বন্ধুমহলে গেট টুগেদার হলে আর শুনতে পাব না, ‘‘আপনাকে ধরে রাখাটাই তো আমার কাজ।’’
ফুটবলার জীবনে মাঠে, আর খেলা ছাড়ার পর কানের পাশে যে মানুষটা টুক করে এই কথাটা বলে শিশুর মতো নির্মল হাসিমুখ নিয়ে সামনে দাঁড়াত সেই প্রশান্ত সিংহ আর নেই।
মঙ্গলবার সন্ধেয় যখন দুঃসংবাদটা পেলাম তখন আমার যোধপুর পার্কের বাড়ির জানলা দিয়ে দেখলাম অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। মনে হল সদাহাস্য, অজাতশত্রু প্রশান্তর প্রয়াণে প্রকৃতিও অশ্রুপাত করছে।
সপ্তাহটাই ভীষণ খারাপ যাচ্ছে। শুরু হয়েছিল বন্ধুবর জগমোহন ডালমিয়ার মৃত্যু সংবাদে। সোমবার দুপুরে সিএবিতে প্রয়াত ডালমিয়াকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে বাড়ি ফেরার সময় সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম পরিচিত সকলকে সুস্থ রাখতে। কিন্তু সেই প্রার্থনা তিনি শুনলেন কই! পরের দিনই কেড়ে নিলেন আমার অনুজ সহযোদ্ধা প্রশান্তকে।
ছয়ের দশকে যখন চুটিয়ে মোহনবাগানে খেলছি তখন ময়দানে রেলের ‘থ্রি পি’-র কথা খুব শুনতাম। প্রদীপ-প্রদ্যোৎ-প্রশান্ত। অ্যাটাক, গোলকিপিং আর মাঝমাঠে তিন জনই নিজের দিনে দেশের সেরা।
বাঘাদার ছাত্র ছিল প্রশান্ত। ও যে কতটা টাফ প্রতিপক্ষ সেটা ও যখন রেল টিমে খেলত তখন থেকেই ওদের বিরুদ্ধে ম্যাচে টের পেতাম আমি। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে এই ছেলেটার খেলায় কী এমন বাহার আছে? কিন্তু যে ওর সঙ্গে বা ওর বিরুদ্ধে খেলেছে সে জানে প্রশান্তর নিখুঁত ট্যাকল, অক্লান্ত পরিশ্রম, দ্রুত জায়গা নেওয়া, গোটা মাঠ দৌড়ে বিপক্ষকে কী রকম নাস্তানাবুদ করতে পারত। তার চেয়েও মজার, রেলে যখন খেলত তখন ছিল লেফট আউট। তার পর কখনও ইনসাইড ফরোয়ার্ড, কখনও মাঝমাঠ আর শিল্ড ফাইনালে পাস ক্লাবের বিরুদ্ধে তো ওকে স্টপারেও দাপটে খেলতে দেখেছি। এক জন কমপ্লিট ফুটবলার বলতে যা বোঝায় আমার কাছে প্রশান্ত সিংহ ছিল সেটাই।
ক্লাব ফুটবলে কখনও আমার সঙ্গে খেলেনি। সব সময় ও ইস্টবেঙ্গলে। আমি মোহনবাগানে। কিন্তু তাতেও দু’জনের সুসম্পর্ক এক দিনের জন্যও নষ্ট খায়নি। তবে মাঠের ভেতর ও একদম অন্য মানুষ। তখন কাউকে ছাড়ত না। আজ জীবনের সায়াহ্নে এসে বলতে আমার দ্বিধা নেই, প্রশান্তর ট্যাকল টপকানো আমার কাছে বেশ চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার ছিল। পাহাড়ের মতো পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়ে পড়ত সামনে। বহু ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে ওর বিরুদ্ধে খেলেছি। কখনই আমাকে ও এক হাতের বেশি দূরে রাখত না। ছিনে জোঁকের মতো গায়ে লেগে থাকত।
আমি কখনওসখনও মজা করে বলতাম, ‘‘খেলা তো অন্য দিকে চলছে। এখন আমার গায়ে লেগে থেকে কী করবি?’’ এখনকার দিনে প্রতিপক্ষ এ ধরনের কথা বললে মাঠে দু’দলে হাতাহাতি হতে পর্যন্তও দেখি। অথচ প্রশান্ত আমার টিপ্পনিতে এক দিনও রাগেনি। বরং সেই শিশুর মতো নির্মল হাসি মুখে ঝুলিয়ে যেটা বলত আজও কানে বাজে সেই কথাটা —আপনাকে ধরে রাখাটাই তো আমার কাজ। এখানে বলে রাখি, ও বরাবর আমাকে আপনি বলত।
মাঠে প্রশান্তর নাছোড় মনোভাবের জন্যই জাকার্তা এশিয়ান গেমসে অধিনায়ক চুনী গোস্বামীর কাছে ও ছিল একটা লুকোনো তাস। সেমিফাইনালের আগের সকালটা তিপান্ন বছর পরেও আজ মনে পড়ছে। গ্রুপ লিগে সব ম্যাচ রামবাহাদুর খেলেছিল। কিন্তু মাঝমাঠে আমাদের ট্যাকলটা ঠিক মতো হচ্ছিল না। তাই সেমিফাইনালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে নামার আগে রহিম সাহেবকে গিয়ে বললাম, ‘‘রামবাহাদুর পাস বাড়াবে সেটা ঠিক। কিন্তু আমরা গোল করার পর সেই গোল তো রাখতেও হবে। আপনি দয়া করে প্রশান্তকে খেলান রামবাহাদুরের জায়গায়।’’ নিজের ছেলের মতো আমাকে ভালবাসতেন উনি। আমাকে সে দিন সমর্থন করেছিল প্রদীপও। রহিম সাহেব সব যুক্তি শুনে বললেন, ‘‘ঠিক আছে। তোমার প্লেয়ারই খেলবে।’’
তার পর সেমিফাইনাল আর ফাইনালে প্রশান্ত কী খেলাটা খেলেছিল তা আজও ভারতীয় ফুটবলে ইতিহাস। ফাইনালে ওর ট্যাকলে কোরিয়ানদের পা সরিয়ে নিতেও দেখেছি।
এশিয়াড সোনা জেতার দিনটা কোনও দিন ভুলব না। ৪ সেপ্টেম্বর। কে জানত সেই চিরস্মরণীয় সাফল্যের মাসেই আমাকে প্রিয় এক সহযোদ্ধাকে হারাতে হবে! মাসখানেক আগে ওকে বাড়িতে দেখতে গিয়েছিলাম। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবু ক্যাপ্টেনের হাতটা শক্ত করে ধরে সেই নির্মল হাসিটা যন্ত্রণার মধ্যেও মুখে ঝুলিয়ে রেখেছিল সারাক্ষণ। এটাই প্রশান্ত সিংহ। ফুটবলটা ওর কাছে শুধু খেলা ছিল না। ধর্মও বটে।
প্রশান্ত তুমি যেখানেই থাকো শান্তিতে থেকো। ভালবাসার মানুষের মৃত্যু হয় না কি! 

http://www.anandabazar.com/khela/%E0%A6%B8%E0%A6%A4-%E0%A6%AF-%E0%A6%95-%E0%A6%B0-%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A6%AA-%E0%A6%B2-%E0%A6%9F-%E0%A6%AB-%E0%A6%9F%E0%A6%AC%E0%A6%B2-%E0%A6%B0-%E0%A6%9B-%E0%A6%B2-%E0%A6%AA-%E0%A6%B0%E0%A6%B6-%E0%A6%A8-%E0%A6%A4-1.212535#