বুদ্ধদেব বসু সংখ্যা
বুদ্ধদেব বসুর হঠাৎ চলে যাওয়াতে দুটো আক্ষেপ তৈরি হয়েছিল ওঁর ভক্তদের মধ্যে।
এক, ‘আমাদের কবিতা ভবন’-এর পর তাঁর আত্মস্মৃতিতে যে অংশ আসার কথা ছিল, তা আর এল না।
আর দুই, তাঁর ‘মহাভারতের কথা’র দ্বিতীয় খণ্ডে আর হাত দেওয়া হল না।
‘মহাভারতের কথা’য় মহাপ্রস্থানিক পর্বে এসেছিলেন বুদ্ধদেব, সে-পর্বের সঙ্গে টলস্টয়ের ‘ওয়র অ্যান্ড পিস’ উপন্যাসের বিস্তৃত উপসংহার বৃত্তান্তের তুলনা করেছিলেন।
এর পর দ্বিতীয় খণ্ডে কী প্রসঙ্গ আনতেন ভক্তদের ধারণা নেই।
কিন্তু আত্মস্মৃতির পরের অংশ এলে?
ভোজ, ভূরিভোজ, ব্যাঙ্কোয়েট! তিনি লিখবেন নিজেকে নিয়ে, আর তারই মধ্যে পাঠক প়ড়ে নেবে কিছুটা কিছুটা বাঙালির ইতিহাস। তাঁর অতীব স্বাদু ও সূক্ষ্ম গদ্যে বর্ণিত দৃশ্যগুলো হবে ক্যামেরাবন্দি মুহূর্তের মতো। স্ন্যাপশটস্!
যেমন, শান্তিনিকেতনে শেষ বয়েসের রবীন্দ্রনাথকে দেখে বুদ্ধদেবের মনে এসেছিল শেষ বয়েসের টলস্টয়কে।
যেমন, নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেনে উঠেছেন ঢাকার পথে। সঙ্গে স্ত্রী রাণু, মানে প্রতিভা এবং কন্যা মিমি, মানে মীনাক্ষী। কামরায় উঠে বসবার পরেই চোখে পড়ল উল্টো দিকের আসনে বসে নজরুল ইসলাম। কবি জানলা দিয়ে গম্ভীর মুখে বাইরে তাকিয়ে আছেন।
বুদ্ধদেব স্ত্রীকে বললেন, ‘‘রাণু, ওই যে তোমার কাজিদা।’’
প্রতিভা দ্রুত তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘‘আপনি!’’ কবি মুখ ফেরালেন, অনেকক্ষণ প্রতিভাকে দেখে বললেন, ‘‘রাণু?’’
বুদ্ধদেবের শঙ্কা হয়েছিল কবি ঠিক প্রকৃতিস্থ নেই।
যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দেখা যাচ্ছে ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবিতে হাতে গোল্ড ফ্লেক সিগারেটের টিন নিয়ে উদাস চোখে হেঁটে যাচ্ছেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
•••
‘মহাভারতের কথা’ প্রকাশকালে একটা ধারণা চারিয়েছিল বুদ্ধদেব বসুর ভক্তসমাজে। তা হল, তাঁর বইয়ের নায়ক যুধিষ্ঠিরের মধ্যে নিজের সারস্বত জীবনের ছবি দেখছেন বুদ্ধদেব।
বনবাসকালে কী করছেন যুধিষ্ঠির?
না, ক্রমান্বয়ে মুনিঋষিদের সঙ্গে আলাপে, আলোচনয় মগ্ন। তাঁর চরিত্রের ব্যাখ্যায় (পড়ুন সমর্থনে) বুদ্ধদেব লিখছেন—
‘‘যুধিষ্ঠির কোনো মহাপুরুষ নন, আমাদের অনেক ভাগ্য তিনি মানুষ, শুধুমাত্র মানুষ— ইতিপূর্বে এরকম একটি কথা আমি বলেছিলাম। সেই সঙ্গে এ কথাটিও এখন যোগ করা দরকার যে তিনি কোনো দেবতার দ্বারা বিশ্রুতভাবে বরপ্রাপ্ত বা অভিশপ্ত হননি (যেমন হয়েছিলেন অর্জুন ও কর্ণ); তাঁর সব বর এবং অভিশাপ তাঁর নিজের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিলো— সেগুলিকে তিনি কেমন করে স্বীয় চেষ্টায় সমন্বিত ও বিকশিত ক’রে তুলেছিলেন, হ’য়ে উঠেছিলেন সর্বক্ষণসম্পন্ন এক মর্ত্য মানুষ, তারই ইতিহাসের নাম মহাভারত।’’
বুদ্ধদেবের জীবনে যুক্তি-তক্কো-গপ্পের ভূমিকা প্রসঙ্গে খুব সুন্দর মন্তব্য আছে কন্যা মীনাক্ষীর। ‘স্মৃতিতে চিঠিতে বুদ্ধদেব বসু’ বইয়ে লিখছেন—‘‘‘কবিতা ভবন’ ছিল বারোমাসের ‘ওপেন হাউস’। বহু রাত অবধি চলত হাসি-গল্প-তর্ক। মতানৈক্য বাবা শুধু সহ্যই করতেন না, স্বাগত জানাতেন। সেটা ছিল তাঁর কাছে উত্তেজক টনিক ও মননের প্রয়োজনীয় ব্যায়াম।’’
তর্কে জমে যাওয়াটা কদ্দুর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেত বুদ্ধদেবকে তারও একটা সুন্দর গল্প শুনিয়েছেন মীনাক্ষী: ‘‘আমার মেয়ে তিতির (কঙ্কাবতী) বাড়ির প্রথম নাতনি। মার কাছেই সে বেশি সময় কাটাত। একদিন তিতিরের জ্বরজ্বর হওয়াতে ও বাড়ি যায়নি। মা বাবাকে পাঠালেন নাতনির খোঁজ করতে, আমাদের কর্নফিল্ড রোডের ফ্ল্যাটে। বাবা ঢুকেই জ্যোতির (জ্যোতির্ময় দত্ত) সঙ্গে তর্কে জমে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে বাড়ি চলে গেলেন।
নীচে নেমেও দু’জনের কথা শেষ হয় না, আমি পাঁচ তলার ওপর থেকে দেখছি, জল পাঠিয়ে দিলাম, বাবা বার বার জল খান বলে। জলের গ্লাস হাতে নিয়ে খেয়াল হল, চোখ তুলে বললেন, ‘তিতির কেমন আছে রে? তোর মাকে গিয়ে বলতে হবে।’ সে দিন সন্ধ্যায় মা আর আমি মিলে বাবাকে যা বকুনি!’’
•••
আমাদের সৌভাগ্য বুদ্ধদেব বসুর জীবনের অনেক মূল্যবান ছবি আমরা পেলাম ওঁর স্ত্রী, কন্যার রচনায়। বিশেষ করে প্রতিভা বসুর স্মৃতিচারণা ‘জীবনের জলছবি’-তে এমন সব টুকরো টুকরো ঘটনা যা স্বভাবসংবৃত বুদ্ধদেবকে বেশ কাছের, জীবন্ত মানুষ করে তোলে। এমন একটা টুকরো কথা হল বুদ্ধদেবের সঙ্গে প্রতিভার রবীন্দ্রনাথকে দেখতে যাওয়া। বিবরণটা প্রতিভার চিত্তাকর্ষক উপন্যাসিক ভাষাতেই শোনা উচিত—
‘‘আমার বিবাহের কিছুকালের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোতে এসেছেন শুনে বুদ্ধদেব আমাকে নিয়ে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ খুশি হলেন বুদ্ধদেব নববধূ নিয়ে তাঁর কাছে যাওয়াতে। আমি প্রণাম করে মুখ তুলতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। পা নড়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে, দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘মেয়েটিকে তো আমি চিনি গো। তা হলে এই গাইয়ে কন্যাটিকেই তুমি বিবাহ করেছো?’ সামান্য একটু উত্তেজিত হলেই রবীন্দ্রনাথ হাঁটু নাড়াতেন, দাড়িতে হাত বুলোতেন।
বুদ্ধদেব বাড়ি ফিরে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আগেও দেখা হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘আমাকে বলোনি তো!’
‘কী প্রসঙ্গে বলবো। তুমি তো জিজ্ঞাসা করোনি।’
‘এর জন্য প্রসঙ্গ দরকার হয়? জিজ্ঞাসা করার প্রশ্ন ওঠে? রবীন্দ্রনাথকে দেখা শোনা পরিচয় থাকা সবই তো একটা ঘটনা। একটা বলবার বিষয়।’
‘সে তো নিশ্চয়ই।’
‘তবে?’’’
স্ত্রী প্রতিভার যেমন স্মৃতি আছে স্বামীর সঙ্গে রবীন্দ্রদর্শনে যাবার, কন্য মীনাক্ষীর মনে পড়ে বাবার সঙ্গে পথ চলতে মাঝেমধ্যে অল্প সময়ের জন্য জীবনানন্দের সঙ্গে দেখা হওয়ার।
বুদ্ধদেব তাঁর প্রিয় জীবনানন্দকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘নির্জনতম কবি’ এবং ঘোষণা করেছিলেন ‘জীবনানন্দর দৃশ্যগন্ধময় নির্জন কান্তারে’ তিনি আনন্দে বিচরণ করেন। মীনাক্ষী লিখেছেন তাঁর বাবা প্রায় জীবনানন্দের ফেরিওয়ালার কাজ করেছেন।
তো এই নির্জন কবির সঙ্গে পথের সাক্ষাৎগুলো কেমন হত? কন্যা লিখছেন, জীবনানন্দ মানুষ এড়িয়ে চলতেন, ‘‘পথে বাবার সঙ্গে দেখা হলে আমরা থাকলে কথা বলতেন না। চট করে রাস্তা পার হয়ে চলে যেতেন, যদি দেখা যেত রাস্তার ওপারে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তা হলে বাবা রাস্তা পার হয়ে গিয়ে কথা বলে আসতেন।
‘‘আমাদের বাড়ি অবশ্য প্রায়ই আসতেন জীবনানন্দ, সকাল অথবা দুপুরের দিকে, যখন ধরে নেওয়া যায় বাইরের কেউ থাকবেন না। কখনো রিল্যাক্স করে আড্ডা দিতে দেখিনি তাঁকে, দেখিনি বাড়ির কোনো উৎসবে কি নিমন্ত্রণে। কাজের কথা বলেই চলে যেতেন।’’
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত পত্রিকার (‘প্রগতি’, ‘কবিতা’ ও ‘বৈশাখী’) ওপর জীবনানন্দের নির্ভরতা এবং বুদ্ধদেবের জীবনানন্দ মুগ্ধতার এক চমৎকার তথ্য দিয়েছেন সমীর সেনগুপ্ত তাঁর ‘বুদ্ধদেব বসুর জীবন’ বইয়ে। লিখছেন— তাঁর কবিতার সংখ্যা ১৬২ (জীবিত অবস্থায়)। ‘প্রগতি’, ‘কবিতা’ ও বৈশাখী’ মিলিয়ে বুদ্ধদেব বসু প্রকাশ করেছেন তাঁর ১১৪টি। ‘কবিতা’ পত্রিকার সঙ্কলন করার সময় পুরোনো সংখ্যাগুলো পড়তে গিয়ে মীনাক্ষী দেখেছেন এক-এক সংখ্যায় আটটি-দশটি করে জীবনানন্দের কবিতা।
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’-য় জীবনানন্দের উনিশটি কবিতা, যেখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ষোলোটা এবং পঞ্চ কবির কারওরই ষোলোটার বেশি নয়। ‘‘আজীবন বাবা ছিলেন, ’’ মীনাক্ষীর কথায়, ‘‘জীবনানন্দের পরম সুহৃদ ও উগ্র প্রচারক।’’
প্রতিভা বসু তাঁর স্মৃতিচারণায় শ্লাঘার সঙ্গে জানিয়েছেন যে, পরবর্তী সময়ে সেরা কবির দলে আসা প্রায় সকলের লেখাই ‘কবিতা’ পত্রিকা বা কবিতা ভবন থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’ ও সমর সেনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। প্রতিভা লিখছেন, কবিতা ভবনের প্রথম প্রকাশিত বই জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’; দ্বিতীয়টি প্রতিভার গল্পের বই ‘মাধবীর জন্য’।
কবিতা ভবন থেকে যখন ‘এক পয়সায় একটি’ সিরিজ বেরোলো তার কবিতা সম্পাদক হলেন বুদ্ধদেব, গল্পের সম্পাদক প্রতিভা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তা জেনে প্রতিভাকে বললেন, ‘তবে তো আপনার সম্পাদনায় আমার গল্পই প্রথমে যাওয়া উচিত।’
তাই গেল, কিন্তু মানিকবাবুকে সম্মান দক্ষিণা দেওয়া গেল না। প্রতিভা লিখছেন, ‘‘মোটা কাচের চশমার ফাঁকে তাঁর সেই দুই উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি প্রজ্বলিত করে আমাকে ভস্ম করে দিয়ে বললেন, ‘লেখা আমি স্বেচ্ছায় দিয়েছি, টাকার জন্য দিইনি।’
বুদ্ধদেব ও তাঁর বন্ধুবর্গ প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তর কথা এসে পড়বেই। মীনাক্ষীর মতে, পঞ্চাশের দশকে ওঁর বাবার প্রিয়তম বন্ধু ছিলেন সুধীন্দ্র। সুধীন্দ্র বিএ পাশ করেছিলেন। সমস্ত রকম অ্যাকাডেমিক ও সরকারি বাধা অতিক্রম করে বুদ্ধদেব তাঁকে যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে পড়াবার জন্য নিয়ে আসেন। বিভাগের প্রথম কয়েক বছরের ছাত্রছাত্রীরা বুদ্ধদেব ও সুধীন্দ্রনাথকে একই সঙ্গে শিক্ষকরূপে পেয়েছিল। এ বার মীনাক্ষীর বয়ানে শুনুন সেই সময়কার একটা ঘটনা—
‘‘ওই সময় সুধীন্দ্র ও রাজেশ্বরী দত্ত প্রায়ই বিকেলে কবিতা ভবনে আসতেন। কিন্তু রাত হওয়ার আগেই তাঁরা চলে যেতেন। জ্যোতি বাবাকে বলল, ওঁরা রাত হবার আগে কেন চলে যান বুঝতে পারেন না? আমাদের একটু কোহল রাখতে হবে।
‘‘জ্যোতি খলনায়কের মতো, অতি সুচতুরভাবে সুধীন্দ্রের নাম করে বাড়িতে প্রথম এক বোতল জিন নিয়ে এল। জ্যোতি রন্ধন ও ককটেল শিল্পে নিপুণ। বাতাবি লেবুর রস দিয়ে সে এক উত্তম পানীয় বানাল। বরফের বালতি, বিটার্স ইত্যাদি অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই, সে এক উৎসব শুরু করে দিল। সুধীন্দ্র সেই সন্ধ্যায় উসখুস করার সঙ্গে সঙ্গেই পানীয় উপস্থিত। অনেকেই কী খাচ্ছেন বুঝতে না পেরে তুলে নিয়েছিলেন।’’
এখানে আমার দুটো বুদ্ধদেব–স্মৃতি উল্লেখ করলে কাজে দেবে। যার একটিতে লেখকের তর্কপ্রিয়তা এবং অন্যটিতে নিজেকে নিয়ে বেশি কিছু বলার অনীহা প্রকট হয়।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ পাদে কলেজ স্ট্রিট পাড়ার বড় বাটার দোকানের পাঁচ তলায় আমেরিকান ইউনিভার্সিটি সেন্টারে বিতর্ক, বক্তৃতা, কাব্যপাঠ, ক্যুই়জ ইত্যাদির জমাটি আসর বসত মাসে অন্তত চার-ছ’দিন। এমএ ক্লাসের পড়ুয়া আমরা কোনওটাই মিস করতাম না।
এরকম এক আলোচনা চক্রে মধ্যমণি হয়ে এলেন বুদ্ধদেব। অন্য আলোচকদের মধ্যে তখনকার ডাকসাইটে লেখক-সাংবাদিক, ঠোঁটে পাইপ-ধরা সন্তোষকুমার ঘোষ, জ্যোতির্ময় দত্ত, কবি নরেশ গুহ ছিলেন।
আলোচনা অচিরে তর্কে দাঁড়িয়ে গেল এবং সমস্ত তর্ক উছলে উঠছিল বুদ্ধদেবের হঠাৎ হঠাৎ করা সাহিত্যিক মন্তব্য থেকে।
সন্তোষবাবু কিছুক্ষণ তর্কে থেকে তার পর পাইপ ধরিয়ে এক মনে বুদ্ধদেবের মন্তব্য উপভোগ করতে লাগলেন।
নরেশ গুহ মাঝে মাঝে কিছু বলছিলেন ঠিকই, কিন্তু তর্ক যা চালিয়ে যাচ্ছিলেন জ্যোতির্ময়। শেষে তিনিও হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘এ বার অডিয়েন্সও যোগ দিন, আমি আর কত ঝগড়া করব?’
এটা বলার কারণ তার একটু আগে জ্যোতির্ময় বুদ্ধদেবকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার কি মনে হয়, এখানকার সাহিত্যে ইংরেজ কবি জন ডান-এর মতো কাউকে কখনও পাওয়া গেছে?’
ওঁর প্রশ্ন শেষ হতে না-হতে বুদ্ধদেব বলে বসলেন, ‘কেন, বিদ্যাপতি!’
অমনি কী তুমুল হাসি হল জুড়ে। বিদ্যাপতি সত্যিই জন ডান-এর মতো কিনা এবং হলে কেন, সে-সব চিন্তা সকলের কাছেই তখন অমূলক। সবাই তখন উপভোগ করছে বুদ্ধদেবের ধাঁধিয়ে দেবার মতো ঝাঁ চকচকে রেপার্টি। সন্তোষকুমারকেও দেখা গেল ঠোঁট থেকে পাইপ সরিয়ে ভাল করে হেসে নিচ্ছেন।
দ্বিতীয় স্মৃতিটা আমার। কবির নাকতলার বাড়িতে। অধুনালুপ্ত হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার পূজা অ্যানুয়ালের জন্য এক সন্ধ্যায় বুদ্ধদেবের ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম।
বেজায় দুর্যোগের সন্ধে। তার ওপর এলাকা জুড়ে লোডশেডিং। ফাঁকে ফাঁকে চা আসছিল। একটা হাল্কা গাউন জড়িয়ে লম্বা সোফায় বসেছিলেন বুদ্ধদেব। দেখলাম খুব রোগা হয়ে গিয়েছেন ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’-র নাট্যকার, ‘মহাভারতের কথা’-র লেখক, ‘আমাদের কবিতা ভবন’-এর স্মৃতি রোমন্থক। কিন্তু মাথার এক ঝাঁক চুল, ঘাড়-কান বেয়ে নেমে আসছে।
আমার ইংরেজিতে করা প্রশ্নের উত্তরে ধীরেসুস্থে ইংরেজিতে উত্তর জুগিয়ে যাচ্ছেন। আমি মোমবাতির আলোতে লংহ্যান্ডে কমা, ফুলস্টপ সমেত ওঁর প্রতিটি শব্দ লিখে নিচ্ছি।
বুদ্ধদেব উত্তর দিতে দিতে একের পর এক ‘ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট’ সিগারেট টেনে যাচ্ছেন (পরে শুনেছিলাম ওঁর দেখাদেখি কিছু কবি, বুদ্ধিজীবী ‘ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট’ ধরেছিলেন)।
সেই সাক্ষাৎকার ছিল ষোলো আনা বুদ্ধদেবের কাজ নিয়ে। ওঁর উত্তরগুলো টাইপ করে ওঁর কাছে পাঠালাম দু’দিন পরে। তার পরের দিনই অপিসে ফোন এল কবির।
‘শোনো, ইন্টারভিউ ছেপো না।’
‘কেন স্যার?’
‘আমি নিজেকে নিয়ে এত সব বলেছি ভাবতেই পারছি না। মনেই হচ্ছে না এসব আমার কথা।’
‘লেখায় কিছু ভুল দেখলেন?’
‘না, ভুলের কথা তো বলিনি। তবে যা বলেছি, তা আমার নিজের কথা বলে ভাবতে পারছি না।’
‘তা হলে?’
‘এবারটা ছেড়ে দাও। পুজোর লেখালেখি যাক। নতুন করে একটা সংলাপে বসব। নিজেকে নিয়ে নয়, সাহিত্য নিয়ে।’
সেই দ্বিতীয় সুযোগটা আর আসেনি, কোনও কিছুর জানান না দিয়েই ‘বন্দীর বন্দনা’-র কবি এই জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে নিলেন। স্ত্রী
প্রতিভা সেই সঙ্কটকালের এক অপরূপ ছবি রেখেছেন ‘জীবনের জলছবি’-তে—
‘‘ডাক্তার ওঁকে বলেছিলেন লেখা নিয়ে সমস্তক্ষণ বসে থাকেন, একটু হাঁটা ভালো। সেই থেকে বাড়ির ছাদে গিয়ে নিয়মিত দু’চার পাক হাঁটতেন। চিরকাল বিদ্যাসাগরীয় চটি পরতেন। ছাদে ঐ চটির শব্দ ছাদের তলাকার মানুষদের কানেও বেশ ভালোভাবে পৌঁছতো। এক দিন হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চটির শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। আমি রুদ্ধশ্বাসে সেই শব্দ শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। এ পাশ ও পাশ তাকিয়ে আয়াকে দেখতে না পেয়ে ‘গঙ্গামণি গঙ্গামণি’ বলে ডাকতে লাগলাম।
গঙ্গামণি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বললো, ‘… আমার একটা কী হয়েছে মা, বাবুর জন্য কেমন ভয় করে। রুটি করলাম, মনে হল বাবুর পায়ের আওয়াজটা থেমে গেল। অমনি দৌড়োলাম উপরে। গিয়ে দেখি ছাদে ফুটফুটে জ্যোৎস্না, মস্ত চাঁদ। বাবু সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন। একটু বাদেই বুদ্ধদেব নেমে এলেন, বললেন, ‘কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে। তোমর টাইল পাতা ছাদটা তার আলোয় কী ভালো দেখাচ্ছিল!’’
এর কিছু দিন পরেই কবি চলে গেলেন। এবং আরেক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এক অপূর্ব এলিজি লিখলেন।
No comments:
Post a Comment