সেই সময় ইস্টবেঙ্গলের জয় স্বাভাবিক ঘটনা
কলকাতা সোমবার ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫
সুরজিৎ সেনগুপ্ত: কলকাতা লিগকে গুরুত্বহীন করে দেওয়ার সবরকম অপচেষ্টা সত্ত্বেও কলকাতা লিগ তার গুরুত্ব বা আকর্ষণ হারায়নি। আজও কলকাতার দুই বড় ক্লাব ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান কলকাতা লিগ জেতাকে ততটাই উজ্জ্বল সাফল্য বলে মনে করে যতটা আগে করত। তার মূল কারণ, দর্শকরা বা সমর্থকেরা কলকাতা লিগকে গুরুত্ব সহকারে দেখে। ’৭০ থেকে ’৭৫— এই ৬ বছর পরপর কলকাতা লিগ জিতে ইস্টবেঙ্গল রেকর্ড করেছিল। তারপর ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান দুই ক্লাবই এই রেকর্ড ভাঙার স্বপ্ন দেখেছে, চেষ্টারও ত্রুটি রাখেনি। দীর্ঘদিন পর এইবার ইস্টবেঙ্গল সেই রেকর্ড স্পর্শ করল। ইস্টবেঙ্গলের এই সাফল্যে দলের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। আমি ইস্টবেঙ্গলের সাফল্যে বিশেষভাবে খুশি এই কারণে যে, ১৯৭৫ সালে যখন ইস্টবেঙ্গল এই রেকর্ড সৃষ্টি করে, তখন আমি লাল–হলুদ জার্সি পরি। আজ সেই স্মৃতি আমাকে বিশেষভাবে সুখে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ৬ বছর লিগ জেতার রেকর্ডে শেষ ২ বছর আমি একজন সৈনিক। মোহনবাগান থেকে ইস্টবেঙ্গলে এসে যে পার্থক্যটা আমি লক্ষ্য করেছিলাম সেটা হল ড্রেসিংরুমের আবহাওয়া। উষ্ণতা আর আন্তরিকতায় প্লেয়ার, কর্মকর্তা, মালি, সভ্য সমর্থক সব যেন একাকার— বিশেষত ম্যাচের দিন। সবে ইস্টবেঙ্গলে এসেই হাবিবের কাছে শুনেছিলাম— ‘তু খেলেগা তো টিম খেলেগা।’ সিনিয়র প্লেয়াররা মোহনবাগানেও আমাকে যতটা সাহস দিয়েছেন, ইস্টবেঙ্গলেও ততটাই। তফাত শুধু এই যে ইস্টবেঙ্গলে দু’তিনজন নয়, সব প্রাক্তন ফুটবলারদেরই সম্মান পেতে দেখেছি। টিম স্পিরিটের কারনে ’৭৪–এর লিগে তো আমি হায়েস্ট স্কোরারই হয়ে গেলাম। ’৭৪ সালে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলে কলকাতা লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পর ’৭৫ সালে মরশুম শুরুর সময় নিজের ফর্ম নিয়ে বেশ আস্থাবান ছিলাম। কারণ, প্র্যাকটিসে সুধীর কর্মকারকে ১০ বারের চেষ্টায় অন্তত ৩ বার বা কখনও ৪ বার টপকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু, লিগ শুরু হওয়ার পর দেখা গেল আমি বেশ খারাপ খেলছি। তৃতীয় ম্যাচে প্রদীপদা বসিয়ে দিলেন, সুভাষ ভৌমিক আমার ফর্ম ফেরাবার দায়িত্ব নিল। তখন লিগে মোট ২২টা দল, তার মানে ২১টা ম্যাচ। ৩টে ম্যাচ বিশ্রাম নিয়ে ৭ নম্বর ম্যাচ থেকে খেলায় ফিরলাম। হঠাৎ লিগ বেশ কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। কারণ, মহমেডান মাঠে গ্যালারি ভেঙে গিয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটল। আমি খারাপ খেলি বা না–ই খেলি ইস্টবেঙ্গল কিন্তু ম্যাচ জিতছিল। সেবার লিগ জেতার পথে আমরা ২১টা ম্যাচই জিতেছিলাম, কোনও ম্যাচ ড্র–ও করিনি। যাই হোক, কিছুদিন লিগ বন্ধ থাকার পর লিগ শুরু হল ঠিকই, তবে হল আর এক বিপত্তি। ইডেন গার্ডেনসে ইস্টবেঙ্গল যখন মহমেডানের বিরুদ্ধে ৩–১ এগিয়ে তখন মাঠে জল জমার অজুহাতে মহমেডান মাঠ ছাড়ে। পরে রেফারির রিপোর্টের ভিত্তিতে ইস্টবেঙ্গলকে পুরো পয়েন্ট দেওয়া হয়। ব্যস, মহমেডান আদালতে চলে যায়। লিগ চলতে থাকে, চলে মামলাও। শ্যাম থাপার গোলে আমরা মোহনবাগানকে হারাবার পর লিগ জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যাই। কিন্তু ২১টা ম্যাচই জিতে লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়া সত্ত্বেও আদালতে মামলা থাকায় ঘোষণা আটকে থাকে। একটা স্বীকারোক্তি করা দরকার। মামলা, চ্যাম্পিয়নশিপ ঘোষণা পিছিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে প্লেয়ারদের বিশেষ কোনও মাথাব্যথা দেখিনি। এমনকী সব ম্যাচ জিতে কলকাতা লিগের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা জেতার পরও প্লেয়ারদের মধ্যে কোনও আত্মতুষ্টি লক্ষ্য করিনি। সেই সময় ইস্টবেঙ্গল দল ম্যাচ জেতাটাকে স্বাভাবিক ঘটনার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। হেরে যাওয়া তো দূর, ড্র করার কথাও সেই ইস্টবেঙ্গল দল ভাবতে পারত না। তাই, চ্যাম্পিয়নশিপ ঘোষণা হোক বা না হোক, লিগ জেতার কাজ সম্পন্ন হয়েছে, এর পর আই এফ এ শিল্ডের প্রস্তুতি— এই ছিল প্লেয়ারদের মানসিকতা। লিগের শেষ ম্যাচের ১১ দিনের মাথায় ছিল আই এফ এ শিল্ড ফাইনাল, বিপক্ষে মোহনবাগান। সেদিন ক্লাবে আমাদের জানানো হয় (সম্ভবত উৎসাহ জোগাবার জন্যই) মামলার রায় নাকি মহমেডানের বিপক্ষেই যাবে এবং লিগ জয়ের ঘোষণা সময়ের অপেক্ষামাত্র। সেদিন আই এফ এ শিল্ডে আমরা ইতিহাস রচনা করার পরেও ক্লাবের সিনিয়ররা প্লেয়ারদের বোঝান যে, পরপর ৬ বছর লিগ জয় আরও বেশি গৌরবের। ’৭৫ সালে শেষপর্যন্ত লিগ জিতে আমরা রেকর্ড করেছিলাম। রেকর্ড যেমন গড়া হয়, তেমনই ভাঙাও হয়। অনেকের ধারণা রেকর্ড ভাঙলে বা স্পর্শ করলে যাদের রেকর্ড স্পর্শ হল, তারা দুঃখ পায়। সম্পূর্ণ ভুল। আজ যখন আবার ইস্টবেঙ্গল পরপর ৬ বছর চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমাদের রেকর্ড ছুঁল, তখন আমরা খুবই খুশি। কারণ, আজকের রেকর্ডের কথা বলতে গেলে তো এতদিন অক্ষত রেকর্ডের কথা বলতেই হবে। এবার তো মামলার ঝামেলাও নেই, তাই লিগের শেষ ম্যাচের আগেই ইস্টবেঙ্গল লিগ জয়ের উৎসবে মেতে উঠতে পারল। কোচ, অধিনায়ক, প্লেয়ার আর কর্মকর্তাদের সবার জন্য ’৭৫ সালের ইস্টবেঙ্গল দলের সবার পক্ষ থেকে অনেক অনেক অভিনন্দন আর আই লিগের জন্য শুভেচ্ছা রইল।
http://aajkaal.in/sports/%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%87-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%9F-%E0%A6%87%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A7%9F-%E0%A6%B8/
No comments:
Post a Comment