Thursday, 8 September 2016

ছায়াহিন্দোল (On Tarapada Chakraborty)

ছায়াহিন্দোল

এই রাগটি ছিল সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর তৈরি। যাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খান, উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি। তাঁর অত্যাশ্চর্য জীবন-পরিক্রমার কথা গাঁথলেন দৌহিত্র শ্রীজাত

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০০:০৩:৫৪
  

2

সঙ্গীতাচার্য

‘আদাবান্তে নিবেদন এই শ্রী শ্রী বিজয়ার শতকোটি অভিবাদন জানিবেন। ঈদ মুবারক। আপনার গুণে আমি মুগ্ধ এত, পরিচয় দেবার কোনও প্রয়োজন করে না। আপনি আমার হৃদয়ে গাঁথা। আপনি ভারতের রত্ন। স্বনামধন্য মহাপুরুষ, আপনার দীর্ঘ জীবন মায়ের চরণে প্রার্থনা করি। আপনি দয়া করে আসবেন জেনে অধিক সন্তুষ্ট হলেম। দেড়মাস পর যদি আপনি দয়া করে আসেন, তবে বাধিত হব।—আপনার আলাউদ্দিন’

মাইহার থেকে সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তীকে এই চিঠি লিখেছিলেন প্রবাদপ্রতিম উস্তাদ বাবা আলাউদ্দিন খান।
এর চেয়ে বড় শংসাপত্র কোনও প্রতিষ্ঠানও কাউকে দিতে পারে না। চিঠির প্রাপক তত দিনে সঙ্গীতাচার্যের খেতাব পেয়ে গিয়েছেন, লোকে তাঁকে এক ডাকে চেনে।
কিন্তু সেই যুবক তারাপদকে বোধ হয় কেউ চেনে না, যে ফরিদপুরের শান্ত এক গ্রাম থেকে এসে পড়েছিল বিরাট এই শহরটায়, আর গানের নেশার অপরাধেই তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল কোনও এক বাড়ির রোয়াকে।
অবাক করা কথা হলেও, এমনই সব বিস্ময়কর তথ্যে ঠাসা তারাপদ চক্রবর্তীর গোটা জীবনটাই, যার জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়ায়। ১৯০৯ সাল, পয়লা এপ্রিল। আর পাঁচটা বালকের মতো ডানপিটে ছিলেন তিনিও, কিন্তু গানবাজনার পরিবেশে পড়লে সেই ছেলেই হয়ে যেত ধ্যানমগ্ন।
 বাবা কুলচন্দ্র চক্রবর্তী, মা দুর্গারানি দেবী ও কাকা ন্যায়রত্ন রামচন্দ্র চক্রবর্তী। বাবা আর কাকা, দুজনেই ছিলেন রীতিমতো গানের মানুষ। খুরজা ঘরানার বিখ্যাত উস্তাদ জহুর খানের কাছে দীর্ঘদিন তালিম নিয়েছিলেন তাঁরা। সেই সূত্রে গান বেড়ে উঠছিল বালক তারাপদ’র কণ্ঠেও।
তা ছাড়া টোলে সংস্কৃত শিক্ষার পাশাপাশি লোকায়ত গানের একটা আবহও তাঁর মনে প্রভাব ফেলেছিল বইকী। তাই দৈনন্দিন চলাফেরার মধ্যে গানকেই নিজের সঙ্গী করে নিয়েছিলেন তারাপদ।
দুপুরে হয়তো দিঘিতে ছিপ ফেলে বসে আছেন, গুনগুন করে ভাঁজছেন কোনও একটা রাগের চলন। এ দৃশ্যে কোটালিপাড়ার বাসিন্দারা অভ্যস্তই ছিলেন। তার পাশাপাশি বাবার কাছে নিয়মমাফিক রাগসঙ্গীতের তালিম নেওয়া তো ছিলই। তবে তখন কেউ বোধহয় এত দূর ভাবতে পারেননি যে, এই ছেলেই ভারতজোড়া নাম কিনবে কয়েক বছর পর।
যেমন ভাবতে পারেননি তারাপদ’র ভাবী শ্বশুরবাড়ির বেশ কিছু লোকজন।
সে-কালে কম বয়সে বিয়ের চল। কিন্তু যে-বাড়ির মেয়ের সঙ্গে বিবাহ স্থির করার চেষ্টা হল, সে-বাড়ির লোকজন বেঁকে বসলেন। তাঁরা ছিলেন যথেষ্ট সচ্ছল, এ দিকে কুলচন্দ্রের দিন আনা দিন খাওয়া। সম্পদ বলতে কেবল সঙ্গীত। কিন্তু তেমন সম্পদের দাম আর ক’জনই বা বোঝে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের বক্তব্য, ঘুরে বেড়ানো ছাড়া এ ছেলে আর কিছুই করে না। ভবিষ্যতেও যে কিছু করে উঠবে, এমনটা মনে হচ্ছে না। অতএব ধরে বেঁধে নিজেদের মেয়েকে তাঁরা জলে ফেলে দিতে পারবেন না।
বিয়েটা হয়তো হতই না, যদি না উল্টো কথা বলতেন খোদ পাত্রীর বাবা। তিনি সে বয়সেই কিশোর তারাপদর চোখে উদাসীন এক প্রত্যয় দেখে ফেলেছিলেন, যা বাকিদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। তাই শেষমেশ মালাবদল হয়েছিল তারাপদ আর প্রভাবতী’র। আর তার পরপরই উপার্জনের তাগিদে তারাপদ পাড়ি দিলেন কলকাতা। হয়তো তিনি জানতেনও না, এই মহানগরীতেই বাঁধা হবে তাঁর নতুন জীবনের তার।
•••
রোয়াকে রাত কাটানোর প্রসঙ্গ ছিল এই লেখার গোড়ায়। গল্পটা এইরকম, কলকাতায় এসে তারাপদ আশ্রয় নিয়েছিলেন দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে।
নামেই আশ্রয়, তাঁরা এই হঠাৎ আগন্তুকের উপস্থিতি বিষয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তারাপদ অবশ্য বরাবরই একরোখা, বেশ প্রবল তাঁর আত্মমর্যাদা বোধ। কারও দয়া বা দান গ্রহণ করা তাঁর ধাতে নেই। তাই শহর কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় দিনভর রোজগারের ফিকিরে ঘুরতেন তিনি। বাড়ি বাড়ি চাল বিক্রি করেছেন, শাড়ি বিক্রি করেছেন, এমনকী মুটেগিরিও করেছেন।
সেই সামান্য রোজগারের একাংশ পাঠাতে হত দেশের বাড়িতে, বাকিটা নিজের হাতখরচ। কোনও কাজকেই খাটো মনে করতেন না তিনি, বরং মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকাটা তাঁর কাছে অনেক বেশি দামি বলেই মনে হয়েছিল। এই মূল্যবোধের দামও তাঁকে দিতে হয়েছিল অনেক বার, সে সব কথায় পরে আসা যাবে।
সারাদিন তো পথে পথে কাটতই, রাতগুলো কাটতে শুরু করল জলসায়। কোটালিপাড়ায় থাকাকালীন এমন বড় পরিসরে গানবাজনা শোনার সুযোগ মেলেনি, এদিকে কলকাতা তখন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মহাতীর্থ। আজ এখানে মেহফিল, তো কাল ওখানে।
আর সে সব জায়গায় শিল্পী কারা?
এক দিকে উস্তাদ আবদুল করিম খান ও উস্তাদ ফৈয়াজ খান, তো অন্য দিকে পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর আর মুস্তাক হুসেন।
রাতের কলকাতাকে প্রাণ থেকে ভালবেসে ফেললেন যুবক তারাপদ। যে শহরে এমন গানবাজনা শোনা যায়, সে শহর ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
শহর ছেড়ে যেতে হল না ঠিকই, কিন্তু ভিটে ছাড়তে হল।
যাঁদের বাড়িতে ছিলেন, তাঁরা সাফ জানিয়ে দিলেন, রোজ রোজ রাতবিরেতে বাড়ি ফেরা চলবে না। এমনটা চলতে থাকলে অন্যত্র ব্যবস্থা দেখতে হবে।
অন্তর্নিহিত নির্দেশটা খুব সোজা — হয় মাথার ওপর ছাদ, নয় গানবাজনা। তারাপদর কাছে উত্তরটা আরও স্পষ্ট ছিল। সেই রাতেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে পথে এসে দাঁড়ালেন তিনি।
একেবারে আক্ষরিক অর্থেই।
রাত কাটানোর জন্যে বেছে নিলেন হ্যারিসন রোডের একটি বাড়ির রোয়াক। সেখানেও কি কম বিপত্তি? দু’দিন থেকেছেন কি থাকেননি, এক কনস্টেবল এসে লাঠি দেখালেন।
ব্রিটিশ শাসিত কলকাতা, রোয়াকে শুয়ে থাকা চলবে না। তারাপদরও জেদ, এখানেও যদি জায়গা না হয়, কলকাতায় থেকে গানবাজনা শুনবেন কী করে?
‘‘কী করা হয়?’’ বিরক্ত মুখে প্রশ্ন করলেন বয়স্ক সেই কনস্টেবল।
‘‘গান গাই’’, সটান জবাব দিলেন তারাপদ। ছেলেটির চেহারার সঙ্গে জবাবকে কিছুতেই মেলাতে পারলেন না প্রশ্নকর্তা।
তবু তিনি বললেন, ‘‘কীরকম গাস, নমুনা শুনি?’’
মধ্য রাত পেরিয়ে যাওয়া শুনশান হ্যারিসন রোডের সেই রোয়াকে বসেই চোখ বন্ধ করে গান ধরলেন তারাপদ— ‘পিয়া কে মিলনে কী আশ’।
তত দিনে যোগিয়া’র এই ঠুমরি উস্তাদ করিম খান সাহেবের গলায় ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে। সদ্যই এক আসরে খান সাহেবকে শুনেছিলেন তারাপদ, ওই একবার শুনেই গানটি হুবহু গলায় তুলে নিয়েছেন তিনি।
কোনও এক দৈব সংযোগে সেই রাতের সেই কনস্টেবল ছিলেন গানের সমঝদার।
ঠুমরি শেষ হবার পর তারাপদকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তিনি। আর বলেছিলেন, এক শর্তে এই রোয়াকে তাঁকে থাকতে দেওয়া হবে। যদি রোজ রাতে এইরকম গান শুনতে পাওয়া যায়।
ওই বয়স্ক কনস্টেবলই তারাপদ’র নগরজীবনের প্রথম শ্রোতা।
ছোট থেকেই তারাপদ ছিলেন শ্রুতিধর। বিশেষ করে সুরের ক্ষেত্রে। একবার যা শুনতেন, ভুলতেন না। আর সেই ক্ষমতাই এর পর তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিল সে সময়ের খ্যাতনামা গাইয়ে সাতকড়ি মালাকারের জানলার বাইরে।
কলকাতার নানা রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে একদিন হঠাৎ তারাপদ’র কানে এল পুরনো বন্দিশ।
কে গাইছেন এমনভাবে?
খুঁজে খুঁজে পেলেন সেই জানলা, যার ওদিকে বসে ছাত্রদের গান শেখাচ্ছেন সাতকড়ি মালাকার।
তারাপদরও খুব ইচ্ছে, ভেতরে গিয়ে বসে সকলের সঙ্গে গান শেখার, কিন্তু সেই সামর্থ্য বা সাহস, কোনওটাই তাঁর নেই।
অতএব রোজ একই সময়ে জানলার বাইরে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকতে শুরু করলেন তিনি। আর বরাবরের মতোই, একের পর এক রাগ আর বন্দিশের চলন উঠে আসতে লাগল তাঁর গলায়।
বেশি দিন এমনটা চলল না।
ধরা পড়লেন হাতেনাতে। সাতকড়ি মশায় রেগে আগুন। ছোকরা কিনা জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁর বিদ্যা চুরি করছে?
‘‘শুনি কী শিখেছিস?’’ হুকুম করলেন তিনি। তারাপদ লাজুক মুখে দু’খানা বন্দিশ গেয়ে শোনাতেই সাতকড়িবাবুর মন গলে গেল। এমন একজনকেই তো তিনি খুঁজছিলেন এত দিন! তারাপদর ঠাঁই পাকা হল জানলার এদিকেই।
•••
‘‘তোমাকে তালিম দেওয়া মানে খোদার উপর খোদকারি করা। ভগবানই তোমাকে সব আঙ্গিক তালিম দিয়ে পাঠিয়েছেন, তার বাইরে কিছুই নেই। ভারতবর্ষ ঘুরে আমি কিছু অমূল্য বন্দিশ জোগাড় করেছি, সেগুলি তোমাকে সার্থক ভাবে দিয়ে যেতে পারলেই আমার শান্তি’’— তারাপদ চক্রবর্তী বিষয়ে এই বক্তব্য তাঁর পরবর্তী ও শেষ গুরু পণ্ডিত গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী’র।
সাতকড়ি মালাকারের কাছে বেশ কিছু দিন তালিম নেবার পর তারাপদ সান্নিধ্য পান খ্যাতনামা গিরিজাবাবুর, যিনি বিষ্ণুপুর ঘরানার গাইয়ে হয়েও ভারতের বহু ঘরানার গায়কি ও দাওপ্যাঁচ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তারাপদকে একবার শুনেই তিনি বুঝেছিলেন, এ ছেলের মধ্যে গান ছাড়া আর কিছু নেই। আর সে গানও বেশ ভালরকম বিষ্ণুপুরের গায়কি ঘেঁষা। এ তৈরি হয়েই এসেছে, একটু গড়েপিটে নিলেই কেল্লা ফতে।
হয়েওছিল তাই।
মধ্যযৌবন থেকেই কলকাতা ও আশেপাশের আসরগুলোয় নিয়মিত ডাক পড়তে লাগল তারাপদ’র। তাবড় ওস্তাদদের ভিড়ে বাঙালি গাইয়ে হয়ে নাম কেনা তখন বড় সহজ ছিল না।
গোড়ার দিকে গানে উস্তাদ করিম খান সাহেবের ছায়া থাকলেও, খুব দ্রুত তারাপদ চক্রবর্তী’র নিজস্বতা শ্রোতাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল।
বেশ টিকোলো নাক ছিল তাঁর, তাই ডাকনাম ছিল নাকু। তখন বাঙালি শ্রোতাদের কাছে নাকুবাবুর গান এক আলাদা পিছুটান। শুদ্ধকল্যাণ থেকে পুরিয়ায় আসর মাতিয়ে ফেলছেন তিনি। শহরের বাইরেও পৌঁছচ্ছে তাঁর খ্যাতি।
এর মধ্যে দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জের বাওয়ালি মণ্ডল রোডে বাসা ভাড়া নিয়েছেন। দেশ থেকে ভাই হরিপদ আর স্ত্রীকে এনে রেখেছেন কলকাতায়। অনুষ্ঠানের পাশাপাশি একটু একটু করে বাড়িতেই তালিম দিচ্ছেন ছেলেমেয়েদের।
একে একে প্রভাবতী’র গর্ভে জন্মাচ্ছেন পুত্র মানস, কন্যা শ্রীলা, কল্পনা ও সুশ্রী। আসরে তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকছে ভাইপো বিমলেন্দু।
আর কিছু দিন পর খুদে মানস ও শ্রীলা দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করছে জনসমক্ষে। তারাপদ বিস্তৃত হচ্ছেন ক্রমশ... তৈরি হচ্ছেন সঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বে পরিণত হবার জন্য। 
অজস্র বাংলা গান লেখার পাশাপাশি তারাপদ সৃষ্টি করছেন নতুন রাগ –‘ছায়াহিন্দোল’। সে রাগ এত জনপ্রিয় হচ্ছে যে সব ক’টি আসরে শ্রোতাদের অনুরোধে গাইতেই হচ্ছে।
যে মানুষটা শহরের রোয়াকে রাত কাটিয়েছেন, কেবল গানের জোরে একখানা তিনতলা বাড়ি বানাচ্ছেন তিনি লেক গার্ডেন্সে, আদরের সঙ্গে শাসন করছেন গানবাজনার কলকাতাকে। আর বিশালকায় সেই বাড়ির নামও রাখছেন ‘ছায়াহিন্দোল’।
বড় মেয়ে শ্রীলা এ বছর ৭০-এ পা দিলেন। কিন্তু ছোটবেলার স্মৃতি আজও স্পষ্ট তাঁর মনে।— ‘‘চোখ বুজলে এখনও তানপুরার আওয়াজ শুনতে পাই। সারাদিন আমাদের বাড়িটা গানের গন্ধে ম ম করত। বাবা কখনও আমাদের আলাদা করে ডেকে তালিম দিতেন না, আমরাই ক্লাসে এসে বসতাম। আজও কান পাতলে বাবার গলার সা অবিকল শুনতে পাই।’’
ওদিকে পণ্ডিত মানস চক্রবর্তী’র এক সাক্ষাৎকারে পাচ্ছি— ‘‘বাবা বিশেষ কোনও ঘরানার ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকেননি। রাগরূপ এবং বাণীর প্রামাণ্যতা বজায় রেখে, ব্যক্তিগত উপলব্ধি এবং সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে নিজের গানে যোগ করেছেন বিশেষ মাত্রা। গভীরতার পাশাপাশি খেয়াল গানকে একটা পূর্ণতা দিয়েছেন বাবা, যা তাঁর আগে এভাবে ছিল না।’’  
কথাটা ঐতিহাসিক ভাবে সত্যি।
একটা সময় পর্যন্ত খেয়াল গাওয়া হত ছোট বা মাঝারি ঘেরে। অনেকখানি সময় নিয়ে বড় পরিসরে বিস্তার, সেই চল কিন্তু তারাপদবাবুর অবদান। সে সময় আর কেউ এ ভাবে বড় খেয়াল গাইতেন না। যে কারণে অল ইন্ডিয়া কনফারেন্সে তারাপদ’র গান শোনার পর খোদ পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার গান আমাদের জন্য। সবার জন্য নয়।’’
আবার মানসবাবুর স্মৃতিচারণায় পাচ্ছি, ১৯৫০-এ দার্জিলিং-এর এক কনফারেন্সে গাইতে গিয়ে উস্তাদ বড়ে সুলাম আলি খানের সঙ্গে দেখা তারাপদবাবুর। দু’জনেই পরস্পরের অনুরাগী। আরেকটি অনুরাগও অবিশ্যি ছিল। তারাপদবাবু যেমন ধূমপান ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে পারতেন না, তেমনই মদ্যপান ছিল বড়ে গুলাম-এর প্রিয় নেশা।
তারাপদবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘এত মদ্যপান করেন কেন? বিনা মদ্যপানেই তো আপনার গলায় এমন সুর বসে রয়েছে।’’
উত্তরে বড়ে গুলাম হেসে বলেছিলেন, ‘আপনি বুঝবেন না তারাপদবাবু। বিনা সুরায় সুরের ভেতর ঢুকে পড়া খুব কঠিন কাজ। ওটা আপনার মতো সচ্চা কলাকারের পক্ষেই সম্ভব।’’
১৯৭২, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির ফেলো নির্বাচিত হওয়ার পরে বেগম আখতারের সঙ্গে, পিছনে গিরীশ কারনাড (ডান দিকে)
এত মানুষের উদার কুর্নিশ যিনি পেয়েছেন, তিনি কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির আওতার বাইরেই থেকে গেলেন চিরকাল। নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতে পারলেন না, মর্জির বাইরে গিয়ে মনোরঞ্জন করতে পারলেন না, পারলেন কেবল একরোখা শিরদাঁড়াটা টানটান রেখে গান গেয়ে যেতে। তাই শেষমেশ একটা কড়া চিঠি লিখতেই হল তাঁকে, মৃত্যুর ঠিক আগের বছরেই। — ‘‘অন্যায়ের সমর্থন আমি কোনও দিন করেছি বলে আমার মনে পড়ে না, এবং সত্যের জন্য আমাকে অনেক যায়গা থেকেই সরে আসতে হয়েছে। আজ পর্যন্ত পশ্চিম বাঙলার কোন বাঙালী উচ্চাঙ্গ কণ্ঠ সঙ্গীত শিল্পীকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয়নি, কেন জানিনা। আজ থেকে বহুপূর্বে যা পেলে গ্রহণযোগ্য হতো তা এই জীবন সায়াহ্নে পেয়ে আমি এতটুকু উৎসাহ বা আনন্দ পাচ্ছি না বরঞ্চ ক্ষোভ হচ্ছে, এই কথা ভেবে যে আমাকে এ সময়ে পদ্মশ্রী দেওয়ার অর্থ আমাকে এবং সেই সঙ্গে সমস্ত সঙ্গীত জগতকে অপমান করা। তাই ভারত সরকার প্রদত্ত রাষ্ট্রীয় সম্মানসূচক এই পদ্মশ্রী উপাধি আমার পক্ষে গ্রহণের অযোগ্য এবং অসম্মানজনক মনে হল এবং আমি সানন্দে প্রত্যাখ্যান করলাম।’’
৭৪ সালের ৪ জানুয়ারি এই চিঠি লিখেছিলেন তারাপদবাবু। আর এই চিঠিই আজও তাঁর সম্মানকে অন্য চিলেকোঠায় বাঁচিয়ে রেখেছে। স্বয়ং বাবা আলাউদ্দিন যাঁকে ‘ভারতের রত্ন’ বলে সম্বোধন করেন, তাঁর পক্ষেই সম্ভব এভাবে হেলায় পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া।
•••
আর পাঁচ মিনিট।
কথাটা মুখে বললেন না তিনি, বলার শক্তি নেই আর। হাত তুলে পাঁচ আঙুল দেখালেন। এই পৃথিবীতে পাঁচ মিনিট আছেন আর।
সেটা ১৯৭৫ সাল। দিনটা পয়লা সেপ্টেম্বর।
ক’দিন ধরেই বেশ ভুগছিলেন ৬৬ বছরের শীর্ণকায় মানুষটি। খুব ইচ্ছে ছিল বড় মেয়ের হাতের লুচি বেগুনভাজা খাবেন। বড় কন্যাটি তখন ৭ মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা, এক ডাকে ছুটে এসেছেন বাপের বাড়িতে। দু’দিন আগেই তাঁর হাতের রান্না তৃপ্তি করে খেয়েছেন বাবা। তখনও ভাল দেখাচ্ছিল। কিন্তু আজ যেন একটু বেশিই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
একমাত্র ছেলে ডাক্তার ডাকতে যাবেন, এমন সময় হাতের ইশারায় তাঁকে আটকে দিলেন শয্যাশায়ী বাবা। শেষ পাঁচ মিনিটে পরিবারের সকলকে কাছ থেকে দেখে যেতে চান তিনি। 
সকলে তাঁর বিছানার চারপাশে উৎকণ্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে। আরেকবার হাত তুললেন তিনি। এবার তিনখানা আঙুল। আর তিন মিনিট।
এ কেমন অলৌকিক কাউন্টডাউন?
ছেলে বারণ শুনলেন না, খবর দিলেন ডাক্তারকে। ডাক্তার এলেনও। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ইশারায় তিন মিনিট দেখানোর কাঁটায় কাঁটায় তিন মিনিট পরই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন বাবা। চিরতরে চলে গিয়েছেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী।
আজকের প্রজন্ম তাঁকে মনে রেখেছে কিনা, সে প্রশ্ন অবান্তর। না রাখলে ব্যর্থতাটা তাদেরই। তবে ছায়াহিন্দোল নামের বাড়ির বারান্দাটায় আজও যখন হাওয়া দেয়, তখন ধুলোর বদলে সুর উড়ে আসে। তারাপদর, মানসের, শ্রীলার... আপসহীন এক গাছ আর তার ডালপালাদের ছায়া পড়ে থাকে সেখানে। রোয়াক থেকে তিনতলার বিরাট ছাদের যে সফর, ভূপালি থেকে যোগিয়ায় জেগে থাকে যে রাত, তার শেষে কিছুই আর চাওয়ার ছিল না উদাসীন এই শিল্পীর। কেবল বড় মেয়ের সন্তানকে দেখে যেতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন তৃতীয় প্রজন্মের কানে একবার ‘সা’ বলে যেতে।
পারেননি, কিন্তু আমি আজও চোখ বুজলে তাঁর একরোখা সেই ‘সা’ শুনতে পাই। তিনি চলে যাওয়ার সাড়ে তিনমাস পর ৭৫-এর ডিসেম্বরেই জন্ম হয় আমার। সেই শিকড়ই আঁকড়ে রেখেছি আজও। ভিড়ের কলকাতা পার হতে হতে আজও আমাকে টান মারে রাতজাগা এক তানপুরা, যার চারটে তারে আমাদের সকলের জীবন বেঁধে নিচ্ছেন সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী।
কে জানে, আজ কী রাগ শোনাবেন...

(চিঠির বানান অপরিবর্তিত)
ছবি সৌজন্য: শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী

http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/write-up-on-sangitacharya-tarapada-chakraborty-by-srijato-1.301983

‘আশীর্বাদ’-এর দেবদাস (On Rajesh Khanna)

$image.name

‘আশীর্বাদ’-এর দেবদাস

বারবার ঈর্ষা করেছেন অমিতাভ বচ্চনকে। অপমানে বিদ্ধ করেছেন প্রযোজক থেকে সাংবাদিকদের। শেষ জীবনটা তিনিই কাটিয়েছেন এক নিঃসঙ্গ সম্রাটের মতো। রাজেশ খন্না। লিখছেন গৌতম ভট্টাচার্য

১৬ জানুয়ারি, ২০১৬, ০০:০৩:০০
  
 
1
মুম্বইয়ের বিখ্যাত সাংবাদিক। বর্তমানে স্টার স্পোর্টস-এর কমেন্টেটর আয়াজ মেনন সে দিন কর্মজীবনের সব বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতে রাজেশ খন্নার কথা তুলল।
আয়াজ তখন ‘বোম্বে টাইমস’-এর এডিটর। এমন পজিশন যে শাহরুখ থেকে আমির— সবাই সম্পর্ক ভাল রেখে চলবে।
এক দিন হঠাৎ রাজেশের এক বন্ধু ওকে ফোন করে বলল, ‘‘রাজেশ কথা বলতে চান। আপনি যদি এর মধ্যে সন্ধেয় একবার ‘আশীর্বাদ’-এ আসেন।’’
‘আশীর্বাদ’ মুম্বই শহরে এক কথায় সবাই চেনে। কার্টার রোডে রাজেশের বিখ্যাত বাংলো। নির্দিষ্ট দিনে সেখানে গিয়ে আয়াজ রীতিমতো বিস্মিত। ওর ধারণা ছিল রাজেশ নিশ্চয়ই ওয়ান অন ওয়ান কথা বলতে ডাকছেন। এমন একটা মজলিশের মধ্যে ডেকে কেউ জরুরি কথা বলে নাকি। মজলিশের চেহারাটাও এবড়োখেবড়ো। রাজেশ এবং বাকিরা। রাজেশ তখন এমপি। কিন্তু এমপি হলে কী হবে বলিউডের মধ্যগগন থেকে অস্তে যাওয়ার হতাশা তো আর কাটছে না। কয়েক পেগের পর নেশাও তখন চড়েছে। রাজেশ বলতে শুরু করলেন, ‘‘আপনারা জার্নালিস্টরাই মাথায় চড়িয়েছেন অমিতাভ বচ্চনকে। ও কোনও অভিনেতা হল! আম পাবলিকও ওর চেয়ে ভাল অভিনয় করে।’’
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল কী ট্র্যাজিক জীবন। সব কিছু থেকেও সম্রাটের মতো সিংহাসন থেকে বিতাড়িত। আর যাঁর জন্য বিতাড়িত, তাঁকে জীবনভর ক্ষমা করতে পারেননি।
ধর্মেন্দ্র কখনও রাজেশের জায়গায় ছিলেন না। কিন্তু তাঁর অমিতাভ সম্পর্কে মূল্যায়নও তো নেগেটিভ। সম্ভবত একই কারণে নেগেটিভ। আমাকে একটা ইন্টারভিউ-এর মাঝে বলেছিলেন, ‘‘অমিতাভের সব কিছু তো মিডিয়াকে ম্যানেজ করে। এই তো আমি এলাম, কলকাতা এয়ারপোর্টে তেমন কোনও ভিড় নেই। অথচ অমিতাভ যে দিন নামল, কী ভিড়। আমায় বলুন তো লোকে আগে খবর পেয়ে গেল কী করে? নির্ঘাত মিডিয়ার মাধ্যমে। মিডিয়া কেন খবরটা দিল? না ওদের নিশ্চয়ই কিছু দেওয়া হয়েছে।’’
ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে মিডিয়ার সম্পর্ক অতীতে মোটেও ভাল যায়নি। সাংবাদিককের সঙ্গে অসংখ্যবার ঝামেলায় জড়িয়েছেন তিনি। মহিলা রিপোর্টারও তাঁর বদমেজাজের শিকার হয়েছেন।
অথচ সেই সময়ের সাংবাদিকদের মধ্যে যদি ভোট নেওয়া হয় কাকে মানুষ হিসাবে প্রেফার করেন? ধর্মেন্দ্র না রাজেশ? দশজনে ন’জন বলবেন ধর্মেন্দ্র। দশে দশও হয়ে যেতে পারে।
বান্দ্রার এক বিখ্যাত বাড়ির দোতলায় বসে গত বছর একটি সর্বভারতীয় কাগজের সিনিয়র ফিল্ম লিখিয়ে মীনা আয়ার তাঁর করুণ অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। আশির দশকে রাজেশকে তিনি ইন্টারভিউ করতে গেছিলেন। রাজেশ আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছি বলে ঘোরাতে থাকেন।
এভাবে সতেরো দিন তিনি ঘুরিয়েছেন। সতেরো নম্বর দিনে ফোনে বলেন, ‘‘আজ হচ্ছেই। কোনও চিন্তা কোরো না।’’
মীনা তাঁর বাংলোয় বসে সবে টেপ রেকর্ডার বার করেছেন, এমন সময় এক চামচে এসে বলল, ‘‘সাহেব আপনাকে জানাতে বলেছেন আজ ইন্টারভিউ হচ্ছে না।’’
এ বার সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন মহিলা সাংবাদিক। আর সহ্য হয়নি তাঁর। হাউ হাউ করে তিনি কাঁদতে থাকেন। সেই কান্না শুনে ওপর থেকে ছুটে আসেন রাজেশ এবং তাঁর তখনকার সঙ্গিনী টিনা মুনিম।
‘‘কী আশ্চর্য স্যাডিস্ট জানেন? আমার ওই অবস্থায় তখনও ওরা হাসছিল,’’ ক্রুদ্ধ, উত্তেজিত গলায় বলেন মীনা। গল্পটা তিনি আমাকে শোনাচ্ছিলেন না। যাঁকে শোনাচ্ছিলেন গ্যালাক্সি অ্যাপার্টমেন্টের দোতলায় বসা সেই প্রৌঢ় সব শুনেটুনে থমথমে গলায় বললেন, ‘‘বেয়াদ্দপি। কমপ্লিট বেয়াদ্দপি। আমরাও এই সব দেখেটেখে ওর সঙ্গে কাজ করা বন্ধ করে দিই। অথচ তার আগে কী সব সুপারহিট একসঙ্গে করেছি। ‘হাতি মেরা সাথি’, ‘আন্দাজ’।’’
প্রৌঢ়ের নাম সেলিম খান। বিশিষ্ট প্রোডিউসারদের মতো এই মহাতারকা সংলাপ লিখিয়ে জুড়িও সরে যান। রাজেশ থেকে প্রবেশ করেন অমিতাভের জীবনে।
সেলিমের বাড়িতেই পেয়ে গেলাম সাদা চুল, তীক্ষ্ণ চাউনির এক ভদ্রলোককে। বললেন, ‘‘আমি ছিলাম রাজেশের ম্যান ফ্রাইডে। একটা সময়ের পর আর পারিনি। কাজ ছেড়ে দিই। এখন বহু বছর আমি সেলিম সাবের সঙ্গে।’’ ভদ্রলোকের নাম প্রশান্ত রায়।
সেলিমের বাড়ি সফরের উদ্দেশ্য কিন্তু ফিল্মকেন্দ্রিক লেখালেখি ছিল না। বরঞ্চ ক্রিকেটকেন্দ্রিক। ‘সচ্’ লেখার জন্য তখন আমার বিনোদন জগতের কিছু ইনপুটস চাই।
সচিন ভারতের এমন সব রূপকথাসদৃশ আবেগ যে চমকপ্রদ সবাই এক কথায় রাজি। লতা রাজি, আশা রাজি, দেব আনন্দ রাজি। দিলীপকুমার তো বইয়ের মুখবন্ধই লিখে ফেললেন। নব্বই ছুঁই ছুঁই তখন তিনি। ক্রমাগত বাড়ি-হাসপাতাল করে যাচ্ছেন। তবু সাত দিনের মধ্যে সায়রা বানু নিজে উদ্যোগ নিয়ে লেখা মেল করে দিলেন। মান্না দে রি-অ্যাকশন দিলেন অমন অসুস্থ অবস্থায় দূর বেঙ্গালুরু থেকে। আমিরেরটার জন্য সচিন বলল, ওটা আমি করিয়ে দেব। শাহরুখ-অমিতাভেও সমস্যা নেই। সুস্মিতা-ঐশ্বর্যা রাই হয়ে গেল।
সমস্যা একমাত্র রাজেশ খন্না। প্রথম দিন বললেন, ‘‘দেবো।’’ সাত দিন পর আবার ফোন করলাম ওঁর নম্বরে। ধরে বললেন, ‘‘বিজি আছি। ওটা বলব।’’
কয়েক দিন বাদে রাজেশের নম্বর থেকে আমার মোবাইলে ফোন। গাড়িতে তখন। ধড়ফড় করে উঠে কাগজ অর্গানাইজ করে ফেললাম। ফোন ধরে নোট নিতে হবে তো। হ্যালো, হ্যালো।
শুকনো গলায় রাজেশ বললেন, ‘‘কিছু না। হাত লেগে গিয়েছিল।’’ এর পরও আরও দু’দিন একই জিনিস ঘটল। লাস্ট দিন তো হ্যালো, হ্যালো বলে কোনও সাড়াই পেলাম না।
সময়টা দু’হাজার এগারো-র জানুয়ারি। ‘আশীর্বাদ’-এ তখন মিডিয়ার যাতায়াত নেই। ইন্ডাস্ট্রির কারও সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই। মনে হল বহু দিন বাদে কোনও সাংবাদিকের ফোন পেয়ে একটু পুরনো অভ্যাসে তার মজা লুটলেন।
এই সে দিন কৌতূহলবশত মনে হল, নম্বরটায় একটু ফোন করে দেখি না, আদৌ আছে? নতুন কারও কাছে গিয়েছে? গেলে আজকের দিনে কে ব্যবহার করছেন রাজেশ খন্নার ফোন?
ফোন ধরলেন এক মহিলা, কে আপনি? পরিচয় দিলেন অনিতা।
দ্রুত মাথায় খেলে গেল, ইনিই কি তা’হলে অনিতা আডবাণি, যিনি জীবনের শেষ ক’বছর টানা রাজেশের সঙ্গে ছিলেন? এঁর সঙ্গেই কি ডিম্পল-অক্ষয় কুমারদের মামলা-মকদ্দমা চলছে রাজেশের সম্পত্তি নিয়ে?
জানা গেল ইনিই তিনি। এর পর যা কথা হল তুলে দিচ্ছি।
‘‘আপনি কি ‘আশীর্বাদ’ থেকে বলছেন?’’
‘‘না, ‘আশীর্বাদ’ কোথায়! সে বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। শশীকিরণ শেঠি বলে একজন ভদ্রলোক কিনেছেন।’’
‘‘বিক্রি হল কী করে? বাড়ি নিয়ে তো মামলা চলছিল।’’
‘‘সেটাই তো কমপ্লিট আদালত অবমাননা। তাই আমি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছি। ওরা আমার পিটিশন গ্রহণও করেছে। কী নোংরা ব্যাপার বলুন তো! মানুষটা এত করে চেয়েছিল ওর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটা একটা মিউজিয়াম হোক। ওর জিনিসপত্র থাকুক। ছবি থাকুক। লোকে ঘুরে ঘুরে দেখুক, ভারতীয় সিনেমার প্রথম সুপারস্টারকে। কাকাজির এটা প্রাপ্যও ছিল। অথচ কাকে না কাকে ওরা বাড়িটা বেচে দিল। জাস্ট টাকার লোভে। ’’
‘‘শেষ ক’টা বছর ইন্ডাস্ট্রির কার কার সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ ছিল?’’
‘‘কারও সঙ্গে না। উনি সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।’’
‘‘কেন?’’
‘‘মানুষটা এমনিতেই ‘লোনার’ ছিলেন। নিজের ছোট গোষ্ঠী নিয়ে থাকতেন। খালি বসে বসে ভাবতেন, কী ভাবে ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। ভাবতেন কিছু বিশ্বাসঘাতকতার কথা। আমার মনে হয়, ওঁর বোধ হয়, ঘেন্না ধরে গিয়েছিল অনেকের ওপর। তাই কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন না।’’
‘‘টিনা ওঁকে ছেড়ে গেছিলেন কেন?’’
‘‘কারণ টিনা ওঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কাকাজিও রাজি ছিলেন। কিন্তু ডিম্পল ডিভোর্স দিল না। ডিম্পল বলল, সমস্ত সম্পত্তি আমার নামে লিখে দাও, তা হলে তোমায় ছেড়ে দেব।’’
‘‘সেটা করতে উনি রাজি হননি?’’
‘‘না। উনি আদালতে যাওয়াটাওয়া, পাবলিক কেচ্ছা এ সব চাননি। ভেবেছিলেন শান্তিপূর্ণ ভাবে একটা রফা হয়ে যাবে। আবার উনি সিঙ্গল হয়ে বিয়ে করতে পারবেন।’’
‘‘আপনার সঙ্গে বিয়েটাও হল না কি একই কারণে যে উনি ডিভোর্স পেলেন না?’’
‘‘ইয়েস। ডিম্পল কিছুতেই দিল না।’’
‘‘অমিভাভ বচ্চন কি শেষ দিকে ওঁর ক্লোজ ছিলেন?’’
‘‘একেবারেই না। প্রশ্ন নেই।’’
‘‘তা হলে রাজেশের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অমিতাভ যে সবার আগে ছুটে এলেন। ব্লগ-এ পোস্ট করলেন।’’
‘‘আমি বলব এটা অমিতাভের ভেরি গুড জেশ্চার যে ছুটে এসেছিল। এর আগে কখনও ‘আশীর্বাদ’-এ যায়নি। কিন্তু শেষ সময় তো এল।’’
মুনমুন সেনের সঙ্গে একটা সময় খুব বন্ধুত্ব ছিল রাজেশের। মুনমুন মনে করেন, তাঁর মা আর রাজেশে নাকি অসম্ভব মিল, দু’জনেই মুডি, টেম্পারামেন্টাল, নিজেদের স্টাফেদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় এবং বর্ন স্টার। মুনমুন অনেক সহাভূতির সঙ্গে দেখেন রাজেশকে। তাঁর মনে হয় এই পর্যায়ের প্রতিভাসম্পন্ন মানুষকে সাধারণের ক্যাটাগরিতে ফেলে কাঁটাছেঁড়া করাটা অন্যায়। এঁদের আলাদা একটা অ্যালাউয়েন্স সব সময় দেওয়া উচিত।
ডিম্পল কখনও রাজেশ সম্পর্কে খোলাখুলি মুখ খোলেননি, তাঁর ধনকুবের বাবা চুনীলাল কাপাডিয়া খুব তিক্ত ছিলেন জামাই সম্পর্কে। বলেছিলেন, ‘‘রাজেশের আই কিউ এমন যে ওকে যদি বলা হয় ভারত ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করবে তা হলে ও সেটাকে মুম্বইয়ের রেড লাইট এরিয়ার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে পারে।’’
বছর বারো আগে ডিম্পলকে ইন্টারভিউ করার সময় রাজেশ-প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। ২০০৩-এর নভেম্বর। রাজেশ আর অমিতাভ দুজনেই তখন ষাট পেরিয়েছেন, ইন্টারভিউয়ের শেষে এসে জিজ্ঞেস করি, রাজেশ ছিলেন আপনার স্বামী। কোথায় গিয়ে তফাত হয়ে গেল দু’জনের?
ডিম্পল এক মিনিট চুপ। তার পর বললেন, ‘‘তফাত হয়ে গেল টাইমিং আর ভাগ্যে।’’ শুনে অবাক লাগল। রাজেশ সম্পর্কে এমন দার্শনিক, সহানুভূতিশীল জবাব আশা করিনি বলেই বোধ হয়।
আবার বললাম, ডিম্পল, সাধারণ ধারণা কিন্তু এই যে, দৌড়ে রাজেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ অসংযমী জীবনযাপন। শৃঙ্খলাই কি মহা টক্করে থাকা দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ফারাক করে দেয়নি?
ডিম্পল এতটুকু একমত নন। সামনে ইউনিটের স্পট বয় ঘোরাঘুরি করছিল। তাকে ডাকলেন, ‘‘অ্যা-ই তুমি আজ ক’টায় কাজে এসেছ?’’ সে বলল, দশটা। ‘‘ক’টায় ফিরে যাবে?’’ রাত্তির আটটা। ‘‘কালকেও তাই?’’ কালকেও তাই ম্যাডাম।
ডিম্পল এ বার আমার দিকে তাকালেন, ‘‘শুনলেন তো উদয়াস্ত কী খাটনিটাই না খাটছে। দারুণ ডিসিপ্লিনড। আপনি চাইলে সকাল দশটার বদলে সাতটাতেও চলে আসবে। কিন্তু তাতে কী? বুল শিট, যেমন দিনে একশো টাকা করে পেত, সেটাই পাবে, আসল হল তারকা ভাগ্য। ভাগ্যকে আপনি হারাবেন কী করে?’’
অমিতাভ আর রাজেশে আরও একটা বড় তফাত বোধ হয় করে দিয়েছে মন। সুপারস্টারদের মহাকাশে তুখড় অভিনয় ছাড়াও প্রয়োজন একটা ইস্পাত কঠিন মনের। তাঁদের গ্রহের আবহাওয়া যত খারাপই হোক, বেরিয়ে এসে মনের কথা চাঁচাছোলা করে বার করে দেবে না। বিষ যত বেশি মাত্রার হোক, গিলে নিয়ে মন দেবে নিজের কাজে।
বচ্চন চাইলে একটা মোটা বই লিখতে পারতেন, যার হেডলাইন হবে ‘বিজয়’। উনিশটা ছবিতে তাঁর নাম বিজয়। কিন্তু বইটা হত রাজেশ-বিজয়ের ওপর। কী একটা প্রবল শক্তিশালী সাম্রাজ্য, যার ভিত ছিল ১৯৬৯-৭১ এই তিন বছরে সুপারহিট হওয়া পনেরোটা ছবি, তাঁকে পরাস্ত করলাম। করে গড়লাম নতুন সাম্রাজ্য। মার মার কাট কাট বিক্রি হবে সেই বইয়ের।
আজও খোলাখুলি বলতে পারেন ‘গুড্ডি’র সেট থেকে শুরু করে ‘নমকহারাম’-এর ফ্লোর— সর্বত্র তাঁকে কী ভাবে চূড়ান্ত অপমান করেছেন সেই সময়কার সুপারস্টার।
অমিতাভ মুখই খোলেননি। উল্টে সাংবাদিক রউফ আমেদ লিখেছেন, ‘‘শোল-এর শ্যুটিংয়ে জোর আড্ডা হচ্ছে। ধর্মেন্দ্র, হেমা, সঞ্জীবকুমার, জয়া, অমিতাভ, আমজাদ। বিষয় রাজেশ খন্না। সবাই তুলোধনা করছেন রাজেশকে। একমাত্র অমিতাভ কিছু বলছেন না। তখন জয়া খোঁচালেন, ‘কিছু তো বলো।’’’ অমিতাভ ঘাড় নাড়লেন, কিছু বলতে চান না। আবার তাঁকে বলা হল। উত্ত্যক্ত বোধ করা অমিতাভ তখন চেয়ারটা সরিয়ে একটু দূরে গিয়ে বসলেন।
সেলিম জ্যোতিষচর্চায় ঘোর বিশ্বাসী মানুষ। তিনি মনে করেন, মানুষের জীবনে সময় আসল। রাজেশের জীবনে সাফল্য এসেছিল অদৃষ্টের আপন নিয়মে। আবার চলেও গেল আপন নিয়মে।
তিনি অবশ্য এটুকু মেনে নিতে রাজি আছেন যে ভাল যাওয়া সময়েও লোকে বাড়তি পরিশ্রম করেটরে সাফল্যের ওপর বাড়তি একটা পালিশ তৈরি রাখতে পারে। রাজেশ যা একেবারে করেননি। তিনি সাফল্যের ওপর বুঁদ হয়ে বসে গড়গড়া টেনেছেন। কলকাতার পুরনো বাবুদের মতো। বোঝেননি সময় আর পরিস্থিতি কোনওটাই চিরন্তন নয়।
‘আশীর্বাদ’ একটা সময় গান-হাসি-মশকরাতে টইটম্বুর থাকত। কিশোরকুমার নিয়মিত আসতেন, আরডি আসতেন। তখন কিশোরের গলায় রাজেশের গান আর রাহুলদেবের সুর দুর্দান্ত বক্স অফিস ছিল। রাজেশ খুব ভালবাসতেন আরডি-কে। বলতেন, ‘‘পঞ্চম মেরা কলিজা হ্যায়।’’ রাত্তির ন’টা হত কী রাজেশ হাঁক মারতেন বাড়ির কাজের লোকেদের, ‘‘শক্তিদা আ রহে হ্যায়। মেরা ট্রে রেডি করো।’’ ট্রে মানে, ট্রে-তে অবশ্যই মদের গ্লাস আর হুইস্কি।
‘আশীর্বাদ’-এ ভিড় করে থাকত বাঙালিদের গ্রুপ। শক্তি সামন্ত, কিশোরকুমার, শর্মিলা, দুলাল গুহ, অসিত সেন। এঁদের সংসর্গ রাজেশ খুব উপভোগও করতেন। বাঙালি সেই গ্রুপের আস্তে আস্তে আগমন বন্ধ হয়ে গেল। কিশোর মারা গেলেন। আরডি চলে গেলেন বছরখানেক বাদে। সেই জায়গায় ঢুকে পড়ল কিছু ব্যর্থ পঞ্জাবি অভিনেতা এবং দ্বিতীয় শ্রেণির প্রযোজক।
প্রশান্ত রায়ের মতে, এরাই আশীর্বাদ-এর ডিসিপ্লিন নষ্ট করে দিল। পঞ্জাবি গ্রুপটা ক্রমাগত রাজেশকে তেল দিয়ে যেত এই বলে যে, ‘‘পাপে তুসি তোপ হো।’’ মানে, বাবা, তুমি সত্যিই আগুন।
ডিম্পল যখন দুই মেয়েকে কোলে করে বাংলো ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখনও এরাই রাজেশকে সমানে বলে গিয়েছে, ‘‘কাকাজি, আপ ভগবান হ্যায়, এক ডিম্পল গ্যয়ি, পাঁচ ঔর আয়েগি।’’
জ্যোতিষে বিশ্বাস, অনিশ্চিত এই ইন্ডাস্ট্রির খুব কমন ব্যাপার। কিন্তু রাজেশ জ্যোতিষের দাবি মেনে সময় সময় যা করেছেন তাকে হঠকারিতা ছাড়া কিছুই বলা যায় না। শেষ দিকটায় আসলে সাফল্য ফেরত পাওয়ার জন্য দুঃসাহসী হয়ে গিয়েছিলেন।
স্টারডম ফেরত পাওয়ার লক্ষ্যে এক একজন জ্যোতিষী তাঁকে এক একরকম পরামর্শ দিতেন। কেউ বলতেন, বাড়িতে বিশেষ ধরনের মার্বল লাগালে তাঁর ভাগ্য ফিরবে, কেউ বলতেন, বাড়িতে বিশেষ কোনও আংটি।
একবার এক জ্যোতিষী নাকি এসে বলেন, আশীর্বাদ-এর বাইরের ঘরে মার্বল লাগানোর জন্য এই অবস্থা। দ্রুত সেটা তুলে ফেলা হল। তাতেও ভাগ্য ফিরল না। আবার লাখ লাখ খরচা করে সেটা লাগানো হল। আশেপাশের লোকজনের যা নমুনা ছিল তাতে তারা যে কেউ সৎ পরামর্শ দিতে পারবে এমন অবশ্যই নিশ্চয়তা ছিল না। বলিউডের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহানায়ক ক্রমশ ডুবতে থাকেন হতাশা থেকে আরও হতাশায়।
মুম্বইয়ের বিখ্যাত ট্রেড অ্যানালিস্টের সে দিন লেখা দেখছিলাম যে, আশির দশকে রাজেশ খন্নার বেশ কিছু ফিল্ম ভাল ব্যবসা করে ছিল। যেমন, ‘সৌতিন’, ‘বেবফাই’, ‘আজ কা এম এল এ রাম অবতার’। পঁচাশিতে রাজেশের এগারোটা ছবি রিলিজ হয় যার মধ্যে আটটা হিট। তাঁর চির প্রতিদ্বন্দ্বী দীর্ঘতর হিরো তখন স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিদেশে। নিউইয়র্কে ছোট ওয়ান রুম অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। রাজেশের প্রতিদ্বন্দ্বী তখন অনিল কপূর।
সময়টা ভাল কাটছিল তাঁর, ব্যক্তিগত জীবনেও টিনা মুনিম এসে গিয়েছেন। তবু ‘আশীর্বাদ’-এ প্রতি রাত্তিরে তিনি হা হুতাশ করতেন, সেই সময়টা তো আর ফিরল না।
ভাল সময়ে ঠিকঠাক বন্ধুবান্ধব তৈরি হলে তারা বিপদের দিনে আশীর্বাদ হিসেবে হাজির হয়। কিন্তু ‘আশীর্বাদ’বাসীর জীবনে তাদের খোঁজ কোথায়? এত সব সফল ছবির যিনি জুড়ি, সেই শর্মিলার সঙ্গেই কোনও সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয় না। উত্তম আর রাজেশের মধ্যে রোম্যান্টিক নায়ক হিসাবে কে আগে, তুলনা করতে বলায় শর্মিলা বলেছিলেন, ‘‘অবশ্যই উত্তম।’’
আমার টেপ রেকর্ডারে আজও ধরা রয়েছে তেরো বছর আগে নেওয়া সেই ইন্টারভিউ…‘‘অভিনেতা হিসেবে উত্তম অনেক বেটার। বেশি সিনসিয়ার। বেশি সৎ। বেশি রিয়্যাল। রাজেশের মধ্যে একটু গ্যালারি নেওয়ার প্রবণতা ছিল। আমরা  হয়তো সবাই কমবেশি সেটাই করেছি। রাজেশ অসম্ভব জনপ্রিয়ও হয়েছিল। কিন্তু উত্তমের রেঞ্জটা অনেক বেশি ছিল। একটা দৃশ্যের এক্সপ্রেশন কত বিভিন্নভাবে উনি দিতে পারতেন…।’’
আজও সেই সময়কার রাজেশ ঘনিষ্ঠরা দোষারোপ করেন দু’জনকে। প্রয়াত চরিত্রাভিনেতা ওম শিবপুরী আর ভিলেন রঞ্জিত। রাজেশ নাকি সারাক্ষণ এই দুজন পরিবৃত থাকতেন।
তাঁর খুব পরিচিতদের কাছে আজ রাজেশ-কাহিনি শুনলে আশ্চর্য লাগে। তাঁর পিক টাইমে ‘আশীর্বাদ’-এ সর্বক্ষণই কোনও না কোনও কাজ হত। হয় মিস্ত্রি কিছু করছে বা ফার্নিচারওয়ালা কিছু লাগাচ্ছে। শোনা যায়, সেই মিস্ত্রিরা রুটিতে ঘি ঠিকমতো লাগিয়ে খাচ্ছে কিনা, তারও তদারকি করতে বলতেন রাজেশ। ডিসকাউন্টে কোনও কিছু কেনা ছিল তাঁর অপছন্দ। বলতেন, ‘‘রাজেশ খন্না পুরো টাকা দিয়ে জিনিস কেনে, ডিসকাউন্ট-ফিসকাউন্টের চক্করে ঘোরে না।’’
একই সঙ্গে কী কনট্র্যাডিকশন আর কী সীমাহীন ঔদ্ধত্য!  যে মানুষটা মিস্ত্রিদের রুটিতে ঘি লাগানো রয়েছে কিনা প্রয়োজনে তার খোঁজখবর করেছেন, তিনিই কিনা মিডিয়াকে কুকুর বেড়ালের মতো তাচ্ছিল্য করেছেন। প্রডিউসারকে দিনের পর দিন বসিয়ে রেখেও দেখা করেননি।
জানতে ইচ্ছে করে, রাজেশ এত জ্যোতিষী দেখিয়েছেন, কখনও মনোবিদের কাছে গিয়েছেন কি? এক এক সময় তো মনে হয়, তিনি ছিলেন ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড।
সাধারণ ভাবে হিসেব করতে বসলে মনে হয় গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান নয়, রাজেশকে চুড়ো থেকে বেস ক্যাম্পে ছিটকে ফেলে ছিল জাগতিক কিছু কারণ।
• সাফল্যে আত্মহারা হয়ে পড়া
• চামচে পোষা
• ঔদ্ধত্য
সুপ্রিয়াদেবী যেমন আজও মনে করেন, চামচেরাই সর্বনাশ করেছিল উত্তমের। সর্বক্ষণ তারাই সব ভুল পরামর্শ দিত। এদের ইন্ধনেই নাকি রাজকপূরের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের রাস্তায় গেছিলেন উত্তম।
সমস্যা হল রাজেশের এমনই ইগো যে বুঝতে চাননি সময় বদলাচ্ছে। দেশ বদলাচ্ছে, দর্শকের রুচি বদলাচ্ছে। খালি বলতেন, ‘‘এই লম্বু অভিনয় জানে না, সে কত দিন আর থাকবে?’’ চামচেরাও বলত, স্যার পড়ে গেল বলে। আরও পেগ ঢেলে দিত আর বলত, ভারতবর্ষের একমাত্র সুপারস্টার আপনিই। জীবিত বা মৃত। সেই ‘আনন্দ’-এর সময় থেকেই অমিতাভকে তিনি ব্যঙ্গ করতেন, ‘হ্যাঙ্গার সে লটকতা হিরো’ বলে। জয়াকে বলেছিলেন, ‘এই মালের সঙ্গে প্রেম করো কী করে?’
ওদিকে অমিতাভকে তাঁর বাবা বলে দিয়েছিলেন, কোনও বাড়ির ভেতরে যদি ওঠার চেষ্টা করে দ্যাখো ফ্রন্ট গেটে তালা, তখন পাঁচিল টপকে ঢুকবে। তাঁর আগমনের সময়ে ইন্ডাস্ট্রিতে তো সেই অবস্থাই জারি ছিল। রাজেশ বহাল তবিয়তে মানে ফ্রন্ট গেটে তালা। তবু অমিতাভ যে লাফিয়ে ঢুকে পড়তে পেরেছিলেন তার একটা কারণ যদি তাঁর নিজের কৃতিত্ব হয়, অন্যটা রাজেশের মনোভাব। যা পাঁচিলটাকে আরও নিচু করে দিয়েছিল তাঁর প্রতিপক্ষের জন্য।
সাফল্যকে নেওয়ার মনোভাবেও দু’জন এত আলাদা যেন সত্তর দশকের গাওস্কর আর বিশ্বনাথ। গাওস্কর ডাবল সেঞ্চুরির পরের দিনও ব্রেবোর্নে বিজয় মার্চেন্টকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘স্যার, কাল আমার একটা হুক স্কোয়্যার লেগ দিয়ে যাওয়ার বদলে ফাইন লেগ দিয়ে গিয়েছিল, আমার কাঁধটা কি আগেই বাঁ দিকে ঘুরে গেছিল?’’
বিস্ফারিত মার্চেন্ট বলেছিলেন, ‘‘আমি এটুকু বলতে পারি তুমিই ভারতের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান।’’
বিশ্বনাথ হলে? সেঞ্চুরি করুন, পঞ্চাশ বা জিরো, রাত্তিরে ব্ল্যাক লেবেল লাগবেই, দিনের বেলা বিয়ার। এমনও হয়েছে নিউজিল্যান্ডে বালিশের পাশে মদের বোতল নিয়ে ঘুমোতে গিয়েছেন। মদের বোতল পাশবালিশ হলে নাকি ফিলিংসটা অন্যরকম হয়।
অমিতাভ যখন বলেছেন এবং ভেবেছেন, সাফল্য আমার বা অন্যের যারই হোক, এত ক্ষণস্থায়ী যে তা নিয়ে মাতামাতি করার মানে হয় না। তখন রাজেশ পুরনো ছবির পাঁচ বছরের অ্যানিভার্সারি সেলিব্রেশনে পার্টি দিচ্ছেন। একটা বন্ধুও তখন পাশে নেই। যাঁদের যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন সেই শর্মিলা, হেমা, ধর্মেন্দ্র, জয়া, জিনাত এমনকী মুমতাজও নেই। প্রত্যেকে কোনও না কোন‌ও কারণে মানসিক ভাবে আহত হয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।
আর আশীর্বাদ-এর রাজা, তিনি পরের পর রাত মেহফিলে ফুর্তি উড়িয়েছেন। একটু রাত হয়ে গেলে বিষণ্ণ হয়ে পড়েছেন, সোনার দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল? ঝাড়লণ্ঠনের তলায় তাই বারবার ছায়া পড়েছে বিষণ্ণ এক মহানায়কের। যে চক্রব্যূহ থেকে বার হওয়ার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। জীবনটা শেষমেশ তা হলে তাঁর কী? আশীর্বাদ না অভিশাপ? ভাগ্যের বরপুত্র, নাকি শাপভ্রষ্ট রাজপুত্র?
এত সব ধন্য ধন্য ট্র্যাজিক ছবির নায়ক তিনি। কিন্তু রাজেশ খন্নার জীবনের চেয়ে বড় ট্র্যাজিক ফিল্ম সব ক’টা মিলেজুলেও নয়। হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অবিসংবাদী দেবদাস তাঁকেই মনে হয় আমার।
দেবদাস মানে তো শুধুই নারী আর প্রেমে ক্ষতবিক্ষত হওয়া নয়। দেবদাস মুখোপাধ্যায় এক পুরুষের বিয়োগান্ত কাহিনি যে উথালপাথাল আবেগেও নিজের প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। হতাশ প্রেমের আগুনে পুড়তে পুড়তে যে নিষ্ফল মৃত্যুবরণ করে, রাজেশেরটাও বিয়োগান্ত প্রেম। নিজের সাম্রাজ্য ফিরে পেতে চাওয়ার উথালপাথাল করা অভিযানের ব্যর্থ পরিসমাপ্তি। এটাও তো একই রকম রোম্যান্টিক।
সত্তর বছর কয়েক মাস বয়েসে অমিতাভ যখন অলিম্পিকের মশাল নিয়ে লন্ডনের রাস্তায় ছুটছেন, তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী তো পৃথিবীতেই নেই। দিনকয়েক আগে সেই বাড়িতে মারা গিয়েছেন যা তাঁর বৈভব এবং দীনতা একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছে।
মারা যাওয়ার আগে শেষ শব্দ উচ্চারণ করেছেন, ‘‘প্যাক আপ।’’আহা কী সিনেমাটিক, যেমন জীবনে তেমন মরণে।
এই তো সার্থক দেবদাস।

সৌজন্য: ‘তারাদের শেষ চিঠি’,
দীপ প্রকাশন, মূল্য ৩০০ টাকা


http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/special-write-up-by-gautam-bhattacharya-on-rajesh-khanna-1.284294

ধূসর পাণ্ডুলিপি (On Buddhadeb Basu)



বুদ্ধদেব বসু সংখ্যা

$image.name

ধূসর পাণ্ডুলিপি

বুদ্ধদেব বসুর। হাতে এল ৩০ নভেম্বর, তাঁর জন্মদিনে। অনন্য সে-জীবনের জলছবিতে ফিরে গেলেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

৫ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০০:০৩:০০
  
1
বুদ্ধদেব বসুর হঠাৎ চলে যাওয়াতে দুটো আক্ষেপ তৈরি হয়েছিল ওঁর ভক্তদের মধ্যে।
এক, ‘আমাদের কবিতা ভবন’-এর পর তাঁর আত্মস্মৃতিতে যে অংশ আসার কথা ছিল, তা আর এল না।
আর দুই, তাঁর ‘মহাভারতের কথা’র দ্বিতীয় খণ্ডে আর হাত দেওয়া হল না।
‘মহাভারতের কথা’য় মহাপ্রস্থানিক পর্বে এসেছিলেন বুদ্ধদেব, সে-পর্বের সঙ্গে টলস্টয়ের ‘ওয়র অ্যান্ড পিস’ উপন্যাসের বিস্তৃত উপসংহার বৃত্তান্তের তুলনা করেছিলেন।
এর পর দ্বিতীয় খণ্ডে কী প্রসঙ্গ আনতেন ভক্তদের ধারণা নেই।
কিন্তু আত্মস্মৃতির পরের অংশ এলে?
ভোজ, ভূরিভোজ, ব্যাঙ্কোয়েট! তিনি লিখবেন নিজেকে নিয়ে, আর তারই মধ্যে পাঠক প়ড়ে নেবে কিছুটা কিছুটা বাঙালির ইতিহাস। তাঁর অতীব স্বাদু ও সূক্ষ্ম গদ্যে বর্ণিত দৃশ্যগুলো হবে ক্যামেরাবন্দি মুহূর্তের মতো। স্ন্যাপশটস্!
যেমন, শান্তিনিকেতনে শেষ বয়েসের রবীন্দ্রনাথকে দেখে বুদ্ধদেবের মনে এসেছিল শেষ বয়েসের টলস্টয়কে।
যেমন, নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেনে উঠেছেন ঢাকার পথে। সঙ্গে স্ত্রী রাণু, মানে প্রতিভা এবং কন্যা মিমি, মানে মীনাক্ষী। কামরায় উঠে বসবার পরেই চোখে পড়ল উল্টো দিকের আসনে বসে নজরুল ইসলাম। কবি জানলা দিয়ে গম্ভীর মুখে বাইরে তাকিয়ে আছেন।
বুদ্ধদেব স্ত্রীকে বললেন, ‘‘রাণু, ওই যে তোমার কাজিদা।’’
প্রতিভা দ্রুত তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘‘আপনি!’’ কবি মুখ ফেরালেন, অনেকক্ষণ প্রতিভাকে দেখে বললেন, ‘‘রাণু?’’
বুদ্ধদেবের শঙ্কা হয়েছিল কবি ঠিক প্রকৃতিস্থ নেই।
যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দেখা যাচ্ছে ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবিতে হাতে গোল্ড ফ্লেক সিগারেটের টিন নিয়ে উদাস চোখে হেঁটে যাচ্ছেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
•••
‘মহাভারতের কথা’ প্রকাশকালে একটা ধারণা চারিয়েছিল বুদ্ধদেব বসুর ভক্তসমাজে। তা হল, তাঁর বইয়ের নায়ক যুধিষ্ঠিরের মধ্যে নিজের সারস্বত জীবনের ছবি দেখছেন বুদ্ধদেব।
বনবাসকালে কী করছেন যুধিষ্ঠির?
না, ক্রমান্বয়ে মুনিঋষিদের সঙ্গে আলাপে, আলোচনয় মগ্ন। তাঁর চরিত্রের ব্যাখ্যায় (পড়ুন সমর্থনে) বুদ্ধদেব লিখছেন—
‘‘যুধিষ্ঠির কোনো মহাপুরুষ নন, আমাদের অনেক ভাগ্য তিনি মানুষ, শুধুমাত্র মানুষ— ইতিপূর্বে এরকম একটি কথা আমি বলেছিলাম। সেই সঙ্গে এ কথাটিও এখন যোগ করা দরকার যে তিনি কোনো দেবতার দ্বারা বিশ্রুতভাবে বরপ্রাপ্ত বা অভিশপ্ত হননি (যেমন হয়েছিলেন অর্জুন ও কর্ণ); তাঁর সব বর এবং অভিশাপ তাঁর নিজের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিলো— সেগুলিকে তিনি কেমন করে স্বীয় চেষ্টায় সমন্বিত ও বিকশিত ক’রে তুলেছিলেন, হ’য়ে উঠেছিলেন সর্বক্ষণসম্পন্ন এক মর্ত্য মানুষ, তারই ইতিহাসের নাম মহাভারত।’’
বুদ্ধদেবের জীবনে যুক্তি-তক্কো-গপ্পের ভূমিকা প্রসঙ্গে খুব সুন্দর মন্তব্য আছে কন্যা মীনাক্ষীর। ‘স্মৃতিতে চিঠিতে বুদ্ধদেব বসু’ বইয়ে লিখছেন—‘‘‘কবিতা ভবন’ ছিল বারোমাসের ‘ওপেন হাউস’। বহু রাত অবধি চলত হাসি-গল্প-তর্ক। মতানৈক্য বাবা শুধু সহ্যই করতেন না, স্বাগত জানাতেন। সেটা ছিল তাঁর কাছে উত্তেজক টনিক ও মননের প্রয়োজনীয় ব্যায়াম।’’
তর্কে জমে যাওয়াটা কদ্দুর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেত বুদ্ধদেবকে তারও একটা সুন্দর গল্প শুনিয়েছেন মীনাক্ষী: ‘‘আমার মেয়ে তিতির (কঙ্কাবতী) বাড়ির প্রথম নাতনি। মার কাছেই সে বেশি সময় কাটাত। একদিন তিতিরের জ্বরজ্বর হওয়াতে ও বাড়ি যায়নি। মা বাবাকে পাঠালেন নাতনির খোঁজ করতে, আমাদের কর্নফিল্ড রোডের ফ্ল্যাটে। বাবা ঢুকেই জ্যোতির (জ্যোতির্ময় দত্ত) সঙ্গে তর্কে জমে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে বাড়ি চলে গেলেন।
নীচে নেমেও দু’জনের কথা শেষ হয় না, আমি পাঁচ তলার ওপর থেকে দেখছি, জল পাঠিয়ে দিলাম, বাবা বার বার জল খান বলে। জলের গ্লাস হাতে নিয়ে খেয়াল হল, চোখ তুলে বললেন, ‘তিতির কেমন আছে রে? তোর মাকে গিয়ে বলতে হবে।’ সে দিন সন্ধ্যায় মা আর আমি মিলে বাবাকে যা বকুনি!’’
•••
আমাদের সৌভাগ্য বুদ্ধদেব বসুর জীবনের অনেক মূল্যবান ছবি আমরা পেলাম ওঁর স্ত্রী, কন্যার রচনায়। বিশেষ করে প্রতিভা বসুর স্মৃতিচারণা ‘জীবনের জলছবি’-তে এমন সব টুকরো টুকরো ঘটনা যা স্বভাবসংবৃত বুদ্ধদেবকে বেশ কাছের, জীবন্ত মানুষ করে তোলে। এমন একটা টুকরো কথা হল বুদ্ধদেবের সঙ্গে প্রতিভার রবীন্দ্রনাথকে দেখতে যাওয়া। বিবরণটা প্রতিভার চিত্তাকর্ষক উপন্যাসিক ভাষাতেই শোনা উচিত—
‘‘আমার বিবাহের কিছুকালের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোতে এসেছেন শুনে বুদ্ধদেব আমাকে নিয়ে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ খুশি হলেন বুদ্ধদেব নববধূ নিয়ে তাঁর কাছে যাওয়াতে। আমি প্রণাম করে মুখ তুলতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। পা নড়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে, দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘মেয়েটিকে তো আমি চিনি গো। তা হলে এই গাইয়ে কন্যাটিকেই তুমি বিবাহ করেছো?’ সামান্য একটু উত্তেজিত হলেই রবীন্দ্রনাথ হাঁটু নাড়াতেন, দাড়িতে হাত বুলোতেন।
বুদ্ধদেব বাড়ি ফিরে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আগেও দেখা হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘আমাকে বলোনি তো!’
‘কী প্রসঙ্গে বলবো। তুমি তো জিজ্ঞাসা করোনি।’
‘এর জন্য প্রসঙ্গ দরকার হয়? জিজ্ঞাসা করার প্রশ্ন ওঠে? রবীন্দ্রনাথকে দেখা শোনা পরিচয় থাকা সবই তো একটা ঘটনা। একটা বলবার বিষয়।’
‘সে তো নিশ্চয়ই।’
‘তবে?’’’
স্ত্রী প্রতিভার যেমন স্মৃতি আছে স্বামীর সঙ্গে রবীন্দ্রদর্শনে যাবার, কন্য মীনাক্ষীর মনে পড়ে বাবার সঙ্গে পথ চলতে মাঝেমধ্যে অল্প সময়ের জন্য জীবনানন্দের সঙ্গে দেখা হওয়ার।
বুদ্ধদেব তাঁর প্রিয় জীবনানন্দকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘নির্জনতম কবি’ এবং ঘোষণা করেছিলেন ‘জীবনানন্দর দৃশ্যগন্ধময় নির্জন কান্তারে’ তিনি আনন্দে বিচরণ করেন। মীনাক্ষী লিখেছেন তাঁর বাবা প্রায় জীবনানন্দের ফেরিওয়ালার কাজ করেছেন।
তো এই নির্জন কবির সঙ্গে পথের সাক্ষাৎগুলো কেমন হত? কন্যা লিখছেন, জীবনানন্দ মানুষ এড়িয়ে চলতেন, ‘‘পথে বাবার সঙ্গে দেখা হলে আমরা থাকলে কথা বলতেন না। চট করে রাস্তা পার হয়ে চলে যেতেন, যদি দেখা যেত রাস্তার ওপারে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তা হলে বাবা রাস্তা পার হয়ে গিয়ে কথা বলে আসতেন।
‘‘আমাদের বাড়ি অবশ্য প্রায়ই আসতেন জীবনানন্দ, সকাল অথবা দুপুরের দিকে, যখন ধরে নেওয়া যায় বাইরের কেউ থাকবেন না। কখনো রিল্যাক্স করে আড্ডা দিতে দেখিনি তাঁকে, দেখিনি বাড়ির কোনো উৎসবে কি নিমন্ত্রণে। কাজের কথা বলেই চলে যেতেন।’’
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত পত্রিকার (‘প্রগতি’, ‘কবিতা’ ও ‘বৈশাখী’) ওপর জীবনানন্দের নির্ভরতা এবং বুদ্ধদেবের জীবনানন্দ মুগ্ধতার এক চমৎকার তথ্য দিয়েছেন সমীর সেনগুপ্ত তাঁর ‘বুদ্ধদেব বসুর জীবন’ বইয়ে। লিখছেন— তাঁর কবিতার সংখ্যা ১৬২ (জীবিত অবস্থায়)। ‘প্রগতি’, ‘কবিতা’ ও বৈশাখী’ মিলিয়ে বুদ্ধদেব বসু প্রকাশ করেছেন তাঁর ১১৪টি। ‘কবিতা’ পত্রিকার সঙ্কলন করার সময় পুরোনো সংখ্যাগুলো পড়তে গিয়ে মীনাক্ষী দেখেছেন এক-এক সংখ্যায় আটটি-দশটি করে জীবনানন্দের কবিতা।
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’-য় জীবনানন্দের উনিশটি কবিতা, যেখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ষোলোটা এবং পঞ্চ কবির কারওরই ষোলোটার বেশি নয়। ‘‘আজীবন বাবা ছিলেন, ’’ মীনাক্ষীর কথায়, ‘‘জীবনানন্দের পরম সুহৃদ ও উগ্র প্রচারক।’’
প্রতিভা বসু তাঁর স্মৃতিচারণায় শ্লাঘার সঙ্গে জানিয়েছেন যে, পরবর্তী সময়ে সেরা কবির দলে আসা প্রায় সকলের লেখাই ‘কবিতা’ পত্রিকা বা কবিতা ভবন থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’ ও সমর সেনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। প্রতিভা লিখছেন, কবিতা ভবনের প্রথম প্রকাশিত বই জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’; দ্বিতীয়টি প্রতিভার গল্পের বই ‘মাধবীর জন্য’।
কবিতা ভবন থেকে যখন ‘এক পয়সায় একটি’ সিরিজ বেরোলো তার কবিতা সম্পাদক হলেন বুদ্ধদেব, গল্পের সম্পাদক প্রতিভা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তা জেনে প্রতিভাকে বললেন, ‘তবে তো আপনার সম্পাদনায় আমার গল্পই প্রথমে যাওয়া উচিত।’
তাই গেল, কিন্তু মানিকবাবুকে সম্মান দক্ষিণা দেওয়া গেল না। প্রতি‌ভা লিখছেন, ‘‘মোটা কাচের চশমার ফাঁকে তাঁর সেই দুই উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি প্রজ্বলিত করে আমাকে ভস্ম করে দিয়ে বললেন, ‘লেখা আমি স্বেচ্ছায় দিয়েছি, টাকার জন্য দিইনি।’
বুদ্ধদেব ও তাঁর বন্ধুবর্গ প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তর কথা এসে পড়বেই। মীনাক্ষীর মতে, পঞ্চাশের দশকে ওঁর বাবার প্রিয়তম বন্ধু ছিলেন সুধীন্দ্র। সুধীন্দ্র বিএ পাশ করেছিলেন। সমস্ত রকম অ্যাকাডেমিক ও সরকারি বাধা অতিক্রম করে বুদ্ধদেব তাঁকে যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে পড়াবার জন্য নিয়ে আসেন। বিভাগের প্রথম কয়েক বছরের ছাত্রছাত্রীরা বুদ্ধদেব ও সুধীন্দ্রনাথকে একই সঙ্গে শিক্ষকরূপে পেয়েছিল। এ বার মীনাক্ষীর বয়ানে শুনুন সেই সময়কার একটা ঘটনা—
‘‘ওই সময় সুধীন্দ্র ও রাজেশ্বরী দত্ত প্রায়ই বিকেলে কবিতা ভবনে আসতেন। কিন্তু রাত হওয়ার আগেই তাঁরা চলে যেতেন। জ্যোতি বাবাকে বলল, ওঁরা রাত হবার আগে কেন চলে যান বুঝতে পারেন না? আমাদের একটু কোহল রাখতে হবে।
‘‘জ্যোতি খলনায়কের মতো, অতি সুচতুরভাবে সুধীন্দ্রের নাম করে বাড়িতে প্রথম এক বোতল জিন নিয়ে এল। জ্যোতি রন্ধন ও ককটেল শিল্পে নিপুণ। বাতাবি লেবুর রস দিয়ে সে এক উত্তম পানীয় বানাল। বরফের বালতি, বিটার্স ইত্যাদি অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই, সে এক উৎসব শুরু করে দিল। সুধীন্দ্র সেই সন্ধ্যায় উসখুস করার সঙ্গে সঙ্গেই পানীয় উপস্থিত। অনেকেই কী খাচ্ছেন বুঝতে না পেরে তুলে নিয়েছিলেন।’’
এখানে আমার দুটো বুদ্ধদেব–স্মৃতি উল্লেখ করলে কাজে দেবে। যার একটিতে লেখকের তর্কপ্রিয়তা এবং অন্যটিতে নিজেকে নিয়ে বেশি কিছু বলার অনীহা প্রকট হয়।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ পাদে কলেজ স্ট্রিট পাড়ার বড় বাটার দোকানের পাঁচ তলায় আমেরিকান ইউনিভার্সিটি সেন্টারে বিতর্ক, বক্তৃতা, কাব্যপাঠ, ক্যুই়জ ইত্যাদির জমাটি আসর বসত মাসে অন্তত চার-ছ’দিন। এমএ ক্লাসের পড়ুয়া আমরা কোনওটাই মিস করতাম না।
এরকম এক আলোচনা চক্রে মধ্যমণি হয়ে এলেন বুদ্ধদেব। অন্য আলোচকদের মধ্যে তখনকার ডাকসাইটে লেখক-সাংবাদিক, ঠোঁটে পাইপ-ধরা সন্তোষকুমার ঘোষ, জ্যোতির্ময় দত্ত, কবি নরেশ গুহ ছিলেন।
আলোচনা অচিরে তর্কে দাঁড়িয়ে গেল এবং সমস্ত তর্ক উছলে উঠছিল বুদ্ধদেবের হঠাৎ হঠাৎ করা সাহিত্যিক মন্তব্য থেকে।
সন্তোষবাবু কিছুক্ষণ তর্কে থেকে তার পর পাইপ ধরিয়ে এক মনে বুদ্ধদেবের মন্তব্য উপভোগ করতে লাগলেন।
নরেশ গুহ মাঝে মাঝে কিছু বলছিলেন ঠিকই, কিন্তু তর্ক যা চালিয়ে যাচ্ছিলেন জ্যোতির্ময়। শেষে তিনিও হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘এ বার অডিয়েন্সও যোগ দিন, আমি আর কত ঝগড়া করব?’
এটা বলার কারণ তার একটু আগে জ্যোতির্ময় বুদ্ধদেবকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার কি মনে হয়, এখানকার সাহিত্যে ইংরেজ কবি জন ডান-এর মতো কাউকে কখনও পাওয়া গেছে?’
ওঁর প্রশ্ন শেষ হতে না-হতে বুদ্ধদেব বলে বসলেন, ‘কেন, বিদ্যাপতি!’
অমনি কী তুমুল হাসি হল জুড়ে। বিদ্যাপতি সত্যিই জন ডান-এর মতো কিনা এবং হলে কেন, সে-সব চিন্তা সকলের কাছেই তখন অমূলক। সবাই তখন উপভোগ করছে বুদ্ধদেবের ধাঁধিয়ে দেবার মতো ঝাঁ চকচকে রেপার্টি। সন্তোষকুমারকেও দেখা গেল ঠোঁট থেকে পাইপ সরিয়ে ভাল করে হেসে নিচ্ছেন।
দ্বিতীয় স্মৃতিটা আমার। কবির নাকতলার বাড়িতে। অধুনালুপ্ত হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার পূজা অ্যানুয়ালের জন্য এক সন্ধ্যায় বুদ্ধদেবের ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম।
বেজায় দুর্যোগের সন্ধে। তার ওপর এলাকা জুড়ে লোডশেডিং। ফাঁকে ফাঁকে চা আসছিল। একটা হাল্কা গাউন জড়িয়ে লম্বা সোফায় বসেছিলেন বুদ্ধদেব। দেখলাম খুব রোগা হয়ে গিয়েছেন ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’-র নাট্যকার, ‘মহাভারতের কথা’-র লেখক, ‘আমাদের কবিতা ভবন’-এর স্মৃতি রোমন্থক। কিন্তু মাথার এক ঝাঁক চুল, ঘাড়-কান বেয়ে নেমে আসছে।
আমার ইংরেজিতে করা প্রশ্নের উত্তরে ধীরেসুস্থে ইংরেজিতে উত্তর জুগিয়ে যাচ্ছেন। আমি মোমবাতির আলোতে লংহ্যান্ডে কমা, ফুলস্টপ সমেত ওঁর প্রতিটি শব্দ লিখে নিচ্ছি।
বুদ্ধদেব উত্তর দিতে দিতে একের পর এক ‘ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট’ সিগারেট টেনে যাচ্ছেন (পরে শুনেছিলাম ওঁর দেখাদেখি কিছু কবি, বুদ্ধিজীবী ‘ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট’ ধরেছিলেন)।
সেই সাক্ষাৎকার ছিল ষোলো আনা বুদ্ধদেবের কাজ নিয়ে। ওঁর উত্তরগুলো টাইপ করে ওঁর কাছে পাঠালাম দু’দিন পরে। তার পরের দিনই অপিসে ফোন এল কবির।
‘শোনো, ইন্টারভিউ ছেপো না।’
‘কেন স্যার?’
‘আমি নিজেকে নিয়ে এত সব বলেছি ভাবতেই পারছি না। মনেই হচ্ছে না এসব আমার কথা।’
‘লেখায় কিছু ভুল দেখলেন?’
‘না, ভুলের কথা তো বলিনি। তবে যা বলেছি, তা আমার নিজের কথা বলে ভাবতে পারছি না।’
‘তা হলে?’
‘এবারটা ছেড়ে দাও। পুজোর লে‌খালেখি যাক। নতুন করে একটা সংলাপে বসব। নিজেকে নিয়ে নয়, সাহিত্য নিয়ে।’
সেই দ্বিতীয় সুযোগটা আর আসেনি, কোনও কিছুর জানান না দিয়েই ‘বন্দীর বন্দনা’-র কবি এই জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে নিলেন। স্ত্রী
 প্রতিভা সেই সঙ্কটকালের এক অপরূপ ছবি রেখেছেন ‘জীবনের জলছবি’-তে—
‘‘ডাক্তার ওঁকে বলেছিলেন লেখা নিয়ে সমস্তক্ষণ বসে থাকেন, একটু হাঁটা ভালো। সেই থেকে বাড়ির ছাদে গিয়ে নিয়মিত দু’চার পাক হাঁটতেন। চিরকাল বিদ্যাসাগরীয় চটি পরতেন। ছাদে ঐ চটির শব্দ ছাদের তলাকার মানুষদের কানেও বেশ ভালোভাবে পৌঁছতো। এক দিন হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চটির শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। আমি রুদ্ধশ্বাসে সেই শব্দ শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। এ পাশ ও পাশ তাকিয়ে আয়াকে দেখতে না পেয়ে ‘গঙ্গামণি গঙ্গামণি’ বলে ডাকতে লাগলাম।
গঙ্গামণি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বললো, ‘… আমার একটা কী হয়েছে মা, বাবুর জন্য কেমন ভয় করে। রুটি করলাম, মনে হল বাবুর পায়ের আওয়াজটা থেমে গেল। অমনি দৌড়োলাম উপরে। গিয়ে দেখি ছাদে ফুটফুটে জ্যোৎস্না, মস্ত চাঁদ। বাবু সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন। একটু বাদেই বুদ্ধদেব নেমে এলেন, বললেন, ‘কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে। তোমর টাইল পাতা ছাদটা তার আলোয় কী ভালো দেখাচ্ছিল!’’
এর কিছু দিন পরেই কবি চলে গেলেন। এবং আরেক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এক অপূর্ব এলিজি লিখলেন। 


http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/%E0%A6%A7-%E0%A6%B8%E0%A6%B0-%E0%A6%AA-%E0%A6%A3-%E0%A6%A1-%E0%A6%B2-%E0%A6%AA-1.255141