এক জন লিখলেন ‘‘আমাদের শিবসাগরে ইংরেজি স্কুলে অসমীয়া ছেলেদের কোমল মনের উপর গমপেষা যাঁতার মতোই বাংলা ভাষার যাঁতা ঘর্‌ঘর্‌ করে ঘুরিয়ে দিয়েছিল।’ আর এক জন শোনালেন বালেশ্বরের এক প্রভাবশালী জমিদারের কাছারিঘরে বাঙালি বাবুদের বৈঠকে ‘আজকাল’ প্রধান আলোচ্য বিষয় হল কী উপায়ে সরকারি অফিসগুলো থেকে ওড়িয়া তুলে দিয়ে বাংলা ভাষার প্রচলন করা যায়। এবং বাঙালিদের সঙ্গে তর্কবিতর্কের জন্য কেমন করে তিনি বাঙালি সমাজে ‘পরম শত্রু’ হয়ে পড়েছিলেন। বাঙালি বাবুরা ঘৃণাবশে তাঁর নামটি পর্যন্ত করতেন না।
প্রথম ব্যক্তি লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া, যিনি তখনও ভাবতে পারেননি যে, এক দিন তিনি এই বাংলাতেই জামাই হয়ে আসবেন এবং খোদ ঠাকুরবাড়ির, আর শিলঙে যখন তাঁর ‘রবিকাকা’ তাঁকে বলবেন ‘‘তোমরাই তো আসামকে বার করে নিয়ে বাংলা ভাষার পরিসর কমিয়ে দিলে’’— তখন মুখ বুজেই তাঁকে সে কথা হজম করতে হবে, কারণ তিনি তাঁর ‘গুরুজন’। দ্বিতীয় মানুষটি ফকিরমোহন সেনাপতি, যাঁর মাধ্যমে ওড়িয়া সাহিত্যে নবযুগের সূচনা বলে ধরা হয়। ১৯১৮-র ১৮ জুন প্রতিবেশী রাজ্যের এই বিশিষ্ট মানুষটির প্রয়াণের পর বাংলার প্রধান কাগজগুলোতে তাঁকে নিয়ে এক কলম খবরও বেরোয়নি! কিন্তু তিনি বাঙালি বাবুদের সম্পর্কে লেখার সময় ভাবতেও পারেননি যে, এক বাঙালিনি এক দিন পুত্রবধূ হিসেবে হবেন তাঁর রোগশয্যার সেবিকা, আর মৈত্রী নামের পৌত্রীটি তাঁর আত্মজীবনী বাংলায় অনুবাদ করে তাঁকে বাংলার পাঠকদের সামনে তুলে ধরবেন।
দুই প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে বাংলার সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই ভাষাই কখনও উত্তাপ সৃষ্টি করেছে, আবার সেই ভাষায় রচিত সাহিত্যই কখনও কাছে এনেছে, অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ফকিরমোহন লিখেওছেন সে কথা যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ভূদেব মুখোপাধ্যায় বা অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখের বইপত্র প্রকাশিত হলে বাংলা ও ওড়িশার স্কুলগুলোতে পাঠ্যপুস্তকের অভাব দূর হয়েছিল। আর বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’, ‘সোমপ্রকাশ’ বা ‘এডুকেশন গেজেট’ দেখে ‘অজ্ঞাতসারে আমার একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ত’, ভাবতেন ‘‘কবে উৎকল ভাষায় এরূপ একখানি পুস্তক বেরুবে।’’ শেষ অবধি এক দিন তাঁর সাধ পূরণ হল— তৈরি হল ‘পি এম সেনাপতি এন্ড কোং উৎকল প্রেস’, যার আগে উৎকলের একমাত্র ‘পতিতপাবন’ ছিল কটক মিশন প্রেস। বালেশ্বরের এই ছাপাখানা দেখার জন্য ‘‘রথযাত্রার রথ দেখার ন্যায়’’ দু’তিন মাস ধরে ‘‘দূরদূরান্তর হতে লোকেরা সারি সারি ছুটে আসছিল।’’
ফকিরমোহনের জন্ম এই বালেশ্বরেই, ১৭৫ বছর আগে, ১৮৪৩-এ। ন’বছর বয়সেই মা-বাবাকে হারিয়ে বড় হন পিতামহীর যত্নে। নানা রকম রোগের কবল থেকে নাতিকে মুক্ত করতে তিনি বালেশ্বরের দুই পিরের শরণাপন্ন হন, মানত করেন ‘বাছা ব্রজ’ ভাল হয়ে গেলে তিনি নাতিকে তাঁদের ‘গোলাম’ বা ‘ফকির’ করে দেবেন। আর সেই থেকে ব্রজমোহনের নামটি বদলে হয়ে গেল ফকিরমোহন।
পাঠশালার পাট চুকিয়ে ভর্তি হলেন স্থানীয় বারবাটি বঙ্গোৎকল বিদ্যালয়ে। পরে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শিবচন্দ্র সোমের (যিনি ‘উড়িষ্যার ইতিহাস’ লিখেছিলেন ১৮৬৭-তে) আহ্বানে সেখানেই ‘থার্ড মাস্টার’ হিসেবে যোগ দেন। এর পর বালেশ্বর মিশন স্কুলের প্রধান শিক্ষকও হয়েছিলেন। ওড়িয়া ভাষার প্রতি বাঙালি শিক্ষক ও ‘বাঙালি বাবুদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য’ তাঁর মনে আর পাঁচ জন ওড়িয়া যুবকের মতোই গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এক দিকে বাংলা বইপত্রগুলো দেখে ‘দীর্ঘনিঃশ্বাস’ আর অন্য দিকে বাঙালিদের তাচ্ছিল্য— দুইই তাঁকে মাতৃভাষার ‘উন্নতি সাধন’-এর লক্ষ্যে অবিচল করে তোলে।
ওড়িশার পক্ষে তখন সময়টা খুব সুখের ছিল না। বাংলা, মাদ্রাজ আর সেন্ট্রাল— এই তিন প্রেসিডেন্সির মধ্যেই ছিল তার অবস্থান। সম্বলপুর অঞ্চল ছিল ‘সেন্ট্রাল প্রেসিডেন্সি’র মধ্যে, গঞ্জাম ছিল মাদ্রাজের অংশ, আর পূর্ব দিকের উপকূলীয় অঞ্চল— বালেশ্বর, মেদিনীপুর আর পুরী ছিল বাংলার মধ্যে। এই সব এলাকায় তখন হিন্দি, তেলুগু আর বাংলাভাষী আমলাদেরই দাপট, যাঁরা আবার এক ধরনের উপনিবেশবাদ কায়েম করছিলেন। বলাই বাহুল্য তাঁদের অনেকেই ওড়িশার মানুষজনকে খুব সুনজরে রাখেননি। বিষয়টা বেশি করে দেখা গেল পুরী, কটক বা বালেশ্বর অঞ্চলে, যা ছিল বাংলার অধীনে।
কলকাতা তখন রাজধানী। পশ্চিমি জ্ঞানবৃক্ষের ফল প্রথম ভক্ষণকারী বাঙালি প্রশাসনিক চাকরি নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল পেশওয়ার বা রাওয়ালপিন্ডি পর্যন্ত। আর ওড়িশা তো তার নিজের প্রদেশেরই অংশ। তাই সেখানকার স্কুল থেকে প্রশাসন— সর্বত্রই তার প্রাধান্য, আধিপত্য। আর তা বজায় রাখার তাড়নায় যে সে ওড়িয়া ভাষার স্বাতন্ত্র্য অগ্রাহ্য করবে তাতে আর আশ্চর্য কী! এই স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ওড়িশায় শুরু হল ভাষা আন্দোলন। বাংলায় লেখাপড়া শিখে বাঙালির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চাকরির দৌড়ে জেতা কি সহজ? ফকিরমোহন দেখলেন দেশের ঘোরতর সঙ্কট। তিনিও যোগ দিলেন আন্দোলনে।
ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ওড়িশার স্কুলগুলোতে বাংলা ভাষা প্রবর্তনের বিরোধিতা। ইংরেজ আমলে প্রশাসনিক কাজকর্ম যে আয়ের এক নিরাপদ উৎস তা ওড়িশাবাসীও বুঝতে ভুল করেননি। তাঁদের মনে হয়েছিল বাংলা ভাষা প্রচলিত থাকলে ওড়িয়াদের পক্ষে লেখাপড়া শেখা শক্ত হবে এবং ফলত সরকারি চাকরির দরজাও বন্ধ থাকবে। এবং বাঙালিরাই স্থায়ী ভাবে তখন সর্বত্র আধিপত্য করে যাবেন। তা ছাড়া আর একটি দিকও ছিল— বাংলা পাঠ্যবই রচয়িতাদের আয়বৃদ্ধির দিক— যে কথা গগনেন্দ্রনাথ দাসের মতো মানুষ লিখেছেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্রেরই তো স্কুলস্তরে পাঠ্যবই ছিল, যিনি কটকে এক বক্তৃতায় (১৮৬৯) নিদান দিয়েছিলেন: ওড়িয়া ভাষা না ওঠালে এ দেশের (ওড়িশা) উন্নতি সম্ভব নয়।
ঠিক এই সময় ওড়িয়া ভাষায় ফকিরমোহনের লেখা ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রকাশিত হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনে তা যেন আরও ইন্ধন জোগাল। ‘উৎকল দীপিকা’-র সম্পাদক, ওড়িশাবাসী সুপ্রসিদ্ধ বঙ্গসন্তান গৌরীশঙ্কর রায়, যিনি তীব্র ভাবে বাংলা ভাষা চাপানোর বিরোধী ছিলেন, তিনি এ বার আক্রমণ করলেন গ্রন্থকারকে। নিজের পত্রিকায় প্রকাশিত বইয়ের সমালোচনায় (১০ এপ্রিল ১৮৬৯) বললেন, ফকিরমোহনের ব্যবহৃত ভাষায় উচ্চবর্গে প্রচলিত বাংলা ভাষার প্রভাব রয়েছে। রাজেন্দ্রলালের বক্তৃতার পর পরিস্থিতি তখন ছিল রীতিমতো উত্তপ্ত। ফকিরমোহনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল গৌরীশঙ্কর আসলে হয়তো পরিস্থিতির তাড়নাতেই এমন সমালোচনার পথটি নিয়েছিলেন।
বালেশ্বর মল্লিকাশপুরের শান্তিকানন। বলা হয়, ফকিরমোহন এখানে বসেই লেখালিখি করতেন। ছবি: প্রফুল্ল দাস
ভাষাভিত্তিক আধুনিক ওড়িয়া সত্তার নির্মাণে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ফকিরমোহন স্বভাবতই স্পর্শকাতর হয়ে পড়লেন। ব্রতী হলেন বাংলার ছায়ামুক্ত হয়ে এক ‘খাঁটি’ বা বলা যেতে পারে ‘বিশুদ্ধ’ ওড়িয়ার ব্যবহারে। ইতিমধ্যে তিনি অনুবাদ করে ফেলেছেন ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয়ের আদেশে তাঁর রচিত বাংলায় জীবনচরিতখানি’, ১৮৬৬-তে। লক্ষণীয় হল ‘উৎকল দীপিকা’য় প্রকাশিত এক বেনামা চিঠিতে (৯ মার্চ ১৮৬৭) এর ভাষাও কঠোর ভাবে সমালোচিত হয় ওই আগের কারণেই— কৃত্রিমতা, বাংলার প্রভাব, সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত ওড়িয়ার সঙ্গে দূরত্ব।
ফকিরমোহনের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে ১৮৭০-এ প্রকাশিত হল ‘উড়িয়া স্বতন্ত্র ভাষা নহে’। লেখক কান্তিচন্দ্র ভট্টাচার্য। যিনি বালেশ্বর গভর্নমেন্ট স্কুলে ওড়িয়া পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত হয়ে এসেছিলেন এবং ধরে নিয়েছিলেন ওড়িয়া পড়ানোটা তাঁর পক্ষে কঠিন হবে না। কিন্তু বাস্তবে তা হল না। উল্টে ছেলেরা তাঁর ‘হে বাড়ক্‌ গনো’ জাতীয় বাক্যে হাসাহাসি করতে থাকে। সেই জ্বালা জুড়োতেই তিনি বলতে লাগলেন ‘‘আরে উড়িয়া তো স্বতন্ত্র ভাষা নয়। বাংলার বিকৃতি মাত্র, উড়ে পড়ার আর দরকার নেই।’’ কিন্তু বইতে তিনি যা করলেন তাকে সাদা বাংলায় বললে বলা যায়, ফকিরমোহনকে এক রকম ফাঁসিয়েই দিলেন। লিখলেন, স্বয়ং ফকিরমোহনই তো বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত-এর অনূদিত সংস্করণের ভূমিকায় বলেছেন যে, ‘‘কেবল ক্রিয়ামাত্র পরিবর্তন করে দিলে বাংলা ওড়িয়া হয়ে যায়।’’ এবং তিনিই তো দেখিয়েছেন দুটি ভাষায় কত সাদৃশ্য। ‘উৎকল দীপিকা’র কারণে ইতিমধ্যেই চাপে থাকা ফকিরমোহনের অস্বস্তি যে বাড়ল তা কি আর এর পর বলার অপেক্ষা রাখে? তবে সে যাত্রা ফকিরমোহনের ত্রাতা হিসেবে অবতীর্ণ হলেন বালেশ্বরের কালেক্টর জন বিম্‌স। ভাষাতত্ত্বে সুপণ্ডিত এই মানুষটি কান্তিচন্দ্রের বক্তব্যকে ‘profoundly destitute of philological arguments’ বলে এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রবন্ধ পর্যন্ত পেশ করেন। সে কারণেই কি ফকিরমোহন ‘আত্মচরিত’-এ লেখেন, ‘‘সাহেব মহোদয় আমাকে অনেকবার অনেকরকম বিপদ হতে রক্ষা করেছেন’’? বলা হয় এর পর থেকে ফকিরমোহন সাদামাটা ওড়িয়া লিখতে শুরু করেন এবং যা ছিল পরিপূর্ণ ভাবে বাংলা ভাষার প্রভাবমুক্ত। স্বতন্ত্র ওড়িয়া সত্তার এই নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই নাকি ধীরে ধীরে বাংলাভাষীদের সেখানে ‘পলিটিক্যাল আদার’ হিসেবে দেখার সূত্রপাত।
এ সব তো তত্ত্বকথা। বরঞ্চ ফকিরমোহনের লেখায় বাংলা-প্রভাবের কথাই একটু ভাবা যাক। বঙ্কিমচন্দ্র বা লালবিহারী দে-র প্রভাব তো স্পষ্টই। ‘বিষবৃক্ষ’-তে বঙ্কিমচন্দ্র লিখছেন: ‘‘নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ/ যা দেবী বটবৃক্ষেষু ছায়ারূপেণ সংস্থিতা।’’ আর ‘ছ মাণ আঠ গুণ্ঠ’-তে ফকিরমোহন লিখছেন: ‘‘যা দেবী বৃক্ষমূলেষু শিলারূপেণ সংস্থিতা/ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ’’ (‘বুড়িমঙ্গলা’ গল্প)। আবার লেখক যখন ‘অসুর দিঘি’-তে দুপুরে স্নানের সময় মহিলাদের জমজমাট পরচর্চার কথা লেখেন, যার বিষয়বস্তু ‘‘গতরাত্রে কাহার ঘরে কী রান্না হইয়াছিল... কে কখন শুইল, কাহাকে কত মশা কামড়াইল... রামার মায়ের নতুন বউটা বড় ঝগড়াটি’’, তার মধ্যে আবার লালবিহারী দে-র ‘মেয়েদের পার্লামেন্ট’কে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। ঠিক যেমন সংক্ষিপ্ত ‘উৎকল-ভ্রমণম্‌’ (১৮৯২)-এর উপর দীনবন্ধু মিত্রের ‘সুরধুনী কাব্য’-এর প্রভাব আবিষ্কার অসম্ভব না হতেও পারে। আবার তাঁর ‘পেটেন্ট মেডিসিন’ সত্যেন্দ্রনাথের ‘নিদিধ্যাসন’-এর উপর ভিত্তি করেই যে লেখা তা নিয়ে সংশয় নেই। তবে এগুলোকে ঠিক অনুকরণ বলা ঠিক হবে না। শিশিরকুমার দাস ফকিরমোহনের লেখাকে বঙ্কিমী পরম্পরা থেকে মুক্তই রেখেছেন। তাঁর মত হল, "it created a new world of fiction which was further expanded and enriched later in the century by... Premchand and Tarashankar Bandyopadhyay."
আসলে ফকিরমোহনরা কখনও বাংলাকে উপনিবেশের ভাষা বলে মনে করেননি। স্থানীয় সমস্যার প্রতিকারে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় অনেক চিঠিপত্র লিখেছেন ফকিরমোহন। অবশ্যই বাংলা ভাষায়। কিন্তু উপনিবেশের প্রতিনিধি বঙ্গসন্তান যখন সেই ভাষার জোরে আর একটি উপনিবেশ স্থাপন করতে চাইলেন তখনই লাগল গোলমাল। গৌরীশঙ্কর রায় বা রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট বাঙালিরা ওড়িয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে সে দিন বাঙালির মুখ রক্ষাই বোধহয় করেছিলেন। কটক জেলা স্কুলে পড়ার সময় মধুসূদন দাসের লম্বা টিকিটি এক দিন একটি বাঙালি ছেলে কেটে দিয়েছিল।
বাঙালিদের একাংশ (যাদের বসবাস কিন্তু ওড়িশায় ছিল না সব সময়) কিন্তু এ নিয়ে বেশ কুণ্ঠিতই ছিলেন। শিবচন্দ্র সোমের বই তো শুরুই হয়েছে ‘উড়িষ্যার প্রতি বৈদেশিক লোকের অকারণ অশ্রদ্ধা’ দিয়ে। আবার আন্দুল রাজ এস্টেটের ম্যানেজার নগেন্দ্রনাথ মিত্র ‘পুরী তীর্থ’-য় লিখেছিলেন, বাঙালিরা ওড়িয়াদের ঘৃণা ও অবজ্ঞার চোখে দেখতে পারেন। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও তাঁদের জানা উচিত যে ‘‘উড়িষ্যাবাসীগণ পূর্ব্বকালে শৌর্য্য-বীর্য্যে ও শিল্পনৈপুণ্যে বাঙ্গালী অপেক্ষা যে সর্ব্ববিষয়ে শীর্ষস্থানীয় ছিল ইতিহাসই তাহার সাক্ষী।’’ উৎকল স্থাপত্যের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের অপরিসীম শ্রদ্ধার নিদর্শন পাই ‘সীতারাম’-এ। উৎকলের মধ্যযুগীয় সাহিত্যের উৎকর্ষ তুলে ধরেছিলেন যিনি, তিনিও কর্মসূত্রে ওড়িশায় যাওয়া এক বাঙালি, নাম রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ফকিরমোহনও বিপরীতে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতে ভোলেননি যে, ‘‘আমরা বালেশ্বরবাসীরা বাঙালিবাবুদের সংস্রবে এসে সভ্যতা, সাধু ব্যবহার, বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেছি।’’
মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম নিন্দনীয় নয়। যা ফকিরমোহন করেছিলেন। কিন্তু তার জন্য তাঁর প্রতি ওড়িশার বাঙালিদের শ্রদ্ধা কমে গিয়েছিল বলে মনে হয় না। তাঁর প্রয়াণের পর সম্বলপুরে আয়োজিত স্মরণসভায় বেশ কয়েক জন বাঙালি শ্রদ্ধার সঙ্গেই অংশগ্রহণ করেছিলেন (‘সম্বলপুর হিতৈষিণী’, ২২ জুন ১৯১৮)। ভাষা আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক রং চড়েছিল বটে তবে বাংলা-ওড়িশার মনের আসা-যাওয়া বন্ধ হয়েছিল বলে মনে হয় না। ‘আত্মচরিত’-এ ফকিরমোহন লিখেছিলেন, মেদিনীপুরের দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষদের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হওয়া সত্ত্বেও বাড়িতে তাঁদের কথাবার্তা হত ওড়িয়াতে। আর জগন্নাথ দাসের ‘ওড়িয়া ভাগবত’-এর মতো বই সেখানে বাংলা হরফে ছাপিয়ে ‘ঘরে ঘরে পঠিত হচ্ছে’। মজার ব্যাপার হল, ছবিটা এই সে দিনও ছিল একই রকম, না হলে কেন আর কাঁথির ‘নীহার’ পত্রিকায় ১৩৪৪-৪৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে এমনটা দেখতে হয়: জগন্নাথ দাসের শ্রীমদ্ভাগবত ‘উৎকল ভাষায় বঙ্গাক্ষরে মুদ্রিত’? আসলে ওড়িয়া শিক্ষকরা তো ভাষা শেখাতে কেবল দাঁতন, পটাশপুরই নয়, মহিষাদল পর্যন্তও যেতেন। কাঁথি, দাঁতন, বেলদা (কখনও কোলাঘাট, তমলুকও বাদ থাকেনি) জুড়ে চলত ‘উড়িয়া’ যাত্রাপালা (অন্য নামে ‘দখিনা’ যাত্রা)। আর অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন ঢেঙ্কানলে বিশ শতকের গোড়ায় গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘বিল্বমঙ্গল’ বা দ্বিজেন্দ্রলালের ‘মেবার পতন’-এর মতো বাংলা নাটকের অভিনীত হওয়ার কথা। ‘নিমাইসন্ন্যাস’ তো খুবই জনপ্রিয় ছিল। আসল কথা, দু’তরফই আর ওই গোলমালের বিষয়টা মনে রাখেননি। রেগে গিয়ে রাধানাথ রায়ও আবার ওড়িয়া ছেড়ে সাহিত্য রচনার মাধ্যম হিসেবে নিজের মাতৃভাষা বাংলায় ফেরেননি। ফকিরমোহনের প্রদৌহিত্রী বিশিষ্ট ওড়িয়া ইতিহাসবিদ নিবেদিতা মহান্তি তো এক বার হেসেই এ সব কথা উড়িয়ে দিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘‘তোমরা তো ভাই রাজা ছিলে, রাজারা অমন একটু আধটু করে।’’ নীরব থাকাই সে দিন শ্রেয় জ্ঞান করেছিলাম। আসলে সবার মধ্যে ওই একটি শক্তি ছিলেন, তিনি জগন্নাথ। একটা গল্প দিয়ে শেষ করা যাক।
সদ্য বেঙ্গল-নাগপুর রেলপথ বসেছে। হাওড়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলো থেকে দরিদ্র বৃদ্ধারা তখন দু’দিন ধরে হেঁটে বারুণীর সময় আসতেন ‘গঙ্গা নাইতে’। যাত্রাকালে যখন ওই রেলপথটি তাঁরা অতিক্রম করতেন, তখন নাকি ওই লোহার পাতগুলোয় মাথা ঠেকাতেন আর জগন্নাথকে ডাকতেন— ‘‘এ আমাদের ঠাকুরবাড়ির লাইন গো, এ জম্মে তো হল না, পরের জম্মে যদি যেতে পারি।’’ এটাই তো আসল যোগসূত্র। আর ওড়িশা, বাংলা-ওড়িশা সম্পর্ক, ফকিরমোহন— এই সবটাকে বুঝতে হবে এই আবেগপূর্ণ অনুভূতি দিয়েই।

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/fakirmohan-senapati-is-regarded-as-the-father-of-odia-nationalism-and-modern-odia-literature-1.821153?ref=rabibashoriyo-new-stry