বিশু,দেখিস বাবা মোহনবাগানকে হারাতে হবে
সমরেশ চৌধুরী
মাঠে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু নিজের তো গাড়ি নেই। ট্যাক্সি-ফ্যাক্সি ডেকে মাঠে যাওয়ার ঝামেলার চেয়ে রবিবার বাড়িতে বসে টিভিতেই খেলা দেখব। তবে মোহনবাগানকে হারিয়ে আমাদের সময়ের মতো ইস্টবেঙ্গলের আবার টানা ছ’বার লিগ জেতার মুহূর্তটা উপভোগ করতে শনিবার থেকেই প্রহর গুনছি।
কত স্মৃতি মনে পড়ছে। কত আবেগ সেই সব! উনিশশো সত্তরে ইস্টবেঙ্গলে এসে প্রথম দিকে দলে আমার সুযোগ না পাওয়া। তার পর প্রথম দলে নিয়মিত হওয়া। বাহাত্তরে প্রদীপদার কোচিংয়ে লেফট হাফে সরে আসা। তার জন্য সাময়িক মানসিক খুঁতখুঁতানি। ম্যাচের দিনেও মেট্রো কিংবা লোটাসে নুন শো দেখে সাবিত্রী কেবিনে ‘পয়া’ চিকেন স্টু খেয়ে খেলা শুরুর দশ মিনিট আগে ক্লাবে এসে মাঠে নেমে পড়া। লিগ ঘিরে কোর্টকাছারি। আদালতের স্থগিতাদেশ— সব কিছুর যোগফল পঁচাত্তরে রেকর্ড করে আমাদের টানা ছ’বার লিগ জয়।
দু’টো জিনিস অনেকেই বোধহয় জানেন না। ওই যে প্রায়ই ম্যাচের দিন নুন শো দেখতে চলে যেতাম সেটা প্রচুর ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের আমার কাছে ডে’জ স্লিপের বায়না থেকে বাঁচতে। আর পঁচাত্তরের শিল্ড আর লিগ আমরা একই দিনে জিতেছিলাম। কেন? সে বার শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানকে পাঁচ গোল দেওয়ার সেলিব্রেশনের দিনই টানা ছ’বার লিগ জেতার সরকারি খবরটা দিয়েছিলেন জীবনদা (জীবন চক্রবর্তী)! আসলে পঁচাত্তরের লিগে ইডেনে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে মহমেডান আমাদের বিরুদ্ধে এক গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় মাঠ ছেড়ে উঠে গিয়েছিল। আইএফএ রেফারি, ম্যাচ কমিশনারের রিপোর্ট পাওয়ার পরে তিন পয়েন্ট আমাদের দিলে তার বিরুদ্ধে আদালতে চলে যায় মহমেডান। তাই আমরা লিগ জেতার পরেও আদালতের স্থগিতাদেশে সরকারি ঘোষণা হয়নি। শেষমেশ সেটা হয়েছিল সে বার আমাদের শিল্ড জেতার দিনেই।
সে দিন পাঁচ গোলের ম্যাচের পর জীবনদা, পল্টুদারা মালা নিয়ে সোজা ঢুকে পড়েছিলেন মাঠে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘মোহনবাগানকে পাঁচ গোল দেওয়ার জন্য মালা আনসেন?’’ আজও কানে বাজে পল্টুদার উত্তরটা, ‘‘পিন্টু, আজই আদালত কইয়া দিসে লিগ আমাগো। ছয় বার! নতুন রেকর্ড হইল রে।’’
ভাবলে এখনও গর্ব হয়, সত্তর থেকে পঁচাত্তর ইস্টবেঙ্গলের ছ’টা লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বছরেই আমি আর সুধীর (সুধীর কর্মকার) লাল-হলুদ জার্সি গায়ে খেলেছি। অধিনায়কও হয়েছি। একটা মজার তথ্য দিই— পঁচাত্তরে অশোকলালকে (বন্দ্যোপাধ্যায়) বাদ দিলে বাকি পাঁচ বারই আমাদের অধিনায়কের নামের আদ্যাক্ষর ছিল ‘এস’ দিয়ে। শান্ত মিত্র, সুশীল ভট্টাচার্য, সুধীর কর্মকার, স্বপন সেনগুপ্ত আর এই অধম। মেহতাবদের ছ’বারের লিগ অভিযানে এ রকম নামের মিল যদিও নেই। থাকলে ব্যাপারটা আরও জমতো।
আমাদের ছ’বার লিগ জেতার কথা উঠলেই দু’জনের কথা খুব মনে পড়ে। এক জন আমার শঙ্করবাবা (শঙ্কর মালি)। সত্তরে ইস্টবেঙ্গলে সই করে যখন সুযোগ পাচ্ছিলাম না, শঙ্করবাবাই বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘‘যে দিন সুযোগ পাবেন সে দিন এমন খেলবেন যে, আর কেউ কোনও দিন বাদ দিতে পারবেন না।’’ সত্যিই, প্রথম দলে এক বার সুযোগ পাওয়ার পর আর বসতে হয়নি। আর এক জন আমাদের এই ছ’টা লিগের প্রদীপ জ্বালানোর অন্যতম কারিগর প্রদীপদা (বন্দ্যোপাধ্যায়)। আমাকে কত বার যে বলেছেন, ‘‘বাঘাদার (বাঘা সোম) চ্যালা হয়ে ওঁর নামটা ডোবাসনি।’’
মেহতাবদের কথায় আসা যাক। আমাদের সেই কৃতিত্ব ওরা স্পর্শ করতে চলেছে ভেবে দারুণ আনন্দ হচ্ছে। তবে আমাদের সময় সবাই ছিল ভারতীয় ফুটবলার। বিশেষ করে বাঙালি। এখন বিদেশি ডং, বেলোরাই হেডলাইনে বেশি। তবে এ বারের টিমের আক্রমণ আর মাঝমাঠ নিয়ে কোনও কথা হবে না। মেহতাব-খাবরাদের দেখে যেন নিজের যৌবনে ফিরে যাচ্ছি বার বার।
শুধু ছ’বার লিগ জয়ী ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন ফুটবলার হিসেবে দু’টো পরামর্শ রয়েছে। প্রথমটা ডংকে। ওকে আজ মোহনবাগান পুলিশ মার্কিং করবেই। ডং, তুমি সেই ফাঁদে পা না দিয়ে জায়গা অদলবদল করো বারবার। পরেরটা কোচ বিশ্বজিৎকে। বিশু, তোর ডিফেন্সে বেলোর সঙ্গে গুরবিন্দরের মতো একজন ধ্বংসাত্মক ডিফেন্ডার রাখিস। তা হলে টিমটা আরও পোক্ত হবে।
আমি, সুধীররা যেমন আজও ছ’বার লিগ জয় নিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরি— মেহতাব, চাই তোরাও চল্লিশ বছর পর সে ভাবেই ঘুরবি। কেউ যেন না বলতে পারে— দ্বিতীয় বার ছ’বার হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ডার্বিটা জিততে পারেনি। আমরা কিন্তু ওই ছ’বারে এক বারও মোহনবাগানের কাছে হারিনি লিগে।
৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৩:০৩:১৮
No comments:
Post a Comment