বার্তা সম্পাদক গৌরীদি বললেন, ‘‘ধর। চিফ এডিটর কথা বলবেন।’’ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফোনের ও পারে অভীকবাবুর গলা, ‘‘কপিটা কী? এক লাইনে বল।’’ মাথা পুরো ফাঁকাই ছিল এত ক্ষণ। সকাল থেকে ঘটে যাওয়া অতিদ্রুত ঘটনাপ্রবাহে এবং প্রভাবে হতচকিত। প্রধান সম্পাদকের প্রশ্নে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘‘ক্যাডার লিডস দ্য লিডার। নেতাদের নেতৃত্ব দিলেন ক্যাডাররাই।’’ মুহূর্তেই ভেসে এল তাঁর অনুমোদন, ‘‘ঠিক। ওটাই কপি। দ্রুত লিখে ফেল। যে কোনও সময় কিন্তু সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।’’
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। স্থান: অযোধ্যা। ২৫ বছর অতিক্রান্ত। কিন্তু সে দিনের স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে আজও। কমণ্ডল রাজনীতির সুবাদে ১৯৯১ থেকে ১৯৯২, দু’বছরে বার পনেরো অযোধ্যায় আসা-যাওয়া। প্রতি বারই ‘কী হয় কী হয়’ ভাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধর্মগুরু ও রাজনীতিকদের যৌথ প্রয়াসে লেখা চিত্রনাট্য মেনেই বিতর্ক জিইয়ে রেখে নেতাদের হম্বিতম্বিতে শেষ হয়েছে এক এক পর্ব। প্রতি বারই বিফলমনোরথ হয়ে ফিরেছে দাবার বোড়ে, করসেবকরা। সঙ্গে নিয়ে নেতাদের প্রতি পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। ৯২’-এর ৬ ডিসেম্বরের আগেও একাধিক বার করসেবকদের একাংশ চড়াও হয়েছে বিতর্কিত কাঠামোটির উপর। তবে প্রতি বারই নেতারা শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে এনেছেন তাদের। আর গালাগালি দিতে দিতে ফিরেছে তারা।

এ বার তারা যেন প্রথম থেকেই বেশ রাগী। মহারাষ্ট্র থেকে আসা এক দল করসেবকের গেরুয়া টি-শার্টের সামনে স্পষ্ট করে ইংরেজিতে লেখা ‘আয়্যাম অ্যান অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’। পিছনে বিশুদ্ধ দেবনাগরীতে ‘জয় শ্রীরাম’। তাদের মুখের ধ্বনিও সেই ‘জয় শ্রীরাম’। প্রতিসম্ভাষণে ‘জয় শ্রীরাম’ না বললেই পাল্টা হুমকি, ‘‘আবে বোল!’’ ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে প্রতিদিনই করসেবকদের ঢল অযোধ্যায়। নেতাদের পরিকল্পনা ছিল, এক একটা দল আসবে। করসেবাস্থল ঘুরে রামলালার দর্শন করে ফিরে যাবে নিজ গন্তব্যে। রামমন্দিরের পয়লা নম্বর প্রবক্তা অশোক সিঙ্ঘল এবং তাঁর লেফটেন্যান্ট, বজরং দল প্রধান বিনয় কাটিয়ার সাংবাদিকদের জানালেন, করসেবকদের যাওয়া-আসা চলতেই থাকবে। ৬ ডিসেম্বর করসেবার ‘ডি-ডে’তে হাজার পঞ্চাশেক সেবক অযোধ্যায় হাজির থাকবেন। তাঁরাই সরযূ নদীর চর থেকে মুঠি-ভর বালি নিয়ে সুশৃঙ্খল ভাবে বিতর্কিত ২.৭৭ একর এলাকার বাইরে, কংক্রিটের চাতালের চার পাশে ছড়িয়ে দেবেন।
কিন্তু নেতারা ভাবেন এক, ক্যাডাররা আর এক। প্রতিদিনই করসেবকরা আসছে দলে দলে। কিন্তু ফিরছে না কেউই। সকলেই চায়, মূল দিনের করসেবায় অংশ নিতে। এর আগে করসেবকরা মূলত এসেছে উত্তরপ্রদেশ থেকেই। কিন্তু এ বার করসেবকরা বিভিন্ন রাজ্য থেকে। বাংলা, অসম, মহারাষ্ট্র তো আছেই, দলে দলে করসেবকরা আসছে বিন্ধ্যর দক্ষিণ দিক থেকেও। অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, কেরল থেকেও করসেবকদের এমন ঢল নতুন ঘটনা বইকী। সব রাজ্যের শিবির আলাদা। সেই সব শিবিরে শিবিরে ঘুরছেন সাংবাদিকরা। কিন্তু ঠোক্কর খেতে হল অন্ধ্রের শিবিরে যেতেই। প্রবেশ নিষেধ। খানিকটা তর্কাতর্কি, এবং তাদের রক্তচক্ষু দেখে শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকদের পিছু হঠা। সে দিনই বিকেলে অন্ধ্রের সেই দলটিকে দেখা গেল রামকথাকুঞ্জ-সহ বিতর্কিত এলাকার চারপাশে ‘পরিক্রমা’ করতে। সুঠাম চেহারা, চোখের কোণে রক্তিম আভা। রশি, গাঁইতি, শাবল, কোদালে সুসজ্জিত জনা পঞ্চাশেক যুবক। 
পাঁচ তারি‌খ সকাল সকাল বার্ব ওয়্যার, জিআই পাইপের বেড়ার মধ্যে শ’দুয়েক সিআরপিএফ প্রহরায় থাকা রামলালাকে ‘দর্শন’। আসলে ভিতরের ব্যবস্থা সাংবাদিকরা যে যাঁর মতো জরিপ করতে ব্যস্ত। বাস্তবিকই ইনস্যাস রাইফেল আর কার্বাইনে সুসজ্জিত নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আস্থাশীল সকলেই। ঘেরাটোপের এক পাশে প্রচুর বেতের ঢাল আর বেতের লাঠি। বিতর্কিত কাঠামোর পিছনে অন্তত দু’ফুট চওড়া, পনেরো ফুট উঁচু প্রাচীর। লক্ষ্মণ টিলার দিকে, কাঠামোর পিছন দিক থেকে ঢালু নয়, একেবারে খাড়া মাটির টিলা। চার-পাঁচ তলা বাড়ির সমান উঁচু। তার উপরে প্রাচীর-ঘেরা কাঠামো। কেউ বলেন বাবরি মসজিদ, কেউ বা বলেন রামমন্দির। সাংবাদিকরা লেখেন, বিতর্কিত কাঠামোয় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা!!! হায় রে, তখনও কি তাঁরা জানতেন, এই নিরাপত্তা কত ঠুনকো!
৬ ডিসেম্বর দিন শুরু হল সকাল পাঁচটায়। ফৈজাবাদের হোটেল থেকে বেরিয়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরের অযোধ্যার পথে যখন, তখন ঘড়ির কাঁটায় ছ’টা। উত্তরপ্রদেশের শীতের সকাল। ফৈজাবাদের মানুষরা রাস্তার দু’পাশে। হাত দেখিয়ে গাড়ি থামাল এক দল যুবক। মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। এ আবার কী গেরো! গাড়ির কাচ নামাতেই পোয়া-ভাঁড় ভর্তি দুধেল চা, লেড়ো বিস্কুট। যুবকদের বক্তব্য, অযোধ্যায় ভিড় বাড়াবেন না তাঁরা। শীতের সকালে মানুষকে চা খাইয়েই তাঁদের করসেবা চলছে।
লক্ষ মানুষের ভিড় ঠেলতে ঠেলতে গাড়ির প্রথম গন্তব্য সরযূ নদীর তীর। এখান থেকেই ‘মুঠিভর বালি’ সংগ্রহ করে করসেবকদের জন্মভূমি-যাত্রার কথা। কিন্তু কোথায় কী!
ধু ধু সরযূ তীর। সব পথের লক্ষ্যই করসেবাস্থল। পার্কিং-এ গাড়ি রেখে সেই ভিড়ে ভাসতে ভাসতে করসেবাস্থলে। আগের দিনের মতোই সেই ‘নিশ্ছিদ্র’ নিরাপত্তা। অবাধ প্রবেশের অধিকার নেই। সাংবাদিকদের গলায় ঝোলানো রাম জন্মভূমি ন্যাসের গোলাপি পরিচয়পত্র। প্রেস কার্ড। রুটিন মতোই আবার রামলালা সকাশে ঢু মারা। সেখানেই দেখা হয়ে গেল ফৈজাবাদের সিনিয়র সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ (এসএসপি) ডি বি রাই-এর সঙ্গে। বললেন, মাছিও গলতে পারবে না।
এর মধ্যেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্বেচ্ছাসেবকরা দেখালেন, পাশের মানস কুঞ্জের তিন তলার ছাদ হচ্ছে ‘প্রেস গ্যালারি’। সেখান থেকে সামনে তাকালে বিতর্কিত কাঠামো। নীচে তাকালেই উন্মুক্ত করসেবাস্থল। বাঁ দিকে রামকথাকুঞ্জের অস্থায়ী একতলা অফিস। তার ছাদই আজকের ভিভিআইপি মঞ্চ। সেখান থেকেই ভাষণ দেবেন লালকৃষ্ণ আডবাণী, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরকার্যবাহ (সাধারণ সম্পাদক) এইচ ভি শেষাদ্রি, সঙ্ঘের গুরুত্বপূর্ণ নেতা কে এস সুদর্শন, মুরলী মনোহর জোশী, রাজমাতা বিজয়রাজে সিন্ধিয়ারা। সুতরাং প্রেস গ্যালারিতে ‘পজিশন’ নেওয়ার জন্য সাংবাদিকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ছাদে পজিশন নিয়েও কী মনে হতে নেমে এলাম নীচে। সামনের দরজায় স্বেচ্ছাসেবকরা আর সাংবাদিকদের বেরোতে দিচ্ছেন না। অতএব খিড়কি দোরই ভরসা। বেরিয়ে এসে গোলাপি প্রেস কার্ড দেখিয়ে করসেবাস্থলে প্রবেশ। দেখা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সহ-সভাপতি পি পি তোষনিওয়ালের সঙ্গে। তিনিই জানালেন, কোনও করসেবকই অত দূরে সরযূ তীরে যেতে রাজি হয়নি। সে কারণেই পরিকল্পনায় ‘ছোট বদল’ করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। তাঁর সঙ্গে কথা শেষ হতেই দেখা গেল, রামকথাকুঞ্জ আর সংলগ্ন অ্যাপ্রোচ রোডে করসেবকদের ভিড় উপচে পড়ছে। সঙ্গে গগনভেদী হুংকার ‘জয় শ্রীরাম’। ভিড় সামলাতে সঙ্ঘের স্বেচ্ছাসেবকরা ওই শীতেও খাকি হাফপ্যান্ট আর সাদা হাফশার্ট বা টি-শার্ট পরে মানবশৃঙ্খল রচনা করে দাঁড়িয়ে। বিশৃঙ্খল করসেবকদের সামলানোর দায়িত্ব তাঁদেরই। তার মধ্যেই তদারকি করে বেড়াচ্ছেন ‘পহেলবান ধরমদাস’। একদা বিনয় কাটিয়ারের ছায়াসঙ্গী পহেলবান তত দিনে গেরুয়া বসনধারী ‘স্বামী ধর্মদাস’ হয়ে গিয়েছেন। তত ক্ষণে তাঁর শিষ্যদের নিয়ে হাজির আচার্য বামদেব। পুজোপাঠের প্রয়োজনীয় সাজসজ্জা শুরু হয়েছে। নজরে পড়ল, সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত পর্যবেক্ষক তেজশঙ্কর এক কোণে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে সব পর্যবেক্ষণ করছেন। কয়েক দিন আগেই এই তেজশঙ্করের সঙ্গে আলাপ হয়েছে দিল্লিতে, সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি বেঙ্কটচালাইয়ার এজলাসে। করসেবার অনুমতি দিয়ে সে দিনই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ তাঁকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেন।
তেজশঙ্করকে প্রশ্ন করি, কেমন বুঝছেন? হাসলেন, ‘‘এভরিথিং ইজ ফাইন।’’ ঘড়ির কাঁটায় তখন ন’টা।
রামকথাকুঞ্জের মঞ্চ থেকে তখন ভেসে আসছে রাম-ভজন। করসেবা পরিসরের এক কোণে, বিতর্কিত এলাকা ঘেঁষে একটা মাটির ঢিবি। সেখান থেকে চারপাশটা পরিষ্কার দেখা যায়। এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে সেই ঢিবির উপরে দাঁড়ালাম। সেখানে ইটের উপরে বসে উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন ডিরেক্টর-জেনারেল অব পুলিশ তথা বারাণসীর বিজেপি সাংসদ শ্রীশচন্দ্র দীক্ষিত। তিনি আবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদেরও সহ-সভাপতি। পাশেই ফৈজাবাদ ডিভিশনের ডিআইজি উমাশঙ্কর বাজপেয়ী। তিনিও জানালেন, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।
এরই মধ্যে সপার্ষদ হাজির চিত্রকূটের বৈষ্ণবাচার্য হরিচরণ দাস। সঙ্গে ‘টিন-এজ’ সাধু রঘুনন্দন, হরিচরণের শিষ্য। ফর্সা, দোহারা চেহারা। নির্দিষ্ট আসনে বসে রঘুনন্দন তাঁর গেরুয়া ঝোলা থেকে দু’টি ছোট কর্ণিক বের করতেই তেড়ে এলেন পহেলবান। কর্ণিক নিয়ে টানাটানি চলতে চলতেই ছেলেটিকে কাঁধে তুলে নিয়ে পহেলবান ধরমদাস ধেয়ে গেলেন উত্তর-পূর্ব কোণের গেটের দিকে। কার্যত পরিসরের বাইরে ছুড়ে ফেললেন তাঁকে। সঙ্গে সঙ্গে আগুনে যেন ঘি পড়ল। করসেবকদের জমাট ভিড় আছড়ে পড়ল গেটের উপর। স্বেচ্ছাসেবকরা সামলাতে পারলেন না, শ’দুয়েক যুবকের দল ঢুকে পড়ল করসেবাস্থলের মধ্যে। হাতে তাদের কর্ণিক নয়, প্রমাণ মাপের ত্রিশূল। শুরু হল উন্মত্ত নাচ। বোল একটাই, ‘জয় শ্রীরাম’। সঙ্ঘের লাঠিধারী বাহিনী তেড়ে গেল তাদের দিকে। ধাক্কা দিতে দিতে বের করে দিল।
ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁয়েছে। এত ক্ষণ নোটবই, পেন হাতেই ছিল। গলায় ঝুলছিল প্রেস কার্ড। কী মনে হতে সে সব গুটিয়ে পকেটে চালান করলাম। অন্য পকেট থেকে টেনে বের করলাম ‘জয় শ্রীরাম’ লেখা সিল্কের ফেট্টি। রামকথাকুঞ্জের মাইকে তখন ভজন থেমে গিয়েছে। বার বার ‘অনুশাসন’-এর হুঁশিয়ারি আসছে। ভেসে আসছে সিঙ্ঘলের গলা, কাটিয়ারের গলা, ‘‘যাঁরা বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন তাঁরা আমাদের লোক নন। করসেবা ভন্ডুল করতে আসা ষড়যন্ত্রী। পিভি, মুলায়ম, ভিপির পাঠানো লোক। কোনও প্ররোচনায় পা দেবেন না।’’  
স্তব্ধ: কলকাতার রাজপথে সেনা প্রহরা। ১১ ডিসেম্বর, ১৯৯২
করসেবক বনাম স্বেচ্ছাসেবকদের এই টানাপড়েনের মাঝে ছিল উত্তরপ্রদেশের ‘কুখ্যাত’ পিএসি, প্রভিনশিয়াল আর্মড কনস্টেবুলারি। এদের হিন্দু-প্রীতি সুবিদিত। টানাপড়েনের মধ্যে তারা কখন এক পাশে সরে গিয়েছে। চারদিকে সমুদ্রের মতো গর্জন, জয় শ্রীরাম।
বেলা সাড়ে এগারোটা। হঠাৎই বিতর্কিত কাঠামোর পিছন দিক থেকে রশি বেয়ে গম্বুজের মাথায় উঠে এল এক দল করসেবক। পিঠে বাঁধা গাঁইতি, শাবল। অন্ধ্রের সেই দলটি। মুহূর্তে বদলে গেল ছবিটা। সঙ্ঘের তথাকথিত অনুশাসনকে পায়ে দলে করসেবাস্থল হয়ে কাঠামোর দিকে ধেয়ে চলেছে করসেবকরা। এই জনজোয়ারকে আটকাতে বেতের লাঠি হাতে এগিয়ে গেলেন পহেলবান ধরমদাস। কিন্তু জনস্রোতে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলেন তিনি। তার পরই লাফিয়ে ফের দৌড়লেন রামকথা কুঞ্জের দিকে। করসেবকদের কয়েক জন তাড়া করল পহেলবানকে। হাতে ত্রিশূল, মুখে বিশুদ্ধ হিন্দিতে গালি। তত ক্ষণে পহেলবান পগার পা়র।
কোন দিকে যাব বুঝতে পারছি না। রামকথাকুঞ্জে, না কি এখানেই। কী ভেবে করসেবকদের সঙ্গে দৌড়ে গেলাম। ঢুকে পড়লাম বিতর্কিত কাঠামোর মধ্যে। এসএসপি ডি বি রাই চিৎকার করছেন, ‘‘চার্জ টিয়ার গ্যাস!’’ বার বার চিৎকারে তাঁর মুখে দৃশ্যতই ফেনা উঠে গিয়েছে। কিন্তু কাঁদানে গ্যাস যাদের হাতে, সেই পিএসি বাহিনী তখন এসএসপি-র নির্দেশ উপেক্ষা করেই চত্বর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। গোটা কাঠামো তখন করসেবকদের দখলে। শুরু হয়ে গিয়েছে ইটবৃষ্টি। এ বার এসএসপি-র শেষ ভরসা সিআরপিএফ-ও বেতের ঢালে মাথা ঢেকে ছেড়ে যাচ্ছে চত্বর। এক জওয়ান বললেন, ‘‘আপ ভি চলিয়ে, নেহি তো মর যাওগে।’’ তাঁর ঢালে মাথা বাঁচিয়ে নেমে এলাম সীতা রসুইয়ের সামনের রাস্তায়।
এগোলাম রামকথাকুঞ্জের দিকে। সহকর্মী সাংবাদিকরা কে কোথায় ছিটকে পড়েছে। প্রাক্-মোবাইল যুগ। উপরে তাকিয়ে দেখলাম, মানস কুঞ্জের ছাদের প্রেস গ্যালারিতে শুধু থিকথিকে মাথা। কাঠামোর গম্বুজ ভাঙার কাজ তখন শুরু হয়ে গিয়েছে। কংক্রিট নয়, চুন-সুরকির শক্ত পাঁচশো বছরের পুরনো গাঁথনির গম্বুজ। সাড়ে বারোটা নাগাদ সবসুদ্ধ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল বাঁ দিকের প্রথম গম্বুজটি। মীর বাঁকির গড়া ‘বাবরি মসজিদ’-এর ধুলোয় মিশে যাওয়া তখন মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা।
রামকথাকুঞ্জের মাইক এত ক্ষণ ছিল স্তব্ধ। হঠাৎ ঘড়ঘড় আওয়াজ করে সচল হল। এক এক করে ভেসে আসছে আডবাণী, যোশী, রাজমাতা, সুদর্শন, সিঙ্ঘলদের গলা। সকলের অনুরোধ, এ বার নেমে আসুন। কিন্তু কে শোনে সে কথা!
রামকথাকুঞ্জের দিকে এগনোর বৃথা চেষ্টা করে ক্ষান্ত দিয়েছি। দেখা এক সিনিয়র সহকর্মীর সঙ্গে। রামকথাকুঞ্জেই ছিলেন এত ক্ষণ। জানালেন, আডবাণীজি খুবই বিভ্রান্ত। প্রমোদ মহাজন মাথা চাপড়াচ্ছেন, ‘আরে ইয়ে ইস্যু হমারা হাথ সে নিকাল গয়া।’ সকলেই আশঙ্কায়, যে কোনও সময় রাজ্যের বিজেপি সরকারকে ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করবে কেন্দ্র। নরসিংহ রাও সরকার বাকি কাঠামোর সুরক্ষায় ঢোকাবে সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনী। কিন্তু কোথায়
কী! বেলা তিনটেয় ভেঙে পড়ল দ্বিতীয় গম্বুজটিও।
আবার সরব হল মাইক। এ বার ভেসে এল জ্বালাময়ী ভাষণের জন্য বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত) সাধ্বী ঋতম্ভরা ও উমা ভারতীর গলা। এত ক্ষণের ‘স্টান্স’ পালটে ফেলে হিন্দুত্ববাদ এ বার স্লোগান তুলল, ‘‘এক ধাক্কা অউর দো/ বাবরি মসজিদ তোড় দো।’’ নেতারা ভেসে গেলেন ক্যাডারদের স্রোতে।
ইতিমধ্যে হঠাৎই এক করসেবক লাঠি নিয়ে তাড়া করল। তাড়া খেয়ে উঠে গেলাম বিতর্কিত কাঠামোর ঠিক পাশের বাড়ি, সীতা রসুই ভবনে। রামভক্তদের বিশ্বাস, এখানেই ছিল সীতা মাইয়ার রন্ধনশালা। ছাদে দেখা কয়েক জন সহকর্মী সাংবাদিকের সঙ্গে। অনেকেই তখন অযোধ্যা ছেড়ে ফৈজাবাদের পথ ধরেছেন। কিন্তু ঠিক করেছি, শেষ গম্বুজটি ভেঙে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব। শীতের সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। বিকেল ৪টে ৪৯ মিনিট। ভেঙে পড়ল মূল গম্বুজ। মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেল। ভাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুই ভাবতে পারছি না। সকাল থেকে পেটে দানাপানি পড়েনি। খিদের বোধও চলে গিয়েছে।
নেমে এলাম সীতা রসুইয়ের তিন তলার ছাদ থেকে। চার দিকে থিকথিক করছে করসেবক। কেউ বিতর্কিত কাঠামোর ইট সংগ্রহ করছে। কয়েক জন সহকর্মীও ইট নিল। স্মারক। নিতে গিয়েও নিলাম না। এদিক-ওদিক করে ফৈজাবাদ রোডে। সব গাড়ি পালিয়ে গিয়েছে ফৈজাবাদে। আমাদের গাড়িও। স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদপত্রের ‘বহেনজি বাহিনী’ ডাক দিল, ‘‘ভাইয়া, হমারা গাড়ি মে আইয়ে।’’ ওমনি ভ্যানের পিছনের ডিকির দরজা খোলা। স্টেপনির উপর বসে ফিরছি। রাস্তার এ পাশে, ও পাশে টায়ার জ্বলছে। কোথাও দোকান জ্বলছে। গলির মুখে ভয়ার্ত মুখের জটলা। কপি ভাবার চেষ্টা করছি, ইন্ট্রো কী হবে? দূর, কিছু ভাবতেই পারছি না। মাথা ফাঁকা।

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/25-years-of-the-demolition-of-the-babri-masjid-flashback-of-babri-demolition-1.717271?ref=archive-new-stry