক— সবটা মিলে।
সবচেয়ে বড় কথা, মাস্টার্স লজ হল পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে তাবড় সব দিকপাল বুদ্ধিজীবীদের আবাস।
শান্তিনিকেতনে অমর্ত্যদা যে ভাবে সহজেই ‘বাবলু’-তে রূপান্তরিত হয়ে যেতেন, সত্যিই এটা দেখতে পাওয়া বিরল অভিজ্ঞতা।
মনে আছে, এক বিকেলবেলার কথা।
অমর্ত্যদা একজন জুতো-সারাইওয়ালার সঙ্গে কথা বলছিলেন।
সেই আলাপে কী না ছিল!
তাও একেবারে অনুপুঙ্খ ভাবে। লোকটির ছেলেপুলে কী করছে, কোথায় পড়ছে থেকে বর্ষায় ওর বাড়ির ছাদ ফুটো হয়ে জল পড়ছে কি না, সব।
আরও যেটা লক্ষ করার, তা হল, কথাবার্তাটা যেন হচ্ছিল, একেবারে সমানে-সমানে।
এক বিকেলের কথা মনে পড়ে।
ওঁর মা অমিতাদেবী আর অমর্ত্যদার সঙ্গে খুব গল্প-হাসি চলছিল।
আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, অমিতাদেবী আমার দেখা অন্যতম উজ্জ্বল এবং প্রাণবন্ত একজন নারী।
এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি। প্রায়ই আমার কাছের লোকেদের কাছে ব্যাপারটা আমি মজা করে বলে থাকি। অমর্ত্যদাকে বকুনি খেতে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে!
অমিতাদেবী তখন বিরানব্বই।
বয়েসের জন্য স্মৃতি বেশ দুর্বল।
দুপুরে খাওয়ার আগে উনি সে দিন বারবার আমাকে হাত ধোওয়ার কথা বলছিলেন।
পর পর তিন বার বললেন।
একটা সময় অমর্ত্যদা ওঁকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে কড়া বকুনি।—‘‘সুমনকে আমি যতবার খুশি বলব, তুই এর মধ্যে কিছু বলবি না তো বাবলু।’’
বাবা ও মায়ের সঙ্গে শিশু অমর্ত্য ও তাঁর বোন সম্পূর্ণা
এ কথায় অমর্ত্যদা ওঁর চিরাচরিত সুন্দর হাসিটা দিয়ে বকুনিটা মাথা পেতে নিলেন। উত্তর করলেন, ‘‘আচ্ছা, আবার বলো তা হলে ওকে হাতটা ধুয়ে আসতে।’’
নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন তখন পুরোপুরি ‘বাবলু’— ওঁর মায়ের সামনে, একেবারে শিশুর মতো।
কে ভাবতে পারে, আঠেরো বছর বয়সে এই মানুষটার যখন ক্যানসার ধরা পড়ল, ওঁর আয়ু ছিল মাত্র ছ’মাস!
উনি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। ওঁর মা আমাকে বলেছিলেন, চিকিৎসকরা বলে দিয়েছিলেন, আর মাত্র ছ’মাস!
প্রথম ছ’মাস পেরিয়ে গেল। তার পরেও ওর লড়াইটা চলল। উনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলেন। ওখানেই রেডিয়েশন নেওয়া শুরু হল।
এই ঘটনাটা নিয়ে অমর্ত্যদার সঙ্গে কথা বলাটা, সব মিলিয়ে একটা শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা।
ডাক্তাররা যখন ধরতে পারেননি তাঁর ক্যানসার, অমর্ত্যদা নিজেই ধরে ফেলেন তাঁর ক্যানসার হয়েছে।
এমনকী ক্যানসারের উপর প্রচুর মেডিকেল বই তন্ন তন্ন করে পড়ে, কী টাইপের ক্যানসার সেটাও উনি বুঝে ফেলেন।
উনি যে ভাবে নিজের ক্যানসার নিয়ে লড়েছিলেন, তার মধ্যেই বড় মাপের গবেষক হয়ে ওঠার চিহ্নগুলো স্পষ্ট।
আবেগ নেই। শুধু হাতের কাছে যে যে সমস্যা এসেছে, সেটা সমাধান করার একটা খিদে।
আমার তথ্যচিত্রে উনি খুব খোলাখুলি ভাবে এ নিয়ে কথা বলেছিলেন।
প্রথম বার আমার ছবির পাবলিক স্ক্রিনিং। অমর্ত্যদার উপর তথ্যচিত্রটাই ছিল আমার প্রথম ছবি।
স্ক্রিনিং হয় হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। আয়োজন করেছিলেন সুগতদা (বসু)। হার্ভার্ডের ইতিহাসের অধ্যাপক।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, স্ক্রিনিং-এর আগে আমি কী প্রচণ্ড টেনশনে ছিলাম!
বিশেষ করে, ছবি দেখানোর পর প্রশ্নোত্তর পর্বটা নিয়ে। যেখানে আমি, অমর্ত্যদা আর সুগতদা ছিলাম।
শত হলেও সেটা ছিল হার্ভার্ড, বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। দর্শকদের মধ্যে বেশ কয়েক জন নোবেলজয়ী লোকজন আর ‘ফিল্ডস মেডেল’ পাওয়া মানুষ। স্পষ্টতই আমি খুব নার্ভাস। জীবনে কোনও ঘটনায় এতটা নার্ভাস হইনি।
অমর্ত্যদা ব্যাপারটা কোনও ভাবে লক্ষ করেছিলেন। এর পর উনি প্রশ্নোত্তর পর্বে আমাকে যে ভাবে আগলে বেড়ালেন, কিছুতেই ভোলার নয়। এই ব্যাপারগুলো ওঁর মধ্যে খুব স্বাভাবিক ভাবে আসে।
একটা মজার ঘটনা বলে লেখাটা শেষ করব।
লন্ডন থেকে কলকাতা যাব। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ-এর বিমানে। তখন লন্ডন-কলকাতা সরাসরি বিমান চালু ছিল।
আমি একটা বই পড়ছিলাম। দেশপ্রেম নিয়ে কত গুলো প্রবন্ধের একটি সংকলন। তাতে অমর্ত্যদারও একটা লেখা ছিল।
বোর্ডিং-এর আগে হঠাৎ অমর্ত্যদাকে দেখতে পেলাম। এগিয়ে গেলাম। ‘হ্যালো’ বললাম। কথা শুরু হল আমাদের। আমার মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল, কথা বলছিলাম সে সব নিয়েই।
কথার তোড়ে আমার খেয়ালই ছিল না, আমি ওঁর সঙ্গে ফার্স্ট ক্লাস প্যাসেঞ্জারের দিকে চলে এসেছি। এ দিকে আমার টিকিট ইকনমি ক্লাসের। যে এয়ারহোস্টেজ বোর্ডিং পাস চেক করছিলেন, তিনি অমর্ত্যদারটাও চেক করলেন। সঙ্গে সঙ্গে খেয়ালও করলেন আমি ভুল দিকে চলে এসেছি। উনি অমর্ত্যদাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আপনারা কি একসঙ্গে?’’
তখন হুঁশ হল আমার। ভাবলাম, এ বারে নিশ্চয়ই অমর্ত্যদা কিছুটা অস্বস্তিতে পড়বেন। কিন্তু তার সঙ্গে কৌতূহল, উনি কী বলেন সেটা শোনার।
যথারীতি হতাশ করলেন না।
বিমানসেবিকাকে জবাব দিলেন, ‘‘টুগেদার ইন লাইফ, আনফরচুনেটলি নট টুগেদার ইন দিস ফ্লাইট। আই শ্যাল ওয়েট।’’
উনি আমার সঙ্গে অপেক্ষা করলেন। আমরা দু’জনে ইকনমি ক্লাসে উঠলাম।
এই হল অমর্ত্য সেন।
মানুষ অমর্ত্যদা।
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/a-special-write-up-on-amartya-sen-1.346340
No comments:
Post a Comment