‘আশীর্বাদ’-এর দেবদাস
বারবার ঈর্ষা করেছেন অমিতাভ বচ্চনকে। অপমানে বিদ্ধ করেছেন প্রযোজক থেকে সাংবাদিকদের। শেষ জীবনটা তিনিই কাটিয়েছেন এক নিঃসঙ্গ সম্রাটের মতো। রাজেশ খন্না। লিখছেন গৌতম ভট্টাচার্য
১৬ জানুয়ারি, ২০১৬, ০০:০৩:০০
মুম্বইয়ের বিখ্যাত সাংবাদিক। বর্তমানে স্টার স্পোর্টস-এর কমেন্টেটর আয়াজ মেনন সে দিন কর্মজীবনের সব বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতে রাজেশ খন্নার কথা তুলল।
আয়াজ তখন ‘বোম্বে টাইমস’-এর এডিটর। এমন পজিশন যে শাহরুখ থেকে আমির— সবাই সম্পর্ক ভাল রেখে চলবে।
এক দিন হঠাৎ রাজেশের এক বন্ধু ওকে ফোন করে বলল, ‘‘রাজেশ কথা বলতে চান। আপনি যদি এর মধ্যে সন্ধেয় একবার ‘আশীর্বাদ’-এ আসেন।’’
‘আশীর্বাদ’ মুম্বই শহরে এক কথায় সবাই চেনে। কার্টার রোডে রাজেশের বিখ্যাত বাংলো। নির্দিষ্ট দিনে সেখানে গিয়ে আয়াজ রীতিমতো বিস্মিত। ওর ধারণা ছিল রাজেশ নিশ্চয়ই ওয়ান অন ওয়ান কথা বলতে ডাকছেন। এমন একটা মজলিশের মধ্যে ডেকে কেউ জরুরি কথা বলে নাকি। মজলিশের চেহারাটাও এবড়োখেবড়ো। রাজেশ এবং বাকিরা। রাজেশ তখন এমপি। কিন্তু এমপি হলে কী হবে বলিউডের মধ্যগগন থেকে অস্তে যাওয়ার হতাশা তো আর কাটছে না। কয়েক পেগের পর নেশাও তখন চড়েছে। রাজেশ বলতে শুরু করলেন, ‘‘আপনারা জার্নালিস্টরাই মাথায় চড়িয়েছেন অমিতাভ বচ্চনকে। ও কোনও অভিনেতা হল! আম পাবলিকও ওর চেয়ে ভাল অভিনয় করে।’’
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল কী ট্র্যাজিক জীবন। সব কিছু থেকেও সম্রাটের মতো সিংহাসন থেকে বিতাড়িত। আর যাঁর জন্য বিতাড়িত, তাঁকে জীবনভর ক্ষমা করতে পারেননি।
ধর্মেন্দ্র কখনও রাজেশের জায়গায় ছিলেন না। কিন্তু তাঁর অমিতাভ সম্পর্কে মূল্যায়নও তো নেগেটিভ। সম্ভবত একই কারণে নেগেটিভ। আমাকে একটা ইন্টারভিউ-এর মাঝে বলেছিলেন, ‘‘অমিতাভের সব কিছু তো মিডিয়াকে ম্যানেজ করে। এই তো আমি এলাম, কলকাতা এয়ারপোর্টে তেমন কোনও ভিড় নেই। অথচ অমিতাভ যে দিন নামল, কী ভিড়। আমায় বলুন তো লোকে আগে খবর পেয়ে গেল কী করে? নির্ঘাত মিডিয়ার মাধ্যমে। মিডিয়া কেন খবরটা দিল? না ওদের নিশ্চয়ই কিছু দেওয়া হয়েছে।’’
ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে মিডিয়ার সম্পর্ক অতীতে মোটেও ভাল যায়নি। সাংবাদিককের সঙ্গে অসংখ্যবার ঝামেলায় জড়িয়েছেন তিনি। মহিলা রিপোর্টারও তাঁর বদমেজাজের শিকার হয়েছেন।
অথচ সেই সময়ের সাংবাদিকদের মধ্যে যদি ভোট নেওয়া হয় কাকে মানুষ হিসাবে প্রেফার করেন? ধর্মেন্দ্র না রাজেশ? দশজনে ন’জন বলবেন ধর্মেন্দ্র। দশে দশও হয়ে যেতে পারে।
বান্দ্রার এক বিখ্যাত বাড়ির দোতলায় বসে গত বছর একটি সর্বভারতীয় কাগজের সিনিয়র ফিল্ম লিখিয়ে মীনা আয়ার তাঁর করুণ অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। আশির দশকে রাজেশকে তিনি ইন্টারভিউ করতে গেছিলেন। রাজেশ আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছি বলে ঘোরাতে থাকেন।
এভাবে সতেরো দিন তিনি ঘুরিয়েছেন। সতেরো নম্বর দিনে ফোনে বলেন, ‘‘আজ হচ্ছেই। কোনও চিন্তা কোরো না।’’
মীনা তাঁর বাংলোয় বসে সবে টেপ রেকর্ডার বার করেছেন, এমন সময় এক চামচে এসে বলল, ‘‘সাহেব আপনাকে জানাতে বলেছেন আজ ইন্টারভিউ হচ্ছে না।’’
এ বার সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন মহিলা সাংবাদিক। আর সহ্য হয়নি তাঁর। হাউ হাউ করে তিনি কাঁদতে থাকেন। সেই কান্না শুনে ওপর থেকে ছুটে আসেন রাজেশ এবং তাঁর তখনকার সঙ্গিনী টিনা মুনিম।
‘‘কী আশ্চর্য স্যাডিস্ট জানেন? আমার ওই অবস্থায় তখনও ওরা হাসছিল,’’ ক্রুদ্ধ, উত্তেজিত গলায় বলেন মীনা। গল্পটা তিনি আমাকে শোনাচ্ছিলেন না। যাঁকে শোনাচ্ছিলেন গ্যালাক্সি অ্যাপার্টমেন্টের দোতলায় বসা সেই প্রৌঢ় সব শুনেটুনে থমথমে গলায় বললেন, ‘‘বেয়াদ্দপি। কমপ্লিট বেয়াদ্দপি। আমরাও এই সব দেখেটেখে ওর সঙ্গে কাজ করা বন্ধ করে দিই। অথচ তার আগে কী সব সুপারহিট একসঙ্গে করেছি। ‘হাতি মেরা সাথি’, ‘আন্দাজ’।’’
প্রৌঢ়ের নাম সেলিম খান। বিশিষ্ট প্রোডিউসারদের মতো এই মহাতারকা সংলাপ লিখিয়ে জুড়িও সরে যান। রাজেশ থেকে প্রবেশ করেন অমিতাভের জীবনে।
সেলিমের বাড়িতেই পেয়ে গেলাম সাদা চুল, তীক্ষ্ণ চাউনির এক ভদ্রলোককে। বললেন, ‘‘আমি ছিলাম রাজেশের ম্যান ফ্রাইডে। একটা সময়ের পর আর পারিনি। কাজ ছেড়ে দিই। এখন বহু বছর আমি সেলিম সাবের সঙ্গে।’’ ভদ্রলোকের নাম প্রশান্ত রায়।
সেলিমের বাড়ি সফরের উদ্দেশ্য কিন্তু ফিল্মকেন্দ্রিক লেখালেখি ছিল না। বরঞ্চ ক্রিকেটকেন্দ্রিক। ‘সচ্’ লেখার জন্য তখন আমার বিনোদন জগতের কিছু ইনপুটস চাই।
সচিন ভারতের এমন সব রূপকথাসদৃশ আবেগ যে চমকপ্রদ সবাই এক কথায় রাজি। লতা রাজি, আশা রাজি, দেব আনন্দ রাজি। দিলীপকুমার তো বইয়ের মুখবন্ধই লিখে ফেললেন। নব্বই ছুঁই ছুঁই তখন তিনি। ক্রমাগত বাড়ি-হাসপাতাল করে যাচ্ছেন। তবু সাত দিনের মধ্যে সায়রা বানু নিজে উদ্যোগ নিয়ে লেখা মেল করে দিলেন। মান্না দে রি-অ্যাকশন দিলেন অমন অসুস্থ অবস্থায় দূর বেঙ্গালুরু থেকে। আমিরেরটার জন্য সচিন বলল, ওটা আমি করিয়ে দেব। শাহরুখ-অমিতাভেও সমস্যা নেই। সুস্মিতা-ঐশ্বর্যা রাই হয়ে গেল।
সমস্যা একমাত্র রাজেশ খন্না। প্রথম দিন বললেন, ‘‘দেবো।’’ সাত দিন পর আবার ফোন করলাম ওঁর নম্বরে। ধরে বললেন, ‘‘বিজি আছি। ওটা বলব।’’
কয়েক দিন বাদে রাজেশের নম্বর থেকে আমার মোবাইলে ফোন। গাড়িতে তখন। ধড়ফড় করে উঠে কাগজ অর্গানাইজ করে ফেললাম। ফোন ধরে নোট নিতে হবে তো। হ্যালো, হ্যালো।
শুকনো গলায় রাজেশ বললেন, ‘‘কিছু না। হাত লেগে গিয়েছিল।’’ এর পরও আরও দু’দিন একই জিনিস ঘটল। লাস্ট দিন তো হ্যালো, হ্যালো বলে কোনও সাড়াই পেলাম না।
সময়টা দু’হাজার এগারো-র জানুয়ারি। ‘আশীর্বাদ’-এ তখন মিডিয়ার যাতায়াত নেই। ইন্ডাস্ট্রির কারও সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই। মনে হল বহু দিন বাদে কোনও সাংবাদিকের ফোন পেয়ে একটু পুরনো অভ্যাসে তার মজা লুটলেন।
এই সে দিন কৌতূহলবশত মনে হল, নম্বরটায় একটু ফোন করে দেখি না, আদৌ আছে? নতুন কারও কাছে গিয়েছে? গেলে আজকের দিনে কে ব্যবহার করছেন রাজেশ খন্নার ফোন?
ফোন ধরলেন এক মহিলা, কে আপনি? পরিচয় দিলেন অনিতা।
দ্রুত মাথায় খেলে গেল, ইনিই কি তা’হলে অনিতা আডবাণি, যিনি জীবনের শেষ ক’বছর টানা রাজেশের সঙ্গে ছিলেন? এঁর সঙ্গেই কি ডিম্পল-অক্ষয় কুমারদের মামলা-মকদ্দমা চলছে রাজেশের সম্পত্তি নিয়ে?
জানা গেল ইনিই তিনি। এর পর যা কথা হল তুলে দিচ্ছি।
‘‘আপনি কি ‘আশীর্বাদ’ থেকে বলছেন?’’
‘‘না, ‘আশীর্বাদ’ কোথায়! সে বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। শশীকিরণ শেঠি বলে একজন ভদ্রলোক কিনেছেন।’’
‘‘বিক্রি হল কী করে? বাড়ি নিয়ে তো মামলা চলছিল।’’
‘‘সেটাই তো কমপ্লিট আদালত অবমাননা। তাই আমি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছি। ওরা আমার পিটিশন গ্রহণও করেছে। কী নোংরা ব্যাপার বলুন তো! মানুষটা এত করে চেয়েছিল ওর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটা একটা মিউজিয়াম হোক। ওর জিনিসপত্র থাকুক। ছবি থাকুক। লোকে ঘুরে ঘুরে দেখুক, ভারতীয় সিনেমার প্রথম সুপারস্টারকে। কাকাজির এটা প্রাপ্যও ছিল। অথচ কাকে না কাকে ওরা বাড়িটা বেচে দিল। জাস্ট টাকার লোভে। ’’
‘‘শেষ ক’টা বছর ইন্ডাস্ট্রির কার কার সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ ছিল?’’
‘‘কারও সঙ্গে না। উনি সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।’’
‘‘কেন?’’
‘‘মানুষটা এমনিতেই ‘লোনার’ ছিলেন। নিজের ছোট গোষ্ঠী নিয়ে থাকতেন। খালি বসে বসে ভাবতেন, কী ভাবে ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। ভাবতেন কিছু বিশ্বাসঘাতকতার কথা। আমার মনে হয়, ওঁর বোধ হয়, ঘেন্না ধরে গিয়েছিল অনেকের ওপর। তাই কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন না।’’
‘‘টিনা ওঁকে ছেড়ে গেছিলেন কেন?’’
‘‘কারণ টিনা ওঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কাকাজিও রাজি ছিলেন। কিন্তু ডিম্পল ডিভোর্স দিল না। ডিম্পল বলল, সমস্ত সম্পত্তি আমার নামে লিখে দাও, তা হলে তোমায় ছেড়ে দেব।’’
‘‘সেটা করতে উনি রাজি হননি?’’
‘‘না। উনি আদালতে যাওয়াটাওয়া, পাবলিক কেচ্ছা এ সব চাননি। ভেবেছিলেন শান্তিপূর্ণ ভাবে একটা রফা হয়ে যাবে। আবার উনি সিঙ্গল হয়ে বিয়ে করতে পারবেন।’’
‘‘আপনার সঙ্গে বিয়েটাও হল না কি একই কারণে যে উনি ডিভোর্স পেলেন না?’’
‘‘ইয়েস। ডিম্পল কিছুতেই দিল না।’’
‘‘অমিভাভ বচ্চন কি শেষ দিকে ওঁর ক্লোজ ছিলেন?’’
‘‘একেবারেই না। প্রশ্ন নেই।’’
‘‘তা হলে রাজেশের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অমিতাভ যে সবার আগে ছুটে এলেন। ব্লগ-এ পোস্ট করলেন।’’
‘‘আমি বলব এটা অমিতাভের ভেরি গুড জেশ্চার যে ছুটে এসেছিল। এর আগে কখনও ‘আশীর্বাদ’-এ যায়নি। কিন্তু শেষ সময় তো এল।’’
মুনমুন সেনের সঙ্গে একটা সময় খুব বন্ধুত্ব ছিল রাজেশের। মুনমুন মনে করেন, তাঁর মা আর রাজেশে নাকি অসম্ভব মিল, দু’জনেই মুডি, টেম্পারামেন্টাল, নিজেদের স্টাফেদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় এবং বর্ন স্টার। মুনমুন অনেক সহাভূতির সঙ্গে দেখেন রাজেশকে। তাঁর মনে হয় এই পর্যায়ের প্রতিভাসম্পন্ন মানুষকে সাধারণের ক্যাটাগরিতে ফেলে কাঁটাছেঁড়া করাটা অন্যায়। এঁদের আলাদা একটা অ্যালাউয়েন্স সব সময় দেওয়া উচিত।
ডিম্পল কখনও রাজেশ সম্পর্কে খোলাখুলি মুখ খোলেননি, তাঁর ধনকুবের বাবা চুনীলাল কাপাডিয়া খুব তিক্ত ছিলেন জামাই সম্পর্কে। বলেছিলেন, ‘‘রাজেশের আই কিউ এমন যে ওকে যদি বলা হয় ভারত ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করবে তা হলে ও সেটাকে মুম্বইয়ের রেড লাইট এরিয়ার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে পারে।’’
বছর বারো আগে ডিম্পলকে ইন্টারভিউ করার সময় রাজেশ-প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। ২০০৩-এর নভেম্বর। রাজেশ আর অমিতাভ দুজনেই তখন ষাট পেরিয়েছেন, ইন্টারভিউয়ের শেষে এসে জিজ্ঞেস করি, রাজেশ ছিলেন আপনার স্বামী। কোথায় গিয়ে তফাত হয়ে গেল দু’জনের?
ডিম্পল এক মিনিট চুপ। তার পর বললেন, ‘‘তফাত হয়ে গেল টাইমিং আর ভাগ্যে।’’ শুনে অবাক লাগল। রাজেশ সম্পর্কে এমন দার্শনিক, সহানুভূতিশীল জবাব আশা করিনি বলেই বোধ হয়।
আবার বললাম, ডিম্পল, সাধারণ ধারণা কিন্তু এই যে, দৌড়ে রাজেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ অসংযমী জীবনযাপন। শৃঙ্খলাই কি মহা টক্করে থাকা দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ফারাক করে দেয়নি?
ডিম্পল এতটুকু একমত নন। সামনে ইউনিটের স্পট বয় ঘোরাঘুরি করছিল। তাকে ডাকলেন, ‘‘অ্যা-ই তুমি আজ ক’টায় কাজে এসেছ?’’ সে বলল, দশটা। ‘‘ক’টায় ফিরে যাবে?’’ রাত্তির আটটা। ‘‘কালকেও তাই?’’ কালকেও তাই ম্যাডাম।
ডিম্পল এ বার আমার দিকে তাকালেন, ‘‘শুনলেন তো উদয়াস্ত কী খাটনিটাই না খাটছে। দারুণ ডিসিপ্লিনড। আপনি চাইলে সকাল দশটার বদলে সাতটাতেও চলে আসবে। কিন্তু তাতে কী? বুল শিট, যেমন দিনে একশো টাকা করে পেত, সেটাই পাবে, আসল হল তারকা ভাগ্য। ভাগ্যকে আপনি হারাবেন কী করে?’’
অমিতাভ আর রাজেশে আরও একটা বড় তফাত বোধ হয় করে দিয়েছে মন। সুপারস্টারদের মহাকাশে তুখড় অভিনয় ছাড়াও প্রয়োজন একটা ইস্পাত কঠিন মনের। তাঁদের গ্রহের আবহাওয়া যত খারাপই হোক, বেরিয়ে এসে মনের কথা চাঁচাছোলা করে বার করে দেবে না। বিষ যত বেশি মাত্রার হোক, গিলে নিয়ে মন দেবে নিজের কাজে।
বচ্চন চাইলে একটা মোটা বই লিখতে পারতেন, যার হেডলাইন হবে ‘বিজয়’। উনিশটা ছবিতে তাঁর নাম বিজয়। কিন্তু বইটা হত রাজেশ-বিজয়ের ওপর। কী একটা প্রবল শক্তিশালী সাম্রাজ্য, যার ভিত ছিল ১৯৬৯-৭১ এই তিন বছরে সুপারহিট হওয়া পনেরোটা ছবি, তাঁকে পরাস্ত করলাম। করে গড়লাম নতুন সাম্রাজ্য। মার মার কাট কাট বিক্রি হবে সেই বইয়ের।
আজও খোলাখুলি বলতে পারেন ‘গুড্ডি’র সেট থেকে শুরু করে ‘নমকহারাম’-এর ফ্লোর— সর্বত্র তাঁকে কী ভাবে চূড়ান্ত অপমান করেছেন সেই সময়কার সুপারস্টার।
অমিতাভ মুখই খোলেননি। উল্টে সাংবাদিক রউফ আমেদ লিখেছেন, ‘‘শোল-এর শ্যুটিংয়ে জোর আড্ডা হচ্ছে। ধর্মেন্দ্র, হেমা, সঞ্জীবকুমার, জয়া, অমিতাভ, আমজাদ। বিষয় রাজেশ খন্না। সবাই তুলোধনা করছেন রাজেশকে। একমাত্র অমিতাভ কিছু বলছেন না। তখন জয়া খোঁচালেন, ‘কিছু তো বলো।’’’ অমিতাভ ঘাড় নাড়লেন, কিছু বলতে চান না। আবার তাঁকে বলা হল। উত্ত্যক্ত বোধ করা অমিতাভ তখন চেয়ারটা সরিয়ে একটু দূরে গিয়ে বসলেন।
সেলিম জ্যোতিষচর্চায় ঘোর বিশ্বাসী মানুষ। তিনি মনে করেন, মানুষের জীবনে সময় আসল। রাজেশের জীবনে সাফল্য এসেছিল অদৃষ্টের আপন নিয়মে। আবার চলেও গেল আপন নিয়মে।
তিনি অবশ্য এটুকু মেনে নিতে রাজি আছেন যে ভাল যাওয়া সময়েও লোকে বাড়তি পরিশ্রম করেটরে সাফল্যের ওপর বাড়তি একটা পালিশ তৈরি রাখতে পারে। রাজেশ যা একেবারে করেননি। তিনি সাফল্যের ওপর বুঁদ হয়ে বসে গড়গড়া টেনেছেন। কলকাতার পুরনো বাবুদের মতো। বোঝেননি সময় আর পরিস্থিতি কোনওটাই চিরন্তন নয়।
‘আশীর্বাদ’ একটা সময় গান-হাসি-মশকরাতে টইটম্বুর থাকত। কিশোরকুমার নিয়মিত আসতেন, আরডি আসতেন। তখন কিশোরের গলায় রাজেশের গান আর রাহুলদেবের সুর দুর্দান্ত বক্স অফিস ছিল। রাজেশ খুব ভালবাসতেন আরডি-কে। বলতেন, ‘‘পঞ্চম মেরা কলিজা হ্যায়।’’ রাত্তির ন’টা হত কী রাজেশ হাঁক মারতেন বাড়ির কাজের লোকেদের, ‘‘শক্তিদা আ রহে হ্যায়। মেরা ট্রে রেডি করো।’’ ট্রে মানে, ট্রে-তে অবশ্যই মদের গ্লাস আর হুইস্কি।
‘আশীর্বাদ’-এ ভিড় করে থাকত বাঙালিদের গ্রুপ। শক্তি সামন্ত, কিশোরকুমার, শর্মিলা, দুলাল গুহ, অসিত সেন। এঁদের সংসর্গ রাজেশ খুব উপভোগও করতেন। বাঙালি সেই গ্রুপের আস্তে আস্তে আগমন বন্ধ হয়ে গেল। কিশোর মারা গেলেন। আরডি চলে গেলেন বছরখানেক বাদে। সেই জায়গায় ঢুকে পড়ল কিছু ব্যর্থ পঞ্জাবি অভিনেতা এবং দ্বিতীয় শ্রেণির প্রযোজক।
প্রশান্ত রায়ের মতে, এরাই আশীর্বাদ-এর ডিসিপ্লিন নষ্ট করে দিল। পঞ্জাবি গ্রুপটা ক্রমাগত রাজেশকে তেল দিয়ে যেত এই বলে যে, ‘‘পাপে তুসি তোপ হো।’’ মানে, বাবা, তুমি সত্যিই আগুন।
ডিম্পল যখন দুই মেয়েকে কোলে করে বাংলো ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখনও এরাই রাজেশকে সমানে বলে গিয়েছে, ‘‘কাকাজি, আপ ভগবান হ্যায়, এক ডিম্পল গ্যয়ি, পাঁচ ঔর আয়েগি।’’
জ্যোতিষে বিশ্বাস, অনিশ্চিত এই ইন্ডাস্ট্রির খুব কমন ব্যাপার। কিন্তু রাজেশ জ্যোতিষের দাবি মেনে সময় সময় যা করেছেন তাকে হঠকারিতা ছাড়া কিছুই বলা যায় না। শেষ দিকটায় আসলে সাফল্য ফেরত পাওয়ার জন্য দুঃসাহসী হয়ে গিয়েছিলেন।
স্টারডম ফেরত পাওয়ার লক্ষ্যে এক একজন জ্যোতিষী তাঁকে এক একরকম পরামর্শ দিতেন। কেউ বলতেন, বাড়িতে বিশেষ ধরনের মার্বল লাগালে তাঁর ভাগ্য ফিরবে, কেউ বলতেন, বাড়িতে বিশেষ কোনও আংটি।
একবার এক জ্যোতিষী নাকি এসে বলেন, আশীর্বাদ-এর বাইরের ঘরে মার্বল লাগানোর জন্য এই অবস্থা। দ্রুত সেটা তুলে ফেলা হল। তাতেও ভাগ্য ফিরল না। আবার লাখ লাখ খরচা করে সেটা লাগানো হল। আশেপাশের লোকজনের যা নমুনা ছিল তাতে তারা যে কেউ সৎ পরামর্শ দিতে পারবে এমন অবশ্যই নিশ্চয়তা ছিল না। বলিউডের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহানায়ক ক্রমশ ডুবতে থাকেন হতাশা থেকে আরও হতাশায়।
মুম্বইয়ের বিখ্যাত ট্রেড অ্যানালিস্টের সে দিন লেখা দেখছিলাম যে, আশির দশকে রাজেশ খন্নার বেশ কিছু ফিল্ম ভাল ব্যবসা করে ছিল। যেমন, ‘সৌতিন’, ‘বেবফাই’, ‘আজ কা এম এল এ রাম অবতার’। পঁচাশিতে রাজেশের এগারোটা ছবি রিলিজ হয় যার মধ্যে আটটা হিট। তাঁর চির প্রতিদ্বন্দ্বী দীর্ঘতর হিরো তখন স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিদেশে। নিউইয়র্কে ছোট ওয়ান রুম অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। রাজেশের প্রতিদ্বন্দ্বী তখন অনিল কপূর।
সময়টা ভাল কাটছিল তাঁর, ব্যক্তিগত জীবনেও টিনা মুনিম এসে গিয়েছেন। তবু ‘আশীর্বাদ’-এ প্রতি রাত্তিরে তিনি হা হুতাশ করতেন, সেই সময়টা তো আর ফিরল না।
ভাল সময়ে ঠিকঠাক বন্ধুবান্ধব তৈরি হলে তারা বিপদের দিনে আশীর্বাদ হিসেবে হাজির হয়। কিন্তু ‘আশীর্বাদ’বাসীর জীবনে তাদের খোঁজ কোথায়? এত সব সফল ছবির যিনি জুড়ি, সেই শর্মিলার সঙ্গেই কোনও সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয় না। উত্তম আর রাজেশের মধ্যে রোম্যান্টিক নায়ক হিসাবে কে আগে, তুলনা করতে বলায় শর্মিলা বলেছিলেন, ‘‘অবশ্যই উত্তম।’’
আমার টেপ রেকর্ডারে আজও ধরা রয়েছে তেরো বছর আগে নেওয়া সেই ইন্টারভিউ…‘‘অভিনেতা হিসেবে উত্তম অনেক বেটার। বেশি সিনসিয়ার। বেশি সৎ। বেশি রিয়্যাল। রাজেশের মধ্যে একটু গ্যালারি নেওয়ার প্রবণতা ছিল। আমরা হয়তো সবাই কমবেশি সেটাই করেছি। রাজেশ অসম্ভব জনপ্রিয়ও হয়েছিল। কিন্তু উত্তমের রেঞ্জটা অনেক বেশি ছিল। একটা দৃশ্যের এক্সপ্রেশন কত বিভিন্নভাবে উনি দিতে পারতেন…।’’
আজও সেই সময়কার রাজেশ ঘনিষ্ঠরা দোষারোপ করেন দু’জনকে। প্রয়াত চরিত্রাভিনেতা ওম শিবপুরী আর ভিলেন রঞ্জিত। রাজেশ নাকি সারাক্ষণ এই দুজন পরিবৃত থাকতেন।
তাঁর খুব পরিচিতদের কাছে আজ রাজেশ-কাহিনি শুনলে আশ্চর্য লাগে। তাঁর পিক টাইমে ‘আশীর্বাদ’-এ সর্বক্ষণই কোনও না কোনও কাজ হত। হয় মিস্ত্রি কিছু করছে বা ফার্নিচারওয়ালা কিছু লাগাচ্ছে। শোনা যায়, সেই মিস্ত্রিরা রুটিতে ঘি ঠিকমতো লাগিয়ে খাচ্ছে কিনা, তারও তদারকি করতে বলতেন রাজেশ। ডিসকাউন্টে কোনও কিছু কেনা ছিল তাঁর অপছন্দ। বলতেন, ‘‘রাজেশ খন্না পুরো টাকা দিয়ে জিনিস কেনে, ডিসকাউন্ট-ফিসকাউন্টের চক্করে ঘোরে না।’’
একই সঙ্গে কী কনট্র্যাডিকশন আর কী সীমাহীন ঔদ্ধত্য! যে মানুষটা মিস্ত্রিদের রুটিতে ঘি লাগানো রয়েছে কিনা প্রয়োজনে তার খোঁজখবর করেছেন, তিনিই কিনা মিডিয়াকে কুকুর বেড়ালের মতো তাচ্ছিল্য করেছেন। প্রডিউসারকে দিনের পর দিন বসিয়ে রেখেও দেখা করেননি।
জানতে ইচ্ছে করে, রাজেশ এত জ্যোতিষী দেখিয়েছেন, কখনও মনোবিদের কাছে গিয়েছেন কি? এক এক সময় তো মনে হয়, তিনি ছিলেন ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড।
সাধারণ ভাবে হিসেব করতে বসলে মনে হয় গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান নয়, রাজেশকে চুড়ো থেকে বেস ক্যাম্পে ছিটকে ফেলে ছিল জাগতিক কিছু কারণ।
• সাফল্যে আত্মহারা হয়ে পড়া
• চামচে পোষা
• ঔদ্ধত্য
সুপ্রিয়াদেবী যেমন আজও মনে করেন, চামচেরাই সর্বনাশ করেছিল উত্তমের। সর্বক্ষণ তারাই সব ভুল পরামর্শ দিত। এদের ইন্ধনেই নাকি রাজকপূরের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের রাস্তায় গেছিলেন উত্তম।
সমস্যা হল রাজেশের এমনই ইগো যে বুঝতে চাননি সময় বদলাচ্ছে। দেশ বদলাচ্ছে, দর্শকের রুচি বদলাচ্ছে। খালি বলতেন, ‘‘এই লম্বু অভিনয় জানে না, সে কত দিন আর থাকবে?’’ চামচেরাও বলত, স্যার পড়ে গেল বলে। আরও পেগ ঢেলে দিত আর বলত, ভারতবর্ষের একমাত্র সুপারস্টার আপনিই। জীবিত বা মৃত। সেই ‘আনন্দ’-এর সময় থেকেই অমিতাভকে তিনি ব্যঙ্গ করতেন, ‘হ্যাঙ্গার সে লটকতা হিরো’ বলে। জয়াকে বলেছিলেন, ‘এই মালের সঙ্গে প্রেম করো কী করে?’
ওদিকে অমিতাভকে তাঁর বাবা বলে দিয়েছিলেন, কোনও বাড়ির ভেতরে যদি ওঠার চেষ্টা করে দ্যাখো ফ্রন্ট গেটে তালা, তখন পাঁচিল টপকে ঢুকবে। তাঁর আগমনের সময়ে ইন্ডাস্ট্রিতে তো সেই অবস্থাই জারি ছিল। রাজেশ বহাল তবিয়তে মানে ফ্রন্ট গেটে তালা। তবু অমিতাভ যে লাফিয়ে ঢুকে পড়তে পেরেছিলেন তার একটা কারণ যদি তাঁর নিজের কৃতিত্ব হয়, অন্যটা রাজেশের মনোভাব। যা পাঁচিলটাকে আরও নিচু করে দিয়েছিল তাঁর প্রতিপক্ষের জন্য।
সাফল্যকে নেওয়ার মনোভাবেও দু’জন এত আলাদা যেন সত্তর দশকের গাওস্কর আর বিশ্বনাথ। গাওস্কর ডাবল সেঞ্চুরির পরের দিনও ব্রেবোর্নে বিজয় মার্চেন্টকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘স্যার, কাল আমার একটা হুক স্কোয়্যার লেগ দিয়ে যাওয়ার বদলে ফাইন লেগ দিয়ে গিয়েছিল, আমার কাঁধটা কি আগেই বাঁ দিকে ঘুরে গেছিল?’’
বিস্ফারিত মার্চেন্ট বলেছিলেন, ‘‘আমি এটুকু বলতে পারি তুমিই ভারতের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান।’’
বিশ্বনাথ হলে? সেঞ্চুরি করুন, পঞ্চাশ বা জিরো, রাত্তিরে ব্ল্যাক লেবেল লাগবেই, দিনের বেলা বিয়ার। এমনও হয়েছে নিউজিল্যান্ডে বালিশের পাশে মদের বোতল নিয়ে ঘুমোতে গিয়েছেন। মদের বোতল পাশবালিশ হলে নাকি ফিলিংসটা অন্যরকম হয়।
অমিতাভ যখন বলেছেন এবং ভেবেছেন, সাফল্য আমার বা অন্যের যারই হোক, এত ক্ষণস্থায়ী যে তা নিয়ে মাতামাতি করার মানে হয় না। তখন রাজেশ পুরনো ছবির পাঁচ বছরের অ্যানিভার্সারি সেলিব্রেশনে পার্টি দিচ্ছেন। একটা বন্ধুও তখন পাশে নেই। যাঁদের যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন সেই শর্মিলা, হেমা, ধর্মেন্দ্র, জয়া, জিনাত এমনকী মুমতাজও নেই। প্রত্যেকে কোনও না কোনও কারণে মানসিক ভাবে আহত হয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।
আর আশীর্বাদ-এর রাজা, তিনি পরের পর রাত মেহফিলে ফুর্তি উড়িয়েছেন। একটু রাত হয়ে গেলে বিষণ্ণ হয়ে পড়েছেন, সোনার দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল? ঝাড়লণ্ঠনের তলায় তাই বারবার ছায়া পড়েছে বিষণ্ণ এক মহানায়কের। যে চক্রব্যূহ থেকে বার হওয়ার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। জীবনটা শেষমেশ তা হলে তাঁর কী? আশীর্বাদ না অভিশাপ? ভাগ্যের বরপুত্র, নাকি শাপভ্রষ্ট রাজপুত্র?
এত সব ধন্য ধন্য ট্র্যাজিক ছবির নায়ক তিনি। কিন্তু রাজেশ খন্নার জীবনের চেয়ে বড় ট্র্যাজিক ফিল্ম সব ক’টা মিলেজুলেও নয়। হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অবিসংবাদী দেবদাস তাঁকেই মনে হয় আমার।
দেবদাস মানে তো শুধুই নারী আর প্রেমে ক্ষতবিক্ষত হওয়া নয়। দেবদাস মুখোপাধ্যায় এক পুরুষের বিয়োগান্ত কাহিনি যে উথালপাথাল আবেগেও নিজের প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। হতাশ প্রেমের আগুনে পুড়তে পুড়তে যে নিষ্ফল মৃত্যুবরণ করে, রাজেশেরটাও বিয়োগান্ত প্রেম। নিজের সাম্রাজ্য ফিরে পেতে চাওয়ার উথালপাথাল করা অভিযানের ব্যর্থ পরিসমাপ্তি। এটাও তো একই রকম রোম্যান্টিক।
সত্তর বছর কয়েক মাস বয়েসে অমিতাভ যখন অলিম্পিকের মশাল নিয়ে লন্ডনের রাস্তায় ছুটছেন, তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী তো পৃথিবীতেই নেই। দিনকয়েক আগে সেই বাড়িতে মারা গিয়েছেন যা তাঁর বৈভব এবং দীনতা একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছে।
মারা যাওয়ার আগে শেষ শব্দ উচ্চারণ করেছেন, ‘‘প্যাক আপ।’’আহা কী সিনেমাটিক, যেমন জীবনে তেমন মরণে।
এই তো সার্থক দেবদাস।
সৌজন্য: ‘তারাদের শেষ চিঠি’,
দীপ প্রকাশন, মূল্য ৩০০ টাকা
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/special-write-up-by-gautam-bhattacharya-on-rajesh-khanna-1.284294
No comments:
Post a Comment