গল্প লিখছেন।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে।
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, ‘‘হুঁ লোকটা লিখছে বটে কিন্তু লেখাগুলো বড্ড স্থূল। যাত্রার মতো চড়া।’’
শুনে মন খারাপ লাগে।
হয়তো সমালোচকদের কথাই ঠিক, সেই ভেবে রবীন্দ্রনাথকে বই পাঠাতে ভয় করত তারাশঙ্করের। কিন্তু একদিন যা-হবে-হোক ভেবে মরিয়া হয়ে দুটি বই পাঠিয়েই দিলেন শান্তিনিকেতনের ঠিকানায়।
ধরেই নিয়েছিলেন কোনও উত্তর আসবে না। কিন্তু পাঠানোর এক সপ্তাহ পরেই এক বিচিত্র খামের চিঠি তাঁর বাড়িতে। সাদা খামের এককোণে ‘র’ অক্ষর লাল কালিতে ছাপা। অমন খাম বাংলাদেশে একজনেরই রয়েছে। সবাই চেনে।
খাম খুলবেন কি? তার আগেই বুক ঢিপঢিপ। গলা শুকিয়ে কাঠ। হাত পা কাঁপছে উত্তেজনায়। খামটা কোথায় খুলে দেখবেন সেটাই বুঝে পাচ্ছেন না।
শেষে লাভপুর পোস্ট অফিসের পুবদিকে কল্কে ফুলের বনে গিয়ে নিরালায় খুললেন খামটি। ভেতরে সেই অপূর্ব হাতের লেখায় বহু আকাঙ্খিত চিঠি।
‘‘কল্যাণীয়েষু,
আমার পরিচরবর্গ আমার আশেপাশে উপস্থিত না থাকায় তোমার বই দু’খানি আমার হাতে এসেই পৌঁচেছে। কিন্তু তাতে পরিতাপের কোনও কারণ ঘটেনি। তোমার ‘রাইকমল’ আমার মনোহরণ করেছে।’’
ওই পর্যন্ত পড়ে আবার বুক ধড়াস। ভাল লেগেছে! কবিগুরুর ভাল লেগেছে! আর কী চাই জীবনে!
সঙ্গে সঙ্গে কবিকে পালটা চিঠি লিখলেন দ্বিগুণ উৎসাহে, ‘‘রাইকমল সম্পর্কে আপনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন কিনা জানি না। কারণ আমার সমসাময়িকরা আমার লেখাকে বলেন স্থূল।’’
চিঠি পাঠানোর চারদিন পরেই আবার কবির উত্তর এল, এবারের চিঠি আগের বারের থেকেও বড়।
চিঠির শুরুতেই লেখা, ‘‘তোমার কলমের স্থূলতার অপবাদ কে বা কারা দিয়েছেন জানি না, তবে গল্প লিখতে বসে যারা গল্প না লেখার ভান করে, তুমি যে তাদের দলে নাম লেখাওনি, এতেই আমি খুশি হয়েছি।’’
ব্যস, মনের ভেতর যেটুকু নিরাশা, ক্লেদ জমে উঠেছিল, সব ধুয়েমুছে গেল।
কবি লিখেছেন, ‘‘শান্তিনিকেতনে এসে আমার সঙ্গে দেখা করো।’’
তখন চৈত্রমাস।
কবির এমন ডাক পেয়ে আর ধৈর্যে সইল না। আগাম না জানিয়েই রওনা দিলেন শান্তিনিকেতনে।
একে তো কালো রোগা চেহারা, তার ওপর জেল খেটে সামান্য শ্রীটুকুও গেছে। পরনের জামাকাপরও ময়লা।
আগে কোনও দিন যাননি শান্তিনিকেতনে। সোজা গিয়ে উঠলেন শ্রীনিকেতনে। গেস্টহাউজের অধ্যক্ষকে বললেন, ‘‘কবির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, রাত্তিরটা এখানে থাকতে চাই।’’
অধ্যক্ষ ভুরু কুঁচকে ময়লা জামা পরা লোকটিকে বললেন, ‘‘দেখা তো হবে না।’’
‘‘সে আমি ব্যবস্থা করে নেব। আপনি শুধু আজ রাত্তিরটা থাকার ব্যবস্থা করে দিন।’’
সে ব্যবস্থাও হল না।
অগত্যা শ্রীনিকেতনের বাইরে একটি পান্থ নিবাসের ঘুপচি ঘরে রাত্রিবাস।
সেও স্মরণীয় হল।
মশার কামড়ের জন্য একই মশারির ভেতর তারাশঙ্কর, আরও চারটি তরুণ ছেলের সঙ্গে প্রায় সারারাত জেগেই পার করলেন। সকাল হতেই ছুটলেন আবার শান্তিনিকেতনে।
কবির কাছে খবর গেল তারাশঙ্কর এসেছে।
‘‘ডাকো তাকে এখুনি, আমার কাছে ডাকো।’’
গেলেন তারাশঙ্কর। দুরুদুরু বুকে ঘরে ঢুকলেন। কবি বসে আছেন।
দেখেই বললেন, ‘‘এ কী, এ তো চেনা মুখ। কোথায় দেখেছি তোমাকে?’’
‘‘আজ্ঞে বোলপুরেই তো বাড়ি আমার। আপনাকে বেশ কয়েকবার দূর থেকে দেখেছি, তখন হয়তো...।’’
‘‘না না কাছ থেকে দেখেছি। কোথায় দেখেছি বলো তো?’’
তারাশঙ্করও স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন।
মনে পড়ল বছর পাঁচেক আগের কথা। সমাজ-সেবক কর্মীদের একটা সভা হয়েছিল, সেখানে কবি কর্মীদের সঙ্গে কিছুক্ষঁণ দেখা করেছিলেন। তার মধ্যে ছিলেন তারাশঙ্করও। কিন্তু সে কথা কি এত দিন পর কবির মনে আছে? তবুও উল্লেখ করলেন সেই কথা।
‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। তুমি তো ওদের মুখপাত্র ছিলে। আমার সামনে বসেছিলে।’’
তারাশঙ্কর অবাক!
এত দিন পরও সব মনে রেখেছেন! কী সাংঘাতিক স্মৃতিশক্তি!
‘‘তা কী করো?’’
‘‘করার মতো কিছুই মন লাগেনি। চাকরিতেও না, বিষয়কাজেও না। দেশের কাজ করতে গিয়ে জেল খেটেছি।’’
‘‘ও পাক থেকে ছাড়া পেয়েছ?’’
‘‘মনে হয় পেয়েছি।’’
‘‘তাহলে তোমার হবে। তুমি দেখেছ অনেক। তোমার মতো গ্রামের কথা আমি আগে কখনও পড়িনি।’’
‘‘কিন্তু গুরুদেব, লোকে যে আমার লেখাকে স্থূল বলে। আবার আক্ষেপ।’’
কবি বললেন, ‘‘দুঃখ পাবে। পেতে হবে। যত উঠবে তত তোমাকে ক্ষত-বিক্ষত করবে। এ দেশে জন্মানোর ওই এক কঠিন ভাগ্য। আমি নিষ্ঠুর দুঃখ পেয়েছি।’’
একটু থামলেন কবি। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর বলে উঠলেন, ‘‘মধ্যে মধ্যে ভগবানকে বলি কি জানো তারাশঙ্কর? বলি, ভগবান পুনর্জন্ম যদি হবেই তবে এদেশে যেন না জন্মাই।’’
শুনে শিউরে উঠলেন তারাশঙ্কর। কার মুখ থেকে শুনছেন এ কথা! না না গুরুদেব একথা বলবেন না...দয়া করে এই কথা বলবেন না।
শুনে হাসলেন। আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘তোমার এইটুকু যেন বেঁচে থাকে। বাঁচিয়ে রাখতে পারো যেন।
আরেক বার ডাক পড়েছে কবির কাছ থেকে। তারাশঙ্কর গেছেন শান্তিনিকেতন।
উত্তরায়ণের সামনে যেতেই থমকে গেলেন। কবি তাঁর সামনে বসে থাকা একজন লোকের সঙ্গে তীক্ষ্ণ কঠিন গলায় কথা বলছেন। কেদারায় হেলান দিয়ে নয়, সোজা বসে। গলা চড়ছে।
আর সামনে এগোতে সাহস পেলেন না তারাশঙ্কর। ওখানেই থেমে গেলেন।
স্মৃতিকথায় লিখছেন, ‘‘হঠাৎ কবি উচ্চকণ্ঠে ডাকলেন, বনমালী! বনমালী! তারপর ডাকলেন মহাদেব! মহাদেব! কণ্ঠস্বর পর্দায় পর্দায় চড়ছে। এর পরই ডাকলেন সুধাকান্ত! সুধাকান্ত! এরা কি ভেবেছে বাড়ির মালিক মরে গেছে? তখনকার কবির মূর্তি বিস্ময়কররূপে প্রদীপ্ত। যেন প্রখর রৌদ্রে কাঞ্চনজঙ্ঘা চোখ-ঝলসানো দীপ্তিতে প্রখর হয়ে উঠেছে। সমস্ত উত্তরায়ণ যেন সেই কন্ঠস্বরে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। এ-পাশের ও-পাশের বাড়ি থেকে দু একজন উঁকি মারলেন। তাঁদের মুখে শঙ্কার চিহ্ন। দু-একজন উত্তরায়ণের প্রবেশ-পথে যাচ্ছিলেন তারা থমকে দাঁড়ালেন। আমার মনে হল গাছগাছালিগুলিও স্তব্ধ হয়ে গেছে। সুধাকান্ত ছুটে গেলেন কবির কাছে এবং প্রথমেই সেই লোকটিকে উঠতে অনুরোধ করলেন। তিনি উঠে চলে গেলেন। কবি কথা বলছেন সুধাকান্তর সঙ্গে। তখনও গলার তেজ কমেনি তাঁর।’’
তারাশঙ্কর ভাবলেন আজ আর দেখা করে দরকার নেই। পালালেই ভাল। নিঃশব্দে চলে যাচ্ছেন। তখনই সুধাকান্ত আবার দৌড়ে কাছে এলেন।
‘‘আরে আপনি চললেন কই? গুরুদেব ডাকছেন।’’
‘‘আজ আর গিয়ে দরকার নেই। খুব রেগে আছেন উনি।’’
‘‘আরে না না, আপনি চলুন। আসলে হয়েছে কি ওই লোকটি শান্তিনিকেতনের কর্তৃপক্ষকে অশিষ্ট ভাষায় অপমান করেছে। সেই কারণে কবি প্রচণ্ড রেগেছেন, কিন্তু উনি যেহেতু অতিথি তাই সরাসরি কিছু বলতেও পারছেন না। সেই রাগটাই চিৎকার করে ওই বনমালী, মহাদেব আর শেষে এই আমার ওপর দিয়ে বার করলেন। আপনি যান, কোনও ভয় নেই।’’
আশ্বাস পেয়েও যথেষ্ট ভয় নিয়েই কবির কাছে গেলেন তারাশঙ্কর। তখনও কেদারায় পিঠ সোজা করে বসে রয়েছেন।
তারাশঙ্করকে দেখেই কবির প্রথম প্রশ্ন, ‘‘শান্তিনিকেতন জায়গাটা তোমার কেমন লাগে?’’
‘‘আজ্ঞে ভালই লাগে তো বেশ।’’
‘‘তাহলে তুমি সবার কাছে শান্তিনিকেতনের নিন্দা কেন করে বেড়াও?’’
এই কথা শুনে তারাশঙ্করের মাথায় হাত। কবি কী বলছেন!
‘‘আজ্ঞে আমি তো এমন কথা কখনও...।’’
রবীন্দ্রনাথ মৃদু হেসে বললেন, ‘‘তাহলে শান্তিনিকেতনে তুমি আসো না কেন? তোমার বাড়ি তো কাছেই। একটু যাতায়াত তো রাখতে পারো। আমি ভেবেছিলাম শান্তিনিকেতনের এক কোণ তুমি একটু আগলে বসবে। তা তো নিলেই না। আমার সঙ্গে একটু দেখাও করতে আসো না।’’
এমন স্নেহের কথায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তারাশঙ্কর। কী উত্তর দেবেন বুঝে না পেয়ে আমতা-আমতা করে বলে ফেললেন, ‘‘মানে এদিকটায় আসা হয়ে ওঠে না।’’
‘‘বুঝেছি।’’
বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন কবি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘‘তাহলে তোমায় টানা অন্যায় হবে। তোমার ইচ্ছে নেই।’’ একটু মৃদু হাসলেন। তারপর আবার বললেন, ‘‘এ জেলার লোকের কাছে  শান্তিনিকেতন বিদেশই রয়ে গেল। কোথায় যে রয়েছে মাঝখানের খাতটা!’’
কথাগুলো বলার সময়ে গুরুদেবের যে করুণ কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন তা জীবনে ভুলতে পারেননি তারাশঙ্কর।

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/rabindra-nath-tagore-on-tarasankar-bandyopadhyay-1.385519