ছেলেবেলা কাকে বলে? কোন সুর জলতরঙ্গের মতো টুংটাং বেজে ওঠে শব্দটা শুনলেই? নিজের কথা বলতে পারি। আমার কাছে ছেলেবেলার ছবি মানেই গোবেচারা আঁকাবাঁকা একটা নদী— করতোয়া— জীবনে কোনও দিন বন্যা এনে সব কিছু ভাসিয়ে দেওয়ার দম্ভ যে দেখাতে পারেনি। তারই এক পাশে, উঁচু পাড়ের ওপর সাজানো-গোছানো বগুড়ার ছোট্ট একটা শহর। রাস্তায় ধুলো, খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে ইশকুলে যাতায়াতই রেওয়াজ। জায়গাটা মুসলমানপ্রধান হলেও এই তথ্যটির আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে বলে ছেলেবেলায় কোনও দিনই মনে হয়নি। বাড়ির কর্তা— মানে আমার বাবা— স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে বেশির ভাগটাই জেলে জেলে। আমার অভিভাবকত্বের ভার ছিল প্রতিবেশী বয়স্কদের ওপর। তাঁদের স্নেহ, তাঁদের শাসনে বড় হতে হতে এক দিন আবিষ্কার করলাম, এঁদের অধিকাংশই মুসলমান।
ইশকুলেও একই অবস্থা। অঙ্কের স্যর জসিমউদ্দিন আহমেদ ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন বরাবর। সরস্বতীপুজোয় চেয়ার পেতে বসে সব কিছুর খবরদারি করতেন। ফাইনাল পরীক্ষার আগে অঙ্কে-কাঁচা ছেলেদের, যেমন আমি— জোর করে পাকড়ে নিজের বাড়ি এনে শাসন, তর্জন আর স্নেহ দিয়ে রগড়ে রগড়ে কিঞ্চিৎ ভদ্রস্থ করে তোলার চেষ্টা করতেন। বদলে ‘সম্মানদক্ষিণা’ কথাটা তোলার মতো হিম্মত কারও ছিল না।
ইশকুলের শিক্ষকদের মধ্যে দু’জন— সংস্কৃতের পণ্ডিতমশাই আর আরবির মৌলবি সাহেব— সব থেকে কম মাইনে পেতেন সম্ভবত। সেই জন্যেই, কী করে জীবনযুদ্ধে কোনও রকমে টিকে থাকা যায় তার টেকনিক নিয়ে শলা-পরামর্শ করতে করতে নিবিড় বন্ধুত্ববন্ধনে জড়িয়ে নিয়েছিলেন নিজেদের। হেঁটে হেঁটে বহু দূর থেকে ইশকুলে আসতেন তাঁরা, খালি পায়ে। এঁদের প্রাক্তন ছাত্ররা, কেউ এখন উকিল, কেউ অফিসার, কেউ বা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী— হয়তো টাঙা চড়ে উলটো দিকে চলেছেন। এঁদের দেখামাত্র গাড়ি থামিয়ে কাছে এসে প্রণাম বা কদমবুসি জানাতেন। আশীর্বাদ পেয়ে আর দিয়ে যে যার আবার নিজের পথে।
এক ভরা শ্রাবণে ইশকুলে গিয়ে খবর পেলাম, আগের রাতেই মৌলবি সাহেব হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছেন। একটু পরেই তাঁর দেহ এসে পৌঁছবে। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁকে গোর দেওয়া হবে ইশকুল-মাঠের শেষ প্রান্তে উঁচু ঘাসজমিতে। জায়গাটা শহরের শেষ সীমানা ছাড়িয়ে, যার পর অবারিত ধানখেত আর দূরে দূরে ছোট ছোট গাঁ।
কবর খোঁড়া হল। মৌলবি সাহেবকে শুইয়ে দেওয়ার পর আপনজনেরা কয়েক মুঠো করে মাটি ফেলবেন তার ওপর। মাটি চাপানো শেষ হলে আর ফিরে দেখতে নেই নাকি। এটাই প্রথা। অতএব, আমরা সবাই উলটোমুখো হাঁটা শুরু করলাম। এমন সময় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অজয়— ডানপিটেমিতে যে বরাবরই ফার্স্ট বয়, চাপা গলায় বলল, ‘‘দূর, কী হবে ফিরে তাকালে? কচু হবে।’’
বলে, সে ফিরে তাকাল। সেই সঙ্গে আমিও। যে দৃশ্য দেখতে পেলাম তা না দেখলে আমার ছেলেবেলার সোনার ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটাই অদেখা থেকে যেত।
আকাশ জুড়ে থরে থরে কালো পাশবালিশের মতো মেঘের সারি অনেক নীচে নেমে এসেছে। হাওয়া দিচ্ছে শনশন। একটু আগে হয়ে-যাওয়া বৃষ্টির ফোঁটা ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে ঘাসজমির লম্বা লম্বা ঘাসের ডগা থেকে। যেখানে মৌলবি সাহেবকে রেখে আসা হল সেখানে আর কেউ নেই এখন। শুধু এক জন ছাড়া। আমাদের পণ্ডিতমশাই।
হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে তাঁর খাটো উত্তরীয়টা। পইতেটা আঙুলের ডগায় তুলে, আমাদের দিকে পিছন ফিরে, তিনি কী যেন বলে চলেছেন তাঁর সদ্যপ্রয়াত বন্ধুকে। ভাল করে কান পাতলে বোঝা যায়—
‘আকাশস্থ নিরালম্ব বায়ুর্ভূত নিরাশ্রয়
অত্র স্নাত্বা ইদং পীত্বা স্নাত্বাপীত্বা সুখি ভবেৎ।’
ধুলোয় ছড়ানো শল্‌মা-চুমকির মতো এমন কত সব চকচকে ছবি, আমার ছেলেবেলা।
শহরে দু-দু’টো সিনেমা-হল। ‘উত্তরা’ আর ‘মেরিনা’। ‘মেরিনা’ আবার বিশাল একটা পার্কের ঠিক মাঝখানটায়, চার দিকে ফুলের মেলা। ছবি আসত নিউ থিয়েটার্স আর বম্বে টকিজ-এর। সেই সঙ্গে চার্লি চ্যাপলিনের।
চার্লির ছবি মানেই অফুরন্ত মজা। কিন্তু শুনতাম, এ সব ছবির পিছনে নাকি দুর্দান্ত সব ‘হাই থট’ লুকনো থাকে। শহরে মনোয়ার বলে একটা লোক ছিল। খুন-জখম জাতীয় ব্যাপারে খুবই সুনাম তার। সে-ই প্রথম বলেছিল আমাকে, ‘‘চাল্লির ছবি বোঝা অত সোজা না। বাড়িৎ গিয়া ভাব।’’
এ বার সেই ছোট্ট শহরটার দুর্গাপুজোর কথা। এ-পাড়া ও-পাড়া মিলে পুজো হত বেশ কয়েকটা। কিন্তু আমাদের প্রধান আকর্ষণ সাবেকি দত্তবাড়ির দুই তরফের দু’টো জমকালো পুজো। সদ্য-পাওয়া নতুন জুতোজোড়ার কল্যাণে দু’পায়ে বড় বড় ফোস্কা নিয়ে এ-পুজো ও-পুজো করে বেড়াচ্ছি সর্ব ক্ষণ। নহবতখানা থেকে সানাইয়ের সুর। পথের দু’পাশে হল্লাদার মেলা। চরকি থেকে শুরু করে ‘দিল্লি দেখো বোম্বাই দেখো’-র উঁকি-মারা বাক্স, জিলিপি-গজা-রসগোল্লার দোকান। কাঠের বারকোশে স্তূপীকৃত খুরমার পসরা। চুলের ফিতে, কাচের চুড়ি, সোহাগ-আয়না। আদমদিঘির তাঁতিদের বোনা শাড়ি-গামছা। বাদুড়তলার কুমোরদের গড়া রকমারি পুতুল, ঘাড়-দোলানো বুড়োবুড়ি।
শাখাপ্রশাখা: নীচের সারিতে বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়, শিশু তরুণ মজুমদার। ডান দিকের শিশুটি তাঁর ভাই অরুণ মজুমদার। তার উপরের সারিতে একেবারে বাঁ দিকে মা সুনীলা, (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়) ঠাকুমা গিরিবালা। তারও উপরের সারিতে (বাঁ দিক থেকে চতুর্থ) বাবা বীরেন্দ্রকুমার মজুমদার
বড় তরফের নাটমন্দিরে কত রকম যে অনুষ্ঠান! বাইরে থেকে বড় বড় ওস্তাদদের আনাগোনা। বড়ে গোলাম আলি, তারাপদ চক্রবর্তী, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়, তুলসী লাহিড়ী। লখনউ ম্যরিস কলেজের সোনার মেডেল পাওয়া ছাত্র, অতুলপ্রসাদ সেনের প্রিয় শিষ্য পাহাড়ী সান্যাল (পরবর্তী কালে আমার পাহাড়ীদা) এক বার এসে ‘কে তুমি নদীকূলে বসি একেলা’ গেয়ে মফস্‌সলি শ্রোতাদের এমন মনোহরণ করেছিলেন যে পর পর তিন বার একই গান গেয়ে তবে তাঁর রেহাই।
এক দিন হত আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। শহরের ‘চ্যাংড়াপ্যাংড়া’দের, অর্থাৎ ছোটদের জন্য। বড়দের নাটক নামত নবমীর রাতে। বঙ্গে বর্গি, পিডব্লিউডি, তটিনীর বিচার। রিহার্সাল দিতে দিতে গলার বারোটা। গিন্নিরা তটস্থ। ঘন ঘন তুলসীর পাতা দেওয়া চা, গোলমরিচ-তালমিছরির ক্বাথ পাঠাতে পাঠাতে হয়রান। হে মা দুগ্‌গা, মান যেন থাকে।
বিজয়ার বিকেলে করতোয়ার পাড়ে লোকারণ্য। ডবল-নৌকো জুড়ে তার ওপর দেবী ভেসে বেড়াচ্ছেন এ দিক থেকে ও দিক, ও দিক থেকে এ দিক। সন্ধে হল তো হাউই, তুবড়ি, রংমশাল। নিরঞ্জনের পর ঘাট থেকে শুরু হয়ে গেল প্রণাম, কোলাকুলি, আশীর্বাদের পালা।
একটু দূরেই রেলের ব্রিজ। সকাল-সন্ধেয় দু’জোড়া ট্রেনের গুমগুম শব্দে যাতায়াত। তার পর সব চুপচাপ।
এক কোজাগরী রাতের কথা বলি। শহর ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা তফাতে রেলের প্ল্যাটফর্ম। আমার সেই ডানপিটে বন্ধু অজয় হঠাৎ এসে বলল, ‘‘চল, ইস্টিশনটা ঘুরে আসি।’’
‘‘এখন?’’
‘‘তো?’’
‘‘সে যে অনেকটা পথ। মাঝখানে ওই জলাটা। সাপের বাসা একেবারে...’’
‘‘কিচ্ছু হবে না। চল তো। ফুটফুটে জোছনা, দেখবি কেমন মজা।’’
সাপের ভয়ে কাঁটা হয়ে মজা দেখতে দেখতে শেষ অবধি পৌঁছনো গেল। ছোট্ট প্ল্যাটফর্ম, বড় বড় শিরিষের ছায়ায় ঝিমোচ্ছে। কাছে পৌঁছতেই একটা আওয়াজ কানে এল। আওয়াজ নয় ঠিক। বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে ভেসে আসা একটা খালি গলার গান: ‘ঘরবাড়ি ছাড়লাম রে, নদীর চরে বাসা রে—’
এই জনহীন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে শুধু ঝিঁঝিঁ আর কটকটি ব্যাঙের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই থাকবার কথা নয়, সেখানে গান গায় কে?
গুটিগুটি কাছে আসতেই থই পাওয়া গেল। অদূরে মাল ওজন করার যন্ত্রটার ওপর পিছন ফিরে বসে এক ভদ্রলোক জ্যোৎস্না-ধোওয়া জলার দিকে চেয়ে আপনমনে গেয়ে চলেছেন। পরনে ধুতি-শার্ট, ওপরে সুতির ইংলিশ কোট।
প্রৌঢ় স্টেশনমাস্টারমশাই তাঁর ঘরের দরজার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে আমাদের শব্দ করতে বারণ করেন। একটু পরে, গায়কের গান শেষ হলে, কাছে এসে
তিনি ফিসফিসিয়ে বলেন, ট্রেন ফেল করেছেন ভদ্রলোক। গিয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করো। আব্বাসউদ্দিন আহমেদ সাহেব!
এই স্টেশন, এই প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আরও একটা স্মৃতি আছে। সেটা মজার।
আমাদের ইশকুলের পুরনো অঙ্ক স্যর হরলালবাবু রিটায়ার করার পরে তাঁর জায়গায় নতুন এক জন এলেন। রোগাপটকা, মাথায় খাটো, রোদে-ঝলসানো ফরসা গায়ের রং। সব সময় কেমন যেন আনমনা, কী যেন ভাবেন সর্বদা। নাম মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা ডাকতে শুরু করলাম ‘মণি স্যর’ বলে। আগের অঙ্ক স্যর হরলালবাবুর মতো হাঁকডাক নেই। কেউ তাঁকে দেখে ভয় পায় না। শহর থেকে খানিক দূরে ইস্টিশনের কাছে গোটা কয়েক টালি-ছাওয়া ঘর— তারই একটায় ভাড়াটে হয়ে উঠেছেন। অজয় এক দিন এসে বলল, ‘‘চল, স্যরের ডেরাটা একটি ভিজিট মেরে আসি।’’
গিয়ে দেখি, বিচিত্র ব্যবস্থা। একটা খাটিয়া, একটা ট্রাঙ্ক আর একটা হারমোনিয়াম— ব্যস, সংসার বলতে এই। না ওঁর বউ, না ছেলেপুলে। স্টেশনে যে লোকটা পান-বিড়ি, চা-শিঙাড়া বিক্রি করে সেই রামটহল, রামটহল মিশি। সে জানাল, মাস্টারজি নাকি এই রকমই। বিয়ে-থা করেননি। বাড়িতে কোনও উনুন নেই। মাসচুক্তিতে দু’বেলা খাবার পাঠায় রামটহলই। মাস্টারমশাইয়ের ঘরের চাবি, মাসমাইনের টাকা, সবই নাকি থাকে ওর কাছে।
‘‘আজিব আদমি!’’ রামটহল বলে।
কিন্তু কী করে কী করে অজয় আর আমার সঙ্গে স্যরের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। খুব কাছের সম্পর্ক। মনে আছে, সেটা শ্রাবণ মাস। ক’দিন ধরে ঝমঝম করে তুমুল বৃষ্টি। চতুর্থ দিন সন্ধেয় হঠাৎ মেঘের ফাটল দিয়ে চাঁদ উঁকি দিল। নরম জ্যোৎস্নায় ভেসে গেল চারদিক।
অজয় আর আমি চলেছি ইস্টিশনের দিকে বেড়াতে। পৌঁছে দেখি হুলস্থুল কাণ্ড। স্টেশনমাস্টার মশাই, রামটহল আর ট্রলিম্যানরা ঘিরে আছে মণি স্যরকে। মণি স্যর কাঁদো কাঁদো হয়ে বলছেন, ‘‘ও রে! কী হবে এখন? আমি যে কথা দিয়ে কথার খেলাপ করে ফেললাম। এক নিরীহ ভদ্রলোককে এমন বিচ্ছিরি বিপদে ফেলে দিলাম!’’
‘কথার খেলাপ’, ‘নিরীহ ভদ্রলোক’, ‘বিচ্ছিরি বিপদ’— একটা কথারও মানে পরিষ্কার হল না আমাদের কাছে। শেষ পর্যন্ত এর-ওর মুখ থেকে শুনলাম ঘটনাটা।
দিন পাঁচেক আগে সকালের ডাউন ট্রেনটা সবে এসে দাঁড়িয়েছে প্ল্যাটফর্মে, এমন সময় মাঝবয়েসি এক ভদ্রলোক, কাঁচাপাকা চুল, গাড়ি থেকে নেমে একেবারে হইচই করে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কাঁদেন আর বুক চাপড়াতে থাকেন।
কী ব্যাপার? 
জানা গেল, বাড়ি ওঁর চার ইস্টিশন পরে, আদমদিঘিতে। সামনে মেয়ের বিয়ে। গয়না গড়াতে দিয়েছিলেন কলকাতায়। পাত্রপক্ষের খাঁই অনেক। শুধুমাত্র মেয়ে, ওর শ্যামলা রং সত্ত্বেও, দেখতে ভাল বলে এই বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছেন, কমের ওপর দিয়ে। ‘কম’ মানে মেয়েটির বাবার যথাসর্বস্ব।
সেই গয়না নিয়ে ফিরছিলেন ট্রেনে, সারা রাত সাবধানে আগলাতে আগলাতে। ভোরের দিকে একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। সেই ফাঁকে ওঁর গয়নার বাক্স উধাও।
কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ভদ্রলোক এক সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান প্ল্যাটফর্মে। জল, বাতাস, এ সব দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হলে ভদ্রলোক বলেন, তিনি আর ফিরবেন না আদমদিঘিতে। কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবেন নিজের একমাত্র মেয়ের সামনে! তার চেয়ে বরং লাইনে গলা দিয়ে মরবেন।
কান্নাকাটি, হা-হুতাশ, বুক চাপড়ানো— সবই মণি স্যর দেখছিলেন চোখের সামনে। এমন সময় হঠাৎ নাকি এগিয়ে এসে বলেন, ‘‘কী জাত আপনারা?’’
‘‘বামুন। চক্কোত্তি। আদমদিঘির বিশ্বনাথ চক্কোত্তি।’’
‘‘মেয়ের বয়েস?’’
‘‘এই একুশ পেরোবে সামনের মাসে।’’
‘‘দেখুন, রাজি হওয়ার কথা নয় আপনার। বিশেষ, যখন অমন পাত্রী। তবু যদি একান্ত মনে করেন, আমিও বামুন, মণিময় বাঁড়ুজ্যে, কম মাইনের মাস্টার এক জন। আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে পারি। ম্যাচিংটা ভাল হবে না। কিন্তু বিয়েটা তো হবে।’’
‘‘দেনাপাওনা?’’
‘‘নট এ সিঙ্গল পাইস। এই এরা সবাই সাক্ষী।’’
ভদ্রলোক, বলা বাহুল্য, হাতে চাঁদ পান। বিয়ের তারিখ, লগ্ন, এ সব জানিয়ে পরের ট্রেন ধরেন। মণি স্যর কথা দেন, সময়ের আগেই পৌঁছে যাবেন।
আজই সেই রাত। লগ্ন রাত দশটায়। আদমদিঘি যাওয়ার শেষ ট্রেন ছেড়ে গিয়েছে অনেক আগেই। এখন উপায়?
হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। স্টেশন মাস্টারমশাইকে বলি, ‘‘এক কাজ করলে হয় না?’’
‘‘কী?’’
‘‘আপনি যদি একটা ট্রলির ব্যবস্থা করে দেন, ট্রলিম্যানরা তো এখানেই আছে, সেই ট্রলি চেপে স্যর যদি বিয়ে করতে চলে যান? পনেরো-কুড়ি মাইল তো রাস্তা। ঠিক পৌঁছে যাবেন।’’
সবাই সমস্বরে ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’’ বলে ওঠেন।
অতঃপর ট্রলি। বরবেশে মণি স্যর। বরযাত্রী বলতে তিন জন। অজয়, আমি আর রামটহল। হাওয়া দিচ্ছে। মেঘ সরে যাচ্ছে ক্রমশ। তারই ছায়া পড়েছে দু’পাশের খোলা মাঠে জমা জলের বুকে। কচি কচি ধানচারা যেখানে হাওয়ায় দুলছে।
কাহালু, তালোড়া, নসরতপুর পেরিয়ে আদমদিঘি।
আমরা চলেছি মাস্টারমশাইয়ের বিয়ে দিতে।

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/childhood-memories-of-indian-film-director-tarun-majumdar-1.732193?ref=archive-new-stry