মেয়ে নিখোঁজের পরও পি কে–র প্র্যাকটিস!
কলকাতা সোমবার ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫
সুতপা ভৌমিক: স্মৃতির গলি ধূসর হতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু তিনি? ঊনআশিতেও, সময়ের চোখে চোখ রাখেন! শেখ মুজিবুর রহমানের ঢঙেই বুঝি বলে ওঠেন, ‘আমারে দাবায়ে রাখতে পারবা না’! এমন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে অভ্যস্ত যিিন, তাঁর স্মৃতি থেকে কী করে মিলিয়ে যাবে ৪০ বছর আগের সেই দিনটা? বিশেষ দিন, কম–বেশি মনে থাকে সবার। কিন্তু তাঁর কাছে বিশেষ দিনটার আগের দিনটাও তো ছিল না ভোলার মতোই! কী ঘটেছিল ৪০ বছর আগে?
‘ওই দিনটা ভুলে যাওয়ার উপায় আমার নেই। কী করে ভুলে যাব? আমার বড় মেয়ে ওই দিনই যে হারিয়ে গিয়েছিল। পলা তখন ক্লাস থ্রি–তে পড়ে। স্কুল থেকে ওকে অপহরণ করা হয়েছিল। মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না। হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিস। আমার স্ত্রী আরতির অবস্থা তো খুবই খারাপ। কান্নাকাটি করছে। মায়ের কোলে মেয়ে না ফিরলে, অস্থির তো হবেই। আরতির কান্না আমার দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে তুলছিল। বারবার খোঁজ নিচ্ছিলাম। কিন্তু কোনও খবর আসছিল না! কী যে করি! ওই সময় কিছুতে কি মন বসে? কিন্তু আমার যে হাত–পা বাঁধা। ফুটবলাররা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সমর্থকরাও তাকিয়ে আছেন। ওদের ছেড়ে কোথায় যাব? তবে, আমি তো বাবা। মেয়ের জন্য আমারও মন কাঁদে। কেঁদেছিল সেদিনও। তবু মাঠে গিয়েছিলাম। ছেলেদের প্র্যাকটিস করিয়েছিলাম।’ এক নিঃশ্বাসে বলে থামলেন পি কে ব্যানার্জি। ১৯৭৫ সাল। ইস্টবেঙ্গলের সোনার বছর। ‘হেক্সা’ লিগ সেবারই এসেছিল লাল–হলুদের ঘরে। কিন্তু লিগ জয়ের আগের দিন এতটা দুর্বিষহ কাটবে, স্বপ্নেও ভাবেননি বাংলার ফুটবলে ‘ভোকাল টনিক’–এর গুরু। এত বছর বাদেও সেই অস্থিরভাবটা ধরা পড়ল, ‘হেক্সা লিগ’ জয়ের স্মৃতিচারণ করতে বসে। পি কে বলে উঠলেন আবার। ‘সন্তানের জন্য মায়ের মন যতটা কাঁদে, বাবারও ততটাই। জানি না, সেদিন রাতে পলাকে পাওয়া না গেলে কী করতাম!’
আতঙ্কের দিন পেরিয়ে সূর্য উঠল পরের দিন। সেদিন, সূর্যের রঙ সকাল থেকেই ছিল লাল–হলুদ। পরপর ছয়বার কলকাতা লিগ জয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দলকে কী বলেছিলেন সেই সকালে? পদ্মশ্রীর স্বরে উত্তেজনা। ফোনের এপার থেকেই বোঝা গেল দিব্যি। বললেন, ‘মহমেডানের রেকর্ড ভাঙার মুখে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। হাবিব, লতিফউদ্দিন ওই সময় ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে চলে গেছে। অনেক কষ্ট করে গুছিয়েছিলাম দলটা। ছেলেদের বুঝিয়েছিলাম, কেন এমন ম্যাচের আগে রাত জাগতে নেই। কেন অতিরিক্ত তেল–মশলা দেওয়া খাবার খেতে নেই। কিছুতেই যেন শরীর, মন দুর্বল না থাকে। ছেলেদের বলেছিলাম, তোমরা যদি এবার জিততে পারো, তা হলে স্মরণীয় হয়ে থাকবে নাম। গৌতমরা সেটা বুঝেছিল। ওরা সেদিন প্রাণ দিয়ে খেলেছিল।’ খেতাব জয়ের পর? সেই মুহূর্ত… প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই শুরু করলেন পি কে ব্যানার্জি। ‘উফ্, সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা! মাঠে যাওয়ার সময় থেকেই হাজার হাজার লোক সঙ্গ নিয়েছিল। ফেরার পথে সংখ্যাটা বেড়ে িগয়েছিল আরও অনেকটাই! সবাই আমাদের সঙ্গে হাঁটতে চান। সবাই একসঙ্গে উৎসব করতে চান। ওঁদের সেই আবেগ, সেই উচ্ছ্বাস, সেই গর্জন— এখনও স্পষ্ট চোখের সামনে।’ তারপর? একটু থেমেই শুরু করলেন, ‘আরতি সেদিন সবার জন্য খাবার বানিয়েছিল। নিজের হাতে। গোটা দলকে নিয়ে এসেছিলাম আমার বাড়িতে। সবাই মিলে খাওয়া–দাওয়া হয়েছিল। কেউ কেউ তখন না খেয়ে, বাড়িতে খাবার িনয়ে গিয়েছিল। আরতিই গুছিয়ে দিয়েছিল সব।’
১৯৭০ থেকে ১৯৭৫। ইস্টবেঙ্গলের ছয়বারের লিগ জয়ে, তিনি ছিলেন চারবার কোচের দায়িত্ব। লাল–হলুদ ধাপে ধাপে এগিয়েছিল যখন, ’৭২ থেকে তিনিও সাফল্যের সঙ্গী। সাফল্যের কারিগরও বটে। সেই ইস্টবেঙ্গলই আবার টানা ছয়বার ঘরোয়া লিগ জিতল। পি কে–র গলায় উচ্ছ্বাস, ‘ইস্টবেঙ্গল দারুণ খেলেছে। ওরা জিতেছে ঠিকই, কিন্তু গৌরব বেড়েছে বাঙালিরই।’ বিদেশি কোচের রমরমা যখন, তখন আবার একজন বাঙালি কোচের তত্ত্বাবধানে লিগ জিতল ইস্টবেঙ্গল। কেমন লাগছে? পি কে বলেন, ‘বিদেশি কোচের ওপর নির্ভরতার ঠেলায়, যা সর্বনাশ হওয়ার হচ্ছিল। ভাল লাগছে, সেই ছবিটা বদলাচ্ছে দেখে। এমনটা যদি আগে ঘটত, তা হলে বাংলার ফুটবলের উন্নতি হত।’ থামলেন। আবার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই বলে উঠলেন, ‘শোন, অনেক কিছু বললাম এতক্ষণ। আরও একটা কথা বলার আছে। ইস্টবেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হল। চাইব, ঘটিঁ–বাঙাল বিভেদ ভুলে আপামর বাঙালি খুশি হোক। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের ভেদাভেদ এই মুহূর্তে মুলতবি থাকুক।’ ভোকাল টনিকের হেডস্যর, যথার্থই তখন অভিভাবকের ভূমিকায়।
http://aajkaal.in/sports/%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%96%E0%A7%8B%E0%A6%81%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%93-%E0%A6%AA%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%B0/
No comments:
Post a Comment