লোকনাথ ভট্টাচার্যকে (১৯২৭-২০০১) প্রথম বার দেখে চমকে উঠেছিলাম। এত রূপবান হয় মানুষ? মনে হয়েছিল এক ইউরেশীয় ভাস্কর্যের সঙ্গে কথা বলছি। খালি গায়ে বসে ফরাসি দেশ ও সাহিত্য (সম্ভবত দেকার্ত) নিয়ে মৃদু স্বরে কিছু বলছিলেন। জানতাম তিনি পঞ্চাশের দশকে র‌্যাঁবোর ‘মাতাল তরণী’ ও ‘নরকে এক ঋতু’ অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর লেখা ‘কাক’ নাটক রেডিয়োতে শুনেছি, ‘বহুরূপী’তে পড়েছি ‘কালীমাতা রেশন ভান্ডার’। ‘ঘর’ আমার প্রিয় কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু জানতাম না, ফরাসি কবিতার জগতে কাল্ট ফিগার হয়ে আছেন যে ভারতীয়, তিনি লোকনাথ।
ভাটপাড়ার বৈদিক ব্রাহ্মণ পরিবারের এই বিদ্রোহী সন্তান শান্তিনিকেতন ও কলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে সে দেশে যান ১৯৫৩ সালে। সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতে পিএইচডি করার সময় বিদুষী ফরাসিনী ফ্রাঁস মঁতেরু (যিনি ক্রমশ হয়ে উঠবেন ফরাসি দেশ ও বাংলা ভাষাসাহিত্যের প্রধান যোগসূত্র)-র প্রেমে পড়েন। দেখা হয় আরাগঁ-র সঙ্গে, যিনি ‘লে লেত্‌র্‌ ফ্রাঁসেজ’ ও ‘য়্যরোপ’ পত্রিকায় তাঁর কয়েকটি কবিতা প্রকাশ করেন। তখন থেকেই লোকনাথ আধুনিক ফরাসি কবিতার ঐতিহ্য মেনে গদ্যকবিতা রচনায় মন দিয়েছেন। ১৯৫৬ সালে দেশে ফিরে নেফায় নাগা ট্রাইবালদের মধ্যে সংগীত ও নৃত্যের রক্ষণাবেক্ষণের চাকরি। পরে কিছু দিন পুদুচেরিতে কাটিয়ে ১৯৬১ সাল থেকে ‘স্প্যান’ পত্রিকায়। ১৯৬৩ সালে মলিয়েরের ‘তার্ত্যুফ’ অনুবাদ করেন। ১৯৬৫ সালে সাহিত্য অকাদেমির ‘ইন্ডিয়ান লিটারেচার’ পত্রিকার সম্পাদক। ১৯৭২ সাল থেকে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টে, ১৯৮১ সালে সেই সংস্থার ডিরেক্টর। পাশাপাশি চলেছে বিকল্প এক সৃজন।
কমলকুমারের মতোই বিকল্প বাংলা সাহিত্যের তিনি এক পুরোধা। ‘বাবুঘাটের কুমারী মাছ’, ‘অশ্বমেধ’, ‘গঙ্গাবতরণ’ এই শিশ্নোদরতন্ত্রী সময়ে নানা কারণে শিক্ষামূলক। কিন্তু কী করে তিনি জয় করলেন, বিবেকানন্দের ভাষায় ‘পাশ্চাত্য সভ্যতা-গঙ্গার গোমুখ’ ফরাসি দেশ— যা সারা পৃথিবীর শিল্পী-সাহিত্যিকদের স্বপ্ন? যে দেশ রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা ও সত্যজিৎ রায়ের ছবিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়, যেখানে কল্কে পাওয়া সাধারণের ভাগ্যে জোটে না।
এই ঋজু বিশ্বমনা বাঙালি যে ভাবে শ্রেষ্ঠ ফরাসি মনের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন, ঈর্ষণীয়। ১৯৯০-এর দশকে স্যাঁ-সুলপিস গির্জার সামনে এক অপূর্ব বইমেলায় (সেরা বই আর লেখকদের এমন সুভদ্র সমাহার প্যারিস ছাড়া আর কোথাও দেখিনি) কবিতাপাঠের আসরে তাঁকে নিয়ে কবিদের উচ্ছ্বাস দেখে হতবাক হয়েছিলাম! এ দেশের নির্জন, লাজুক ও প্রচারবিমুখ এক লেখক কী ভাবে নিঃশব্দে পার হলেন এক অলীক আন্তর্জাতিক দরজার চৌকাঠ? 
১৯৭৪ সাল নাগাদ বেলজিয়ামের ‘নক ল্য জুৎ’ কবিতা-উৎসব থেকে ফেরার পথে লোকনাথ ভট্টাচার্য ফ্রান্সে নেমেছিলেন বিংশ শতকের ফরাসি কবিতার দুই দেবতা অঁরি মিশো আর রনে শারের সঙ্গে দেখা করবেন বলে। কিন্তু মিশো সম্পূর্ণ অগম্য, ফোন করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। প্রকৃত কবি তো জনাকীর্ণ হতে চান না। শেষে ‘গালিমার’ প্রকাশনা-সংস্থার দফতরে তাঁর বেলজিয়ামে প্রদত্ত বক্তৃতার একটি কপি রেখে আসেন তিনি। অবিলম্বে হোটেলে এসে দেখা করেন ফরাসি কবিতার সম্ভবত সবচেয়ে দুঃসাহসী অভিযাত্রী মিশো! তিনি তাঁর আরও কবিতা পড়তে চান। ফ্রাঁস তাঁর ‘ঘর’ কবিতাটি অনুবাদ করে দেন ‘পাজ স্যুর লা শাঁব্‌র্‌’ নামে। মিশো তা পাঠিয়ে দেন ফরাসি কবিতার বিশিষ্ট প্রকাশক ফাতা মরগানাকে। তার পর সেখান থেকে দীর্ঘ দিন ধরে ফরাসিতে প্রকাশিত হতে থাকবে লোকনাথের অভ্রময় আলোছায়ার কবিতা, ইলাসট্রেশন-সহ দশটি গদ্যকবিতার বই। মঁপেলিয়ের ‘ফাতা মরগানা’ সংগ্রহশালায় গচ্ছিত আছে তাঁদের পত্র-সংলাপ। অনুবাদকদের মধ্যে ছিলেন কবি ও প্রাবন্ধিক জেরার মাসে ও ল্যুক গ্রাঁ-দিদিয়ে।
ইতিমধ্যে ফ্রাঁক-আঁদ্রে জাম ভারতে এসে লোকনাথের সঙ্গে দেখা করেন এবং ফ্রাঁসের অনুবাদে তাঁর ‘অতি বিশিষ্ট অন্ধজন’ (‘দেজাভগ্‌ল্‌ ত্রে দিসত্যাঁগে’) প্রকাশ করেন। জামের সহযোগিতায় লোকনাথ অনুবাদ করেন ‘ল্য দাঁসর দ্য কুর’ (রাজনর্তক ও অন্যান্য), যা ১৯৮৫ সালে প্রকাশ করবে গ্রানিৎ।
লোকনাথের ফরাসি ছিল আসাধারণ, অনুবাদের প্রথম খসড়াটি তিনিই করতেন, যা পরে ফরাসিদের সঙ্গে বসে পরিমার্জনা করে নিতেন। রনে শার যে ছোট্ট শহরে বাস করতেন সেই লিল-স্যুর-সর্গের বিশিষ্ট প্রকাশক ‘ল্য বোয়া দরিয়ঁ’ লোকনাথের একাধিক বই প্রকাশ করেন। ২০০০ সালে খোদ গালিমার প্রকাশ করেন ‘ল্য দাঁসর দ্য কুর’ এবং ‘লে মার্শ দ্যু ভিদ’ (যাতে ছিল ‘মদের পাত্র’, ‘শরৎ বসন্ত’ ইত্যাদি)। ফ্রাঁস ভট্টাচার্যের অনুবাদে তাঁর চারটি উপন্যাস ও দুটি বড়গল্প প্রকাশিত হয় তিনটি প্রকাশনা-সংস্থা থেকে।
লোকনাথের অস্থিমজ্জার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল র‌্যাঁঁবোর অন্তর্দীপ্ত স্নায়ুবিপর্যয়ের কবিতা। ফ্রাঁস ভট্টাচার্যের মতে, তাঁর কবিতা প্রথম থেকেই ভাবাবেগ আর সস্তা রোমান্টিকতাকে বর্জন করতে চেয়েছিল। লেখাগুলি গভীর ভাবে দার্শনিক, যদিও সেগুলি দৈনন্দিন জীবন আর অভিজ্ঞতার কথাই বলে। আবার এমন কিছু বলতে চায় যা বলা যায় না, যা অব্যক্ত।
হয়তো বাংলা কবিতা তাঁর জন্য প্রস্তুত ছিল না। হয়তো ফরাসি ভাষা তাঁর অনুরণনকে যে ভাবে ধারণ করেছে, বাংলা তা পারেনি। ‘দুঃখের সবুজ রাত্রি’ আজও অপরিণত কানে কৃত্রিম লাগবে, কিন্তু ফরাসিতে ‘La nuit verte de la désolation’ হয়ে উঠবে মন্ত্রপ্রতিম। লোত্রেয়ামঁ ও র‍্যাঁবোর সময় থেকে ফরাসি কবিতা অন্তহীন ভাবে এই সূক্ষ্ম ও অদৃশ্য জটিলতাকেই ছুঁতে চেয়েছে। লোকনাথের রচনা ভারতীয় দর্শনে সম্পৃক্ত, সেই সঙ্গে আধুনিক। বিপন্ন এক গ্রহে মানুষ শান্তি ও নিশ্চয়তা খুঁজছে। এমন ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা কী করব? তাঁর কবিতায় একটি বৃত্তের মধ্যে আর একটি বৃত্ত জেগে ওঠে, কোনও কিছুই শেষ হয় না। তাঁর কবিতা যেন ‘সত্যের অনুরণন’, vibrations। ছায়ার ভেতর আলো-আঁধারির খেলা। এগুলি যেন পুনর্নির্মিত ধ্বংসস্তূপ...‘débris reconstruits’।
মিশেল দ্যগি, ভেরনার লাঁবেরসি ও আঁদ্রে ভেলতেরের মতো বিশিষ্ট কবিরা ছিলেন তাঁর বন্ধু। তরুণ ফরাসি কবিরা অনেকেই তাঁর ভক্ত। ক্রিস্তিয়াঁ ল্য মেলেক লিখেছেন রনে দোমাল, শার্ল দ্যুই, ক্রিস্তিয়াঁ গাবরিয়েল ও লোকনাথ ভট্টাচার্যকে নিয়ে একটি বই, ‘Le Vent immobile’ (‘স্তব্ধ হাওয়া’)। ২০০১ সালে মার্ক ব্লাঁশে নামে এক তরুণ লোকনাথকে নিয়ে ‘লোত্র্‌ রিভ’ থেকে প্রকাশ করেন একটি সম্পূর্ণ সাহিত্যজীবনী। সেই সিরিজে আর যাঁদের নিয়ে বই আছে, তাঁরা হলেন— পাউল সেলান, ওক্তাভিও পাস, সিলভিয়া প্লাথ ও অ্যালেন গিন্‌স্‌বার্গ। ছবির দেশ, কবিতার দেশ থেকে এর চেয়ে আর কী বড় সম্মান ও স্বীকৃতি মিলতে পারে? ১৯৯৯ সালে ফরাসি সরকার তাঁকে ‘কমান্ডার অফ আর্ট্‌স্‌ অ্যান্ড লেটার্‌স্‌’ উপাধিতে ভূষিত করে।
২০০১ সালে কায়রোর মোটর-দুর্ঘটনার পর নীল নদে পড়ে যায় তাঁর গাড়ি। সেই মৃত্যু-যন্ত্রণা এ দেশে তাঁর আপনজনদের যতটা কষ্ট দিয়েছে, কবিতার দেশে তার চেয়ে বিন্দুমাত্র কম নয়।

http://www.anandabazar.com/poilaboisakh/special-write-up-on-loknath-bhattacharya-by-chinmoy-guha-1.359604