শিল্টন পালকে নিয়ে লেখাটা লিখতে বসে বেশ খারাপই লাগছে। চল্লিশ বছর পর এক মোহনবাগান গোলকিপারের কাছে আবারও এক অভিশপ্ত বিকেল, আবারও এক অপমানের প্রহর। ১৯৭৫ সালে ইস্টবেঙ্গলের কাছে আমার চার গোল খাওয়াটা লোকে ভুলতে পারেনি এখনও। আমি নিশ্চিত, রবিবারের পর আমার দুর্ভাগ্যের সঙ্গে এ বার শিল্টনেরটাও মিলিয়ে দেখা হবে।
আমাদের দু’জনই মোহনবাগান গোলের নীচে চার গোল করে খেয়েছি ঠিকই, কিন্তু আমাদের মধ্যে তফাতও আছে। ’৭৫-এর অভিশপ্ত ম্যাচে যে সমর্থকদের পাল্লায় আমাকে পড়তে হয়েছিল, এখনকার সমর্থন অতটা উগ্র নয়। এরা বিদেশি ফুটবল দেখে। জানে যে, খারাপ দিনে জিয়ানলুইগি বুফোঁ, পের চেকরাও চার-পাঁচ গোল খেতে পারে। আঘাত পায় ঠিকই, কিন্তু সব ছেড়েছুড়ে গোলকিপারকে টার্গেট বানিয়ে ফেলে না। আমার সময়ে যা ছিল না। তখন বিদেশি ফুটবলের প্রভাব ছিল না। তখন স্রেফ একটা লাইন জানতেন সমর্থকরা— জিতলে তোমাকে মাথায় তুলে রাখব। হারলে তোমাকে ছুড়ে ফেলে দেব।
তা ছাড়া শিল্টন অনেক অভিজ্ঞও পঁচাত্তরের ভাস্করের চেয়ে। আমি তখন আনকোরা একটা ছেলে যে স্বপ্ন দেখছে মোহনবাগান জার্সিতে ডার্বি খেলার। চার গোল খেয়ে মাঠ ছাড়ার পর আমি তো ভেবেছিলাম যে, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়ের ফুটবল আজ শেষ হয়ে গেল। আমার এক সমসাময়িক বিশ্বজিৎ দাস তো সাতাত্তরে দু’গোল খাওয়ার পর মাঠ থেকেই হারিয়ে গেল। আমি ওই ঘটনার পর বাড়ি থেকে অনেক দিন বেরোইনি। আমার আত্মীয়-স্বজনদেরও ছাড়া হত না। শেষ আমিও হয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু নিজেকে ধ্বংস না হতে দিয়ে ঠিক করেছিলাম যে, আমার এখন সবে শুরু। হাতে সময় আছে। আসল ভাস্করকে দেখাব। ওই চার গোলকেই ফেরার মন্ত্র বানিয়ে ফেলছিলাম। এখনও আমার মোবাইল নম্বরের শেষ চারটে সংখ্যা কিন্তু শূন্য। মানে, ওই চারটে অভিশপ্ত গোল। ইচ্ছে করেই নিয়েছিলাম।
মনে হয় না, শিল্টনকে আমার মতো কোনও সমস্যায় পড়তে হবে। ও প্রতিষ্ঠিত। ব্যর্থতা যেমন দেখেছে, সাফল্যও দেখেছে। এটা ওর কাছে ধাক্কা ঠিকই। কিন্তু এটাকে প্রোফেশনাল হ্যাজার্ড হিসেবেই নেবে। ওর তো নিজেকে আর প্রমাণ করার কিছু নেই। গত বার আইলিগও জিতেছে। সমথর্করাও জানে যে ও ক্লাবের জন্য কতটা দিতে পারে। তাই রবিবারের চার গোল ওর কাছে সাময়িক ব্যর্থতার চেয়ে বেশি কিছু হবে না।
আর একা ও কী করবে? ওর সামনে যে ওয়াল ছিল তারাই তো সমস্ত গণ্ডগোলের মূলে। ডংয়ের ফ্রি কিককে আমি ছোট করছি না। দু’টোই অসাধারণ। ময়দানে এমন সেট পিস থেকে গোল বহু দিন দেখা যায়নি। কিন্তু বাগান ওয়ালও নিজের পজিশনে থাকল না। শিল্টন যখন নিয়ার পোস্ট গার্ড করছিল সেখানে ওয়ালে প্রথমে কোনও লম্বা কাউকে রাখা উচিত ছিল। দ্বিতীয় ভুলটা হল, ওয়ালে দাঁড়ানো সবাই আগেই এক দিকে ঝুঁকে পড়ল। কমিট করে গেল। ফলে ডং বুঝে গেল কোন জায়গাটা দিয়ে মারতে হবে। ওয়ালে দাঁড়ানো মূল কথাটাই হল, নড়াচড়া করা চলবে না। যে ফ্রি-কিক মারছে, তাকে বুঝতে দেওয়া চলবে না গোলটা কোন দিক থেকে হতে পারে। আমার সময় সুরজিত্ সেনগুপ্ত, গৌতম সরকার, সমরেশ চৌধুরী দুর্দান্ত ফ্রি-কিক মারত। এরা মারতে এলে আগে থেকেই আমি তৈরি থাকতাম। ওয়ালকে বলতাম, তোমরা যাই করো বলটা আমার অবধি যাতে না পৌঁছোয়। শিল্টন এখানে ভুল করল। ও নিজে জায়গা নিল। কিন্তু ওয়ালকে যতটা সতর্ক করা উচিত ছিল, ততটা করল না।
অভিশাপের দিনে যা হয়। 

http://www.anandabazar.com/khela/ex-keeper-bhaskar-gangopadhyay-recalls-1975-memory-and-compares-him-with-shilton-pal-1.204521