ছবি: গৌতম রায়।
ওঁর ‘কাবুলিওয়ালা’ দেখে প্রচণ্ড রেগে গেলেন সত্যজিৎ রায়!
তত দিনে কিন্তু ছবিটা নিয়ে হই হই পড়ে গিয়েছে সারা ভারতে। পরিচালক তপন সিংহর নামে ধন্য ধন্য করছে সকলে।
তখনই একদিন হঠাৎ সত্যজিতের ফোন পরিচালককে, ‘‘নিজে একজন টেকনিশিয়ান হয়ে এত খারাপ টেকনিকাল কাজ করলেন কী করে?’’
রাগের কারণ শুনে ফোনেই প্রায় হাতজোড় তপনবাবুর।
অসহায়তার কথা কবুল করলেন।
তাতে আরওই ক্ষিপ্ত বহুকালের সুহৃদ সত্যজিৎ, ‘‘এত ভালমানুষ সাজবার দরকার নেই। কাজের সময় কোনও দিন কমপ্রোমাইজ করবেন না।’’
অপরাধ কী?
ছবি বিশ্বাসের মতো অমন মাপের এক জন শিল্পী, কিছুতেই স্পিরিট গাম দিয়ে দাড়ি লাগাতে দিতেন না। ফলে কাবুলিওয়ালার দাড়িটি হয়েছিল প্রায় কদাকার।
বার্লিন ফেস্টিভ্যালে ছবিটি দেখে এক বিদেশি সাংবাদিক পরিচালকের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, ‘‘অভিনয়টি এতই ভাল যে, আপনাকে উনি ওঁর দাড়ির ব্যাপারটা ভুলিয়ে ছেড়েছেন।’’
কিন্তু ছবি বিশ্বাসকে বোঝায় কার সাধ্যি!
এমন এমন সব বিশ্বাস ছিল ওঁর, খুব কড়া ধাঁচের মানুষ না হলে, তা থেকে তাঁকে বের করে আনা রীতিমতো ঝকমারি।
‘কাবুলিওয়ালা’-তে আরও দু’বারের কাণ্ড যেমন।
কাকে করবেন ‘কাবুলিওয়ালা’, তখনও ভেবে পাচ্ছেন না তপন সিংহ।
ছবি বিশ্বাস শুনে বললেন, ‘‘কাবলেদের সম্বন্ধে আমাকে একজন অথরিটি ভেবে নিতে পারো। ওদের সঙ্গে অনেক মেলামেশা করেছি।’’
—তা’হলে তো ওদের পুশতু ভাষাও একটুআধটু জানেন। কিছু সংলাপ পুশতুতে দিতে চাইছি।
এ বার যেন একটু ঘাবড়ে গেলেন ছবি বিশ্বাস। বললেন, ‘‘শুধু শুধু পুশতু-মুশতু আনতে গেলে কেন? বুঝবে কে?’’
—না বুঝলেও চলবে। এতে অভিনয়ের একটা ডায়মেনশন আসতে পারে।
ভেবে বললেন, ‘‘তা ঠিক। একটা কাবলেকে ধরে শিখে নিলেই চলবে। বাদবাকিটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। কেমন পোশাক-পরিচ্ছদ, মেকআপ, চলাবলা...।’’
—প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে একটা বাড়িতে অনেক কাবুলিওয়ালা থাকে। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা বলেছি। সে মাঝে মাঝে আপনার কাছে যাবে।
জতুগৃহ-য় উত্তমকুমার, অরুন্ধতীদেবী।
|
এর পরের কাহিনি শোনা যাক তপন সিংহর কাছেই।
এক জায়গায় লিখেছেন, ‘‘সেটটি ছিল মেটিয়াবুরুজের একটা মুসলমান হোটেলের অংশবিশেষ। ...আমরা যখন সেট লাইট প্রভৃতি নিয়ে ব্যস্ত, হঠাৎ ছবি বিশ্বাস কাবুলিওয়ালার বেশে প্রবেশ করলেন। চমকে উঠলাম। এ কাকে দেখছি? অতি দরিদ্র মলিন বেশধারী হিং বিক্রেতা কোনও কাবুলিওয়ালা, না সদ্য কবর থেকে বেরিয়ে আসা স্বয়ং মহম্মদ বিন তুঘলক? মাথায় জরির পাগড়ি। গায়ে সিল্কের আচকানের ওপর জরির কাজ করা হাতকাটা জ্যাকেট। পায়ে সোনার জরির কাজ করা নাগরা। তখন আমি তিনশো টাকা মাইনের এক জুনিয়র পরিচালক। আর ছবি বিশ্বাস হলেন সে যুগের অজেয় দুর্দান্ত অভিনেতা। সুতরাং ইগনোর্যান্স ইজ্ ব্লিস কথাটি ভেবে কাজ শুরু করে দিলাম।’’
বিকেল বেলা প্রযোজক অসিত চৌধুরী হাজির। দেখে শুনে গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ বাদেই তাঁর প্রস্থান। তিন চার দিন বাদে অসিতবাবু মুখ খুললেন, ‘‘দেখুন মশায়, ছবিদাকে ওই ঔরঙ্গজেবের পোশাক ছেড়ে গরিব কাবুলিওয়ালা সাজতে হবে। যতটা কাজ হয়েছে ফেলে দিন।’’
ঠিক হল দু’জনে মিলে গিয়ে বলা হবে। বেশ ভয়ে ভয়েই ছবি বিশ্বাসের কাছে কথাটা পাড়লেন ওঁরা।
শুনে প্রথমে চমকে উঠলেও পরে অবশ্য যুক্তিটা মেনে নেন তিনি। তখন আবার নতুন করে পোশাক তৈরি। নতুন করে শ্যুটিং।
দ্বিতীয় কাণ্ডটি আরও মারাত্মক।
ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে তপন সিংহ বলেছেন, ‘‘যেমন সুদক্ষ অভিনেতা তেমনি আবার ফাঁকিবাজও ছিলেন।’’
ঘটনাটি অনেকটা সেই ধাঁচেরই বটে।
সে বার শ্যুটিং কাশ্মীরে। শ্রীনগর থেকে পহেলগাঁওয়ের পথে বেশ কিছু ভেতরে সুন্দর একটা উপত্যকায়। অনেকটাই কাবুলের সঙ্গে মিলে যায় তার গড়ন। নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে শ্যুটিং করে তপন সিংহর শরীর তখন বেশ কাহিল। রোজ রাতে জ্বর আসছে।
শ্যুটিঙের দিন ভোরবেলা ছবি বিশ্বাসকে তিনি বললেন, ‘‘শরীরটা আর দিচ্ছে না। আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন। আজকেই কাজ শেষ করে নেব।’’
—দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।
তপন সিংহ লিখছেন, ‘‘শ’খানেক ভেড়া ও লোকজন জড়ো করে অপেক্ষা করছি। এমন সময় ওঁরা এলেন। দূর থেকে দেখছি জিপ থেকে কাবুলিওয়ালা নামলেন, কিন্তু তার পর যিনি নামছেন, তিনি কে? স্যুট পরা লম্বা চওড়া এক ভদ্রলোক! কাছে আসতে চমকে উঠলাম, উনি তো ছবি বিশ্বাস! তা’হলে কাবুলিওয়ালা কে? এসেই বললেন, দারুণ জায়গা বেছে নিয়েছ তো! এত সুন্দর জায়গায় কি আর আমার ক্লোজ-আপ নেবে? তাই তোমার সহকারী বলাইকে কাবুলিওয়ালার মেকআপ করালাম। একটু লং-এ ট্রিট করলে কেউ ধরতে পারবে না।’’
তপন সিংহ নির্বাক! বলেন কি ভদ্রলোক! কিন্তু আর তো উপায়ান্তরও নেই।
অতএব?
শ্যুটিং হল। ওই বলাইকে দিয়েই!
বলাই বাহুল্য, ছবিতে কাবুলের দৃশ্যে আজও কাবুলিওয়ালা বেশে যাঁকে দেখা যায়, তিনি ছবি বিশ্বাস নন। বলাই সেন।
মানুষ যে কত বিচিত্র হয়! কত বৈপরীত্যে ভরা তার যে আচার-আচরণ!
এই ছবি বিশ্বাসই আবার দেখুন, সম্পূর্ণ অন্য চিত্র তখন।
সময়টা ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর। আউটডোরে যেতে তখন অল্প ক’দিন বাকি। পোস্টমাস্টারের চরিত্রটি তখনও কে করবেন, ঠিক নেই পরিচালক তপন সিংহর।
ছবি বিশ্বাসের কাছে গিয়ে কথায় কথায় বললেন, ‘‘কাকে নিই বলুন তো?’’
উত্তর এল, ‘‘একজনই আছে।’’
—কে?
—তার নাম ছবি বিশ্বাস।
নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না তখন।
তপনবাবু বললেন, ‘‘মাত্র দু-তিন দিনের কাজ। রাত বারোটায় ফ্লাইট। সেখান থেকে গাড়ি। আপনার শরীর অত ধকল নিতে পারবে?
—খুব পারবে। ঘাবড়াচ্ছ কেন?
তখন উনি স্টার থিয়েটার-এ। নিয়মিত স্টেজ করছেন। প্রাণান্তকর পরিশ্রম। তার মধ্যেই তিন দিন ‘ম্যানেজ’ করে কাজ করতে ছুটলেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর।
•••
কাবুলিওয়ালা-র মিউজিক করেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
ছবিতে আফগানিস্তানের দৃশ্য আছে। এ সব জায়গায় যা হয়, তাই-ই মনে মনে ভাবছিলেন তপন সিংহও। ‘অ্যারাবিউন টিউন’ জাতীয় কিছু লাগিয়ে দিলেই হয়ে যাবে।
এই ভাবাভাবির মধ্যেই একটা অদ্ভুত যোগাযোগ ঘটে গেল।
রবিশঙ্কর হঠাৎই আফগানিস্তানে ‘কাবুলি রেডিয়ো’-তে বাজাতে যাবার সুযোগ পেয়ে গেলেন। পরিচালককে বললেন, ‘‘দেখা যাক ওখানে কী পাওয়া যায়?’’
যথাসময়ে রবিশঙ্কর ফিরলেন টেপ রেকর্ডারে ভর্তি পুশতু ভাষার গান নিয়ে। এমন অযাচিত স্বর্গ এত অনায়াসে পেয়ে যাওয়ায় অভিভূত হয়ে যান সকলেই।
গল্প হলেও সত্যি-তে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও রবি ঘোষ।
|
সারা রাত কাজ করতেন পণ্ডিতজি। সেই ভোরের আলো না-ফোটা অবধি। চোখ বুজে গুনগুন করতে করতে যখনই সুর খুঁজতেন মৃদু হাসি খেলে যেত তাঁর মুখে।
কোনও দিন এক তিলও মেজাজ খারাপ করতেন না। বারবার হয়তো একই ‘মিউজিক্যাল ফ্রেজ’ দেখাচ্ছেন। যাঁরা বাজাচ্ছেন, তাঁরা কেউই তুলতে পারছেন না। ক্লান্তিতে ঘেমেনেয়ে একশা পণ্ডিতজি। তাও হাসিটা ধরা ঠোঁটে। চাউনি উদাস। মুখে শুধু বলতেন, ‘‘আর পেরে উঠছি না কিন্তু।’’
কাজে তার ছাপ ছিল না কোনও।
•••
দিলীপকুমারের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাটাও তপন সিংহর কাছে বেশ শোনার মতো।
মানুষ হিসেবে দিলীপকুমার এমনিতেই বেশ অদ্ভুত। অভিনয় যদি তাঁর প্রথম প্রেম হয়, দ্বিতীয় প্রেম খেলা।
রোভার্স কাপে ফুটবল খেলেছেন। ছাত্রজীবনে কলেজে বরাবরের দাবা চ্যাম্পিয়ন। সকালে ব্যাডমিন্টন খেলা ছিল নিয়মিত। বিকেলে ঘুড়ি। ইনিই আবার ঊর্দু ভাষার সুপণ্ডিত। এক সঙ্গে নাকি দুটো ছবিতে কাজ করেননি কোনও দিন।
তপন সিংহ লিখেছেন, ‘‘বদনাম একটাই। শ্যুটিঙের দিন কখন যে তিনি আসবেন, কেউ জানে না। আর সিন যদি পছন্দ না হয়, তা হলে কোনও রকম টালবাহানা করে বিদায় নেবেন। শ্যুটিং আর হবে না। এই ধরনের কথাবার্তা সিনেমা মহলে প্রচলিত ছিল। ফলে ‘সাগিনা মাহাতো’ করার সময় প্রমাদ গুনেছিলাম।’’
কার্শিয়াঙে আউটডোরে প্রথম দিন সকালে চার-পাঁচ ঘণ্টা কাজ করার পর যখন শুনলেন, বিকেলেও আবার কাজ, সহকারী বলাই সেনকে ডেকে বলেছিলেন, ‘‘আমাকে দিয়ে যদি এত কাজ করাও, কালই পালাব বম্বে।’’
বলাই সেন নাকি সবার সঙ্গেই একটু গুরুগম্ভীর চালে কথা বলতেন। দিলীপকুমারকেও তেমন করে বলতে গিয়েছিলেন, ‘‘পরিশ্রম করতে হবে দাদা, নইলে জীবনে কিছু পাওয়া মুশকিল।’’
শোনা মাত্র এক চড় দিলীপকুমারের। বলাইবাবু আর দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ পাননি। তার পর অবশ্য ধীরে ধীরে কাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন দিলীপকুমার। কাজও এগোচ্ছিল তর তর করে। কিন্তু যে দিন কাজ করতে ইচ্ছে করত না, সে দিন তাঁকে দিয়ে কাজ করানো ছিল মারাত্মক ব্যাপার।
এক দিন। শ্যুটিং জোনে সবাই তৈরি। কেবল দিলীপকুমারের দেখা নেই। বেলা এগারোটা নাগাদ অধৈর্য হয়ে বাড়িতে ফোন করলেন তপনবাবু। শোনা গেল, বেরিয়ে পড়েছেন। তবে শরীর খুব খারাপ। শুধু পরিচালকের কথা ভেবেই নাকি আসছেন।
এলেন অল্প পরেই। কিন্তু সোজা গ্রিনরুমে গিয়ে আরামকেদারায় শুয়ে পড়লেন। কাঁধে গরম জলের ব্যাগ।
আতঙ্কিত হয়ে তপন সিংহ গিয়ে দাঁড়ালেন তাঁর কাছে, ‘‘কী হয়েছে?’’
—বড় ব্যথা।
সত্যিই প্রমাদ গুনলেন তপনবাবু। কিন্তু এর পরেও দমে গেলে চলবে না! একটা গোটা দিন যাওয়া মানে অনেক টাকার ধাক্কা। পরের পর শিডিউল লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া। ফলে যে করে হোক অবস্থা সামাল দিতে হবে। ভাবতে ভাবতে শুধুমাত্র উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সে দিন শ্যুটিংটা করতে পারলেন তপন সিংহ।
বেশ খানিকটা সহানুভূতি দেখানোর পর বললেন, ‘‘ব্যথা তো একটু হবেই। নার্গিস, মীনাকুমারী, বৈজয়ন্তীমালা... কত কত নায়িকা ওই কাঁধে মাথা রেখে অভিনয় করেছে বলো?’’
এ কথা শুনেই প্রায় লাফিয়ে উঠলেন এতক্ষণের ‘অসুস্থ’ দিলীপকুমার। মুখে চওড়া হাসি। বললেন, ‘‘চলো বাবা, শ্যুটিং করবে চলো। এখুনি মেকআপ করে নিচ্ছি। বাঙালিদের সঙ্গে পেরে ওঠা দায়।’’
আধ ঘণ্টার মধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেল।
ঠিক উল্টো কাণ্ড অশোককুমারের বেলায়।
•••
‘হাটেবাজারে’-র শ্যুটিং। ভুটানে।
পাহাড়ঘেরা একটা ছোট্ট বস্তি। নাম শাম্চি। সেখানেই কাজ হবে। এ দিকে কঠিন হাঁপানিতে ধরল অশোককুমারকে।
দু’দিন দু’রাত শোওয়া নেই। ঘুম নেই। বিছানায় বসে বসে একটানা নিঃশ্বাস ফেলছেন। কষ্টটা চোখ চেয়ে দেখা দেখা যায় না। এত করুণ অবস্থা।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন প্রফুল্ল সেন। তাঁর কাছে খবর গেল। তিনি ডাক্তার মণি ছেত্রীকে পাঠালেন সরকারের নিজস্ব প্লেনে। তাঁর ওষুধেই হাঁপানি কমল। কিন্তু শরীর খুব দুর্বল।
বাধ্য হয়ে ওঁকে বিশ্রাম নিতে বলে অন্যদের নিয়ে কাজ শুরু করলেন তপন সিংহ।
পর দিন ভোর।
কাজে যাবার জন্য সবাই রেডি। হঠাৎ দেখা গেল তৈরি হয়ে বসে আছেন অশোককুমারও।
তপনবাবু দেখেই আঁতকে উঠলেন, ‘‘আরে, এ কী! আপনার তো বিশ্রাম নেওয়ার কথা!’’
উত্তরে অশোককুমার বললেন, ‘‘সবাই কাজ করবে, আর আমি হাঁ করে বসে থাকব? হয় কাজ করতে দাও, নইলে বম্বে ফেরত পাঠাও।’’
নাছোড় অশোককুমার কোনও কথা শুনবেন না। ফলে কাজ করতে দিতেই হল ওঁকে। ধীরে ধীরে সেরেও উঠলেন তিনি।
অশোককুমার মানুষটি ছিলেন এমনই!
হাটেবাজারে ছবিতে অশোককুমার-অজিতেশ।
|
এর আগেরই ঘটনা যেমন। ওই ছবিতেই বৈজয়ন্তীমালাকে পরিচালকের নেওয়ার ইচ্ছে। এক বার সে কথা শুনে অশোককুমারই টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেন তপন সিংহর।
বৈজয়ন্তীমালা আবার বাংলা জানতেন না। তপনবাবু তাই অন্য বুদ্ধি করলেন। সংলাপগুলো তিন ভাবে রেকর্ড করে পাঠান তাঁকে। স্লো স্পিড। মিডিয়াম। নর্মাল। তাই শুনে শুনে সংলাপ মুখস্থ করেন বৈজয়ন্তী।
•••
উত্তমকুমারের সঙ্গে প্রথম কাজ ‘উপহার’-এ। ’৫৪ সাল।
মহানায়ক হওয়া থেকে অনেক দূরে। কিন্তু নায়ক হিসেবে তখন তিনি ক্রমেই উঠছেন।
এমন সময় তপন সিংহর ডাকে একটি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেন উত্তমকুমার। এক তরুণ অধ্যাপকের চরিত্র।
—চিত্রনাট্য আমার খুব ভাল লেগেছে তপনদা।
শুনে তপনবাবু বললেন, ‘‘তোমার যদি মনে হয়, সংলাপের কিছু কিছু জায়গা বদল করে নিয়ো। অভিনয় আর ডায়লগ ব্যাপারটা তো একদম আলাদা, তাই বলছি।’’
এ কথায় খুব খুশি হয়েছিলেন উত্তমকুমার। বলেছিলেন, ‘‘তোমার কাছে প্রথম শুনলাম জানো! সব ডিরেক্টর যা ডায়লগ লেখে, সেটাকেই বলতে বলে। এতে কি অভিনয় হয়, বলো?’’
‘উপহার’-এর পর খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায় দু’জনের। যত বার একে অন্যের সঙ্গে মোলাকাত করেছেন কোথায় যেন আস্থার জমিটা পোক্ত হতে হতে গিয়েছে।
ভাল বিদেশি ছবি দেখলেই উত্তমকুমারকে তপনবাবু বলতেন, ‘‘যাও যাও দেখে এসো।’’
মার্লন ব্র্যান্ডোর ‘গডফাদার’ এল। তাঁর ‘তপনদা’র কথায় দেখে এলেন উত্তমকুমার।
পর দিন কোনও এক ছবির শ্যুটিং। গেছেন স্টুডিয়োয়। সে সময়ই কোনও এক কাজে তপন সিংহও গিয়েছেন সেখানে। তাঁকে দেখে উত্তমকুমার ছিটকে বেরিয়ে এলেন ফ্লোর ছেড়ে, ‘‘দূর দূর শ্যুটিং-ট্যুটিং হবে না এখন। চলো তো তোমার ঘরে গিয়ে বসি। ওফ্ কী ছবি দেখলাম!’’
‘ঝিন্দের বন্দি’ করবেন তপন সিংহ। এ বার নায়ক উত্তমকুমার। ছবির কাজ শুরু করার আগে তাঁর নায়ককে বললেন, ‘‘তোমাকে একটু ঘোড়ায় চড়া শিখতে হবে।’’
উত্তমকুমার শুনে বললেন, ‘‘জানতাম, জানো। অনেক দিন চড়ি না, এই যা। প্র্যাকটিস করতে হবে।’’
ব্যবস্থা করে দিলেন পরিচালক। ভোর পাঁচটায় উঠে ময়দানে ঘোড়া চড়তেন তাঁর নায়ক। একেবারে নিয়ম করে। সে যত কাজই থাকুক। তাতে ফলও মিলল হাতেনাতে।
শ্যুটিং-এর সময় তাঁকে দেখে তপন সিংহর মনে হয়েছিল, এ নায়ক উত্তমকুমার নয়, পোড়খাওয়া কোনও এক ঘোড়-সওয়ার।
ছবির জন্য তরোয়াল খেলাও শিখতে হবে। তাতেও রাজি হলেন নায়ক। ম্যাসি টেলর বলে একজন বিদেশিকে আনলেন তপন সিংহ। অলিম্পিক বিজয়ী।
চেয়ারে বসে ম্যাসির অসিচালনা দেখে দেখে তাঁকে হুবহু কপি করে ফেললেন নায়ক। পরিচালক তো বটেই, চমকে গিয়েছিলেন স্বয়ং ম্যাসিও।
‘ঝিন্দের বন্দি’র সঙ্গীত করেছিলেন উস্তাদ আলী আকবর খান। সেখানেও একটি বেশ কষ্টকর সঙ্গীত-বিন্যাসকে রীতিমতো কসরত করে তাঁর নায়কের ধরার ভঙ্গিতে হতবাক হয়ে যান পরিচালক।
হঠাৎ তপনবাবুর মনে হয়েছিল, মদ্যপান করলে অনেক সময় যেমন লোকে ভুলভাল বলে, গানেও যদি সে রকম রাখা যায়।
উস্তাদকে বলতেই আলী আকবর বললেন, ‘‘ভারী ভাল ভেবেছেন তো! আমি তৈরি করি।’’
সুর হল। কোনও একটি রাগ নয়, রাগের সমাহার। এক রাগ থেকে অন্য রাগে চলে যাচ্ছে সুরের চলন।
গাইতে ডাকা হল প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রেকর্ডিং হল। উত্তমকুমার সবটা শুনে বললেন, ‘‘তুমি আমায় রেকর্ডিংটা দাও। আমি বাড়িতে রেওয়াজ করি।’’
এ বারও যেন ম্যাজিক দেখলেন তপন সিংহ, তাঁর নায়কের কাছে।
ফ্লোরে যখন এলেন উত্তমকুমার, এতটাই তৈরি যে, প্রথম টেক-এই ওকে! ক্যামেরার ও পাশে দাঁড়িয়ে তখন কথা সরেনি পরিচালকের মুখে।
উত্তমকুমারের ‘স্ত্রী’ রিলিজ করল। গেলেন তপন সিংহ। দেখে উত্তমকে বললেন, ‘‘খুব ভাল অভিনয় করেছ।’’
সেই শুনে নাকি থমকে গিয়েছিলেন উত্তমকুমার, ‘‘তুমিও এ কথা বলছ?’’
—কেন গো?
—দেখলে না, আগাগোড়া ছবিদাকে (বিশ্বাস) নকল করে গেলাম। জমিদারের রোল করছি, ছবিদা ছাড়া তো আর উপায় নেই।’’
আরেক বারের কথা।
সে বার ছবি প্রযোজনা করবেন ঠিক করেছেন উত্তমকুমার। পরিচালনা করার আব্দার নিয়ে গেলেন তপন সিংহর কাছে।
তখন সুবোধ ঘোষের ‘জতুগৃহ’ কাহিনিটা মাথায় ঘুরছে তপন সিংহর। গল্পটা ওঁকে পড়ার কথা বললেন। উত্তর এল, ‘‘আমি কী পড়ব তপনদা! ও তুমি যা ভাল বুঝবে, তাই করবে।’’
এতটাই বিশ্বাস, এতটাই বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ওঁদের।
উত্তমকুমার এমনও এক বার বলেছিলেন ওঁকে, ‘‘তপনদা, আমি তো ভবানীপুরের রকে আড্ডা মেরে বড় হয়েছি, উচ্চারণ খুব একটা ভাল নয়। ছবিদার মতো মার্জিত ডায়লগ বলতে পারি না।’’
তারও নাকি দাওয়াই বলে দিয়েছিলেন তপন সিংহ।
‘‘রোজ সকালবেলা একটা করে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করবেন।’’
অক্ষরে অক্ষরে নাকি এ পরামর্শও মেনে চলতেন তাঁর নায়ক।
এমন একটা ভরসার সম্পর্কে কোথায় যেন তাল কেটে গেল ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ করতে গিয়ে।
চ্যালেঞ্জিং রোল। কোনও দিন অমন চরিত্র করেননি। সানন্দে রাজি হলেন উত্তমকুমার। ডেটও দিলেন। শ্যুটিং-শিডিউল সে ভাবেই ঠিক হয়ে গেল।
কিন্তু তার পরে কী যে হল!
তপন সিংহ লিখেছেন, ‘‘হঠাৎ ডেট বদলাতে চাইল উত্তম। বম্বেতে কী একটা হিন্দি ছবির কথা চলছিল। ওই ছবির জন্য আমাকে দেওয়া ডেটগুলোর দরকার হয়ে পড়ল! পরের মাসে শ্যুটিং করতে চাইল ...ওকে বললাম, হতে পারে অন্যরা ছোট আর্টিস্ট। কিন্তু তাঁদেরও তো একটা সম্মান আছে। পরের মাসে শ্যুটিং করা যাবে না। তুমি বরং ছবিটা ছেড়ে দাও।’’
এর পর সব চুপচাপ। একটা ঠান্ডা ঝড় এত দিনের একটা সম্পর্ককে ছারখার করে দিল!
উত্তমকুমারের জায়গায় দীপঙ্কর দে-কে নিলেন তপনবাবু। শ্যুটিং করে কলকাতায় ফিরে শুনলেন সুপ্রিয়া চৌধুরী মামলা করেছেন।
সে-মামলা অবশ্য ধোপে টিকল না। আসলে ছবিতে সময়টা দেখাতে চেয়েছিলেন শীতকাল। সেই অনুযায়ী বাগানে ফলমূল, সবজি লাগিয়েছিলেন। অপেক্ষা করলে তা শুকিয়ে যেত। এই কথটাটা ঠারেঠোরে লেখা ছিল চুক্তিপত্রে। তাই মামলায় হেরে যান উত্তমকুমার। কিন্তু সম্পর্কে সেই যে চিড় ধরল, সে আর ফেরেনি।
পরে বহু দিন তপনবাবু ভেবেছিলেন, সব মিটিয়ে নেবেন। হয়ে ওঠেনি। আর তার পরেই তো সব শেষ। সমস্ত জাগতিক সম্পর্কের ইতি টেনে চিরকালের জন্য চলে গেলেন মহানায়ক।
নিথর উত্তমকে শেষ দেখা দেখতে গিয়ে ভাই তরুণকুমারের সঙ্গে দেখা। তপনবাবুর হাতটা ধরে তরুণকুমার বলেছিলেন, ‘‘দাদাও খুব চেয়েছিল, সম্পর্কটা আবার ফিরে আসুক। খুব দুঃখও করত এ নিয়ে। একটা ছবি করতে গিয়ে এত দিনের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল!’’
হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বর শোক যেন তখন দ্বিগুণ হয়ে বিঁধে গিয়েছিল বুকে।
‘ঝিন্দের বন্দি’ করার সময় ঘোড়া চড়ার অভ্যাস করান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেও। সে ’৬০-’৬১ সালের কথা।
তার পর প্রায় পঁচিশ বছর কোনও কাজে ডাকেননি সৌমিত্রবাবুকে। এক সময় নিজেই আপসোস করতেন এ নিয়ে।
বলতেন, ‘‘ও যে নিজেকে কতটা পরিণত করেছে, জানাই ছিল না আমার। টের পেলাম ‘আতঙ্ক’ করতে গিয়ে।...সঞ্জীবকুমার যেমন ধরনের অভিনেতা, সৌমিত্র
ঠিক তেমনই। কিংবা তার চেয়ে বেশি বলে আমার মনে হয়।’’
ঠিক তেমনই। কিংবা তার চেয়ে বেশি বলে আমার মনে হয়।’’
সৌমিত্রবাবুকে নিয়ে ‘হুইলচেয়ার’ করার সময় আরেক ধরনের অদ্ভুত তালিমের কথা বলেছিলেন তপন সিংহ।
বলেছিলেন, ‘‘তোমাকে অন্তত এক মাস হুইল চেয়ারে বসে ঘুরে বেড়ানো রপ্ত করতে হবে।’’
বনহুগলিতে এক পরিচিত ডাক্তার ছিলেন, দুর্ঘটনায় তাঁর পা দুটি বিকল হয়ে যায়। হুইলচেয়ারে বসেই তিনি গোটা হাসপাতাল চক্কর দিতেন। এমন এক জন ব্যস্ত মানুষ কী করে এই ব্যাপারটা করেন, দেখতে চেয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও। দু-তিন বার তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ওঁকে।
•••
‘ঝিন্দের বন্দি’র শেষটা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনির থেকে বদলে দিয়েছিলেন তপন সিংহ। পরে এ নিয়ে আক্ষেপ করতেন। তারই কাছাকাছি আক্ষেপ ছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ ছবিটিকে ঘিরে।
‘হাঁসুলি...’ সিনেমা হবে শুনে তারাশঙ্কর অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন। তা নিয়ে যে কাণ্ড করেছিলেন, রীতিমতো অদ্ভুত।
মূল কাহিনির পটভূমি ছিল বীরভূমের লাভপুর। তপন সিংহকে নিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলেন সেখানে।
মাইলের পর মাইল হাঁটতেন। লোকেশন দেখে বেড়াতেন। অন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়ত। তারাশঙ্করের ক্লান্তি নেই। চোখের দৃষ্টি যেন মাঝে মাঝে দিগন্ত ছাড়িয়ে কোথায় উধাও হয়ে যেত। ধ্যানমগ্ন ঋষি যেন!
এক বার বলেছিলেন, ‘‘জানো তপন, এই লাভপুরের আশেপাশে পাঁচ-ছখানা গ্রামে ক’খানা গাছ আছে, তা’ও বলে দিতে পারি আমি।’’
সেই কোপাই নদী। গাঁ-ঘর। তার লোকজন। এমনকী করালীর পিসতুতো ভাই নসুবালা, যে মেয়ে সেজে ঘুরে ঘুরে বেড়াত, তাকেও চিনিয়ে দিয়ে ছিলেন তারাশঙ্করই।
দিনের শেষে কাজের পর লাভপুরের বাংলোয় বসে মহাভারতের গল্প শোনাতেন তারাশঙ্কর।
তেমনই এক দিন।
তপন সিংহ লিখছেন, ‘‘হঠাৎ এক জন বৃদ্ধা এসে তাঁকে প্রণাম করল।...‘কেরে নসু নাকি... আয় আয়।’ সাদরে আহ্বান জানালেন তারাশঙ্কর। ‘হ্যাঁ বাবু, ভাল আছেন তো?’ বৃদ্ধাটি বলল। কিন্তু গলার আওয়াজ শুনে কেমন যেন মনে হল। তারাশঙ্কর আমার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে এই বাবু এসেছেন, তোদের নিয়ে সিনেমা করতে।’ আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘এ হচ্ছে হাঁসুলিবাঁকের উপকথা-র নসুবালা। এ বার ভাল করে দেখলাম— যাকে বৃদ্ধা ভেবেছিলাম সে আসলে একজন পুরুষ। .... নসুবালা নাচে, গান গায়, তামাক খায়, মদ খায়, ঢোল বাজায়।... হঠাৎ তারাশঙ্কর বললেন, ‘এই নস্যে, বাবুকে একটা গান শোনা।’ কানে এক হাত দিয়ে দু’বার গলা খাঁকারি দিয়ে নসুবালা শুরু করলে— ‘আহা—আমায় এ হিদি মাঝারে আঁকা হয়ে গেলা শ্যামের চরণখানি।’’’ নসুকে এত কাছ থেকে দেখেও সিনেমায় তাকে ‘মেয়ে’ হিসেবে দেখিয়েছিলেন তপন সিংহ। পরে ভুল বুঝেছিলেন। তখন আপসোসের অন্ত ছিল না!
‘হাঁসুলি বাঁক...’ করতে গিয়ে অদ্ভুত ভাবে আবিষ্কার করেছিলেন রবি ঘোষকে। এলটিজি-র ‘অঙ্গার’ নাটকে তখন অভিনয় করছেন রবি ঘোষ। এর পর তাঁকে ‘নির্জন সৈকত’-এও নিলেন। ওড়িশাবাসী এক পাণ্ডার চরিত্রে। সে অভিনয় এতই জীবন্ত যে, শ্যুটিং-এর সময় রেলস্টেশনে পাণ্ডারাই ধোঁকা খেয়ে গিয়ে রবি ঘোষকে এই মারে তো সেই মারে!
এর পরেই ওঁকে নিয়ে তপন সিংহর অন্যতম সেরা চমক ‘গল্প হলেও সত্যি’। উত্তম-সুচিত্রার গ্ল্যামারের ভিড়েও যা আজকের কথায় প্রায় ‘ব্লকবাস্টার’ হয়ে গেল! এ ছবিতে আবার গানও গাইলেন তপনবাবু।
•••
সাহিত্যিক বনফুল থাকতেন ভাগলপুরে। তিনি তখন ওখানকার নামকরা ডাক্তার-প্যাথোলজিস্ট।
তপনের শৈশব-কৈশোর কেটেছে ওই ভাগলপুরেই। কিন্তু তখন গম্ভীর প্রকৃতির সেই মানুষটির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস হয়নি।
প্রায়ই দেখা যেত লাঠি হাতে সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবি গায়ে, ধুতিটা লুঙ্গির মতো পরে নিজের ল্যাবরেটরিতে চলেছেন বনফুল।
অনেক পরে সেই বনফুলের ছোট গল্প ‘অর্জুন কাকা’-কে নিয়ে ছবি করার খুব ইচ্ছে হল।
ভয়ে ভয়ে চিঠি লিখে ফেললেন ভাগলপুরে। উত্তরও এল। তাতে লেখা, কোনও এক কাজে কলকাতায় আসছেন বনফুল। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-এ তাঁর ছেলের ফ্ল্যাটে দেখা করতে হবে।
জড়সড় হয়ে দুরু দুরু বুকে গেলেন সে-ফ্ল্যাটে। দেখা হল। কিশোরবেলায় দেখা বনফুলের সেই গাম্ভীর্য ভাবটা তখন কই!
বনফুল বললেন, ‘‘কথা পরে হবে। আগে ভাগলপুর থেকে আম এনেছি, জর্দালু আম, একটু খেয়ে নাও। এ রকম আম কলকাতায় আর কোথায় পাবে?’’
এই এক কথাতে ভয়ের প্রাচীরটা যেন ভেঙে গেল।
‘অর্জুন কাকা’ নিয়ে ছবি হবে শুনে তার নামও ঠিক করে দিলেন বনফুল—‘আরোহী’।
চিত্রনাট্য আগে শোনাতে চাইলে হেসে বললেন, ‘‘কিছু দরকার নেই। মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করে যাও।’’ টাকাপয়সা নিয়ে একটি কথাও বললেন না।
ছবি তৈরি হল।
কিন্তু মুক্তি নিয়ে নাটকীয় কাণ্ড!
রিলিজের আগে পশ্চিমবঙ্গের সব প্রেক্ষাগৃহের কর্মীরা হরতাল ডেকে বসলেন। খবরটা কানে যেতেই তপনবাবু ধরেই নিয়েছিলেন ছবির দফারফা! কিছুতেই আর রক্ষা পাওয়ার নয়।
ছবির মুক্তি পাওয়ার কথা মিনার-বিজলী-ছবিঘরে। তার আগে ছবিটা এক বার চালিয়ে শব্দ আর প্রজেক্টরের আলো প্রিন্ট অনুযায়ী ঠিক করা হবে।
মুক্তির ঠিক দু’দিন আগের কথা। শূন্য হলে তপন সিংহ আর তাঁর কিছু সহকর্মী বসে।
ছবি চলল। ওঁরা দেখলেন। সবার অজান্তে ইউনিয়নের কিছু লোকও দেখলেন। সেই যাঁরা হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু ছবি শেষে তাঁরা এত খুশি যে, হরতাল কিছু দিনের জন্য বন্ধ রেখে দিলেন।
বাংলা ছায়াছবির ইতিহাসে এমন ঘটনা আর কবে ঘটেছে, জানা নেই।
•••
’৭০ সালের পর বেশ কিছু হিন্দি ছবি করেছেন তপন সিংহ। ‘সাগিনা মাহাতো’-র হিন্দি। ‘ক্ষণিকের অতিথি’-র হিন্দি ‘জিন্দেগী জিন্দেগী’, ‘সফেদ হাতি’, ‘আজ কা রবিনহুড’, ‘এক ডক্টর কী মওত’, ‘আনোখা মতি’। সেখানেও কারা না কারা সব অভিনয় করলেন— সায়রা বানু-ওয়াহিদা রহমান-শাবানা আজমি...।
’৭৮-এ ‘সফেদ হাতি’ তৈরির সময় সে আরেক অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড।
গল্পের নায়ক ঐরাবত নামে একটি শ্বেত হস্তি। অতএব সাদা হাতি চাই-ই চাই। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে তেমন হাতি?
রেওয়াতে নাকি সাদা বাঘ আছে। লোকমুখে শোনা গেল, সেখানে সাদা হাতিও পাওয়া যায়।
পরে খবর নিয়ে জানা গেল, বাজে কথা। কারা যেন বলল, বর্মায় সাদা হাতি পাওয়া যায়। সেটিও বাজে কথা।
এর পরও হাতি কিন্তু ছবিতে সাদাই। কী করে এমনটা সম্ভব হল। রহস্য!
তবে সমাধানটি হয়েছিল অতি সহজে। একটি বিখ্যাত রঙের কোম্পানি এক বিশেষ ধরনের সাদা রং তৈরি করে দিয়েছিলেন। যা দিয়ে হাতিকে রং করলেও তার শরীরের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়।
সাদা হাতির সমস্যা তো মিটল।
ছবি: এস রায়।
|
কিন্তু একটি ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যের শ্যুটের সময় ঘটে গেল অদ্ভুত কাণ্ড।
ছবিতে একটি দৃশ্যে দেখানো হবে শিশু অভিনেতা শিবু গভীর জঙ্গলে হেঁটে যাচ্ছে, এমন সময় একটা চিতা বাঘ তার পিছু নেবে। হঠাৎ শিবুর নজরে আসে চিতাবাঘ তার পিছনে। সে প্রাণপণে দৌড়তে থাকে। চিতাবাঘও তার পিছনে পিছনে ছোটে।
শ্যুটিং-এর জন্য ক্যামেরা নিয়ে জঙ্গলে ঢোকা শুরু হল। একটু বাদেই বিরাট হুঙ্কার। ফরেস্ট গার্ড হেসে বললেন, ‘‘বুনো হাতি! আমাদের এগোতে বারণ করছে।’’
শুনে ইউনিটের লোকজনের বুক শুকিয়ে কাঠ।
তখনও কি জানা ছিল, আরও চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটতে চলেছে একটু বাদেই।
শ্যুটিঙের জন্যই খাঁচায় রাখা ছিল দুটো চিতা বাঘ। তার মধ্যে একটি আবার বেশ ‘দুষ্টু’। শিশু অভিনেতার বয়স মাত্র সাত-আট বছর। তার সঙ্গে চিতার শ্যুটিং। যথেষ্ট ভয়ের। তার ওপর একটা দৃশ্য আছে, যেখানে চিতাটা শিবুর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
ক্যামেরা থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে চিতাটাকে রাখা হল। শিবু বিশ গজ দূরে। দুজনেই ক্যামেরার দিকে ছুটবে, এই আশায়। ক্যামেরা চলল। ইশারায় চিতাকেও ছাড়া হল। চিতা এক বার এ দিকে তাকাল। তার পর ও দিকে। হঠাৎ লোকজনের মাথার ওপর দিয়ে এক বিরাট লাফ। সোজা গভীর জঙ্গলে ধাঁ। আর তাকে ফেরানো যায়নি।
‘আজ কা রবিনহুড’ করতে গিয়ে তো প্রাণেই মারা পড়ছিলেন। হাতির লাথি খেয়ে পাঁজর ভাঙল। তার পরও হাতিটা ছাড়েনি ওঁকে। পিষে মেরে ফেলার চেষ্টায় ছিল। কোনও ক্রমে বাঁচিয়েছিল মাহুত।
•••
এমন এক বর্ণময় জীবনের শেষকালটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। স্ত্রী অরুন্ধতী চলে গিয়েছিলেন অনেক আগেই।
এক সময় ছেলে রানা এলেন বিদেশ থেকে। তার স্ত্রী রয়ে গেলেন ও-বাড়িতেই। ছেলে যাতায়াত করতে লাগলেন।
এর মাঝেই ‘দাদা সাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ড’, স্বাধীনতার ষাট বছরে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’...! পুরস্কার, সম্মান, তখন তাঁর জীবনে কতটুকু!
নিউ আলিপুরের তিন তলা বাড়িতে তখন তিনি প্রায় বন্দিই। শ্বাসের সমস্যা তো ছিলই। পেসমেকার বসানোর পর অদ্ভুত এক সমস্যা দেখা দিল। শরীর নিতে পারছিল না যন্ত্রটা। ভীষণ একা লাগত। পুরনো ছবি, পুরনো কথা ঘুরে বেড়াত চারপাশে। নিউ থিয়েটার্স... পঙ্কজ মল্লিক... রাইচাঁদ বড়াল... বিমল রায়ের সঙ্গ...! আর শৈশবের ভাগলপুর...।
যে এক-দু’জন মাঝে মাঝে আসত-যেত তাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতেন ছেঁড়া ছেঁড়া সেই স্মৃতির খেয়া।
সে সময়েরই এক সাক্ষাৎকারে এক বার বলেছিলেন, ‘‘এখন কী ভাল লাগে জানো, বিকেলবেলা একান্তে বসে শুধু ‘গীতবিতান’-এর পাতা উল্টে যেতে। বারান্দায় বসে গীতবিতানের গান গুনগুন করি। কোনওটায় সুর আসে, কোনওটায় আসে না।...এখন যে রবীন্দ্রনাথই আমার আশ্রয়।’’
২০০৯-এ জানুয়ারি ১৫, সমস্ত আশ্রয়ের ঊর্ধ্বে উঠে চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ‘আপনজন’।
ঋণ: অরিজিৎ মৈত্র, সুকুমার রায়, তপন সিংহ চলচ্চিত্র আজীবন, মনে পড়ে (তপন সিংহ)
No comments:
Post a Comment