এ বাবা ছেলে ধুতি পরে! এমন একটা ধুতি পরা ছেলেকে কিছুতেই বিয়ে করব না।
লালকৃষ্ণ আডবাণীকে দেখে ঠিক এমনটাই প্রতিক্রিয়া ছিল তাঁর হবু-স্ত্রী কমলাদেবীর।
সেই প্রথম দেখা। ঘটনাস্থল মুম্বই।
কমলাদেবীর ব্যবসায়ী-বাবা বলেছিলেন, ‘‘আরে করাচির সিন্ধি ছেলে। এখন দেশভাগের পর এখানে কোথায় পাব অমন এক সিন্ধি যুবক! তা ছাড়া ওর বাবাকেও চিনি আমি।’’
আডবাণী তখন সাংবাদিক। রাজনৈতিক সংবাদদাতা নন, ফিল্মক্রিটিক। চিত্রসমালোচক। ‘পাঞ্চজন্য’ আর ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকার জন্য কাজ করেন।
বিয়ে তো হল। তার পরও কমলাদেবী ধুতি নিয়ে তাঁর আপত্তি থেকে এক চুলও সরলেন না।
আজও আডবাণী সে কথা মনে করে বলেন, ‘‘ধুতি আর পাঞ্জাবির পাশাপাশি শার্টপ্যান্ট-স্যুট-গলাবন্ধ কো়ট সবই পরা শুরু করতেই হল। পোশাকআশাক নিয়ে আমার কোনও কালেই কোনও সংস্কার ছিল না। আর ধুতি পরা নিয়েও লজ্জা না।’’
বিয়ের পর দিল্লির রামকৃষ্ণপূরমের একটি ছোট ফ্ল্যাটে সংসার পাতেন লালকৃষ্ণ আর কমলা।
তখনকার নেহরু সরকার সাংবাদিকদের মধ্যে বেশ কিছু ফ্ল্যাট বিতরণ করেন। আডবাণী আরএসএস প্রচারক হলেও বা আরএসএস-এরই পত্রিকার সাংবাদিক হওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেস সরকার তাঁরও থাকার সুব্যবস্থা করে।
সেই ফ্ল্যাটে নতুন উঠে একবারে গৃহপ্রবেশ থেকেই ঘরদোর গোছানোর কাজ শুরু করে দেন গৃহবধূ। নতুন সংসার পাতলে যে কোনও ভারতীয় সমাজে নতুন বৌ যেমন করে, ঠিক তেমন করেই! বৈঠকখানায় সোফার ঢাকা লাগানো, পর্দার কাপড় তৈরি, ঘরের আনাচকানাচ এটা-ওটা জিনিস দিয়ে সাজানো...।

কাছেই ছিল সরোজিনী নগরের একটা বাজার। সেই বাজার থেকে ঘর সাজানোর জিনিসপত্র কেনা হল। মাটির ঘোড়া, পুতুল...। একটা আ্যাশ-ট্রেও কিনলেন কমলা। বসার ঘরে টেবলের ওপর সেটা সাজিয়ে রাখলেন।
বা়ড়ি ফিরে আ্যাশ-ট্রে দেখে মহা খেপে গেলেন আডবাণী। কেন? কেন আবার! নিজে কোনও দিন ধূমপান করেননি। অন্য কেউ করুক, সেটাও আডবাণীজি চাননি কোনও কালেই। সেই তাঁর বাড়িতেই কিনা তাঁরই স্ত্রী অ্যাশ-ট্রে কিনে সাজিয়ে রেখেছেন?
চিৎকার-চেঁচামেচি করা লালকৃষ্ণের কোনও দিনই পছন্দ নয়। কিন্তু আপত্তির কথা জানাতেও ভোলেন না। তাঁর মতো করে।
স্ত্রীর ক্ষেত্রেও তাই হল।
কমলা কিন্তু চট করে দমার পাত্রী নন। বললেন, ‘‘তুমি খাও না তো কী, তোমার অতিথি বন্ধুরা তো...!’’
স্বামীর আপত্তি যে তাতেও!
শেষে করলেন কী?
কমলাদেবী আমায় বলেছিলেন, ‘‘এর পরেও অ্যাশ-ট্রেটা কিন্তু আমি ফেলে দিইনি। সাধ করে কেনা, ফেলব কেন? শুধু ওর চোখের সামনে থেকে সরিয়ে বুক শেল্ফে বইয়ের আড়ালে রেখে দিয়েছিলাম। তার পর কবে যে ওটা এক দিন ওখান থেকে উধাও হয়ে গেল, বুঝতে পারিনি।’’
লালকৃষ্ণ-কমলার ছেলেমেয়েও এ ব্যাপারে বাবার ধাত পেয়েছেন। ওঁদের ছেলে জয়ন্ত বা মেয়ে প্রতিভাও কোনও দিন ধূমপান করেননি। তবে তাঁরা আমিষ খান। যেখানে লালকৃষ্ণ বা কমলাদেবী দুজনেই নিরামিষাশী।
আডবাণী বলেন, ‘‘সিন্ধিরা কিন্তু সচরাচর নিরামিশাষী হন না। করাচির বাড়িতে মুরগি-মাছ সবই খাওয়াদাওয়া হত।’’
আডবাণী একটা সময়ের পর স্বেচ্ছায় আমিষ ছেড়ে পুরোপুরি নিরামিশাষী হয়ে যান। কমলাদেবীও এর পর আমিষ ছেড়ে দেন তাঁর ‘লাল’-এর জন্য।
তবে ছেলেমেয়েদের ওপর এ নিয়ে কোনও বাধানিষেধ চাপাননি ওঁরা। জয়ন্ত-প্রতিভা দুজনেই আমিশাষী। জয়ন্তর বৌ গীতিকাও তাই। রীতিমতো দোকান  চিকেন, ফিশ-ফ্রাই এনে খান ওঁরা। তাতেও বাবা-মায়ের কোনও বাধা ছিল না কোনও কালেই।
বিয়ের দিনে
কমলাদেবীর ভাইবোনেরাও আমিষ খান, ওঁরা বাড়িতে এলেও বাইরের খাবার আনা হয়। তাতেও আপত্তি নেই। তবে ওঁদের রান্নাঘরে কোনও দিন আমিষ রান্না হতে দেখিনি।
আডবাণীর মধ্যে একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করি। ভারতের শীর্ষনেতাদের মধ্যে অন্যতম। চরম ব্যস্ততার মধ্যেও দেখেছি ওঁকে, শতকরা দুশো ভাগ ‘ফ্যামিলি ম্যান’। সত্যি বলতে কী, এমন ‘ফ্যামিলি ম্যান’ দিল্লির রাজনীতিকদের মধ্যে আমি কমই দেখেছি।
প্রায় ৫০ বছরের এক দীর্ঘ দাম্পত্যজীবন ওঁদের। কিন্তু যতটুকু লক্ষ করেছি, তাতে মনে হয়েছে, এমন বন্ধুত্ব, এমন সখ্য, এমন পারস্পরিক নির্ভরতা সচরাচর দেখা যায় না। আর দু’জনের আরেক জায়গায় অসম্ভব মিল। প্রচণ্ড অতিথিবৎসল ওঁরা দু’জনেই।
কাজেকম্মে আডবাণীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে, কমলাদেবী ঢুকে পড়তেন বাড়ির অফিস ঘরে। ঢোকার আগে এক বার ফাঁক দিয়ে শুধু দেখে নিতেন, অতিথিটি কে। ব্যস, ওইটুকুই। তার পর সটান ঢুকে আসতেন।
আর ঢুকেই মুখটা ঈষৎ বাঁকিয়ে গালে হাত দিয়ে আডবাণীর দিকে তাকিয়ে ঠায় বসে থাকতেন। আডবাণী ওঁর সেই শ্যেন দৃষ্টি দেখে প্রায়ই হেসে ফেলতেন। তার পর প্রথমেই বলতেন বলতেন, ‘‘ওকে কিছু খেতে দেবে তো?’’
প্রথম যে দিন পান্ডারা পার্কে আডবাণীর বাড়ি গিয়েছিলাম, সময়টা এখনও মনে আছে। ১৯৮৭ সাল। মে মাস। দিল্লিতে খুব গরম। কমলাদেবী আম কেটে খাইয়েছিলেন।
পান্ডারা পার্কের বাড়িটা ঘিরে আডবাণীজির অনেক স্মৃতি।
ওখানেই জয়ন্ত-প্রতিভার শৈশব কেটেছে। আবার এই বাড়িতে থাকার সময়ই হাওয়ালা কান্ডের ঝড় উঠেছিল। টালমাটাল হয়ে পড়েছিল আডবাণীজির রাজনৈতিক জীবন।
সেই সন্ধেটির কথা কিছুতেই ভোলার নয়।
হাওয়ালা অভিযোগে প্রকাশিত হয়েছে আডবাণীর নাম। ওঁর বাড়িতে গিয়ে দেখি, থমথমে মুখে বসে আছেন।
তার মধ্যেই ঠিক করে ফেলেছেন, সাংসদের পদ থেকে ইস্তফা দেবেন। দলের শীর্ষনেতারা নিষেধ করছেন। কেন অমন কাজ করবেন? ‌আডবাণীকে তো সৎ ব্যক্তি বলে জানেন অনেকে, তিনি যে হাওয়ালা কাণ্ডে ঘুষ নিতে পারেন, এমনটা বিশ্বাস করেন না বহু লোকেই। ওই সময় দেখেছিলাম কমলাদেবীকে। বারবার আডবাণীকে বোঝাচ্ছিলেন, ‘‘তুমি নির্দোষ। ইস্তফা দিতেই যখন ইচ্ছে, তখন বিবেক যা বলবে, তাই শোনো। দেখবে, এক দিন তুমি নির্দোষ প্রমাণিত হবে।’’
বাড়ি থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যায় অশোকা রোডের দলীয় কার্যালয়ে এসে গেলেন আডবাণী। কাতারে কাতারে দলীয় কর্মী সেখানে। বিজেপি সংসদীয় বোর্ডের বৈঠক বসল।
ইস্তফা দিলেন আডবাণী।
ভোট হল। লড়লেন না।
প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী থেকেও সরে যেতে হল (যদিও আডবাণী অবশ্য বলেন, এ ঘটনার বহু আগেই প্রথানমন্ত্রী হিসেবে তিনি অটলবিহারী বাজপেয়ীর নাম ঘোষণা করে দিয়েছিলেন)।
সময়কালটা হয়তো’বা আডবাণীর রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে কঠিন তখন। অমন সঙ্কটের দিনে কমলা যে ভাবে ওঁর পাশে পাশে থাকতেন, এক বার দেখলে সত্যিই কোনও দিন ভোলার নয়।
পান্ডারা পার্কের ওঁদের যে বাড়িটা, তাঁর রান্নাঘরটার পাশেই ছিল ছোট গোলাকার একটা ডাইনিং টেবল। রান্নাঘরের দেওয়ালে এক বার একটা জানলা তৈরি করিয়ে নিয়েছিলেন কমলা।
কেন বলুন তো?

মিস্টার অ্যান্ড...
ছবি: রাজেশ কুমার
যাতে ওই জানলা দিয়ে গরম গরম রুটি বানিয়ে দিতে পারেন তাঁর ‘লাল’-কে। গরম রুটির বড় ভক্ত যে আডবাণী! উত্তর ভারতে এই রুটি গুলোকে বলা হয় ‘ফুলকা’, মানে ফুলকো চাপাটি। প্রতি দিনই খাবার সময় জানলা দিয়ে তেমনই ফুলকা চলে আসত লালকৃষ্ণের কাছে।

নর্থ ব্লকে তখন তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দুপুর একটার পর ফোন করে বলতেন, ‘‘এ বার নর্থব্লক থেকে বেরিয়ে পড়লাম।’’
অর্থাৎ আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যাবেন। এই ফোন পেয়েই কমলাদেবী রুটি করতে শুরু করতেন।
কোনও দিন একটু দেরি হলেই কমলাদেবী ফোন করেতেন, ‘‘কী হল? এখনও বেরলে না?’’ তখন আবার তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়তেন খোদ ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী’র ডাকে।
মনে আছে, এক বার তিনি বেরোবেন নর্থব্লক থেকে। দুপুর দেড়টা হবে প্রায়। ঠিক ওই সময়ই একটা কাজে গিয়েছি ওঁর কাছে। কথা বলতে বলতে উঠতে দেরি হয়ে গেল। হঠাৎ বাড়ি থেকে কমলাদেবীর ফোন।
ওঁরা নিজেদের মধ্যে সিন্ধি ভাষায় কথা বলতেন। হাবেভাবে বুঝলাম, দেরি হওয়ার কারণ জানাতে হঠাৎ আমার এসে পড়ার কথা বলছেন আডবাণী।
কথা বলতে বলতেই আমার দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে আডবাণী বললেন, ‘‘কমলা তুমসে বাত্ করনা চাহ্‌তি হ্যায়।’’
ফোন ধরতেই বললেন, ‘‘তুমিও চলে এসো। রুটি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এখানে খেতে খেতে গল্প করবে। নইলে ওর খাওয়ার সময়টা পেরিয়ে যাবে।’’
বাধ্য হয়ে আডবাণীর গাড়ি চেপেই ওঁর বাড়িতে যেতে হল।
এরকম যে কত বার হয়েছে!
বহু বার দেখেছি, খাবার সময়ও বহু রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী হাজির হয়ে গিয়েছেন। খাবার টেবলেই রাজনৈতিক আলোচনা চলছে। কখনও আরএসএস ঘনিষ্ঠ স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক গুরুমূর্তি চেন্নাই থেকে চলে আসতেন, কখনও শত্রুঘ্ন সিংহ। তো কখনও প্রমোদ মহাজন, অনন্তকুমার কী স্মৃতি ইরানি।
কমলাদেবী সবাইকে যত্ন করে খাওয়াতেন। কিন্তু কোনও দিন ওঁকে কোনও রাজনৈতিক কথাবার্তা বলতে দেখিনি কারও সঙ্গেই।
বরঞ্চ কেউ যদি কারও নামে কোনও অভিযোগ জানাতেন তাঁর কাছে, খুব বিরক্ত হতেন।
মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও আডবাণী বিরোধী নেতা হিসেবে বেশ সক্রিয় ছিলেন। প্রতিভা পাতিল তখন রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতি ভবনে যেমন এখনও যান, তখনও নিয়মিত যেতেন আডবাণী।
কমলাদেবীকে কোনও দিনই এ সব অনুষ্ঠানে যেতে দেখিনি। বরং মেয়ে প্রতিভাকে বারকয়েক দেখেছি আডাবাণীকে সঙ্গ দিতে।
একবারের এক অনুষ্ঠানে সকালবেলা সনিয়া গাঁধীর পাশে বসে আডবাণী। রাষ্ট্রপতি ভবনে অনুষ্ঠান কর্মসূচি উপস্থিত সকলকে দেওয়া হয়েছে।
সনিয়া সে দিন তাঁর চশমাটি আনতে ভুলে গিয়েছিলেন। পাশে বসা আডবানীকে তিনি বললেন, ‘‘কিছুই তো পড়তে পারছি না। দেখবটা কী? এখন কী অনুষ্ঠান হবে?’’
উত্তরে আডবাণী বললেন, ‘‘আমার চশমাটা দেব? পরে এক বার দেখবেন নাকি?’’
পরে অবশ্য নিজেই পড়ে শোনাতে লাগলেন অনুষ্ঠান-সূচি।
দুপুরবেলা বাড়ি ফিরলেন আডবাণী। কমলাজি যথারীতি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন, কী কী হল অনুষ্ঠানে, কী কী খেতে দিল, সব।
আডবাণী নিজের থেকেই সনিয়ার চশমা-প্রসঙ্গটি তুললেন। আমিও ছিলাম সে দিন। বললাম, ‘‘আপনি তো আবার আপনার চশমাটা দিয়ে সনিয়াজিকে দেখানোর চেষ্টা করছিলেন।’’
আডবাণী রসিক মানুষ। মৃদু হেসে শুধু বললেন, ‘‘তাতে উনি তো দেখলাম, আমার কাছ থেকে শোনাটাই বেশি পছন্দ করলেন!’’
এর মাঝে কমলাজিকে দেখলাম, একেবারে অন্য এক প্রসঙ্গে চলে গিয়েছেন। বললেন, ‘‘এক দিন সনিয়াকে দুপুরবেলা বাড়িতে নেমন্তন্ন করো। সিন্ধি খাবার করে খাওয়াব ওঁকে।’’
তখন কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে সংসদে বিজেপি-র তুমুল লড়াই চলছে। আডবাণী আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘তা তো হতেই পারে। কিন্তু এর পর এরা যে সব কাহিনি লিখতে শুরু করে দেবে! কান দেওয়া যাবে না যে তাতে।’’
সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে কমলাদেবীর দেখা হয়েছিল ১০ জনপথ রোডে। আডবাণীজি সে দিন কমলাকে নিয়ে সনিয়ার বাড়িতে গিয়েছিলেন ওঁর জীবনীগ্রন্থটি সনিয়ার হাতে তুলে দেবেন বলে। সেই বোধ হয় প্রথম বার তিনজনে বসে এক সঙ্গে গরম কফি খেয়েছিলেন।
সিন্ধি রান্না নিয়ে বেশ গর্ব ছিল কমলাদেবীর। আঞ্চলিক রান্না নিয়ে নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করা ছিল তাঁর শখ। পাঁউরুটি দিয়ে এক ধরনের তরকারি বানাতেন। এই পদটা দু’জনেই খুব ভালবেসে খেতেন। আবার খাবার নিয়ে ওঁদের তক্কাতক্কিও ছিল দেখার মতো। এক বার যেমন। পাপড়ের মতো একটি খাবার—খাগড়া, সেটি আদৌ গুজরাতি না সিন্ধি তা নিয়ে শিশুর মতো তর্ক করতে দেখেছি দুজনকে।
সোজা কথা হল, ওঁদের দাম্পত্যজীবনটা ছিল প্রাণচঞ্চল। মুখরিত। একসঙ্গে ছবি তোলা, এক সঙ্গে সিনেমা দেখা, ছেলেমেয়ের জন্ম দিন পালন...!
এই ‘একসঙ্গে’ ব্যাপারটাতে কি একে অন্যকে খানিকটা প্রভাবিতও করতেন ওঁরা?
কেন বলছি, বলি।
আডবাণীর রাজনীতি তো একটা বড় অংশ হিন্দুত্ব নিয়ে। রামমন্দির আন্দোলনের বলতে গেলে জনকই ছিলেন তিনি। কিন্তু বাড়িতে কোনও দিন তাঁকে পুজোআচ্চা করতে দেখিনি।
পান্ডারা পার্কের বাড়িতেও দেখিনি, আবার ৩০ পৃথ্বীরাজ রোডের বাড়িতেও না।
মুরলি মনোহর যোশী, অটলবিহারী বাজপেয়ী বা নরেন্দ্র মোদীও যতটা পুজো করেন, যজ্ঞ করেন, সে সব কোনও দিন ওঁকে করতে দেখিনি। প্রায় একই অভ্যাস ছিল কমলাদেবীরও। নিয়মিত পুজোপাঠ তিনিও করতেন না।
তার মানে এই নয় যে ওঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না। বাড়ির ভিতর গণেশ থেকে তিরুপতি— নানা ধরনের দেবদেবীর মূর্তি দেখেছি।
তবে পান্ডারা পার্কের বাড়িতে একটা ছোট ঘর ছিল, অনেকটা ঠাকুর ঘর গোছের। পৃথ্বীরাজ রোডের বাড়িতেও শোবার ঘরের লাগোয়া ছিল একটা মন্দির-কক্ষ। নিয়মিত সেখানে পুজো পাঠ হত না বটে, কিন্তু সমস্ত দেবদেবীর মূর্তি ওখানেই রাখা থাকত।
কমলাজির কাছে শুনেছি, অনেক দলীয় কর্মী, বন্ধু-পরিজন নানা সময়ে নানা ধরনের দেবদেবীর মূর্তি উপহার দেন ওঁদের। যত্ন করে সেগুলো তিনি রেখে দেন ওই ঘরেই।
এর বাইরে কোনও ধর্মাচার করতে ওঁদের কোনও দিনই দেখিনি।
দিল্লিতে হনুমান মন্দিরই বলুন বা কলকাতায় কালীঘাট, কখনও দেখিনি বা শুনিনি ওঁরা পুজো দিতে গিয়েছেন।
বিশ্বাসে প্রায় একরকম, খাওয়া-থাকা-অভ্যাসে এত মিল, কিন্তু রাজনীতির প্রশ্নে স্বামীর হয়ে কিন্তু কোনও দিন প্রকাশ্যে কোনও সওয়াল করতে দেখিনি কমলাদেবীকে। 
রাতে শোবার ঘরের বড় টিভিটায় হিন্দি বা হলিউড ছবি দেখাটা আডবাণীর বহু দিনের নেশা।
হলিউড নিয়ে কমলাজির তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু বলিউডের ছবি হলে ওঁরা দেখতেন একসঙ্গেই। সে শুধু বাড়িতে নয়, হলে গিয়েও। যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তখন তো সিরিফোর্ট অডিটোরিয়ামে নিয়মিত একসঙ্গে অনেককে নিয়ে সিনেমা দেখতেন ওঁরা।
মহাদেব রোডের অডিটোরিয়ামে বছর কয়েক আগেও কমলা-লালকৃষ্ণকে একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখতে দেখা গেছে।
এত কিছুর পরেও সব সময় তাঁর ‘লাল’-কে খেয়াল রাখা, তাঁকে নজরে রাখাটা ছিল যেন কমলাজির দিনের সবচেয়ে জরুরি কাজ।
ছোট্ট ছোট্ট কত যে বিষয়ে নজর ছিল ওঁর।
রাতে হলুদ দিয়ে গরম দুধ খান আডবাণী। বহু দিনের অভ্যাস। হাজার ব্যস্ততা থাক, যত দিন সুস্থ ছিলেন, সেই নিয়মের কোনও দিন অন্যথা হতে দেননি কমলা।
লালকৃষ্ণ আডবাণী যখন উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন একবার কমলাকে নিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। কমলার নিজের এক ভাই নিউ জার্সিতে থাকতেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করার, তাঁর কাছে থাকার  ইচ্ছে খুব।
চিরকালই কমলা বিমানে চড়তে ভয় পেতেন। বিমানে চড়লেই তাঁর গা গোলাত, দম বন্ধ লাগত।
মুম্বই-এ নিজের ভাইবোনের সঙ্গে দেখা করতে গেলেও দিল্লি থেকে অগস্টক্রান্তি এক্সপ্রেসে করে যেতেন। বিমানে যেতেন না। কিন্তু সে বার তো আর তার উপায় ছিল।
নিউ জার্সি পৌঁছে প্রথম দু’তিনদিন বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন কমলা। অদ্ভুত এক রোগে পায় তাঁকে। কেবলই ওঁর মনে হতে থাকে, তিনি দিল্লিতেই রয়েছেন। বাড়ির দীর্ঘদিনের পরিচারক ভবানী। কমলার প্রায় পুত্রসম। ওখানে গিয়েও তিনি হাঁক ছাড়তেন, ‘‘ভবানী কেন সাহেবের জন্য এখনও চা করে দিচ্ছে না?’’ সকালবেলা তিনি ভাবতেন, এই বুঝি বিকেল হল। আবার কখনও বলতেন, ‘‘সন্ধ্যা হয়ে গেল, এখনও ভবানী গাছে জল দিল না।’’
সবাই ভেবেছিলেন বোধহয় জেটল্যাগ-এর জন্যই অমনটা হচ্ছে। দু’তিনদিন পর সব স্বাভাবিকও হয়ে গেল। দেশেও ফিরে এলেন ওঁরা। ভালই ছিলেন। সদ্য বছর খানেক ধরে দেখা গেল, ধীরে ধীরে তিনি সব কিছু ভুলে যাচ্ছেন।
রাজনীতিতে আডবাণী ইদানীং তেমন কোনও সক্রিয় চরিত্র নন। দিনের বেশির সময় বাড়িতেই কাটান। ফলে কমলাকে অনেক বেশি সময় দিচ্ছিলেন তিনি।
এর মধ্যে চিকিৎসকরা দেখে গেলেন। তাঁরা দেখেশুনে রায় দিলেন, নিউ জার্সি শহরে থাকার সময়ই নাকি কমলার ‘মনস্তাত্ত্বিক অ্যাটাক’ হয়েছিল। যার ফল টের পাওয়া যাচ্ছে আজ। এই দশ বছর বাদে।
ফিজিওথেরাপিস্ট রাখা হল।  একজন মনস্তত্ত্ববিদও। কমলা হাঁটাচলার স্বাভাবিক ক্ষমতা হারালেন। হুইলচেয়ারে করে ঘরের মধ্যে যাতায়াত করতে লাগলেন। খাবারটাও খাইয়ে দিতে হত।
খাবার সময় ডাইনিং টেবিলে আডবাণী বসতেন। হুইলচেয়ারে কমলাও এসে পড়তেন তখন। দু’জনকে যে একসঙ্গে খেতেই হবে! হাজার ভুলে যাওয়ার মাঝে লাল-কে নিয়ে তাঁর একটা শব্দও যেন হারিয়ে যাওয়ার নয়।
মেয়ে প্রতিভা একটা বেসরকারি মিডিয়া হাউস তৈরি করেছিলেন। মায়ের অসুখের জন্য সে সব ছেড়ে দিয়ে বাড়িতেই সারাক্ষণ থাকতে শুরু করলেন।
বাবা আর মেয়ে মিলে ঠিক করেন, অসুস্থ কমলাকে ফেলে দু’জনে একসঙ্গে আর বাড়ির বাইরে যাবেন না। আডবাণীর দেশের মধ্যে ঘোরা অনেক কমে গিয়েছিল। কোনও কারণে বাইরে গেলে মেয়ে প্রতিভা থাকতেন বাড়িতে।
ছেলে জয়ন্ত, তাঁর স্ত্রী গীতিকাকে নিয়ে বছরখানেক হল আলাদা ফ্ল্যাটে। তবে খুব দূরে নয়। অক্ষরধাম মন্দিরের কাছে তৈরি একটি আবাসনে থাকেন ওঁরা। জয়ন্তর এক মেয়ে। পৃথ্বীরাজ রোডের বাড়িতে স্থানাভাব, তাই তাঁর চলে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
মাঝে মধ্যেই মেয়েকে নিয়ে গীতিকা আসতেন। ঠাকুমার সঙ্গে খেলতেন নাতনি। জয়ন্তর একটি টেবল টেনিস বোর্ড এ বাড়িতে রাখা। বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে টেবল টেনিস খেলে বাড়ি যেতেন তিনি। বেশির ভাগ সময় তাঁর খেলার পার্টনার হতেন তাঁর শ্যালক হেমন্ত।
অসুখের পর থেকে প্রত্যেকদিন কমলাকে অঙ্ক কষতে দিতেন মনস্তত্ত্ববিদ। ওটাই থেরাপি। ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত লিখে যেতে হবে।
এর মাঝে কোনও দিন হয়তো সন্ধ্যাবেলা গিয়েছি। আডবাণীজি বলতেন, ‘‘জানো, আজ কমলা ৮৫ পর্যন্ত লিখতে পেরেছে।’’
তাতেই কী খুশি ওঁর!
আডবাণীকে দেখতাম, কমলার পাশে বসে হাতের উপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ওঁর স্পর্শটা অনুভব করতেন কমলা। অপলক তাকিয়ে থাকতেন তাঁর লাল-এর দিকে। বাকিটা যেন ধোঁয়াশা। আবছা।
ফুরিয়ে আসা জীবন কি এমনই হয়?
এক দিনের কথা মনে পড়ছে।
সে দিনও আডবাণীর বাড়ি গিয়েছি। কমলাদেবীকে ডেকে পাঠালেন আডবাণীজি। এলেন তিনি। হুইলচেয়ারে বসা কমলাকে আডবানী বললেন, ‘‘কী, চিনতে পারছ? বলো তো, কে এসেছে!’’ পুরনো কেউ গেলে এ ভাবেই যেন কমলাকে পরখ করতেন আডবাণী।
সে দিনও তাই।
কমলাদেবী অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। ম্লান একটা হাসি লেগে ঠোঁটে। কিন্তু কিছুই বলতে পারলেন না। আডবাণী নিজের কথা বলতে লাগলেন। আড়চোখে কমলাদেবীকে দেখলাম, তখনও আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন।
হঠাৎ বললেন, ‘‘আরে তুম ইধার কেয়া কর রাহে হো?’’
ব্যস ওইটুকুই।
মনস্তত্ত্ববিদরা যেমন সংখ্যা লিখতে দিতেন ওঁকে, তেমন নামও লিখতে বলতেন। তখন অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটত। একটাই শব্দ নাকি লিখে যেতেন কমলা—লালকৃষ্ণ আডবাণী, লালকৃষ্ণ...।
বারবার। প্রতি বার।
শেষ দিকে আর কাউকে চিনতেও পারতেন না। শুধু তাঁর ‘লাল’-কে ছাড়া।
জীবনের শেষ দিনটিতে দুপুরের খাবার সময়ও তাঁরা ছিলেন পাশাপাশি।
মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আডবাণী!

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/mr-and-mrs-advani-1.359949