সে  উনিশ শতকের কথা। তখন বাংলা বানানে লখনউ শহরটাও ছিল অন্য রকম: ‘লক্ষ্ণৌর বাদশা কয়েদ থেকে খালাস হয়ে মুচিখোলায় আসায় শহর বড় গুলজার হয়ে উঠলো।’ লিখছেন হুতোম। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ দিয়েই মুখপাত শ্রীপান্থের ওয়াজিদ-দর্শনের। অযোধ্যার সদ্য-রাজ্যহারা নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কোম্পানির পেনশন নিয়ে লখনউয়ের কোনও প্রাসাদে নিশ্চিন্তে থাকতেই পারতেন। তা না করে ছুটলেন কলকাতা। ইচ্ছে, কাউন্সিলের কর্তাদের কাছে সওয়াল করবেন সিংহাসন উদ্ধারের জন্য। সফল না হলে যাবেন লন্ডনে, রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে। ইংরেজের ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে তাঁর মোহ তখনও কাটেনি। পরিস্থিতির চক্রব্যূহে কোনও কিছুই শেষ পর্যন্ত কাজে এল না, পেনশন নিতে রাজি হয়ে কলকাতাতেই জীবনের বাকি তিরিশটা বছর কাটিয়ে দিলেন ওয়াজিদ আলি।
সেটাই হল কাল। লখনউ থেকে সরে গিয়ে মূল স্রোতের ইতিহাস থেকেও হারিয়ে গেলেন তিনি। ওয়াজিদ আলি অযোধ্যা হারালেন ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬, লখনউ ছাড়লেন সে বছরেরই ১৩ মার্চ, কলকাতা এলেন ৬ মে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জ্বলে উঠল মহাবিদ্রোহের আগুন। তখনও কলকাতায় ভাল ভাবে থিতু হননি ওয়াজিদ আলি, নিতে রাজি হননি পেনশনও। কারণ লন্ডনে তখন ‘আউধ মিশন’ সক্রিয়, তাঁর হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন মা বেগম আউলিয়া আর তাঁর সহযোগীরা। সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাওয়ায় সে গুড়েও বালি পড়ল। ব্রিটিশ জনমত পুরোপুরি ঘুরে গেল ভারতীয়দের বিরুদ্ধে। এ দিকে কোম্পানির সরকার হঠাৎ মেটিয়াবুরুজের অস্থায়ী বাসস্থান থেকে গ্রেফতার করল ওয়াজিদ আলিকে। ষড়যন্ত্রের অভিযোগ একটা তোলা হয়েছিল বটে, তবে তার বিশেষ ভিত্তি ছিল বলে কেউই মনে করেন না। ওয়াজিদ নিজে বিদ্রোহ সমর্থন করেননি, লখনউয়ে তাঁর বেগম হজরত মহল ছেলে বিরজিস কদ্রকে নতুন নবাব ঘোষণা করে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিলেও। আসলে পাছে বিদ্রোহীরা জোর করে ওয়াজিদকে নেতা হিসাবে তুলে ধরে, হয়তো সেই ভয়েই তাড়াতাড়ি ফোর্ট উইলিয়ামে গৃহবন্দি করা হয় তাঁকে। সেখানে থাকতে হল ২৫ মাস, বিদ্রোহ মিটে যাওয়ারও আট মাস পর তিনি ছাড়া পান। মেনে নেন পেনশনও। এই সময় থেকেই মেটিয়াবুরুজের নবাবির সূচনা। আর তাই ইতিহাসের বইয়ে বেগম হজরত মহল কি বিরজিস কদ্র যেটুকু গুরুত্ব পেয়েছেন, রাজ্যচ্যুত নবাব তা-ও পাননি।
তার উপর, মেটিয়াবুরুজে রাতারাতি যে ছোট লখনউ গড়ে তুলেছিলেন ওয়াজিদ আলি, তাঁর মৃত্যুর পর ততটাই দ্রুততায় তাঁর সব স্মৃতি মুছে ফেলেছিল ব্রিটিশ সরকার। সে সময়কার নবাবি দফতরের কোনও নথিপত্র রক্ষা পায়নি বললেই চলে, নবাবের লেখা কিছু বই ছাড়া। শ্রীপান্থ তাঁর ‘মেটিয়াবুরুজের নবাব’ (১৯৯০) বইয়ের ভূমিকায় সোজাসুজিই বলেছেন, ‘জানা ছিল না ইংরেজের দেওয়া মাসোহারা-নির্ভর রাজ্যহারা এই নবাব শহরের উপান্তে গড়ে তুলেছিলেন দ্বিতীয় এক লক্ষ্মৌ। অযোধ্যার রাজধানী লক্ষ্মৌর সঙ্গে অবশ্য তুলনা চলে না তার, কিন্তু এখানেও সেই রাজকীয় জৌলুস আর বিলাস। প্রাসাদ, বাগবাগিচা, চিড়িয়াখানা।’ স্বাভাবিক ভাবেই এই পর্বের ইতিহাসের উপাদান সামান্য, তাই শ্রীপান্থকে ছুটতে হয়েছে কখনও মেটিয়াবুরুজ থেকে লখনউ, কখনও লখনউ থেকে মেটিয়াবুরুজ। ফলে তাঁর বইয়ে ওয়াজিদ আলির জীবনের প্রায় অর্ধেকের কথা যেমন উঠে এসেছে, তেমনই স্পষ্ট হয়েছে দুই শহরের সাংস্কৃতিক আত্মীয়তার রূপরেখা। এর আগে বাঙালি পাঠকের কাছে এই দু’টি দিক প্রায় অজানা ছিল। সাম্প্রতিক কালে অন্তত দু’জন গবেষক এই দু’টি দিকের কাজ আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। রোজি লিউলিন জোনস তাঁর ‘দ্য লাস্ট কিং ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে মেটিয়াবুরুজের ওয়াজিদ আলিকে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সরকারি সূত্র থেকে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে। বিশেষ করে নজরে পড়ে বেগমদের সঙ্গে ওয়াজিদের সম্পর্কের বিষয়টি। রোজি সম্প্রতি কলকাতায় সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, বাংলা তিনি পড়তে পারেন না। তবে উর্দু নিয়েই স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করার ফলে ওই ভাষার অনেক সূত্র তিনি কাজে লাগাতে পেরেছেন। শ্রীপান্থ সমসাময়িক পত্রপত্রিকা, হুতোমের মতো বই যে ভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন, রোজির পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। আর কলকাতায় ওয়াজিদ আলির ইতিহাস নতুন করে তৈরি করতে গেলে বাংলা সূত্র বাদ দিয়ে তা করা যাবে না। সুদীপ্ত মিত্র তাঁর ‘পার্ল বাই দ্য রিভার/ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহজ কিংডম ইন একজাইল’ বইয়ে প্রাক-মেটিয়াবুরুজ পর্বের জন্য প্রকাশিত তথ্যের উপর অনেকটাই নির্ভর করলেও আসল অংশে সমাবেশ ঘটিয়েছেন প্রচুর নতুন তথ্যের, বিশেষ করে তাঁর লক্ষ্য যেখানে শ্রীপান্থের সঙ্গে একই, অর্থাৎ কলকাতার সংস্কৃতির সঙ্গে লখনউ সংস্কৃতির যোগসূত্র অনুসন্ধান। সুদীপ্ত আর এক ধাপও এগিয়েছেন। জোর দিয়ে বলেছেন, নবাবি মেটিয়াবুরুজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তার প্রভাব হারায়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা রীতিমত দাগ রেখে গিয়েছে। তবে শ্রীপান্থ থেকে শুরু করে সকলেই অনেকটা ভরসা করেছেন আবদুল হালিম ‘শরর’কে, নবাবি মেটিয়াবুরুজ নিয়ে সংক্ষিপ্ত হলেও এত ভাল প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আর দ্বিতীয়টি নেই বলে।
যখন বুঝলেন বাকি জীবনটা কলকাতায় কাটাতে হবে, ঠিক কী করতে চেয়েছিলেন ওয়াজিদ আলি? রাজ্য না থাক, মোটা মাসোহারা তো আছে। ফেরত পেয়েছেন রাজকীয় গয়না, মণিমুক্তোও। তাই দিয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করলেন। ‘মেটিয়াবুরুজে যেন লক্ষ্মৌর সূর্যাস্তের আভা।’ আসলে মেটিয়াবুরুজের চার দেওয়ালে ঘেরা জগৎ ছিল বাইরের পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। ওয়াজিদ আলি (১৮২২-১৮৮৭) যত দিন জীবিত ছিলেন, সেখানে টিকে ছিল মুঘল দরবারি সংস্কৃতির শেষ ছায়া। যে ছায়া খোদ এই সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র দিল্লি থেকে বিদায় নিয়েছিল ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের অনেক আগেই।
মাঝের তিরিশ বছরে কত কী ঘটে গিয়েছে। ১৮৫৮-য় কোম্পানির হাত থেকে ভারত শাসনের দায়িত্ব রানির হাতে যাওয়া দিয়ে শুরু; শেষ পর্বে ১৮৮৫-তে তৈরি হয়েছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। মাঝে একের পর এক ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনে কলকাতা উত্তাল। বাংলায় নবজাগরণের ঢেউ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) ওয়াজিদ আলিরই সমসাময়িক। নবাব কিন্তু এ সবের বাইরে, কাছে থেকেও দূরে। পশ্চিমি কেতার প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল না। তাঁর আমলে লখনউয়ের সাংস্কৃতিক জীবনে হিন্দু-মুসলমানের পুরাণ, উপকথা, লোকগাথার বিশেষ প্রভাব। মেটিয়াবুরুজেও তা বদলায়নি। 
ওয়াজিদ আলির বিরুদ্ধে কোম্পানির শাসনকর্তাদের অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ইংরেজের কাছে যে যে কারণে তিনি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেননি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই কারণগুলির জন্যই তিনি পথিকৃতের মর্যাদা পেতে পারেন। রমণীবিলাস (সারা জীবনে তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা প্রায় ৩৭৫ জন) ছাড়া তাঁর নাচ-গানে অতিরিক্ত আসক্তিই ব্রিটিশের আপত্তির প্রধান কারণ ছিল। অথচ কেউ কেউ তাঁকে হিন্দুস্তানি থিয়েটারের প্রথম নাট্যকার বলে বর্ণনা করেছেন। তখনও তিনি নবাব হননি, ১৮৪৩ সালে ভাই সিকন্দর হাসমতের সম্মানে এক জলসার আয়োজন করেন ওয়াজিদ আলি। সেখানে নিজের লেখা নাটক ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ করেন। এই কিস্সাকেই বলা যায় প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক। কৃষ্ণ ছিলেন তাঁর রোল মডেল। যমুনাতীরে পূর্ণিমা রাতে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা নবাবের চিরকালীন অনুপ্রেরণা ছিল। কৃষ্ণের রাসলীলা থেকেই লখনউয়ে ‘রহস’-এর সৃষ্টি। ওয়াজিদ আলির রহস বস্তুত অপেরা, যেখানে তিনি ব্রজ অঞ্চলে কৃষ্ণের জীবন নিয়ে প্রচলিত নৃত্যের সঙ্গে নিজস্ব কত্থকের কম্পোজিশন মিলিয়েছিলেন। রহস নাটক হল নৃত্যনাট্য, যেখানে নির্দিষ্ট গল্প থাকত। লখনউয়ে নবাবির সময় ওয়াজিদ আলি মোট চারটি জলসার আয়োজন করেন, আর মেটিয়াবুরুজে ১৮৫৯ থেকে ১৮৭৫-এর মধ্যে অন্তত ২৩টি। ১৮৬১ থেকে মেটিয়াবুরুজে নিয়মিত ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ হয়েছে, সেখানে তা আরও পরিণত।
তবে ওয়াজিদ আলির নাট্যপ্রয়াস কলকাতার নাটমঞ্চকে আদৌ প্রভাবিত করেছিল এমন তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু কত্থক নাচের সংস্কৃতিকে ওয়াজিদ আলি যে স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন, কলকাতায় সেই লখনউ ঘরানাকে রসিক মহলে আদৃত করে তোলার পিছনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সংশয়ের বিশেষ অবকাশ নেই। ওয়াজিদ নিজে মহারাজ ঠাকুর প্রসাদের কাছে কত্থক শেখেন। ১৮৭৫-এ তিনি ‘মুসাম্মি বা বানি’ নামে কত্থক নিয়ে একটি সচিত্র বই লেখেন যা মেটিয়াবুরুজে লিথোগ্রাফ করে ছাপা হয়। কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত রূপ দু’টিই আছে। বইয়ে ওয়াজিদ লিখেছেন, তাঁর সময়ে লখনউয়ে কত্থক শুধু হিন্দু শিল্পীদের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, মুসলিম শিল্পীরা একে গ্রহণ করে আরও পরিণত করেন। কলকাতায় তিনি লখনউয়ের অনেক শিল্পীকেই ডেকে নিয়েছিলেন। শোনা যায়, ১৮৬৭-তে হোলির সময় মেটিয়াবুরুজের দরবারে ওয়াজিদ আলি স্বয়ং নর্তকীর বেশে নৃত্য পরিবেশন করেন, গেয়ে শোনান ঠুমরিও। কলকাতার সংগীতরসিকদের মধ্যে অঘোরনাথ চক্রবর্তী, সাজ্জাদ মহম্মদ এবং আরও অনেকে নাকি সেই অনুষ্ঠানে ছিলেন। আবদুল হালিম ‘শরর’ অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন, ওয়াজিদ নিজে কখনও নাচতেন না। লখনউ ঘরানার কত্থকশিল্পীরা ওয়াজিদের সূত্রেই কলকাতায় সমাদৃত হন।
আর ঠুমরির তো কথাই নেই। সংগীতবেত্তা রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৪০-১৯১৪) পাথুরিয়াঘাটা থেকে মেটিয়াবুরুজ যেতেন লখনউ ঠুমরির টানে। যদুনাথ ভট্টাচার্য বা যদুভট্ট, অঘোরনাথ চক্রবর্তী নবাবের দরবারি ঠুমরির রীতিমত ভক্ত ছিলেন। বস্তুত ওয়াজিদ আলির দাক্ষিণ্যে মেটিয়াবুরুজ হয়ে উঠেছিল ধ্রুপদী কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। লখনউয়ে ওয়াজিদ আলির দরবারেই ঠুমরি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছয়। আর মেটিয়াবুরুজ থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বুকে। নবাব নিজে কম গান লেখেননি। এমনকী দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত ‘বাঙালীর গান’-এও (১৯০৬) ওয়াজিদ আলির লেখা তিনটি গান ঠাঁই পেয়েছে, সব চেয়ে বিখ্যাত বোধহয় ‘যব ছোড়ে চলে লক্ষ্ণৌ নগরী’।
প্রাসাদ: মেটিয়াবুরুজের সুলতানখানা। ছবি সৌজন্য: পার্ল বাই দ্য রিভার/ সুদীপ্ত মিত্র
মেটিয়াবুরুজের দরবার যন্ত্রসংগীতেও তুলনাহীন। ‘তারিখ-ই-পরিখানা’-য় ওয়াজিদ লিখেছেন, তিনি বিখ্যাত সেতারি কুতুব আলি খানের কাছে সেতার শেখেন। সেনি ঘরানার উস্তাদ বসত খান মেটিয়াবুরুজে রবাব নিয়ে আসেন। সুরশৃঙ্গারও তাঁরই আনা, ওয়াজিদ এই যন্ত্রটিকে জনপ্রিয় করেন। ছিলেন বিখ্যাত বিনকার ও রবাবিয়া কাসিম আলি খান। ওয়াজিদের আহ্বানে কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দরবারে সুরবাহার বাজিয়েছিলেন। এই দরবারেই নাকি উস্তাদ নিয়ামতুল্লা খান আধুনিক সরোদ সৃষ্টি করেন। এগারো বছর তিনি ওয়াজিদ আলির কাছে ছিলেন। ওয়াজিদ তবলাকেও এ শহরে জনপ্রিয় করেন। সানাই, এসরাজের সঙ্গেও জড়িয়ে তাঁর নাম।
এখানেই শেষ নয়। ইঙ্গিত ছিল শ্রীপান্থে, সুদীপ্ত মিত্র সবিস্তারে দেখিয়েছেন, কলকাতার আরও অনেক ঐতিহ্যের সূচনাই মেটিয়াবুরুজে। আলিপুর চিড়িয়াখানার জন্ম ১৮৭৬-এ, তার অনেক আগেই নিজস্ব বিশাল চিড়িয়াখানা তৈরি করেন ওয়াজিদ আলি। সেখানে জীবজন্তুর সংখ্যা ও বৈচিত্র ছিল ঈর্ষণীয়। ‘দমপোখ্‌ত’ বা ঢিমে আঁচে রান্না তিনিই নিয়ে আসেন কলকাতায়, বিশেষ করে বিরিয়ানি। বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলনও তাঁর হাতেই কি না, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। লখনউ পানের কদর আজও কম নয়। তাম্বুলবিলাসী হলেও নবাব মদ বা আফিম স্পর্শ করেননি।  
২১ সেপ্টেম্বর ১৮৮৭ চলে গেলেন ওয়াজিদ আলি শাহ। ইংরেজ তাঁর রাজ্য কেড়ে নিয়েছিল, কিন্তু জীবনের রস উপভোগ থামিয়ে দিতে পারেনি। চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও ওয়াজিদ আলি তাঁর জীবনচর্যায় কোনও তালভঙ্গ হতে দেননি। দেননি বলেই আমাদের সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। ওয়াজিদ আলির জীবনচর্যার উদ্ধার কোনও অস্তমিত রাজমহিমার গুণকীর্তন নয়, আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের শিকড়সন্ধান। শুধু স্বপ্নবিলাস নয়, এক অন্য জাগরণ। নবজাগরণের কলকাতায় অন্তঃসলিলা সেই জাগরণের দিকে শ্রীপান্থই আমাদের নজর ফিরিয়েছিলেন, সুদীপ্ত মিত্র তাকে অন্য মাত্রা দিলেন।