হাতে একটা হ্যাঁচকা টান দিলেন বায়ুসেনার বাঙালি স্কোয়াড্রন লি়ডার, ‘‘যেতে চান চলুন, আমরাও একটা অ্যাডভেঞ্চার করে আসি। এক জন বাঙালি কোনও কিছু না ভেবে ডিঙি নৌকো নিয়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিল, আর আপনি আমার সঙ্গে প্লেনে ওকে খুঁজতে যেতে পারবেন না? চলুন, চলুন। আকাশে উড়ে দেখবেন, জীবন কত তুচ্ছ।’’
ভেতো বাঙালি রিপোর্টার আমি কোনও দিন এমন পরিস্থিতির সামনে পড়িনি। একটু হতভম্ব হয়েই বলি, চলুন।
এর পর এগোতে গিয়েও একটু থমকে গিয়ে বায়ুসেনার অফিসার বললেন, ‘‘আপনি মরলে কাঁদার জন্য কে কে আছে? মা, বাবা, বউ?’’
বললাম, দূর মশাই, আগে তো মরি।
আসলে ততক্ষণে হারিয়ে যাওয়া নৌ-অভিযাত্রী ডিউক-পিনাকীকে বঙ্গোপসাগরে খুঁজতে যেতে জেদ চেপে গিয়েছে। সত্যিই তো, পিনাকীর ঝুঁকির কাছে এটা তো কিছুই না!
পিনাকী। পিনাকীরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। আর ডিউক মানে জর্জ অ্যালবার্ট ডিউক। বছর তেইশের পিনাকী তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যার গবেষক, রোয়িংয়ে চ্যাম্পিয়ন।
ওঁর সঙ্গী, দিল্লির ছেলে জর্জ অ্যালবার্ট ডিউক ভারতীয় নৌসেনার অফিসার। পিনাকীর চেয়ে ডিউক দু’বছরের বড়।
১ ফেব্রুয়ারি ওঁরা কলকাতায় গঙ্গার বুকে দাঁড় টানা ডিঙি নৌকোয় রওনা হয়েছেন আন্দামানের উদ্দেশে। নৌকোর নাম কানোজি আংরে।
শিবাজীর নৌ সেনাপতি তুকোজি আংরের ছেলে ছিলেন কানোজি আংরে। একাই ইংরেজদের বহু জাহাজকে ধ্বংস করেছিলেন। সেই কানোজির নামেই নৌকোর নামকরণ।
যত দূর মনে পড়ছে, নামকরণটা করেছিলেন ওই অভি়যানের প্রাণপুরুষ, বিশ্ববন্দিত সাঁতারু মিহির সেন। কিন্তু অভিযান শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই বিপত্তি। ৮ তারিখ থেকে ওদের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বেতারে ওদের ‘আর আর আর’ সঙ্কেত আসার কথা। অর্থাৎ সব ঠিক আছে। অথচ কোনও সঙ্কেতই আসেনি।
১৯৬৯। ১২ ফেব্রুয়ারি। ঠিক হয়েছে, বায়ুসেনার বিমান বঙ্গোপসাগরের উপর আকাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় উড়ে ওঁদের খুঁজতে যাবে। খবর পেয়ে সাতসকালে চলে আসা বিমানবন্দরে। তখন নাম ছিল দমদম বিমানবন্দর। সেখানে কানপুর থেকে উড়ে এসেছে বায়ুসেনার বিমান সুপার কনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে যাই সেই স্কোয়াড্রন লিডারকে, যিনি ওই বিমান নিয়ে উড়বেন। আর দেখি, তিনিও বাঙালি।
গোপনে সফর
স্কোয়াড্রন লিডার বললেন, ‘‘আপনি সিভিলিয়ান। এয়ারফোর্সের প্লেনে যাওয়ার পারমিশন এমনিতে নেই। আমি সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি। তবে এর কোনও রেকর্ড থাকবে না। খারাপ কিছু ঘটলে আপনার খবর কেউ কিছু জানতে পারবে না।’’
সুপার কনি ছোট প্লেন। এমন বিমানে কখনও উঠিনি। আরামের আসন নয়। কোনও রকমে বসে থাকা। এখন যেমন ইসলামিক স্টেট জঙ্গিরা তাদের শত্রুদের পিছমোড়া করে বেঁধে বধ্যভূমিতে কোতল করতে নিয়ে যায়, ওই প্লেনের আনকোরা যাত্রী এই সাংবাদিককে পিছমোড়া করে তেমন ভাবে বেঁধে দেওয়া হল। প্লেন গোঁত্তা খাওয়ার সময়ে যাতে ছিটকে না পড়ি।
কিন্তু প্লেনে বসেই বুক দুরু দুরু। কোনও অঘটন ঘটলে তো কোনও প্রমাণও থাকবে না। অফিস, বাড়ি কেউ কোথাও জানবে না, আমার কী হল। স্কোয়াড্রন লিডারকে জিজ্ঞেস করলাম, হেলিকপ্টারেও তো তল্লাশি চালানো যেত!
অভিযান শুরু
|
উনি বললেন, ‘‘হেলিকপ্টার অত দূর গিয়ে ফিরতে ফিরতেই জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে।’’ এই সব কথাবার্তার মধ্যে মিনিট পনেরোর মধ্যে সুপার কনি টেক অফ করল। তখন সকাল ১০টা। চারশো মাইল বেগে সুপার কনি উড়ে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে। কুড়ি মিনিটের মধ্যে সীমাহীন জলরাশির উপরে আকাশে চক্কর শুরু হল। কানোজি আংরে-র সম্ভাব্য গতিপথ বৃত্তাকারে তল্লাশির জন্য বায়ুসেনার বিমান গোঁত্তা খেয়ে নিমেষে দু’হাজার ফুট নীচে নেমে এল। বঙ্গোপসাগরের বুক থেকে আমরা তখন মাত্র পাঁচশো ফুট উপরে। বিমানের জানালা দিয়ে সাগরের উঁচু উঁচু ঢেউ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি জলে পড়ে যাবে প্লেন।
আংরে নিখোঁজ
প্রথমে শূন্যে বড় একটা অদৃশ্য বৃত্ত তৈরি করে খোঁজা শুরু হল। তার পর ক্রমশ সেই বৃত্তকে ছোট, আরও ছোট, আরও আরও ছোট করে ডিউক-পিনাকীকে খুঁজতে শুরু করল সুপার কনি। কিন্তু পাওয়া গেল না।
এ বার অন্য দিকে সরে গিয়ে একই ভাবে অনুসন্ধান।
চতুর্দিক নীল আর নীল, তার মাঝখানে দু’টো সাদা বিন্দু। পরে বুঝলাম, বহু দূরে দু’টো জাহাজ। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে আসছে কলকাতার পথে বঙ্গোপসাগর ধরে।
সুপার কনি থেকে তাদের জিজ্ঞেস করা হল, তোমরা কি কানোজি আংরে-কে দেখতে পেয়েছ? দেখতে পেলে জিজ্ঞেস করবে, ওরা কেমন আছে। সমুদ্রে ওদের অবস্থানটাও নির্ভুল ভাবে জানাবে।
কিন্তু কোথায় কী!
দু’টো জাহাজই হতাশার খবর শোনাল। জানাল, ওরা সেই নৌকোর দেখা পায়নি। কাকতালীয় ভাবে ঠিক তখনই দমদমের কন্ট্রোল টাওয়ারের প্রশ্ন, কানোজি আংরে-র কোনও খবর পাওয়া গেল? সুপার কনি-র জবাব, ‘‘নো নো, নট ইয়েট।’’
সমুদ্রের বুকে আলো কমে আসছে ক্রমশ। সূর্য তখন সে দিনের মতো ডুব দিতে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের অনন্ত জলরাশির বুকে।
সুপার কনি-র বাঙালি স্কোয়াড্রন লিডার তবুও হাল ছাড়ার পাত্র নন। সার্চ লাইট জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ দেখা হল। তবু কোথাও ডিউক-পিনাকীর খোঁজ নেই।
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সুপার কনি দমদম বিমানবন্দরে ফিরে এল। রিক্ত, ব্যর্থ হয়ে। ডিউক-পিনাকী সংক্রান্ত কোনও খবর যে তার কাছে নেই। মানে, আমাদের কাছে নেই।
বিমানবন্দরের প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে ঢুকতেই শুনতে পেলাম লাউডস্পিকারে ইংরেজি ও বাংলায় ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘এই মাত্র বে অব বেঙ্গলে সার্চ করে এয়ারফোর্সের প্লেন ফিরেছে। কানোজি আংরের দেখা পাওয়া যায়নি। কাল এয়ারফোর্সের বিমান ফের সার্চ করতে বেরোবে।’
ঘোর দুশ্চিন্তা নিয়ে ষষ্ঠসিন্ধুবিজয়ী সাঁতারু মিহির সেনকে ফোন করলাম।
হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করি, তা হলে কি ধরে নেব, সব শেষ, আর কোনও আশা নেই? ওরা কি বঙ্গোপসাগরে ভেসে গেল!
মিহির সেন অভয় দিলেন।
বললেন, ‘‘সম্ভবত ওরা স্যান্ডহেডস থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে। নেভি-র জাহাজ আই এন এস কুকরি ওদের জন্য অয়্যারলেসের নতুন ব্যাটারি সেট আর কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যাবে। দেখা পেলে দেবে।’’
দরিয়ায় ভাসছে আংরে
|
বুঝলাম, আমার মানসিক অবস্থা আঁচ করে মিহির সেন আমাকে এ সব বলে সান্ত্বনা দিতে চাইছেন। আমার সব ভাবনাচিন্তা কিন্তু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। পর দিন বায়ুসেনার বিমানে ওঁদের খুঁজতে বেরোলেন নৌসেনার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রথীন দাস।
অভিযানের জন্য উনিই ডিউক-পিনাকীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। রথীন দাস এমনই এক জন, যাঁর কাছে স্যান্ডহেডস থেকে পোর্ট ব্লেয়ারের রুট শুধু না, বঙ্গোপসাগরের নাড়ি-নক্ষত্রও জানা। তাই, কিছুটা ভরসা পেলাম।
সে দিন আর বায়ুসেনার বিমান নয়, সকাল থেকে আমার ঠিকানা বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ার। মাঝেমধ্যেই বার্তা আসছে যে, সার্চ চলছে। দমদম থেকেও জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, এনি নিউজ?
প্রতি বারই নেতিবাচক উত্তর।
এ বার জিজ্ঞেস করা হল, ‘ইজ কমান্ডার দাস দেয়ার? দ্য জার্নালিস্ট অব আনন্দবাজার পত্রিকা ওয়ান্টস হিজ ভার্শন।’ কমান্ডার দাস এ বার নিজেই বললেন, ‘নো নিউজ অব কানোজি আংরে।’
সে দিন বিকেল চারটেয় ওঁর সুপার কনি দমদমে নামল। তবে কমান্ডার দাস দেখলাম হতাশ নন। উনি ব্যাখ্যা দিলেন, ‘‘এই দু’দিন আমরা সম্ভবত সমুদ্রের ভুল জায়গায় খুঁজেছি। কালও যাব। তবে স্ট্র্যাটেজি বদলাতে হবে। এ বার সাগরের অন্য দিকে আমাদের সার্চ করতে হবে। কাল দু’টো প্লেন যাবে। আর সুখবর হল, বে অব বেঙ্গলের ওয়েদার ভাল।’’
আমি কিন্তু কমান্ডার দাসের কথায় নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না।
ডিউক-পিনাকী ভেসে যায়নি
১৪ ফেব্রুয়ারি।
সকাল থেকে ফের আমার ঠিকানা বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ার।
টেক অফ করার আগে একটি প্লেনের পাইলট আত্মবিশ্বাসী গলায় বলে গেলেন, ‘‘আজ ওদের খুঁজে পাবই।’’ আর সুপার কনির সেই বাঙালি স্কোয়াড্রন লিডার বলে গেলেন, ‘‘ইয়েস অর নো। ওরা আছে না নেই। দু’টোর একটা আজ জেনেই ছাড়ব।’’ প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে মনে হচ্ছে অনেক দীর্ঘ।
বেলা দশটা, এগারোটা, বারোটা।
দেখতে দেখতে একটাও বেজে গেল। দু’টো প্লেনের কারও কাছ থেকে ভাল খবর কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা কেবলই বলছে, সার্চ চলছে।
এ বার প্রতিটি মিনিট দেখছি। বুকে যেন হাতুড়ি পিটছে। মনে হচ্ছে, ফুটবল ম্যাচের টাইব্রেকার চলছে। না না সাডেন ডেথ।
দু’টো বেজে এক মিনিট। দুই। তিন। চার। পাঁচ। ছয়। সাত। দু’টো আট। সব নিস্তব্ধতা ভেঙে তল্লাশিতে যাওয়া সুপার কনি জানাল, ‘হ্যালো দমদম। হেয়ার ইজ কানোজি আংরে!’
বায়ুসেনার সেই বিমানের বার্তা যেন এক শব্দময় প্রতিচ্ছবি পাঠাল, ‘বে অব বেঙ্গলে ওদের দেখা যাচ্ছে। আমরা সমুদ্র থেকে পাঁচশো ফুট উপরে। ওদের আর একটু কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ওরা সঙ্কেত পাঠাচ্ছে ‘আর আর আর’। মানে, সব ঠিক আছে! মাস্তুলে বেলুন উড়ছে। দুই অভিযাত্রীর পরনে ট্র্যাক সুট। নৌকায় দাঁড়িয়ে দু’জনেই হাত তুলে নাড়াচ্ছে।’
পিনাকী-ডিউকের সঙ্গে শেষ মুহূর্তের বোঝাপড়ায় রথীন দাস (মাঝে)
|
সুপার কনি-র ওই বার্তা যেন ছিল আর্কিমিডিসের ইউরেকা।
দমদম বিমানবন্দরের লাউঞ্জে লাউডস্পিকারে কানোজি আংরের খবর ঘোষণা করা হল। সঙ্গে সঙ্গে স্পেশ্যাল বুলেটিন আকাশবাণীর।
প্রায় এক সপ্তাহ সবাই গভীর উৎকণ্ঠায় কাটানোর পর কানোজি আংরে-র সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হল। ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ওঁদের খবর পাওয়া যাচ্ছিল না।
১৪ তারিখ বায়ুসেনার দু’টো বিমানই ওদের দেখা পায়। কলকাতা থেকে ওরা তখন ১৯০ মাইল দূরে।
পর দিন আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম হল, ‘ডিউক-পিনাকী ভেসে যায়নি।’ বঙ্গোপসাগরের জলে তাঁর ছেলেকে দেখা গিয়েছে। সে ঠিক আছে শুনে দক্ষিণ কলকাতার সদানন্দ রোডে চোখের জল পড়া বন্ধ হল পিনাকীর মা নীলিমা চট্টোপাধ্যায়ের।
আবারও নিখোঁজ
এর পর এগারো দিন দিব্যি সব ঠিকঠাক চলছিল।
মন্থর গতিতে হলেও আন্দামানের দিকে এগোচ্ছিল কানোজি আংরে।
তখন সম্ভবত উজানে যেতে হচ্ছিল ডিউক-পিনাকীকে। সাগরের বাতাসও অনুকূল ছিল না। পাল তো নেই, দাঁড় বেয়ে কত দ্রুতই বা যাওয়া সম্ভব!
কিন্তু ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ফের কানোজি আংরে-র খবর নেই।
নেভি-র জাহাজ বা পোর্টব্লেয়ার যাতায়াতের পথে কোনও বাণিজ্য জাহাজও কিছুই জানাতে পারছে না।
আমার রক্তচাপ ফের ঊর্ধ্বমুখী।
ওরা কি ওদের গন্তব্য আন্দামানের লক্ষ্য থেকে ভুল পথে চলে গেল?
নৌসেনার এক অফিসার বললেন, ‘‘ওরা যদি স্রোতের টানে অন্য দিকে চলে গিয়ে থাকে, তা হলে স্যান্ডহেডস থেকে আন্দামানের পথে ওদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভারত মহাসাগরের অকূল দরিয়ায় চলে যাবে।’’
কাজেই, আবার অনিশ্চয়তা। নতুন করে উৎকণ্ঠা। ২৭ তারিখেও কোনও খবর এল না। ২৮ তারিখ সারা দিনেও না। হঠাৎ সে দিন সন্ধ্যা সাতটায় পোর্টব্লেয়ার থেকে আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদদাতা সমর সোমের টেলিফোন, ‘‘দূর সমুদ্র থেকে নৌবাহিনীর একটি জাহাজ কানোজি আংরে-র খবর দিয়েছে শিপিং কপোর্রেশনের জাহাজ এম ভি নিকোবরকে। ওরা জানিয়েছে, পোর্টব্লেয়ার থেকে কানোজি আংরের দূরত্ব ৩৮০ মাইল।’’
তবে সেই বার্তা অনুযায়ী, এম ভি নিকোবর ওদের অবস্থান আন্দাজ করে সাগরের সেখানে পৌঁছে ওঁদের দেখা পায়নি।
যদিও ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ ‘ওশেন প্রিন্সেস’ যোগাযোগ করতে পেরেছিল ডিউক-পিনাকীর সঙ্গে। কিন্তু বিস্তারিত খবর পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবছিলাম, এম ভি নিকোবরকে খবর দেওয়ার পর কি কানোজি আংরে কোনও বিপদে পড়ল? রাত একটায় লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রথীন দাস ফের আশ্বস্ত করলেন, ডিউক-পিনাকীর হারিয়ে যাওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই। তবু ভয় হচ্ছে। ঠিকঠাক তথ্য তো কিছুই মিলছে না ওঁদের সম্পর্কে।
দুর্যোগেও দুর্জয়
গোটা অভিযানে দু’দফায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে হয়েছিল ডিউক-পিনাকীকে।
এক রাতের কথা।
পিনাকী সে দিন জেগে না গেলে অভিযান আর ওঁদের জীবন— দুটোরই ইতি তখনই ঘটে যেত।
দু’জনেই ঘুমোচ্ছিল তখন।
রাতের সমুদ্র হঠাৎই ভয়ঙ্কর চেহারা নিল। শুরু হল প্রবল ঝড়। এক-একটা ঢেউ তখন ২০ ফুট উঁচু।
কানোজি আংরে তখন যেন কাগজের নৌকো। মনে হচ্ছে, যে কোনও সময়ে উল্টে যাবে। পিনাকী কোনও রকমে ডেকে তোলেন ডিউককে। দু’জনে দ্রুত কোমরে দড়ি বেঁধে নেন। কোনও রকমে নৌকো সোজা করে পাম্প করে জল ফেলতে হয়। টানা তিন দিন, তিন রাত।
ভাগ্যিস, নৌকোর মধ্যে খাবার ছিল জালে বাঁধা। না হলে অনাহারে কাটাতে হত। পানীয় জলও কিছুটা নষ্ট হয়ে যায়। সমুদ্রের জলে ওষুধ দিয়ে তা-ই পান করতে হয়েছিল ওঁদের।
ওই অবস্থায় আর কোথায় অয়্যারলেস সেট! একটা পুরোপুরি নষ্ট। অন্যটার মাধ্যমে যোগাযোগ করার ফুরসতটুকু পাননি দুই অকুতোভয় অভিযাত্রী।
ওদের নিয়ে বিমান নামল দমদমে
|
আসলে ইন্দোনেশিয়ায় সেই সময়ে ভূমিকম্প হয়েছিল। তার জেরেই সমুদ্র অস্বাভাবিক রকম উত্তাল হয়ে ওঠে। স্যান্ডহেডস থেকে আন্দামানের নির্দিষ্ট পথ থেকে তাই অন্য দিকে বেশ কিছুটা সরে গিয়েছিল ওঁদের নৌকো।
আবার ঝড়ে কানোজি আংরে-র মাস্তুল ভেঙে যায়। কয়েকটা দাঁড়ও। পিনাকীর ডান হাতের আটটা লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। বাকি ক’দিন বাঁ হাতে দাঁড় টানতে হয় পিনাকীকে। ওঁর সঙ্গী ডিউকের আগেই হার্নিয়া ছিল। সেটা যায় বেড়ে। এই সব সমস্যার মুখোমুখি ওঁদের হতে হয়েছিল ৭ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি।
আবার সমুদ্র অশান্ত ২৫ ফেব্রুয়ারি। পাহাড় সমান উঁচু উঁচু ঢেউ। সে বার ঢেউয়ে একটি কম্পাস ভেঙে যায়। কানোজি আংরে-কে অবশ্য কোনও রকমে রক্ষা করতে পেরেছিলেন ওঁরা।
সে বারও নিদ্রাহীন দিন-রাত।
ওই ঝড়ের সময়ে ফের গতিপথ থেকে সরে যায় কানোজি আংরে। সমুদ্রে একটু থিতু হতেই ২৭ তারিখ ওঁরা ‘আর আর আর’ পাঠিয়েছিলেন।
কাছাকাছি তখন কোনও জাহাজ বা অন্য নৌকো ছিল না, যেখানে সেই বার্তা পৌঁছয়।
সুখবর
১ মার্চ সকাল প্রায় ১০টা। একটি ফৌজি বিমান ওদের দেখতে পায়।
পোর্টব্লেয়ার থেকে সমর সোমও ফোন করলেন, ‘‘ওঁরা এখন পোর্টব্লেয়ার থেকে ২৭০ মাইল দূরে। ৯ মার্চের মধ্যে ওঁরা পোর্টব্লেয়ারে পৌঁছতে পারে।’’ ফৌজি বিমানের বার্তা পেয়ে নৌবাহিনীর জাহাজ আই এন এস রঞ্জিত থেকে কয়েক জন অফিসার ও চিকিৎসক স্পিড বোটে দুই অভিযাত্রীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কিছু চাই কি না।
ডিউক-পিনাকী জানিয়ে দেন, কোনও প্রয়োজন নেই। সে দিনই জানা যায়, মাঝদরিয়ায় ওঁরা দশ দিন ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগেছিলেন, শারীরিক ভাবে দুর্বল, কিন্তু মানসিক ভাবে পুরোপুরি উজ্জীবিত, উৎসাহে এতটুকুও ভাটা পড়েনি। এর পর আর সাগরে হারিয়ে যায়নি কানোজি আংরে।
কলকাতার ম্যান অব ওয়ার জেটি থেকে প্রথম এভারেস্ট জয়ী অভিযাত্রী তেনজিং নোরগের পিস্তলের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে আন্দামান অভিযানের লক্ষ্যে কানোজি আংরের যাত্রা
শুরু হয়েছিল ১ ফেব্রুয়ারি। আর ডিউক-পিনাকী পোর্টব্লেয়ারের অ্যাবার্ডিন জেটিতে পৌঁছন ৮ মার্চ সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে। পোর্টব্লেয়ারের সমুদ্রতীরে তখন জনসমুদ্র।
পুনশ্চ: প্রেমের জোয়ারে
সাতচল্লিশ বছর আগে শিউলি চট্টোপাধ্যায়ের পদবি তখনও পাল্টায়নি। তিনি তখন শিউলি দাশগুপ্ত। স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্রী। বিএ পরীক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু কানোজি আংরে-র সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক? গোড়ায় জানতাম না।
ওই অভিযানে পিনাকীরা পোর্টব্লেয়ারে পৌঁছনোর এক দিন আগে যে ভূখণ্ডে প্রথম পৌঁছয়, তার নাম ল্যান্ডফল আইল্যান্ড। ৭ মার্চ। তার ২৭ দিন আগে ডিউক আর পিনাকীর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল। সাগর মোহনায় স্যান্ডহেডস-এ।
ল্যান্ডফল আইল্যান্ডে ওঁরা পৌঁছতে চোখে পড়েছিল, দোমড়ানো-মচকানো-রংচটা কানোজি আংরে-র গায়ে ছুরি দিয়ে কেটে ইংরেজি হরফে লেখা— শিলু।
ডিউক জানালেন, ওটা পিনাকীর কাজ। পিনাকীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে এক বার তাকাতেই তিনি বিষয়টা খোলসা করেন। শিউলি বা শিলু তাঁর প্রেমিকা। প্রায় পাঁচ দশক আগের সেই সব কথা স্মরণ করছিলেন শিউলি।
বলছিলেন, ‘‘আমাদের মেলামেশার কথা তখন জানলে দু’বাড়ির কেউই আমাদের আস্ত রাখত না। লুকিয়ে লুকিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতাম। ওর বাড়ির প্রায় সবাই আন্দামান অভিযানের বিরোধিতা করেছিল। আমি ঠেলেঠুলে পাঠাই। বলি, দেখো, তুমি সফল হবেই।’’
শিউলি এখন দক্ষিণ কলকাতার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আর বিকেলের ঠিকানা গঙ্গাতীরের সি এক্সপ্লোরার্স ইনস্টিটিউট।
প্রায় ৩২ বছর আগে প্রয়াত পিনাকীর স্বপ্ন ছিল, বাঙালি যেন সমুদ্রের ডাকে সাড়া দিয়ে অভিযানে বেরোয়। সেই স্বপ্ন সাকার করতেই চেষ্টা চালাচ্ছেন শিউলি।
বললেন, ‘‘আন্দামান রওনা হওয়ার আগে ও বলে যায়, ‘আমাদের তো যোগাযোগ করার কিছুই থাকবে না। তুমি রোজ রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমাদের দু’জনকে দু’জনের সব খবর চাঁদ পৌঁছে দেবে।’ তাই, ওদের হারিয়ে যাওয়ার খবর কাগজে পড়ে চিন্তা হলেও খুব একটা ঘাবড়াইনি। কারণ ওই চাঁদ!’’
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/kanhoji-angre-1.330318
No comments:
Post a Comment