চিত্রণ: সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়
জাপটে ধরে বন্ধুকে খপ করে চুমুই খেয়ে বসলেন হেমেন্দ্রলাল রায়৷
প্রায় আশি বছর আগে মধ্য কলকাতার এক রেস্তোরাঁয় ঘটনাটি ঘটছে যখন, তখন চারপাশের লোকজনের অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়৷
আড্ডায় ছিলেন শিব্রাম চক্রবর্তীও৷ তৎক্ষণাৎ ছড়া ঘনাল তাঁর মনে। লিখে ফেললেন—
‘‘গল্প, না বৎস, না কল্পনাচিত্র
হেমেন্দ্রচুম্বিত প্রেমেন্দ্র মিত্র৷’’
বন্ধুভাগ্য চিরকালই বেশ ভাল প্রেমেন্দ্র মিত্রের৷ ছোটবেলা থেকেই ঠাঁইনাড়া জীবনে একলা থাকার যন্ত্রণা ভুলিয়েছে তাঁর বন্ধুরাই৷
বাবা হয়ে গেলেন দূরের মানুষ
হুগলির কোন্নগর গ্রামের এক অভিজাত পরিবারে জন্মের পরে ছোট ছেলেটি বড় হচ্ছিল আর পাঁচটা ছেলের মতোই৷
বাড়িও ছিল জমজমাট৷ ঠাকুরদা শ্রীনাথ মিত্রর বন্ধু শিবনাথ শাস্ত্রী৷ বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ মিত্র ব্রিটিশ রেলকোম্পানির অ্যাকাউন্ট্যান্ট৷
মা সুহাসিনী উত্তর প্রদেশের মির্জাপুরে রেলেরই ডাক্তার রাধারমণ ঘোষের একমাত্র মেয়ে৷
কিন্তু খুব ছোটবেলায় তাল কেটে গেল জীবনের৷ সুহাসিনী বেঁচে থাকতেই জ্ঞানেন্দ্রনাথ আবার বিয়ে করলেন৷
ছোট্ট প্রেমেন্দ্রর কাছে বাবা হয়ে গেলেন দূরের মানুষ৷ দূরে চলে গেল বাংলাও৷ মায়ের সঙ্গে প্রেমেন্দ্রর ঠিকানা হল মির্জাপুরের রেল হাসপাতালের কোয়ার্টার৷
সেখানেই জীবনের প্রথম দুই বন্ধুকে পাওয়া৷ লজ্জু আর মুরাদ৷
তারের বেড়ায় ঘেরা বিশাল হাসপাতাল-প্রাঙ্গণে দাদামশায়ের কম্পাউন্ডারের এই দুটি ছেলেমেয়ে কেটে দিয়েছিল মনের তারের বেড়াগুলো৷
তিন জনে এক বার বাগানে গিয়েছিল টেপারি খেতে। তাতে ঝোপকাঁটায় লেগে জামা গেল ছিঁড়ে। কী হবে? মাকে কী বলবে এখন? বাড়ি ফিরতে মা জানতে চাইলে লজ্জু বলে দিল, এক দুর্ধর্ষ ডাকু তাদের পাকড়ায়, তাতেই নাকি এই দশা!
তাতে ওদের কী দশা হয়েছিল অবশ্য জানা নেই। কিন্তু জীবনে প্রথম বানিয়ে গল্প বলতে শেখানোটা যে এই লজ্জুরই, পরে আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন ঘনাদার দারুণ সব গুল্পের লেখক প্রেমেন্দ্র৷
গঙ্গার বান দেখতে স্কুলে ছুটি
লজ্জু আর মুরাদের সঙ্গে পরে আর দেখা হয়নি৷ কিন্তু কলকাতায় স্কুলে পড়তে পড়তে পেয়েছিলেন আর এক বন্ধু অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে৷
বাংলা সাহিত্যে সেই বন্ধুত্বের গল্প ইতিহাস হয়ে আছে৷
শহরে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ছায়া৷ সাউথ সুবার্বন স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন প্রেমেন্দ্র৷ ১৯১৭-য় তিনি দশম শ্রেণিতে, খাতায়-কলমে বয়স তখনও পুরো ১৪ নয়৷
অচিন্ত্যকুমার পড়তেন নীচের ক্লাসে৷ দশম শ্রেণিতে আলাপ, আর প্রথম দেখাতেই অচিন্ত্যকুমার চমকে গেলেন, ‘‘লক্ষ করলাম সমস্ত ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে অসাধারণ ওই একটিমাত্র ছাত্র— প্রেমেন্দ্র মিত্র৷ একমাথা ঘন কোঁকড়ানো চুল, সামনের দিকটা একটু আঁচড়ে বাকিটা এক কথায় অগ্রাহ্য করে দেওয়া— সুগঠিত দাঁতে সুখস্পর্শ হাসি, আর চোখের দৃষ্টিতে দূরভেদী বুদ্ধির প্রখরতা৷’’
বন্ধুত্বটা পাতিয়েছিল কবিতাই৷ দুজনেই কবিতা লিখতেন আর তাতে প্রেরণা আর অকুণ্ঠ উৎসাহ সব থেকে বেশি জোগাতেন সংস্কৃতের রণেন-পণ্ডিত, রণেন্দ্রনাথ গুপ্ত৷ কিন্তু সে কালের আর পাঁচজন বালক কবির মতো রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণ করেননি প্রেমেন্দ্র, অনুকরণ করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে!
উৎসাহ দিতেন বাংলার স্যার হরিদাস পণ্ডিতও৷ তাঁর কাছে ক্লাসে গোলমাল করার অপরাধ মাফ হয়ে গিয়েছিল কবিতার খাতিরেই৷
বাংলার আর এক স্যার কিরণ মিত্র আবার গঙ্গার বান নিয়ে রচনা লিখতে দিয়ে ছুটি দিয়েছিলেন, সঙ্গে ট্রামের ভাড়াটিও৷ লেখার আগে বান চাক্ষুষ করা চাই, তাই।
বাড়িতেই চিড়িয়াখানা
কবিতার জন্য কলকাতায় এসে জুড়ে গিয়েছিলেন অচিন্ত্যকুমারের সঙ্গে। আর নভেল লেখার প্রথম শিক্ষা দিয়েছিলেন বীরুমামা৷
সে অবশ্য কলকাতায় আসার আগে, নলহাটিতে৷ দাদামশায় রাধারমণের মৃত্যু হল বসন্ত রোগে, মির্জাপুরেই৷
মির্জাপুর শহরের আমির-ফকির সকলকে দিনরাত্রি বসন্তের টিকা দিতে দিতে তাঁর নিজের টিকা নেওয়া আর হয়ে ওঠেনি৷ তাঁর মৃত্যুর পরে মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে দিদিমা কুসুমকুমারী চলে এসেছিলেন নলহাটিতে৷
তাঁরই ভাইয়ের ছেলে, বীরেন্দ্রনাথ, বীরুমামা৷ মামা-টা কেবল সম্পর্কের ডাক, আসলে তিনিও প্রেমেন্দ্রর আর এক বন্ধু৷ বোলতা-ফড়িং-শুঁয়োপোকা-মশা ইত্যাদি শিশি-বোতলে ধরে দুই বন্ধুতে বাড়িতেই গড়ে তুলেছিলেন চিড়িয়াখানা৷
বাড়ি থেকে পালিয়ে
বীরুমামাই দিলেন ‘বই লেখার শিক্ষা’৷— ‘‘একদিন খাতাকলম নিয়ে আমায় ডেকে সে বললে, আয়৷ আমরা বই লিখব৷...তার কাছে জানলাম বই মানে নভেল, বাড়ির গুরুজনেরা অবসর পেলে যা পড়ে; আর সে বই লিখতে হলে প্রায় এইরকমভাবে শুরু করতে হয়;— কলিকাতা নগরীর নির্জন স্বল্পালোকিত একটি গলির জরাজীর্ণ একটি অট্টালিকার অন্ধকার একটি প্রকোষ্ঠে গ্রীষ্মের এক নিশীথে এই উপাখ্যানের প্রধান দুই পাত্রপাত্রীর মধ্যে নিম্নলিখিত রূপ কথোপকথন হইতেছিল—।’’
নিজের উপন্যাস অবশ্য এ ভাবে বঙ্কিমী গদ্যে শুরু করেননি প্রেমেন্দ্র মিত্র৷
সহজ গদ্যে গভীর গল্প বলাই ছিল তাঁর স্বভাব৷ কিন্তু কলকাতায় আসার আগেই ওই যে তাঁর বই লেখার শিক্ষায় পিছু নিল কলকাতা, জীবনভর সে আর পিছু ছাড়ল না৷
অথচ প্রেমেন্দ্র পালাতে চেয়েছেন বার বার, এই শহর থেকে৷
সেই কবে বর্মায় পালিয়ে যাওয়া তাঁর এক নাম-ভুলে-যাওয়া সহপাঠী শুনিয়েছিল নিরুদ্দেশের ডাক৷
তার পরে একদিন সত্যি সত্যিই অভিমানে ঘর ছাড়লেন৷ অভিভাবকদের কাছে একটা অভিধান আর বালির কাগজের খাতার বদলে এক্সারসাইজ বুক চেয়েও না পাওয়ার বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন হাওড়া স্টেশনে৷
দু’দিন স্টেশনেই থেকে উঠে বসেছিলেন দূরপাল্লার ট্রেনে৷
কিন্তু পারলেন না দূরে পাড়ি দিতে৷ ফিরে এলেন বাড়িতেই৷ জীবনে বহু বার তার পরে রওনা হয়েছেন, কিন্তু পিছু নিয়েছে এই শহর আর তার জীবন৷ কবিতায় তাই বোধ হয় লিখছিলেন, ‘‘যেখানেই কেন রওনা হও না ঘরেই নিজের ফিরবে!/ তেপান্তরেও হারাতে চাইলে সেই দেয়ালেই ঘিরবে৷’’
মন চলো শান্তিনিকেতনে
যতই দরজা-জানলা ভেজান, তাঁর জীবনে আকাশ উঁকি দিয়েছে বার বার৷ শিরায় শোণিতে ছটফটে ছোঁয়া বুঝেছেন আর ভেসে পড়েছেন৷
অচিন্ত্যকুমার লিখেছেন বন্ধুর সেই ভেসে পড়ার কথা, ‘‘নন কো-অপারেশনের বান-ডাকা দিন৷ আমাদের কলেজের দোতলার বারান্দা থেকে দেশবন্ধুর বাড়ির আঙিনা দেখা যায়— শুধু এক দেয়ালের ব্যবধান৷ মহাত্মা আছেন, মহম্মদ আলি আছেন, বিপিন পালও আছেন বোধহয়—তরঙ্গতাড়নে কলেজ প্রায় টলোমলো৷ কী করে যে আঁকড়ে থাকলাম কে জানে, শুনলাম প্রেমেন ভেসে পড়েছে৷’’
ভেসে পড়া অবশ্য অসহযোগ আন্দোলনে নয়, চিরন্তন ভারতবর্ষের খোঁজে৷ মন তখন বলছে, দেশে কি বিদেশে মামুলি পড়াশোনা করে কোনও লাভ নেই৷ নগরে বন্দরে নয়, আসল ভারতবর্ষ যেখানে অবহেলায় পড়ে আছে, গ্রামাঞ্চলের সেই চাষিদের মধ্যে গিয়ে কাজ করতে হবে৷ তার জন্যে আধুনিক বৈজ্ঞানিক কৃষিবিদ্যা শেখা দরকার৷
অতএব চলো রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতন৷
চুলোয় যাক কলেজের পুঁথিশিক্ষা৷ কানাকড়ি পকেটে নেই৷ শ্রীনিকেতনে ভর্তির পয়সা দেবে কে! এলমহার্স্ট বিনা পয়সায় পড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন৷ নিজের হাতে টমেটো ফলালেন৷ তা নিয়ে স্টলও দিলেন পৌষমেলায়৷
পরিবার-পরিজনদের মাঝে
রইল পড়ে শান্তিনিকেতন
টমেটোর সূত্রেই প্রথম কথা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে৷ প্রদর্শনী দেখতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ টমেটো দেখে মজা করে বলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্রকে, ‘‘দেখিস, লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে ফেলিস না যেন৷’’
কিন্তু আবার তাঁকে টানছে কলকাতা৷ বড়দিনের ছুটিতে কলকাতা আসার অনুমতি পাওয়া গেল সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের কাছে৷
কথা ছিল শ্রীনিকেতনে পাকাপাকি থাকার ব্যবস্থা করার জন্যই কলকাতায় আসা৷ কিন্তু শহরে পা দিতেই জড়িয়ে পড়লেন মায়ায়৷
আবার সাউথ সুবার্বন কলেজে পড়তে চাইলেন৷ সেখানে তখনও নাম কাটা যায়নি৷ শুধু বকেয়া ফি জমা দিলেই পড়া যাবে, জানালেন কর্তৃপক্ষ৷ কিন্তু ওই যে, শিরায় শোণিতে ছটফটে নেশা! শ্রীনিকেতন, কলকাতা পড়ে রইল৷ টেনদার সঙ্গে চাঁদপাল ঘাট থেকে তেরপল-ঢাকা গাধাবোট-বাঁধা সুন্দরবন ডেসপ্যাচ সার্ভিসের স্টিমারে ঢাকার উদ্দেশে ভেসে পড়লেন প্রেমেন্দ্র মিত্র৷
মেসের টানে কলকাতায়
টেনদা মানে বিমলচন্দ্র ঘোষ৷ বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রেমেন্দ্র, এই অভিমানে তাঁর অভিভাবক দিদিমা কাশীর বাড়িতে গিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখন হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়ির কিছুটা রেখে বাকিটা ভাড়া দিয়ে দেওয়া হল৷
প্রেমেন্দ্র উঠলেন ২৮ নম্বর গোবিন্দ ঘোষাল লেনের মেসবাড়িতে৷ এই মেসই পরে হয়ে উঠবে ঘনাদার গল্প আর মেজকর্তার ভূতের গল্পের ঠেক৷
এরই পরিচালক ছিলেন বিমলচন্দ্র। যাঁর আদলে প্রেমেন্দ্র তৈরি করেছিলেন তাঁর গল্পের আর এক চরিত্র নীপুদা-কে৷
ছোটগল্পকার প্রেমেন্দ্র মিত্রেরও জন্ম এই মেসে। কুলুঙ্গিতে রাখা পুরনো এক পোস্টকার্ডের চিঠির সূত্রে৷
ঢাকার মেডিক্যাল স্কুলে ডাক্তারি পড়তে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু প্রথম তালিকায় নাম না থাকায় ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন ঢাকারই জগন্নাথ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে৷ থাকতেন লক্ষ্মীবাজারে অক্সফোর্ড মিশন ছাত্রাবাসে৷ কিন্তু সেই টেনদার মেসের টানে বার বার ছুটে আসতেন কলকাতায়৷
তেমনই এক বার ঢাকা থেকে ফিরেছেন। মেসের ঘরের কুলুঙ্গিতে হঠাৎ পেলেন সেই ঘরের কোনও পুরনো বাসিন্দার নামে লেখা এক জীর্ণ পোস্টকার্ড— ‘‘দামি কিছু নয়, বেশ পুরনো একটি আধময়লা পোস্টকার্ড। কাঁচা বাঁকাচোরা হস্তাক্ষরে পোস্টকার্ডটিতে যা লেখা তার কিন্তু একটা নিজস্ব মাধুর্য আছে৷ আঁকাবাঁকা হাতের লেখায় ভুল বানানে একটি গ্রাম্য বধূ সে পোস্টকার্ডে কলকাতার অফিসে চাকরি করতে যাওয়া তার স্বামীকে গ্রামের ঘরসংসারের অভাব অভিযোগ মেশানো নানা সমস্যার সঙ্গে নিজের অগোচরে যে মধুর একটি প্রণয় ব্যাকুলতার আভাস দিয়েছে, তা মনকে নাড়া দিয়ে গেল৷’’ সেই রাতেই লিখে ফেললেন দুটি গল্প, ‘শুধু কেরাণী’ আর ‘গোপনচারিণী’৷ পাঠিয়ে দিলেন প্রবাসী পত্রিকায়, ছাপাও হল৷
প্রথম উপন্যাস
একের পরে এক ছোটগল্প শখতে লাগলেন। ‘কল্লোল’, ‘কালি-কলম’, ‘সংহতি’, ‘বিজলী’-র মতো সে কালের নামকরা সব পত্রিকায়৷
খ্যাতিও হল৷ কিন্তু খ্যাতির দেয়ালে এক জায়গায় আটকে থাকার মানুষ নন যে তিনি৷
ঠিক করলেন, ব্যবসা করবেন৷ করেওছিলেন৷ টালিখোলার ব্যবসা৷ জমল না৷ তখন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে সাঁওতাল পরগনার ঝাঝায় ছোট একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে শুরু করলেন৷
লেখা অবশ্য থামাননি৷ তত দিনে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে প্রথম উপন্যাস ‘পাঁক’৷ লিখেছিলেন অবশ্য তার বেশ কিছু আগে৷ তখন থাকতেন ভবানীপুরে ৫৭ হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের একটি পুরনো বাড়িতে৷ লিখছেন, ‘নলহাটি ছেড়ে কলকাতায় এলাম৷ কলকাতা মানে ভবানীপুরের শেষ প্রান্তে একটা দুখিনী রাস্তার সেকেলে একটা পুরোনো একতলা বাড়ি৷ এই বাড়িটিই আমাদের জন্যে কেনা হয়েছে৷ পিছনে প্রকাণ্ড উঁচু দেয়াল তুলে পাহারা দেওয়া একতলা বাড়ি৷ সামনে টিনের চালের একটা আলাদা বাসা৷ সে বাড়ির চেহারা একটু আধটু বদলেছে, কিন্তু সামনের ইট চুন বালি সুরকি বিক্রির সারি সারি গোলা শোভিত সুরকির কল নিনাদিত রাস্তাটির বিশেষ পরিবর্তন হয়নি৷ পরিবর্তন হয়নি ওপারের জেলখানারও৷ রাস্তা দিয়ে বলদ গাড়ির বদলে এখন শুধু লরির বহর যায়৷ আর বুজে-আসা আদিগঙ্গা বেশ কিছু খোঁড়াখুঁড়ি সত্ত্বেও নদীর বদলে নালার ধর্মই পালন করে৷ মানুষ বেড়েছে বহু গুণ, বাড়ি-ঘর কিছু নতুন উঠেছে, কিছু পুরনো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে৷ কিন্তু আমাদের পাড়াটার চরিত্র যেন বদলায়নি৷’
এই বাড়ি থেকেই স্কুলে যাওয়ার পথের দু’ধারের জীবন নিয়ে ‘পাঁক’ লিখেছিলেন৷ পরে সে উপন্যাসের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘‘স্কুলে যেতে লম্বা একটা আঁকাবাঁকা গলি পেরুতে হত৷ সেই গলির একটা বাঁকের পাশে মস্ত একটা নোংরা পুকুর৷ চারপাশে বেশির ভাগ নারকেল পাতা আর দু’একটা ভাঙা খোলায় ছাওয়া গরীবদের বস্তি৷...গলির পথে যেতে-আসতে যাদের দেখেছি, তাদের নিয়ে প্রথম উপন্যাস শুরু করলাম৷’
খবরের কাগজ, রেসের মাঠ
উপন্যাসটা পড়ে মুগ্ধ হয়ে চিঠি লিখেছিলেন কাশীর প্রফুল্ল চক্রবর্তী আর কেদারেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়৷ চিঠিতেই তাঁরা বন্ধু হয়ে গেলেন৷
এমনই সেই বন্ধুত্ব যে তাঁদেরই ডাকে পাকাপাকি ভাবে কাশীতে থাকার জন্য চলে এলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র৷ কিন্তু কাশী-ই আবার পাঠিয়ে দিল কলকাতায়৷
সে এক অদ্ভুত যোগাযোগ৷
বাংলা সাহিত্যের দুঁদে গবেষক দীনেশচন্দ্র সেনের ছেলে বিনয় সেনের সঙ্গে আলাপ হল৷ তিনিই কলকাতায় কোনও একটা চাকরি করে দেওয়ার আশ্বাস দিলেন৷
কলকাতায় ফিরে ৭ বিশ্বকোষ লেনে দেখা করলেন বিনয় সেনের সঙ্গে৷ সেখানেই পাকা হয়ে গেল চাকরি। দীনেশচন্দ্র সেনের সহকারী হিসেবে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট’-এর কাজ৷ মাইনে পঁচাত্তর টাকা৷
কিন্তু শুকনো গবেষণার কাজে তাঁর মন ভরবে কেন? সময়ে হাজিরা দেন না দীনেশ সেনের কাছে। মাঝে মাঝে ডুবও দেন৷ তার উপর বন্ধু উপেন বন্দ্যোপাধ্যায় আর একটা জগতের হাতছানি দিয়েছেন, খবরের কাগজ৷— ‘‘উপেনদা বললেন, এই প্রেমেন! খবরের কাগজে চাকরি করবি? খবরের কাগজে! আমি অবাক হওয়ার সঙ্গে কৌতুকও অনুভব করে বলেছি, খবরের কাগজে কাজ করব কী? আমি পলিটিক্সের কিছু জানি না৷ তাহলে তুই বেস্ট ম্যান! বলে উপেনদা পরের দিন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রিটের একুশ না বাইশ নম্বরে যেতে বলেছেন৷ মনে মনে যতই দ্বিধা থাক বিনয় সেনের পেড়াপেড়িতে না গিয়ে পারিনি৷’’
এ ভাবেই ঢুকে পড়লেন সুভাষচন্দ্র বসুর ‘বাংলার কথা’’ কাগজে৷ পাশাপাশি দীনেশ সেনের সহকারীর কাজও চলছিল৷ সঙ্গে লেখালেখি তো বটেই, দাবা, ক্রিকেট এমনকী রেস-ও৷ গবেষক রামরঞ্জন রায় জানিয়েছেন, বন্ধু অনিল মিত্রের সঙ্গে বহু বার প্রেমেন্দ্র রেসের নানা বিষয়ে পরামর্শ করতেন৷ পরাশরের কাহিনি ‘ঘোড়া কিনলেন পরাশর বর্মা’-য় বোঝা যায় কতটা অভিজ্ঞ ছিলেন রেসের মাঠ সম্পর্কে৷
শরৎচন্দ্র, বন্দুক, রুদ্রাক্ষের মালা
সিনেমা পরিচালনা তো করেইছেন, পরবর্তী কালের বিখ্যাত অনেক অভিনেতার সঙ্গে ছিল পাড়াতুতো দাদার সম্পর্ক৷
তেমনই এক জনের সঙ্গে দেখতে গিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে৷ তাঁরই পাড়ায় থাকতেন ‘সানুদা’, বিখ্যাত অভিনেতা হরিধন বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তাঁর সঙ্গেই প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখা৷
প্রেমেন্দ্র লিখেছেন, ‘‘সানুদা শরৎচন্দ্রের ঠিকানা ঠিকমত সংগ্রহ করতে পারেননি৷... শেষ পর্যন্ত শিবপুরের অত্যন্ত প্রাচীন শ্রীহীন একটি পাড়ার একটি জীর্ণ গোছের বাড়িতে সশরীরে সত্যিই আমরা শরৎচন্দ্রের দর্শন পেলাম৷ দর্শন পাবার পর প্রথম বিস্ময় জাগল তাঁর চেহারায়৷ এ পর্যন্ত শরৎচন্দ্রের যা কিছু ছবি চোখে পড়েছে তা সবই গুম্ফশ্মশ্রুমণ্ডিত৷ কিন্তু এ যে একেবারে মেঘমুক্ত মুখ!... সেই পরিচ্ছন্ন মুখ দেখে যত অবাক-ই হই তার চেয়ে বেশি হয়েছিলাম তাঁর ঘরটিতে বসে৷ এক তলাতেই অত্যন্ত সংকীর্ণ একটি ঘর৷... মেঝেতে কম্বল গোছের কিছুর উপর একটি গেরুয়া রঙের চাদর পাতা৷ ঘরের একদিকে একটি নিচু দু’থাকের সস্তা কাঠের শেল্ফে কিছু বই আর সামনের লম্বা দেয়ালের একটি হুকে একটি বন্দুক আর তার ওপর একটি রুদ্রাক্ষের মালা টাঙানো৷...স্বয়ং শরৎচন্দ্রকে যত না লক্ষ করেছিলাম তার চেয়ে বেশি বোধহয় করেছিলাম দেয়ালে টাঙানো ওই বন্দুক আর তার ওপরকার রুদ্রাক্ষ মালাটি৷’’
বিদেশ থেকেও পালালেন
আসলে জীবনের নানা মজায় প্রেমেন্দ্র মিত্র হারিয়ে যেতে চেয়েছেন বার বার৷
নিরুদ্দেশের নেশা উসকে দিয়েছিল সেই নাম-ভুলে-যাওয়া সহপাঠী৷ আর ভেতো বাঙালির বৃত্তের বাইরে বেরোতে শিখিয়েছিলেন আর এক সহপাঠী বন্ধু, পরবর্তী কালের বিখ্যাত ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী৷ সম্পন্ন আর অভিজাত বাড়ির ছেলে দেবীপ্রসাদের মামার বাড়িতেই প্রেমেন্দ্র প্রথম দেখেছিলেন রাজকীয় কোনও বাড়ির অন্দরমহল, ‘দোতলা সমান আয়না’, তার সঙ্গে আগাগোড়া কাপড়ে মোড়া পাখির খাঁচা-ঝোলানো হলঘর৷
পরে লিখেছেন, ‘‘ছেলেবেলা থেকে আমার মনের জগৎকে বিস্তৃত করার ব্যাপারে শিল্পী দেবীপ্রসাদের কিছুটা ভূমিকা যে আছে অকপটে তা স্বীকার করতে পারি৷ ... প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন আমরা নেহাত ছোট ও স্কুলের বেশ নিচের শ্রেণীতে পড়ি৷ অন্যদের তুলনায় আমার বয়স আবার আরো অল্প৷ ও বয়সে বাইরের বিশালতর জগতের ব্যাপার সম্বন্ধে অজ্ঞ উদাসীন থাকবারই কথা৷ কিন্তু দেবীপ্রসাদই থাকতে দেয়নি৷ তখনই ওর কাছ থেকে সত্যে কল্পনায় মেশানো বিশ্বযুদ্ধের নানা কাহিনী শুনেছিলাম৷ ছেলেমানুষী আতিশয্যে একটু চড়া রঙে আঁকা হলেও সে-ই প্রথম জার্মানী ফ্রান্স ইংলন্ড ইটালীর মত নামগুলির সঙ্গে বাইরের জগতের একটা চেহারা আমার কাছে ফুটিয়ে তুলেছে৷’’
কিন্তু বিদেশ সত্যিই গেলেন যখন তখন ঠান্ডার ভয়ে পালিয়েও এলেন নির্ধারিত দিনের আগেই৷
দেশিকোত্তম পাওয়ার দিনে, ছবি: মোনা চৌধুরী
শেষ কবিতা
জীবনের শেষের দিকে মার্কিন সরকারের লিডার্স গ্র্যান্ট নিয়ে আমেরিকা ও ইংল্যান্ড সফর করেন৷ সে সময়ই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়৷
সুনীল লিখেছেন, ‘‘প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে সেখানে দেখা হতে পারে এই সম্ভাবনায় আমি একটা উত্তেজনা বোধ করেছিলাম৷ যাত্রার আগে এক দুপুরে ঠিকানা খুঁজে প্রেমেনদার বাড়িতে হাজির হয়ে তাঁকে বললাম, একবার আয়ওয়া শহরে আসতেই হবে৷ তিনি খুব উৎসাহিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আমি বেশি ঘোরাঘুরি পছন্দ করি না৷ আমি তোমার বাড়িতে গিয়ে থাকব বেশ কয়েকটা দিন৷ ওখানে কীরকম ঠান্ডা বলো তো?’’
নিজের ঘনাদাকে তিনি পাঠিয়েছেন সাখালিন দ্বীপ থেকে আফ্রিকা, এমনকী কল্পবিজ্ঞানের গল্পের নায়কদের মঙ্গলগ্রহে বা সমুদ্রের নীচে, কিন্তু নিজে যে এক চরম খেয়াল-মানুষ তিনি!
তাই সুনীলের আশা মেটেনি৷ লিখছেন, ‘‘আয়ওয়ায় পৌঁছে আমি প্রেমেনদার প্রতীক্ষায় ছিলাম দিনের পর দিন৷ তিনি এলেন না৷ পরে চিঠি লিখে জেনেছি, আমেরিকায় পা দেবার কয়েকদিন পরেই নাকি তিনি ঠান্ডার ভয়ে দেশে ফিরে গেছেন!’’
এমনই খামখেয়াল তাঁর, সারা জীবন জুড়ে৷ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আর পরিমল গোস্বামীর সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করছেন৷ বলতে উঠে বললেন, ‘‘আমার ইচ্ছার সঙ্গে আমার মোটর নার্ভ যোগ দেয় না৷ ইচ্ছা হয় হাঁটি, কিন্তু চড়ি মোটরে৷ ইচ্ছা হয়, সভায় যাব না, কিন্তু বললে জোরের সঙ্গে না বলতে পারি না৷...খাবার ইচ্ছা নেই, কিন্তু দিলে না বলতে পারব না৷’’
এমন মনই কি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মাসখানেক আগে তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় অদ্ভুত এই শেষ কবিতা!— ‘পটল করেলা উচ্ছে/ কেবড়কাহার উচ্ছে / বুঝবে কি করে তা/ তাই সারাদিন কাটছে কুটছে ধুচ্ছে৷’
জীবনরসিক না হলে প্রান্তকালে এমন কথা ভাবা যায়?
ঋণ: নানা রঙে বোনা (প্রেমেন্দ্র মিত্র), প্রেমেন্দ্র মিত্র (সুমিতা চক্রবর্তী), সুরজিৎ দাশগুপ্ত, মৃন্ময় মিত্র, হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/a-write-up-on-writer-premandra-mitra-1.366533
No comments:
Post a Comment