কলকাতার পার্সি ক্লাবের এক চিলতে সবুজ লনে বসে আছি আমি আর জামশিদ।
এই তো ক’দিন আগে।
টেলিফোনে জামশিদকে বলেছিলাম, মজিদকে নিয়ে একটা বড় লেখা করছি, তোমার একটু সাহায্য চাই।
এমনিতে জামশিদ খুব একটা মিডিয়ার মুখোমুখি হতে চায় না। কিন্তু লেখাটা মজিদকে নিয়ে বলেই বোধ হয় এক কথায় রাজি হয়ে গেল।
শুক্রবারের মেঘলা দুপুর। আমি জামশিদের সঙ্গে বসে।
বয়স জামশিদের শরীরে তার অমোঘ, অনিবার্য ছাপ রাখলেও ও এখনও বেশ হ্যান্ডসাম। ঢোলা কালো বারমুডা আর সাদা স্পোর্টস শার্টে বেশ স্পোর্টিংও।
শুরুতেই বলল, ‘‘মজিদের জীবনটা তো খোলা পাতা। নতুন আর কী শুনতে চাও?’’
বললাম, মজিদ তো পুরনো হওয়ার নয়। আজও ফেসবুকে মজিদের ফ্যান-পেজ রয়েছে।
জামশিদ হাসল।
তার পর বলল, ‘‘আমি আর মজিদ দু’জনেই খোরাম শহরের। একই সঙ্গে একই কোচের কাছে প্র্যাকটিস করতাম। মজিদ আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। ও যখন ইরানের জুনিয়র টিমে, আমি তখন সাব জুনিয়রে। ও যখন ইরানের ওয়ার্ল্ড কাপ টিমে, আমি তখন ইরানের কোকাকোলা ইউথ টিমে। আমাদের দু’জনেরই ওঠাবসা ছিল একসঙ্গে। তার পর তো ইরান ছেড়ে ভারতে পড়তে আসা, তাও এক সঙ্গেই।’’
আর এখন?
জামশিদ কলকাতায় স্ত্রী-পুত্র নিয়ে থিতু হয়ে বসেছে। ওর ১৫ বছরের ছেলে স্পেনের কোচিং নিচ্ছে। স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন।
আর মজিদ?
কেউ খোঁজ রাখে না তার। জীবনের স্রোত থেকেই সে যেন লোপাট হয়ে গেছে।
কেন এমন হল?
অল্প থমকালো জামশিদ।
তার পর ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে পরিচিত সেই ঢঙে বলল, ‘‘আসলে মজিদ নিজের জীবনের রাশটাকে ধরে রাখতে পারল না।’’
কেমন ছিল সেই জীবন?
মধ্য আশির মজিদ, ছবি: অশোক চক্রবর্তী
জামশিদ বলতে লাগল, ‘‘নটরাজ বিল্ডিং-এ আমরা যখন থাকতে শুরু করেছিলাম, সেই সময়টা বড় ভাল ছিল। সেটা ইস্টবেঙ্গলে থাকার সময়।
মজিদ বরাবরই একটু অলস প্রকৃতির ছিল। রান্নাবান্নার কাজটা ফ্ল্যাটে আমিই করতাম। পার্কসার্কাস মার্কেট থেকে মাটন কিংবা চিকেন আমিই কিনে আনতাম। মজিদ বড়জোর ডিশ-টিশ সাফাই করত। এর বেশি কিছু নয়।
ইস্টবেঙ্গলে থাকার সময় তবু খানিকটা শৃঙ্খলা ছিল। সমস্যাটা হল ১৯৮২-তে মহমেডানে আসার পর। মজিদ সেই সময় কিছু বদসঙ্গে পড়েছিল। আমরা তখন নটরাজ বিল্ডিং ছেড়ে সঙ্গম বিল্ডিং-এ এসেছি।
প্রায় প্রতি রাতেই লিফ্টম্যানের সঙ্গে, ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে মজিদের বচসা হাতাহাতিতে গড়াত।
তখন ও নানা ধরনের নেশাও ধরেছে। এমনকী কাশির সিরাপ খেয়েও মজিদ নেশায় বুঁদ হয়েছে। তখনই আমি ঠিক করি, আর নয়। এ বার আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় এসেছে।
আমি চলে গেলাম দেওদার স্ট্রিটে মোহনবাগান কর্তা ধীরেন দে’র বাড়ির উল্টো দিকের একটা ফ্ল্যাটে। আর মজিদ চলে গেল ইলিয়ট রোডে। মহমেডান স্পোর্টিং-এর মেসে।
এই মহমেডান মেসে যাওয়াটাই মজিদের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াল। আরও বেশি নেশা, আরও বোহেমিয়ান হয়ে ওঠা।
প্র্যাকটিস করতে চাইত না। একটু ফিটনেস ট্রেনিং করেই চলে যেত বিয়ার খেতে। বহু দিন বারণ করেছি। শোনেনি।
তাও ১৯৮৫ সালে আমি ওকে একবার ফেরাবার চেষ্টা করেছিলাম। সে বার জীবনদা, পল্টুদা আমাকে মহমেডান থেকে ইস্টবেঙ্গল যাওয়ার অফার দিলেন। আমি ওঁদের বললাম, আমার সঙ্গে মজিদকে নিন। পল্টুদা বেঁকে বসলেন। বললেন, মজিদ বদসঙ্গে পড়েছে, নেশা করে। আমরা ক্লাবের পরিবেশ নষ্ট করতে পারি না।
আমি সে দিন মজিদের জন্য অনেক বার দু’জনকে বলেছিলাম, ওকে একটা শেষ সুযোগ দিন। দু’জনেই আমাকে বললেন, যদি কৃশানু, বিকাশ আমাদের দলে এ বার সই না করে তা হলে মজিদকে নিতে পারি। ভাগ্য এমনই খারাপ, ওরা দুজনেই ইস্টবেঙ্গলে এল। মজিদের আর ফেরা হল না।
নটরাজ বিল্ডিং-এ থাকার সময় মজিদের বহুচর্চিত প্রেম নিয়ে কথাটা পাড়লাম।
তাতে জামশিদ পাল্টা প্রশ্ন করে বসল, ‘‘তুমি কি ওদের প্রেমটাকে সিরিয়াস বলে মনে করো? ওটা তো তোমাদের, মানে কাগজওয়ালাদের অনেকটাই কল্পনা ছিল। একজন দুর্দান্ত ফুটবলার, আর একজন ভারতের বাস্কেটবল খেলোয়াড়। একই বিল্ডিং-এ থাকে। একটু কথাবার্তা। একটু বাইরে খেতে যাওয়া। তার মানেই কি প্রেম? যদি ওরা সিরিয়াস হত, তা হলে তো বিয়েই করে নিত।’’
জামশিদকে আর বলা হল না যে, দেশের বিখ্যাত স্পোর্টিং পরিবারটিতে মজিদকে কেন্দ্র করে সেই সময়ে কী ধরনের ঝড় উঠেছিল। সম্ভবত মজিদ সত্যিই ভালবেসে ফেলেছিল সেই সময়ে এক সন্তানের জননী ওই রমণীকে।
জামশিদ আর এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাইল না।
এখন কোথায় মজিদ?
হাত উল্টালো জামশিদ। বলল, ‘‘এ ব্যাপারে তুমিও যেখানে, আমিও সেখানে। এই তো কিছু দিন আগে এক জার্নালিস্ট আমাকে বলল, মজিদ নাকি মারা গেছে। খুব খারাপ লেগেছিল। খোঁজখবর নিলাম। কিন্তু কেউ কনফার্ম করল না। বরং শুনলাম, সাদার্ন ইরানে মজিদ নাকি ফোর্থ ডিভিশনের একটা ক্লাবকে কোচিং করাচ্ছে। শুনে ভাল লাগল। যদি সেটা সত্যি হয়, আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না।’’
মজিদ-জামশিদের পাশাপাশি যে নামটি উচ্চারিত হয় সে নামটি হল মেহমুদ খাবাজি। আরেক ইরানি। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছিল মজিদ-জামশিদের গডফাদার।
কলকাতায় মহমেডান স্পোর্টিং-এ খাবাজি খেলেছে বেশ কয়েক বছর। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান জনতার কাছে খাবাজি প্রায় ভিলেন ছিল। কারণ ব্লকার হিসেবে বিপক্ষের স্ট্রাইকার কিংবা উইঙ্গারদের সঙ্গে প্রায়ই তার ঠোক্কর লাগত। প্রায়ই হলুদ বা লাল কার্ড দেখত খাবাজি।
মহমেডান জনতাও যে খাবাজিকে খুব পছন্দ করত তা নয়। এ নিয়ে জামশিদ পরিষ্কার বলল, ‘‘খাবাজি গোল করত না। যেটা আমি আর মজিদ করতাম। তাই মহমেডান সমর্থকরা ওকে খুব পছন্দ করত না। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবী ছিল খাবাজি। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্ট্যাটিসটিক্স-এ এমএসসি করেছিল ও। আমরা একটা সময় কলকাতায় সঙ্গম বিল্ডিং-এ একসঙ্গেই থাকতাম। ও মজিদকে নানা ধরনের বই পড়তে বলত। মজিদ ওকে ঠাট্টা করে ‘পাদ্রি সাহেব’ ডাকত। এই তো ক’দিন আগে খাবাজি দু’-এক দিনের জন্য কলকাতায় এসেছিল। ও বিয়ে করেছে হাঙ্গারির একটি মেয়েকে। দুবাইয়ে ওদের ইলেকট্রনিক্স অ্যাপ্লায়েন্সের বিরাট ব্যবসা। খাবাজি আমাকে ওর কাছে ক’দিনের জন্য বেড়াতে যাবার কথা বলেছে।’’
মজিদের কথা জিজ্ঞাসা করেনি খাবাজি?
আনমনা জামশিদ পার্সি ক্লাবের বেতের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘‘খাবাজি শুধু আমায় বলেছে, মজিদ যেখানেই থাকে, যেন সুখে থাকে।’’
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/it-was-a-fault-of-ashir-mazid-to-go-to-eliot-road-1.353924
No comments:
Post a Comment