টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োতে ‘ফরিয়াদ’ ছবির শ্যুটিং চলছে।
বিখ্যাত সেই রাত-পার্টির গানের দৃশ্যটি টেক করা হবে।
গানের মাঝে, শব্দে সাজানো মেলোড্রামা, ‘আমি হাসি/ শুধু হাসি।’ মাউথপিস হাতে ওই জায়গাটায় নায়িকা মর্মান্তিকভাবে হেসে উঠবেন, পরক্ষণেই তাঁর কান্না মিশে যাবে অর্কেস্ট্রার সুরের কোহলে। নচিকেতা ঘোষের সুরে, নায়িকার নিজের আগ্রহে করা হাসি-কান্নার জায়গাটার ডামি টেপ শুনে, আশা ভোঁসলে গেয়েছেনও তুখড়।
এ বার শ্যুটিং। ফ্লোরে হঠাৎ ডাক পড়ল গীতিকারের। ফোন করলেন স্বয়ং ছবির নায়িকা।
সুচিত্রা সেন!
ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে ফ্লোরে হাজির গীতিকার।
তাঁকে দেখেই ছুটে এলেন মহানায়িকা। সঙ্গে নিয়ে প্রায় দৌড়ে চললেন নিজস্ব মেক-আপ রুমের দিকে। রাগে তখন তাঁর চোখ-মুখ লাল। চিক চিক করছে চোখের কোণ! জোরে জোরে শ্বাসের সঙ্গে ওঠা নামা করছে বুক। সাজঘরে ঢুকেই খিল!
গীতিকার সে দিনের সাজঘরের গোপন-কথায় লিখছেন, ‘‘দেখলাম স্বল্প-বসনা ম্যাডামের হুঁশই নেই নিজের পোশাক সম্পর্কে।... মিসেস সেন দড়াম করে মেক-আপ রুমের দরজাটি বন্ধ করে দিলেন। ভেতরে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে দেখলাম অনন্য সুচিত্রা সেনকে।’’
কে এই গীতিকার?
বাংলা সিনেমার গানে চার দশকের দরাজ-দিল সম্রাট পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
আড়ালপ্রিয়া মহানায়িকা সে দিন হাঁফাতে হাঁফাতে অভিমান উজাড় করে দিয়েছিলেন গীতিকারকে। বলেছিলেন, ‘‘জানেন ওঁরা খালি সেটের ছবি তুলছেন। কোথায় ক্লোজ শট? আপনি লিখেছেন, ‘চোখের এই জল শুধু চেয়োনা/ একে যায় না কেনা।’ আমি আমার চোখের তারায় এই গানের হাসি আর কান্না একসঙ্গে নিখুঁত করে দেখাব বলে কত দিন সাধনা করেছি! আর তা দেখাবার কোনও স্কোপ নেই!’’
প্যাক-আপ করে স্টুডিয়ো ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সুচিত্রা।
টলিপাড়া থেকে হাওড়ার সালকিয়া হাউস, সারাটা পথ পুলক ফিরেছিলেন মনখারাপ নিয়ে। তাঁর কেবলই মনে হয়েছে, সুচিত্রা সেনের ক্লোজ-আপের কথা। পর্দাজুড়ে সুচিত্রার ক্লোজ-আপে ধরা ঠোঁটের লিপস্টিক, কথাবলা চোখের ছলবলি, ফেরানো মরাল গ্রীবা বিভঙ্গ আর নিজের গানের কথা। তাঁর ছবিতেই ক্লোজ-আপ নেই! পরে অবশ্য সুচিত্রার কথা মতোই ক্লোজ শট ছিল দৃশ্যায়নে। স্মৃতি সবই স্মৃতি! ফিরে ফিরে সেই এলোমেলো স্মৃতির কথাই পড়ন্ত বেলায় ভেবেছেন পুলক।
বাংলা ছায়াছবি যে বার সবাক হল, সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে দর্শক শুনল সুর, সেই বছরই বৈশাখি পূর্ণিমায় এই গীতিকারের জন্ম। 
দিনটা ছিল ১৯৩১, ২ মে।  
কে জানে ক’ঘণ্টা, পাবে রে জীবনটা
কিশোর বয়সেই সিনেমার জন্য প্রথম গান লেখেন পুলক, ক্লাস নাইনে!
তবে কবিতার অনুরাগ সেই ছোট্ট বয়স থেকেই।
স্কুলবেলায় আনন্দবাজার-এ তাঁর কবিতা ছাপে। মানি অর্ডারে পাঁচ টাকা হাতে পেয়ে, সারা দিন নতুন জুতো পরে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন।
বাবা, কান্তিভূষণ ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের ছাত্র। নির্বাক ছবির যুগের নায়ক।
নিউ থিয়েটার্সের ছবি, শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’র নামভূমিকায় তিনি অভিনয় করেছিলেন। সেই সূত্রে বাড়িতে সিনে-দুনিয়ার নক্ষত্রদের আসা যাওয়া ছিল।
তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শিল্পী দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরকার হীরেন বসু, চিত্র পরিচালক সুশীল মজুমদার...। নিত্য তাঁদের মজলিশ থেকে উড়ে আসত সেলুলয়েডের শব্দ-সুর-সংলাপ। আর সে সবই প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরত পুলকের কানে। একটু বড় হয়ে গোপনে গোপনে চলত গঙ্গার উদাসী হাওয়ার পিঠে মনকেমনের কথা বসানো।
একদিন সেই সুরের হাওয়ায় ভেসেই পাড়ি দিলেন বাংলা গানের সুর-সফরে।
উত্তর থেকে দক্ষিণ তখন দৌড়চ্ছেন বিখ্যাত সব সুরকারদের কাছে। কোনও একদিন।
রাসবিহারী থেকে গড়িয়াহাট যাবেন পুলক। অপেক্ষা করছেন। দেশপ্রিয় পার্ক কাঁপিয়ে মটরবাইক নিয়ে পান-মুখে হাজির এক রবীন্দ্রসঙ্গীত-গায়ক। সটান হুকুম করলেন, ‘‘উইঠা বসো!’’
‘‘আমি!’’
‘‘আইজকালকার মাইয়ারা চাপছে। তুমি পারবা না!’’
পুলক ভয়ে জুজু!
রীতিমতো ধমক খেয়ে ইষ্টনাম জপতে জপতে চেপে বসলেন মোটরবাইকের পিছনে। চোখ বন্ধ, গলা শুকিয়ে কাঠ!
স্পিড বাড়তেই জড়িয়ে ধরলেন চালককে। মনে মনে বললেন, ‘প্রাণে বাঁচলে বাপের নাম!’ গড়িয়াহাটে নামিয়ে দিতেই ধড়ে প্রাণ ফিরল তাঁর। চির অমলিন হাসি বিলিয়ে ততক্ষণে মোটবাইকআরোহী মিলিয়ে গিয়েছেন পার্ক সার্কাসের দিকে। পুলক জানেন, এখন ভদ্দরলোক জীবনবিমা অফিসে যাবেন। তারপর রিহার্সালে! পুলককে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন, কে ওই গায়ক?
জর্জ বিশ্বাস!

একটি বাংলা ছবির গান রেকর্ডিং-এর আগে মান্না দে-র (মাঝে) সঙ্গে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় (বঁা দিকে)
ছবি: সমর দাস
ওই প্রীতম এল তোর প্রেমের মায়ায়
কাঁচা বয়সেই নিজের লেখা গান নিয়ে কোথায় না যাবার কথা ভেবেছেন পুলক!
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই প্রেম-বিরহের গান লিখে বাড়িতে বড়দের দেখানোরও সাহস পাননি তিনি। দেখালেন তুলনায় সহজ মানুষ, প্রযোজক জামাইবাবু সরোজ মুখোপাধ্যায়কে।
তত দিনে সরোজবাবুর ‘অলকানন্দা’, ‘মনে ছিল আশা’ ছবি রিলিজ করে গিয়েছে। হাত দেবেন ‘অভিমান’ ছবিতে। শ্যালকের লেখা গান দেখে, তাঁকে ছবির সিচুয়েশন দিলেন।
পুলক লিখলেন সে গান। সুর করেছিলেন বম্বের ‘বন্ধন’, ‘পুনর্মিলন’ খ্যাত রামচন্দ্র পাল। যেদিন প্রথম দেখা হল সুরকারের সঙ্গে গীতিকারের, সেও এক বিড়ম্বনা!
তার আগে তো কেউ কাউকে দেখেননি, পুলক গান পাঠিয়েছিলেন ডাকে। নলিনী সরকার স্ট্রিটে কলম্বিয়ার অফিসে ডেকে পাঠালেন গীতিকারকে। তার ঠিক ছ’ দিন বাদে পুলকের ম্যাট্রিক পরীক্ষার টেস্ট। তবুও গেলেন।
সে দিনের ঘটনার কথা লিখেছেন পুলক, ‘‘নাম বললাম। নাম শুনেই রামবাবুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অস্ফুটে স্বগতোক্তি করে বলে ফেললেন, এত ছোট বয়স... একে দিয়ে কী হবে!’’
আসলে, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় যে অত অল্প বয়সের গীতিকার, সেটা কল্পনাতেও আসেনি রামচন্দ্রের!
সেই শুরু হল।
তারার চোখে তন্দ্রা এল চাঁদ ঘুমালো
গঙ্গা কিনারে বসে, নিভৃত দুপুরে পুলকের বুকের মধ্যে বাজত বাবার এস্রাজের ছড়ের সুর। কখনও নিজেই বসতেন চার্চ পিয়ানোতে। ক্রমে স্কটিশের ক্লাসঘর থেকে কবিতার শব্দেরা যেন ডানা মেলে উড়ে এসে বসতে লাগল তাঁর কলমে।
বাংলা নিয়ে ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে পড়তেই কলকাতা বেতারে গীতিকারদের তালিকায় নাম উঠে গেল পুলকের! সে সময় রেডিয়োর অফিস গার্স্টিন প্লেস ছিল চাঁদের হাট। সখ্য হল অনেকের সঙ্গে। হাতে এল, দক্ষিণামোহন ঠাকুরের সুরে প্রদীপকুমার অভিনীত ছবি ‘পলাতকা’-র কাজ।
জীবনের এই পর্বেই পুলক লিখলেন রঙমহলের নাটকে, অভিনেত্রী রানিবালার জন্য গান। সেলুলয়েডের সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটারের জন্য তাঁর গান লেখার শুরু সেই তখনই!
কলেজ পেরিয়ে পুলক যখন স্নাতকোত্তরের ছাত্র। একদিন ফের ডাক পেলেন গার্স্টিন প্লেসের বিমান ঘোষের কাছে থেকে। দোলের অনুষ্ঠানের জন্য গান লিখতে হবে। সুরকার অনুপম ঘটক! নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না পুলক! পুলক লিখলেন ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ ছুঁয়ে দোলের সঙ্গীতালেখ্য।
কিছু দিন পরে অনুপম ঘটকই একদিন পুলককে ডাকলেন ওয়েলিংটন স্কোয়ারে, তখনকার হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানিতে।
সে দিনই নিজের লেখা জীবনের প্রথম নন-ফিল্মি গানটি রেকর্ড হল পুলকের! শিল্পী নিখিল চট্টোপাধ্যায়ের কন্ঠে গানটি ছিল ‘এবার আমি মা চিনেছি’, শ্যামা মায়ের সাধন-কথার গান। আশ্চর্য, পুলকের জীবনের শেষের গানেও সেই মায়ের কথা! নিঃশেষে গেয়েছিলেন মান্না দে।
সেই তো আবার কাছে এলে
মান্না দে’র আধুনিক বাংলা গানের প্রথম গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার হলেও, পুলক ছিলেন তাঁর কাছে ‘ভার্সেটাইল গীতিকার’। পুলক তাঁর কাছে সংবেদনশীল, রোম্যান্টিক কবিও।
সুরকার নচিকেতা ঘোষ গৌরীপ্রসন্ন ও পুলককে নিয়ে একটি প্রজেক্ট করেছিলেন। গেয়েছিলেন মান্না দে। গৌরী রাজি হলেও, পুলক প্রথমে রাজি হতে চাননি। পরে গৌরী যখন প্রথমে লিখলেন, ‘ওগো বর্ষা তুমি ঝোরো না গো অমন জোরে’, তার উত্তরে পুলক লেখেন, ‘তুমি একজনই শুধু বন্ধু আমার’ আবার গৌরী লিখলেন, ‘যদি কাগজে লেখো নাম কাগজ ছিঁড়ে যাবে’। জবাবে পুলক লিখেছিলেন, ‘আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে।’
নিজেদের মধ্যে এই স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা নিয়ে পুলক পরে লিখছেন, ‘‘সুরসৃষ্টির একটা নেশা ছিল নচিকেতা ঘোষের।... দু’জনকে লড়িয়ে দিয়ে দু’জনের কাছ থেকে সত্যিকারের ভাল গান আদায় করে নেবার এ একটা অভিনব টেকনিক। একদিন দশ পনেরোবার আমাকে গেয়ে শোনালেন গৌরীবাবুর লেখা ‘মালতী ভ্রমরে করে ওই কানাকানি।’ পরদিন-ই সকালে আমি লিখে ফেললাম, ‘বেঁধোনা ফুল মালা ডোরে’। একদিন আমাকে বার তিনেক গেয়ে শোনালেন গৌরীবাবুর রোম্যান্টিক লেখা, ‘সূর্য ডোবার পালা আসে যদি।’ তখন-ই লিখে ফেললাম, ‘এক বৈশাখে দেখা হল দুজনার’।... গৌরীবাবু বলতেন, ‘জানেন, নচিকেতার হাতে একটা দাঁড়িপাল্লা আছে। ও তার একদিকে একবার আমায় চাপায় আর একবার অন্য দিকে আপনাকে।’’’
যা যা বেহায়া পাখি যা না
নিজের লেখা কাহিনি ‘ছুটির ফাঁদে’-নিয়ে ছবি তৈরির সময় নিজেই গান লেখার কথা ভাবলেন সাহিত্যিক সমরেশ বসু। নচিকেতা একটু চিন্তাতেই পড়লেন। সুরের সঙ্গে না জানি কি লিখবেন সমরেশ!
ভরসা না পেয়ে পুলককেও ডাকলেন। পুলকের স্মৃতিতে, অনেক চেষ্টায় সে বার ‘আমি এখন সিক’ গানটি লিখেছিলেন সমরেশ।
তারপর হাসতে হাসতে পুলককে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার শখ মিটেছে। বাকি গানগুলো আপনি লিখুন।’’ নচিকেতার এমন নানা স্মৃতি ফিরে ফিরে এসেছে পুলকের কথায়।
একদিন যেমন, নচিকেতা ফোন করে পুলককে বললেন, ‘‘ও পুলক, কোনও গান নেই। আমি হারমোনিয়াম নিয়ে বসে আছি।... হয় এখনি এসো— না হয় টেলিফোনেই একটা গানের মুখড়া দাও।’’
জুতসই গানের কথা না পেলে টেলিফোনে এমনই কাতর হয়ে পড়তেন নচিবাবু।
সে সময় স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে তাঁর।
হঠাৎ সেটা মনে পড়তেই পুলক টেলিফোনের ওপাশ থেকে বললেন, ‘‘লিখে নিন, দুটো লাইন। কাল-পরশুর মধ্যে গিয়ে বাকি গানটা শেষ করব। লিখুন, ‘ক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে।’’’
পুলক লিখছেন, ‘‘নচিবাবু আমার এক্সটেম্পোর বলা কথাগুলোর জবাব দিলেন প্রায় এক মিনিট পরে। শুধু বললেন, আবার বলো। আবার বললাম। শুনে টেলিফোন লাইনটা কেটে দিলেন। কী একটা কাজ নিয়ে সবে তখন বসেছি। আবার টেলিফোন। এবার অন্য ধরনের কন্ঠস্বর। এক্ষুনি চলে এসো। আমি তোমার গাড়ির পেট্রোলের দাম দেব।’’
চলে গিয়েছিলেন পুলক। পুরো গান শেষ করে ফিরেছিলেন একটু অধিক রাতে। ’৭১-এ সে-গানই গাইলেন মান্না!
‘চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি’ আর ‘আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে’ এমন করেই লেখা। ’৭১-এর কথায় পুলক লিখেছেন, ‘‘‘ধন্যি মেয়ে’র ‘যা যা বেহায়া পাখি যা না’ গানটার সুরের সঙ্গে লেখা শেষ হতেই ইমোশানে আমার গালে একটা চুমু খেয়েছিলেন নচিবাবু।... যেদিন ‘ছিন্নপত্র’ ছবির ‘তোমাকে স্বপ্নে দেখেও সুখ’ লিখলাম, বললেন, চলো, আমরা দু’জনে কোথাও ‘অসভ্য’ করে আসি!’’

ভি বালসারা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-এর পাশে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)
ছবি: সমর দাস
আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না
মান্না দে পুলকের লেখা গান প্রথম প্লে-ব্যাক করেন ৬৫ সালে ‘দিনান্তের আলো’ ছবিতে। তার পর কত গান...!
একবার এয়ারপোর্ট থেকে মান্নাকে রিসিভ করে ফিরছেন পুলক।
পথে মান্না একটি ঠুংরি গুনগুন করছিলেন। ঠুংরিটি কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে শেখা ‘শ্যাম, ঘুংঘট কে পট খোলো’। হঠাৎ পুলককে মান্না বললেন, ‘‘এইরকম একটা গান লিখুন তো মশাই।’’ পথে যেতে যেতেই গানের কথা এল পুলকের মনে। ততক্ষণে শ্যামবাজার...!
পুলক বললেন, ‘‘গানটা এসে গেছে মশাই, নেমে পড়ুন, এখনই করে ফেলা যাক।’’
কাছেই গানের স্কুল বাণীচক্র।
সেখানে গিয়ে একটি ঘর চেয়ে নিয়ে, হারমোনিয়াম আর খাতা পেন নিয়ে বসে পড়লেন দুই শিল্পী। জন্ম হল নতুন গানের। কোন গান? ‘ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না।’
১৯৭০। ছবি ‘প্রথম কদম ফুল’। একটি গান-গাঁথার গল্পও খুব চমকপ্রদ। মান্না দে রান্না করতে ভালবাসতেন। একবার মুম্বইতে পুলক গিয়েছেন মান্নার বাড়ি। গিয়ে দেখলেন, রান্নাঘরে মান্না। অবাক পুলক। বললেন, ‘‘রান্না করছেন! কী রান্না?’’
‘‘তা তো বলব না আগে থেকে। আগে রান্না শেষ হোক। খেয়ে দেখুন। তারপর আপনাকেই বলতে হবে যে!’’
একটু পরে মান্না বসার ঘরে গিয়ে দেখলেন, পুলক একটা কাগজে লিখে ফেলেছেন বেশ কয়েকটা লাইন।
মান্না বললেন, ‘‘কী ব্যাপার? কিছু লিখে ফেললেন নাকি এখন?’’
পুলক বললেন, ‘‘এটা লিখলাম!’’
সেই লেখা হল, বিখ্যাত গান ‘আমি শ্রীশ্রী ভজহরি মান্না’।
পাগল তোমার জন্য যে
ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে পুলক জড়িয়ে ছিলেন অনেকের সঙ্গে।
সুরকার কমল দাশগুপ্তের অর্থকষ্ট তাই তাঁকে ভাবিয়েছে। এইচএমভি’র রকে বসে নিঃসঙ্গ সময়ে কানে বেজেছে কমলের কথা, ‘রেকর্ড দুটো তেমন চলল না রে’!
আর যখন কেবলমাত্র জীবনধারণের জন্য স্ত্রী ফিরোজা বেগমকে নিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছিলেন সুরকার-শিল্পী, মনে মনে কষ্ট পেয়েছেন পুলক। দুঃখ পেয়েছেন, অখিলবন্ধু ঘোষের মতো শিল্পীর একাকীত্বে। জীবনের শেষ ক’বছর আর ডি বর্মণের মনোকষ্টে! দহিত হয়েছেন, অকালে শ্যামল মিত্র, উত্তমের চলে যাওয়ায়! ব্যথিত হয়েছেন, গুরু দত্তের আত্মহত্যার পর গীতা দত্তের এলোমেলো জীবনযাপনে।
ঘনিষ্ঠতা ছিল সুরকার রবীন মজুমদার-ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য-নচিকেতা ঘোষ-সুধীন দাশগুপ্ত-রতু মুখোপাধ্যায়-হেমন্ত-মান্নার সঙ্গেও!
মান্নার সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের কথা দুই শিল্পী তাঁদের আত্মজীবনীতে অকপট জানিয়েছেন। কখনও সেই নিবিড়তা থেকেই নতুন গানের জন্ম হয়েছে। সে বার যেমন, মান্নার সঙ্গে তাঁর স্ত্রী সুলোচনাদেবীর জোর মান-অভিমানের পালা চলছে। দুই মেয়েকে নিয়ে বাপির বাড়ি চলে গেলেন সুলোচনা। মনে মনে কাতর হয়েও অভিমানে অনড় মান্না!
মান্না লিখছেন, ‘‘আমার সেই ব্যথাতুর দৃষ্টি দেখে পুলকবাবু লিখে ফেললেন, ‘তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ, দিতে পারোনি’। সেই গানে সুর দিয়ে রেকর্ড করতে গিয়ে সে কী বিপত্তি। যত বার গাইতে যাই, শুধু কান্না এসে যায়। গাইব কী, শুধু কাঁদছি।... সেই রেকর্ড সুলুর হাতেও পৌঁছল যথাসময়। আর সেই গান শুনে ওর সব অভিমান ভুলে সুলু আবার ফিরে এল আমার জীবনে। সেই ফিরে পাওয়ার আনন্দেই তারপরে আমি গাইলাম, ‘ধন্য আমি ধন্য যে, পাগল তোমার জন্য যে।’’’
জুঁই স্মৃতি শামিয়ানার নীচে বসে এমন কত যে কথা শুনিয়েছেন মান্না-পুলক দু’জনেই তাঁদের আত্মজীবনীতে!
আমি বলি তোমায় দূরে থাক
কলকাতা এলে শচীনকত্তা উঠতেন তাঁর সাউথ এন্ড পার্কের বাড়িতে।
একবার কত্তাকে দিয়ে নিজের গান করাবার আশায় হাজির পুলক।
হঠাৎ হারমোনিয়ম এগিয়ে কত্তা পুলককে গান শোনাতে বললেন। পুলক তো শুনেই পালাবার পথ খুঁজছেন। বললেন, ‘‘আপনি ভুল করছেন। আমি গান গাই না। গান লিখি।’’ স্বল্পভাষী শচীনদেব বললেন, ‘‘হ হ শোনাও।’’ শোনাতেই হল পুলককে। একটু পরে থামতে বললেন কত্তা। বললেন, ‘‘তোমার হবেরে ভাই, তোমার হবে। আমি এতক্ষণ তোমার পরীক্ষা নিচ্ছিলাম তোমার সুরবোধ কেমন। ভাল গান লিখতে হলে তোমাকে গান জানতেই হবে।’’
এর পর কত্তার কথা মতো মুম্বইতে যান পুলক। তবে নিজে গাইলেন না। পুলক তাই পোস্টকার্ডে সে দিনই গান পাঠালেন কলকাতা। অখিলবন্ধুকে। ‘ও দয়াল বিচার করো/ দাওনা তারে ফাঁসি!’ পরে পুলকের গানে সুর করেছিলেন পঞ্চমও। আরডি-র করা প্রথম সেই বাংলাগানে গেয়েছিলেন লতা। ‘আমার মালতী লতা’।
আরডির সুরে, আশা ভোঁসলে আর অমিতকুমারের পুজোর গানের গল্পও খুব জনপ্রিয়। সে বার আরডির ডাকে রাতের ফ্লাইটে পুলক মুম্বই চললেন। বাইরে জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর।  মাঝ উড়ানে অল্পবয়সি সুন্দরী বিমান সেবিকা পুলকের কাছে এসে মধুস্বরে অটোগ্রাফের অনুরোধ করলেন। অমন চাঁদমুখের দিকে তাকিয়ে পুলক ফেরাতে পারলেন না!
অটোগ্রাফের খাতায় লিখলেন, ‘সাদা দুটো মেঘ যেন দু’খানা ডানা/ চাঁদকে করেছে আজ রুপালি পরী।’
খাতা ফেরত পেয়ে গালে টোল ফেলে হাসলেন চন্দ্রমুখী! আর পুলক সে গান এসে শোনালেন পঞ্চমকে। রেকর্ডও করলেন আরডি। খুব পছন্দ হয়েছিল অমিতকুমার আর আশাজির। কিন্তু ষোলোটি গান লিখেও সেবারের প্রজেক্ট এগোয়নি! হারিয়ে গিয়েছে পুলকের লেখা আর আরডি-র সুরের সেই সব মহার্ঘ্য রেকর্ডিং!
ও কেন এত সুন্দরী হল
কলকাতা আর মুম্বই শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করে গীতিকার যখন খ্যাতির মধ্যগগনে, টলিপাড়ার হাওয়ায় উড়ল রঙিন গসিপ।
সে সব কেচ্ছায় মিলল শহরের আনাচে কানাচে সর্বনাশী লাস্য-রাত। টলিপাড়ার নর্তকীর ঠারঠুর আর রাতের কলকাতার ধিঙ্গিপনা!
পুলক যেন তার জবাবেই মান্নার জন্য ’৮১-র পুজোর গানে লিখলেন, ‘নিন্দুকে যা বলছে বলুক, তাতে তোমার কী আর আমার কী!’  
১৯৭২ থেকে ৯৯ সাল পর্যন্ত মান্নার নন-ফিল্মি বাংলা গানের সংখ্যা ২০১টি। যার মধ্যে পুলকের লেখা গানের সংখ্যাই ১০৮!
একবার, পুজোর আগে সিন্ধ্রি খনি অঞ্চলে একটি অনুষ্ঠান করতে গিয়েছেন মান্না দে। সে বার সঙ্গে ছিলেন পুলকবাবুও। সেই এলাকায় তাঁর ভায়রা-ভাই গৌরীসাধন থাকতেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁর বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না। মান্নাকে গাড়িতে বসিয়ে, বাড়ি খুঁজতে গেলেন পুলক। একটু পরে ফিরলেন হাসতে হাসতে। বললেন,
‘‘মান্নাদা, আপনার পুজোর গান তৈরি হয়ে গেছে!’’
মান্না তো খুব অবাক! পুলক গাড়িতে বসতেই তিনি বললেন, ‘‘সে কী মশাই? আমি তো এখান থেকে দেখতে পেলাম আপনি ওই বাড়িতে গেলেন, কলিংবেল টিপলেন, কে যেন দরজা খুলে আপনাকে কী বলল আর আপনিও দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন। এর মধ্যে গান তৈরি হল কী করে?’’
পুলক হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? বলছি তো নতুন গান তৈরি হয়ে গেছে।’’
বাকিটা পুলক-মান্নার স্মৃতি-লেখা থেকে, সে দিন একটা ভুল বাড়ির দরজার কলিংবেল বাজিয়েছিলেন পুলক। বেলের শব্দে এক ‘অসাধারণ’ সুন্দরী দরজা খুলে ভুল ভাঙিয়ে দেন। কিন্তু ততক্ষণে পুলক পেয়ে গিয়েছেন মান্নার জন্য তাঁর গানের মুখড়া। লিখে ফেলেন, ‘ও কেন এত সুন্দরী হল? এমনি করে ফিরে তাকালো! দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই! আমি তো মানুষ!’
এমন ভাবেই সুন্দরী বিমানসেবিকাকে দেখে, প্লেনের উইন্ডো সিটে বসে ন্যাপকিনে লিখেছিলেন, ‘ও চাঁদ, সামলে রাখো জোছনাকে।’
চলকানো রাতপার্টির লাজুক সুন্দরীর কান থেকে পড়ে যাওয়া ঝুমকো কুড়িয়ে ফেরত দিতে দিতে লিখেছিলেন মান্নার মহার্ঘ গান, ‘জড়োয়ার ঝুমকো থেকে একটা মতি ঝরে পড়েছে।’ এ সব গানের কথা, আজও বাঙালি শ্রোতার মর্মে গাঁথা।
অমন ডাগর ডাগর চোখে
সেবার স্কটিশের বাইরে সরস্বতী পুজো। হেমন্তকে নিয়ে আসার কথা চলছে। পুলক তখন ছাত্র। আমন্ত্রণ করতে গেলেন। হেমন্ত বললেন, ‘‘পঞ্চাশ টাকা করে নিই, তুমি চল্লিশ দিয়ো।’’ পুলক দর করলেন। বললেন, পঁয়ত্রিশ! বন্ধুত্বের জন্য সহাস্যে তাতেই রাজি হেমন্তকুমার। গেয়েছিলেন নতুন রেকর্ডের গান, ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ।’
মান্নার জন্য সব থেকে বেশি গান লিখলেও, পুলকের লেখা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের সংখ্যাও কম নয়! হেমন্ত তাঁর গান প্রথম প্লে-ব্যাক করেন ৫০ সালে।
গানটি ছিল ‘শোনো তবে বলি’। ছবির নাম, ‘অপবাদ আজ’। জুটি জনপ্রিয় হল ৬৪-তে ‘অশান্ত ঘূ‎র্ণি’ ছবি থেকে। রাজেন সরকারের সুরে হেমন্তর গাওয়া গানটি ছিল, ‘আমার নতুন গানের জন্মতিথি।’ একে একে পুলক হেমন্তর জন্য লিখলেন দুর্ধর্ষ সব প্লে-ব্যাক। 
কেবল ছায়াছবি নয়, আধুনিকেও এই জুটির গানে গানে ছেয়ে ছিল স্বর্ণযুগ! পুলকের কথায় হেমন্তর প্রথম আধুনিক গান, ১৯৫৮ সালে। ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলোনা’ এবং ‘কত রাগিণীর ঘুম ভাঙাতে’। তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল গান দুটি। পরের বছর এই জুটির নিবেদন ছিল, ‘কোনদিন বলাকারা’ এবং ‘জানি না কখন তুমি’।
লজ্জা, মরি মরি এ কী লজ্জা
হেমন্ত-মান্নার মতো, বহু শিল্পীর চিরদিনের গান লিখেছেন পুলক।
অনেকের প্রথম বাংলা গানও তাঁর লেখা। হেমন্তর ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবির ক্ল্যাপস্টিক দিতে কলকাতা এসে, লতা যেমন নিজেই ডেকে নিয়েছিলেন পুলককে। গিয়েছিলেন পুলক!
তবে বাদ বাধল নতুন গানের সুর নিয়ে। সুরকার ভূপেন হাজরিকা পুলককে বললেন, ‘‘রেডি গান কোথায়? নতুন গান সুর করার আমার সময় নেই এখন!’’
নাছোড় পুলকও।
সুরকারের পিছু নিলেন গীতিকার! কলকাতা দেখছে দুই গান-পাগলের কীর্তি! চৌরঙ্গি এলাকায় ঘুরপাক দিতে দিতে শেষে পুলক প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের নিশিনিলয়ের একটি কেবিনে ভূপেনকে পাকড়াও করলেন!
পরদা সরিয়ে ঢুকতেই চমকে গেলেন ভূপেন। সেখানে বসেই তাঁর ‘পরহু পুয়াতে তুলো না’-র সুরে কথা বসালেন পুলক রেস্তোরাঁর বিলে। পুলক পাহাড়িয়া সুরে কথা বসালেন রেস্তোরাঁর বিলে। লেখা হয়ে গেল বাংলায় লতার প্রথম পুজোর গান, ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’!
লতার মতো মুকেশও নিজেই আগ্রহ দেখিয়েছিলেন বাংলা গান করার। প্রথম ছবির গান, ‘সরি ম্যাডাম সরি’। পরে রতু মুখোপাধ্যায়ের সুরে পুলকের দুটি আধুনিক ছিল, ‘ওগো আবার নতুন করে’ এবং ‘দেহেরি পিঞ্জরে প্রাণ পাখি কাঁদে।’
এমন করেই অলকা ইয়াগনিক, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, সুমন কল্যাণপুর, উষা মঙ্গেশকর, চিত্রা ও জগজিৎ সিংহ, ঊষা উত্থুপ, উদিত নারায়ণ, অনুপ জলোটা, কুমার শানুর প্রথম বাংলা গানও লিখেছিলেন পুলক।
কিশোরকুমার তাঁকে ‘পোলাওবাবু’ ডাকতেন, লিখেছিলেন তাঁর জন্যও ‘হয়তো আমাকে কারও মনে নেই’, ‘মিলন তিথির পূর্ণিমা চাঁদ’-এর মতো চিরদিনের গান। লিখেছিলেন চিরশ্রবণীয়, আরতি মুখোপাধ্যায়ের পুজোর গান ‘লজ্জা, মরি মরি এ কী লজ্জা।’
ফিরায়ে দিও না মোরে শূন্য হাতে
আহিরীটোলা ঘাটের ঠিক ওপারে বাঁধাঘাট। কত স্মৃতি এই ঘাট, অনতিদূরে সালকিয়া হাউসের!
ফেরিতে গঙ্গা পারাপারের সময় পুলক মাঝে মাঝেই চেয়ে থাকতেন জলের গহনে। সুদূর থেকে কানে বাজত প্রিয় মানুষদের কথা-সুর! কোথায় যে গেল ফুল-পাখি-চাঁদ-তারা। চশমার কাচ মুছে স্বগতোক্তি করতেন যেন, ‘তারা সব কোথায় গেল!’ বুকটা কেবলই যেন খাঁ খাঁ করত তাঁর!  নানা মুখ আর কথার ভিড়ে মনে পড়ত আমহার্স্ট স্ট্রিটের রয়্যাল হোটেলের সেই সন্ধ্যারাতের কথা।
মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানির কমল ঘোষ পুলককে নিয়ে চললেন হোটেলের বিশেষ একটি ঘরে। রেকর্ড কোম্পানির ইচ্ছে সে ঘরের অতিথি, তাঁদের বাঁধা শিল্পী ‘মালিকা এ গজল’ বেগম আখতর বাংলায় গান রেকর্ড করুন। সে গান লিখবেন পুলকই! ‎
কিমামে ভেজা লালি ঠোঁট। সেই মিঠে, নরম ঠোঁটে সফেদ সিগারেট পুড়ছে।  নাকে চিক চিক হিরের ফুল!
রুপোর পানদানি রেখে, সুখটান দিতে দিতে চোখ বন্ধ, বেগমসাহেবার। একটান, দু’টান...!  শূন্যে ধোঁওয়া ছেড়ে একসময় ‘মালিকা এ গজল’ তাঁর সঙ্গিনীকে ঝলমলিয়ে বললেন, ‘‘গাও!’’ তাঁর যেমন স্বভাব, একটু পরে নিজেই হারমোনিয়ামের একটা দিক কোলে তুলে সুর লাগালেন মধ্য সপ্তকে।
একটু আলাপ, অনতিপর বেহ্জাদ লাখনভির লেখা সেই বিখ্যাত গজল ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে।’  সেলাম জানাতে মেহেদি হাত উঠ‌ল ঈষৎ। মোহিনী হাসি বিলোলেন গজল সম্রাজ্ঞী বিব্বি!
সুর্মাপরা ডাগর চোখের চাহনি আর সুরের সারিন্দায় যেন নেশা ধরল সন্ধে রাতের কলকাতার।
গান লিখবেন কী, মুখোমুখি গান শুনে পুলক ‘দিওয়ানা!’ যে সময়ের কথা হচ্ছে, ফৈজাবাদী আখতারের তত দিনে ঠুংরি-গজল-দাদরার জন্য দেশজুড়ে অগণিত ‘দিওয়ানা’। পুলকের ঝিম ঝিম করছে শরীর। বেগমের ইচ্ছেয় তাঁর ‘কোই না মানে গুলশান গুলশান’- সুরে হোটেলের মেঝেতে বসে গান লিখতে গিয়ে কলম যেন আর সরছে না!
জীবনের প্রান্ত বেলায় এসে স্মৃতির অতল থেকে লিখেছেন, ‘‘ওঁর হাতের আঙুলে ঝলমল করছে একখণ্ড বহুমূল্যবান হিরে। তার দ্যুতি ছিটকে পড়ছে ওঁর হারমোনিয়াম বাজানো হাতের আঙুলের নাড়াচাড়ায়।... লিখলাম, ‘এ কী আনন্দে দোলে এ-জীবন।’’’
আইনি জটিলতায় শেষ পর্যন্ত সে গান রেকর্ড করা হয়নি বেগমের। পুলক পরে লিখলেন প্রিয় বেগমের জন্য, ‘ফিরায়ে দিও না মোরে শূন্য হাতে’। গান রেকর্ডও হল এইচএমভি থেকে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সৌজন্যে।
বাকিটা কিংবদন্তি!
ভাবি গঙ্গায় ঝাঁপ দিই
জীবনের জলসাঘরে পুলক কি একা হয়ে গিয়েছিলেন?
খুব কাছ থেকে যাঁরা দেখেছেন গীতিকারকে তাঁদের মনে হয়েছে, শেষ দিকে পুলকের বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই ক্রমশ ফুরিয়ে আসছিল। কোনও কিছুতেই যেন আর মন বসছিল না তাঁর! কোনও গানই যেন আর স্বর্ণযুগের গান হয়ে উঠছিল না! মনে হচ্ছিল ‘সব-ই মেকানিক্যাল’!
কেউ কেউ বলেন, মানুষটা হতাশা আর অবসাদে ভুগছিলেন। শেষের দিকের গানগুলোও যেন কেমন কেমন ঠেকছিল তাঁর বন্ধু-শিল্পীদেরও।
পুলক চলে যাওয়ার পর শোকে কাতর হয়ে পড়েন মান্না। শোক জানাতে গিয়ে লিখেওছিলেন, ‘‘পুলকের মতো জীবনরসিক লোক আত্মহত্যা করবে এটা আমার জীবনের সবচেয়ে অকল্পনীয় অনুভূতিগুলোর মধ্যে একটা। এখন শুধু মনে হচ্ছে, বন্ধু, এত বড় ফাঁকি দিলে- আমার সঙ্গে ভাগ করে নিলে না তোমার যন্ত্রণা!... ওর বাড়ির লোকের কাছে জানতে চাইব, কী এমন ঘটল যে, এত বড় জীবনরসিক মানুষটাকে নৌকো থেকে ঝাঁপ দিতে হল!’’
কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি লিখেছেন, ‘‘ওই তো লিখেছিল, ‘ভাবি গঙ্গায় ঝাঁপ দিই’, তখন কি জানতাম- এটাই ছিল পুলকবাবুর মনের আসল কথা? ...ভবিতব্যকে পালটাতে পারতাম না জানি, তবু বলতাম, অন্তত এটুকু বলে যান কেন এ-রকম দুঃখের ভার বয়ে বেড়িয়েছেন আপনি দিনের পর দিন? কী ছিল আপনার দুঃখ?’’
কী এমন ঘটল, সে উত্তর আজও স্বচ্ছ নয়!  নিশুতি রাতের গঙ্গার ঘূর্ণি হাওয়া কি জানে?
সালকিয়া হাউসের ঝাড়-লন্ঠন, দেউড়ি-দালান, বাঁধাঘাট!
ঋণ: ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘আনন্দধারা’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ‘জীবনের জলসাঘরে’, মান্না দে, ‘মুখোমুখি মান্না দে’, অতনু চক্রবর্তী, আনন্দলোক, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা সঙ্গীত সংখ্যা

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/say-me-you-will-come-again-a-write-up-on-pulak-bandyopadhyay-1.359942