কলকাতার একটা ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছি না কিছুতেই। জায়গাটার কথা বলেছিলেন আমাকে এক কলকাতা-বিশেষজ্ঞ বন্ধু— সিসিওএস (CCOS), জায়গাটা নাকি এক কালে ওই নামেই পরিচিত। এই সংক্ষেপিত নামটির গোটা পরিচয় এমনতর— চিৎপুর-কাশীপুর (Cossipore) ওপেন স্পেস। তখন টালা ট্যাঙ্ক হয়েছিল কি না বলতে পারব না, টালা পার্ক নামটিও কবে থেকে চালু হয়েছে জানি না। কিন্তু এই অঞ্চলেরই একদা পরিচয় ছিল সিসিওএস।
টালা পার্ক রাস্তার নামও এক সময় বদলে গেল— হল তারাশঙ্কর সরণি— তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে এবং তাঁর জীবিতকালে নয়, তাঁর তিরাশিতম জন্মোৎসবের (জন্ম: ১৮৯৮, মৃত্যু: ১৯৭১) কালে। তারাশঙ্কর ওই সিসিওএস-এর ১৭১ নং প্লটটি কিনেছিলেন কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের কাছ থেকে। ওটাই ছিল ঠিকানা, ১৭১ সিসিওএস। বছরটা ছিল ১৯৪৭। পরে নতুন করে রাস্তার নামকরণ হল, সংখ্যারও বদল হল। ১৭১ হল ২৭, আর রাস্তার নাম টালা পার্ক অ্যাভিনিউ। ১৯৮০ সালে আবার নাম বদল হল— বাড়ির ঠিকানা ২৭ তারাশঙ্কর সরণি। ছোট ছেলে সরিৎকুমারের পড়ার সুবাদে কলকাতায় এসে উঠেছিলেন আনন্দ চ্যাটার্জি লেনের একটা ভাড়া বাড়িতে। অনেক কষ্ট করে ধারদেনা করে টালা পার্কের নতুন বাড়িটি সমাপ্তপ্রায় হলে সরিৎবাবুর বিয়ের পরে পরেই নতুন বাড়িতে এসে উঠলেন ১৯৪৯ সালের রথযাত্রার দিনে।
এই বাড়িতে বসেই লিখলেন ‘কালিন্দী’, ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাস। তখন তুষারকান্তি ঘোষ গুটিপায়ে এই রাস্তা দিয়েই আপন শ্বশুরবাড়িতে আসতেন, তাঁর সহচর দক্ষিণারঞ্জন বসু মশায় তো এই বাড়ির পাশের বাড়িতে বাসিন্দা হয়ে এসে যান। বাড়ির নীচের ঘরে বাঘছালের ওপর (এটা দিয়েছিলেন দুই পুত্রের কমন শ্বশুরমশায় অবনীনাথ ভট্টাচার্য, তাঁর বেয়াইমশায়কে)। সামনে থাকত কাঠের নানা সাইজের ডেস্ক। সেগুলি এখন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্পদ।
তারাশঙ্কর ছবিও আঁকতেন, তাঁর শিল্পচর্চার শুরু বাড়ির দেওয়ালে— চুঁইয়ে-আসা জলে দেওয়ালের গায়ে যে জলছবি আপনা-আপনিই গড়ে উঠত, তাতে খড়ি-রং-কাঠকয়লা বুলিয়ে।
তত দিনে তারাশঙ্কর সরণি আর তার আশেপাশের রাস্তায় নানা জনের বসবাস, আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েেছে। কাছেই ইন্দ্র বিশ্বাস রোডে প্রায় সাত কাঠা পরিমাণ জায়গা কিনে সজনীকান্ত দাস আর ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আধাআধি পরিমাণ জমিতে বাড়ি করে বসবাস শুরু করেছেন। তবে জমজমাট আড্ডাটি সংলগ্ন পাইকপাড়াতেই জমে উঠেছিল। তারাশঙ্করের বাড়ির সামনে বাড়ি করেছেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। দোতলা বাড়ি। দু’জনের বাড়ির সামনে একটা লেডিজ পার্ক। সেই সব ঘটনার একমাত্র সাক্ষী হিসেবে বিরাজ করছেন এখনও কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তিনি শৈলজানন্দের বাড়ির একতলায় এসেছেন ভাড়াটে হিসেবে। নীরেন্দ্রনাথ বললেন, লেডিজ পার্কের ভিতর দিয়ে যাওয়ার একটা অলিখিত অনুমতি পেয়ে গিয়েছিলেন উভয় পক্ষ। প্রায়ই তিনি তারাশঙ্করের বাড়িতে যেতেন এবং তারাশঙ্করও হামেশাই এসে হাজির হতেন শৈলজা-নীরেনের বাড়িতে। আড্ডা হত না, কিন্তু আলাপ-পরিচয়ে কেটে যেত সোনার মুহূর্তগুলি। সে একটা দিন গিয়েছে। কৌতূহলীরা তাঁর গদ্যসমগ্রের দ্বিতীয় খণ্ডটা একটু উলটে-পালটে দেখে নিতে পারেন।
দেখতে দেখতে টালা পার্কের লাগোয়া পাইকপাড়ায় এসে বাসা বাঁধতে শুরু করেছেন গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, গৌরকিশোর ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বিমল করদের সঙ্গে ঘোরতর আড্ডাধারী ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকার সম্পাদক শিবনারায়ণ রায়, তাঁর যাবতীয় ‘র‌্যাডিক্যাল’ চরিত্রকে দূরে সরিয়ে রেখে। অনেকেই অনেক কথা স্মৃতি থেকে উদ্ধার করেছেন বটে, কিন্তু শিবনারায়ণ রায়ের কলমে তা উজ্জীবিত এখনও। সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের ‘কলেজ স্ট্রিটে সত্তর বছর’ বইয়ের পরিশিষ্ট অংশে ধরা আছে সেই সব। কারণ এই আড্ডাতে সাহিত্য ছাড়িয়ে, চপ-কাটলেট মুড়ি খাওয়ার সূত্রে পরস্ত্রী-কাম-বন্ধুপত্নীদের সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়ার কথাটা শিবনারায়ণবাবু নিজের ঘাড়েও নিয়েছেন। ঠিক যেন বুঝতে পারিনি— নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে মোহরের যেন কী একটা সম্পর্কের কথা তিনি আবছা-ধোঁয়াশায় ছেড়ে দিয়েছেন। মোহরকে আপনাদের না-চেনার কথা নয়। ঠিকই ধরেছেন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই বলছি। এ-সব পাঁচকান করে শিবনারায়ণবাবু ভাল করেছেন কি না জানি না। তাঁদের উত্তরাধিকারীদের কাউকে কাউকে জিজ্ঞেস করতেই তাঁদের আরক্তিম বদন দেখে বুঝেছি, যা যা রটে, তার কিছু কিছু বটে!
পঞ্চাশের দশকের সূচনায় টালার গা-লাগোয়া নীলমণি মিত্র লেনে একক বাসিন্দা শিবনারায়ণ রায়— তিনতলা একটা বাড়ির ছাদের একটেরে চিলেকোঠায়। এই অধ্যাপক ঘরে গৃহিণী এলেন। এক এক রাতে নাছোড়বান্দা কোনও সাহিত্যিক এসে পাণ্ডুলিপি খুলে পাঠ শোনান। এ হেন কালে এক দিন গৌরকিশোর ঘোষ এসে পাইকপাড়ায় একটা ফ্ল্যাটের সন্ধান দিয়ে দু’জনের মিলিত সংসার ফ্ল্যাটে ভাগাভাগি করে স্থাপনের প্রস্তাব দিলেন। প্রস্তাব গিলে ফেললেন রায় মশায়। পরকে আপন-করা দু’টি গেরস্তালিতে হানা দিতে লাগলেন আশপাশের পড়শি সাহিত্যিকেরা। আড্ডাটা জমে ওঠে এই পাড়ার আর এক বাসিন্দা— সাহিত্যিক-কাম-প্রকাশক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের বাড়িতেও তাঁর ‘শয্যাগৃহ-কাম-বৈঠকখানা’য়। এখানে এমনকী বই ছাপানোর সূত্রে তাঁর প্রকাশক গৌরীশঙ্করের আড্ডায় এসে হাজির হতেন তারাশঙ্করবাবুও। আসতেন ‘আরণ্যকের বিভূতিভূষণ’, ‘বিস্তারিতবপু ডাক্তার ঔপন্যাসিক’ বনফুল এবং কুস্তিগীর দীর্ঘকায় প্রতিভাবান ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরি এবং ‘হ্যাংলাটে চেহারার’ অবধূত। একদা শিবনারায়ণবাবু তাঁর লেখা বিষয়ে কটু মন্তব্য করলে অবধূত শিবনারায়ণ রায়কে ভয় দেখান যে তিনি এমন মন্ত্রপূত বাণ প্রয়োগ করবেন যার ফলে সপ্তাহখানেকও কাটবে না, মুখ দিয়ে রক্ত উঠে ‘বাক্যস্ফূর্তি’ চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে যাবে।’ তবে আড্ডা জমে উঠত অনেকের গৃহিণীর প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে— গৌরীশঙ্করের স্ত্রী সুরূপা— চা সরবরাহে অক্লান্তা, রায়গিন্নি, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের স্ত্রী শোভনাদের উপস্থিতিতে। সত্যি কি না জানি না কিন্তু শিবনারায়ণ লিখে গেছেন বলে শোভনা বিষয়ে তাঁর একটি মন্তব্য আমাদের কোনও মন্তব্য ছাড়াই হুবহু তুলে দিচ্ছি—‘আমার সঙ্গে তাঁর সৌহার্দ্যের সম্পর্ক নিয়ে তাঁদের বাড়ির অল্পবয়সিনীরা শুনেছি রঙ্গরসিকতা করতেন।’
আড্ডায় আসতেন যুগান্তরের বার্তা সম্পাদক দক্ষিণারঞ্জন বসু, বাজার যাওয়ার পথে থলি হাতে। আসতেন সন্তোষকুমার ঘোষ ‘কথার অফুরন্ত ফোয়ারা’ নিয়ে। এক বার একটা কাণ্ড করলেন তিনি— সমকালীন বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তারাশঙ্কর, বনফুল, বিমল মিত্র থেকে শুরু করে সমরেশ বসু, সুবোধ ঘোষকে একটানা মুণ্ডপাত করে যেতে লাগলেন নিষ্ঠুর, শ্লীল-অশ্লীল-উলঙ্গ ভাষায় আক্রমণ করে। শিবনারায়ণবাবু সকলের অজান্তে একটি ব্যাটারি-চালিত টেপরেকর্ডার টেবিলের নীচে রেখে সবটা রেকর্ড করে রাখেন, পরে সন্তোষবাবুকে শোনান। সেটি যদি এখন এক বার আমরা পেতাম!
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে আলাপের সূচনায় পণ্ডিত শিবনারায়ণ বলে ফেলেছিলেন— আপনার ‘কিনু গোয়ালার গলি’ পড়ে আমার খুব ভাল লেগেছিল। সন্তোষকুমার ঘোষের কৃতিত্ব নরেন্দ্রনাথ মিত্র গ্রহণ করতে চাননি বলে মৃদুকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, অনেকেই এ ভুল করে, কিন্তু সন্তোষবাবুর মতো চোখা কলমে আমি তো লিখতে পারি না।’ শোনা যায়, মৃদুকণ্ঠ নরেনবাবু নাকি তাঁর অনেক লেখার রসদ এই আড্ডা থেকেই সংগ্রহ করতেন।
আসতেন সংগীতশাস্ত্রী পণ্ডিত রাজ্যেশ্বর মিত্র, এবং একদা কালীপদ পাঠককে পর্যন্ত আড্ডায় ধরে এনেছিলেন গৌরকিশোর। আসতেন সংগীতবিশারদ, ‘স্মৃতির অতলে’-র লেখক অমিয়নাথ সান্যাল এবং কার্টুনসিদ্ধ চিত্রশিল্পী অহিভূষণ মালিকও। ভারী গলা এবং ভারী শরীর নিয়ে তিনি এক বার গৌরীবাবুর চৌকির একটা পায়া ভেঙে দিয়েছিলেন। আড্ডা সে দিন ‘তিনপেয়ে’ হয়ে পড়েছিল। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথা বলেছি। তাঁর ‘নীল নির্জনে’-র ‘হা-রে-রে, রঙ্গিলা তোর কথার টানে টানে’ পঙ্‌ক্তিতে আড্ডাধারীরা বিমোহিত। আসতেন উত্তরসূরি-বিখ্যাত অরুণ ভট্টাচার্যও।
বিমল কর আড্ডাধারীদের মধ্যে তাঁর বাসস্থানের স্বতন্ত্রতায় স্বতন্ত্র ছিলেন। তিনিই একমাত্র দোতলা কিন্তু টিনের চালওয়ালা ‘দুর্গে’ বাস করতেন। রোগজীর্ণ চেহারা। কিন্তু আড্ডায় ‘ইঁদুর’ গল্পটির পাণ্ডুলিপি গৌরকিশোরকে দিয়ে পড়িয়ে আসর মাত করেছিলেন। যত ক্ষণ পড়া চলেছিল, তিনি গৌরীশঙ্করবাবুর পায়খানাতে নিজেকে অন্তরীণ রেখেছিলেন। আসতেন নবীন লেখক দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘চর্যাপদের হরিণী’-র সেই বিখ্যাত লেখকও! শান্তিনিকেতন থেকে আসতেন শান্তিদেব ঘোষও। রূপদর্শীর সে কী আনন্দ! উদীয়মান কবিদের সংস্পর্শে আড্ডা জমে উঠত।
টালা পার্কে টালা ট্যাঙ্ক থেকে তখন যে বিশুদ্ধ কবিতারস প্রবাহিত হয়ে আপামর বাঙালি রসিকের পিপাসা নিবারণ করত, তাতে আর সন্দেহ কী! সেই পাড়ায় এখন নবীন বাসিন্দা হল আড্ডার স্থানে সাহিত্যের এক পীঠস্থান। অমলশঙ্কররা খুশি, তাঁদের বাড়িতে এখন সশরীরে আড্ডা দিতে এসে হাজির বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ। তার অন্যতম অভিভাবক কবি শঙ্খ ঘোষও ঘটনাচক্রে এই পাড়ার বাসিন্দা ছিলেন— একদা।

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/most-of-the-prominent-writers-came-to-tarasankar-bandyopadhyay-s-house-to-chat-1.772524?ref=archive-new-stry