আমাদের সময়ে লিগ আর ডার্বি, দু’টো জেতাই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখন লিগ জেতার চেয়ে ডার্বির মর্যাদা বেশি।
পৃথিবী উল্টে যাক, লিগ চুলোয় যাক, কিন্তু ডার্বি হারা চলবে না। ফুটবল সচিবের চেয়ারটা তাই অসম্ভব উত্তপ্ত লাগছে এখন। আসলে লিগ জেতার সম্ভাবনা আমাদের খুব কম। যা আমরা পারি, তা হল ডার্বিটা জিততে পারি। জিতে ওদের লিগ জয়ের উৎসবটা মাটি করে দিতে পারি। ডার্বি না পেলে লিগ জিতে লাভ কী? লোকে তো তখন বলবে, মোহনবাগান লিগ না পেলেও লিগজয়ীদের হারিয়েছে। সম্মানের যুদ্ধে হারেনি। তা ছাড়া একটা ব্যক্তিগত হিসেবও মেটানোর আছে। ফুটবলার হিসেবে জীবনের প্রথম ডার্বিটা জেতা হয়নি। ড্র করেছিলাম। আজ, রবিবার যুবভারতীতে কর্তা সত্য-র প্রথম ডার্বি।
জানি না ঈশ্বর আমার জন্য এ বার কী ভেবে রেখেছেন!
৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ তারিখটা আমার জীবনে বেশ অদ্ভুত একটা দিনই বলতে হবে। যেখানে গোটা দিন খুঁজেও ফুটবলার সত্যজিতের সঙ্গে কর্তা সত্যজিতের কোনও মিলই পেলাম না! ডার্বি আমার জীবনে নতুন নয়। ফুটবলার সত্যজিৎ ও সব অনেক খেলেছে, জিতেওছে। কিন্তু কখনও সে মনে করতে পারে না ডার্বির আগের এক রাতের কথা, যেখানে সে না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। বা গোটা দিনটা ছটফট করেছে পরের দিন মাঠে কী হবে ভেবে। খেলতাম যখন, ক্লাবের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াটা আমার স্বাভাবিক রুটিনের মধ্যে পড়ত। ডার্বির আগেও চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছি, ইয়ার্কি-ফাজলামি মেরেছি। শুধু পরের দিন বড় ম্যাচ বলে আনন্দটা একটু বেশি থাকত। ওই পর্যন্ত।
আর কর্তা সত্যজিৎ? বিশ্বাস করুন, সে ঘুমোতে পারছে না। ঠিক করে খেতে পারছে না। খাবে কী? তার তো খিদেই পাচ্ছে না!
সন্ধেয় নিজের ফুটবলজীবনের ডার্বির দিনগুলোর কথা ভাবছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না যে, কী করে তখন ও রকম নির্লিপ্ত, শান্ত থাকতে পারতাম? আর আজ দেখুন। ক্লাবের ফুটবল সচিব এখন আমি। ঢুকতেই কেউ কেউ বলল, কী রে সত্য কাল জিতবে তো টিম? শুনেই পেটে গুড়গুড় করে উঠল। মনের মধ্যে কেউ একটা বলে উঠল, জিতবে তো কী রে! কাল তো জিততেই হবে সত্য।
কেউ কেউ ভাবতে পারেন, লোকটা একটু বেশিই টেনশনে ভুগছে। এমন তো নয় যে, পৃথিবীর শেষ মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলটা রবিবার যুবভারতীতে হতে যাচ্ছে। সেখানে নাওয়া-খাওয়া ভুলে পেটের ভিতর হাত-পা সেঁধিয়ে ফেলার মানে কী? মানে আছে। আর্মান্দো কোলাসোর সময় যেমন লিগ হারিয়েও ডার্বি জিতেছিলাম। রবিবারও যুবভারতীতে সেটা করতে চাই।  
আসলে আমাদের মতো কট্টর মোহনবাগানীদের তো এটাই মুশকিল। টিমটা একেবারে রক্তে ঢুকে গিয়েছে। আমার দাদু কার্তিকচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অনিল দে, বলাই চট্টোপাধ্যায়দের সমসাময়িক। মোহনবাগান খেলার প্রস্তাব পেলেও দাদু কোনও দিন হাওড়া ইউনিয়ন ছাড়তে পারেননি। লোকে বলত, হাওড়া ব্রিজটাই খুলে দেব, দেখি কী করে যায়! দাদু যাননি, কিন্তু তাঁর শিষ্য ল্যাংচা মিত্র মোহনবাগানের প্রথম লিগজয়ী টিমের সদস্য। বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে রবিন পাত্র—অনেকেই বালি অ্যাথলেটিক ক্লাব থেকে মোহনবাগান খেলেছেন। মোহনবাগানে খেলার স্বপ্নটা তাই পরিবার থেকে পেয়েছিলাম।
পঁচাশিতে বিসি রায় ট্রফি খেলার পর মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল দু’টো ক্লাব থেকেই প্রস্তাব পেয়েছিলাম। শৈলেন মান্না নিজে গিয়ে দাদুকে রাজি করিয়ে নেন। ইস্টবেঙ্গল যাওয়া আর হয়নি কখনও। পরে আটানব্বই সালে জাতীয় লিগ জেতার পর ইস্টবেঙ্গলের এক বড় কর্তা ফোন করে বলেছিলেন, ফোনেই ‘হ্যাঁ’ বলতে। ‘না’ বলা যাবে না। আর টাকাটা আমাকে ঠিক করতে। মাথা ঘুরে গিয়েছিল শুনে। টুটুদা (টুটু বসু) রাতের দিকে তখন ফোন করতেন। বলতেন, ‘‘তুই যাস না। যতটা পারব দেব তোকে।’’ দাদু তখন আর নেই। কিন্তু দাদুর কথা ভেবেই মোহনবাগান আমার আর ছাড়া হয়নি। মোহনবাগান আমাকে দিয়েওছে অনেক। সম্মান, অর্থ, ট্রফি— কোনও কিছুরই অভাব হয়নি আমার। এখন ক্লাব কর্তা। শুধু একটা আক্ষেপ আছে। কালকের ডার্বিটা নিয়ে ভাবতে বসলে যা হচ্ছে।
মাথা থেকে পা পর্যন্ত মোহনবাগানের জেনেও তো কাল কেউ বলবে না আজ সম্মানের যুদ্ধ, সত্য বলটা নিয়ে ইস্টবেঙ্গল গোলের দিকে ছুটে যা!
 ছবি: উৎপল সরকার, শঙ্কর নাগ দাস।

http://www.anandabazar.com/khela/%E0%A6%A1-%E0%A6%B0-%E0%A6%AC-%E0%A6%A8-%E0%A6%9C-%E0%A6%A4%E0%A6%B2-%E0%A6%B2-%E0%A6%97-%E0%A6%9C-%E0%A6%A4-%E0%A6%B2-%E0%A6%AD-%E0%A6%95-1.204035