দেশ সলাতুর। নাম পাণিনি। মা দাক্ষী। বাবার অথবা গোত্রের নাম পাণিন। এর বেশি কিছু জানা যায় না সারা পৃথিবীর সর্বকালের অত্যাশ্চর্য ব্যাকরণের রচয়িতা পাণিনির সম্পর্কে, আমেরিকার গঠনতাত্ত্বিক ভাষাতত্ত্বের জনক লিওনার্দ ব্লুমফিল্ডের মতে যিনি ‘মনুমেন্ট অব হিউম্যান ইনটেলিজেন্স’, এবং যাঁর ভাষাদর্শনে গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন আধুনিক গঠনতাত্ত্বিক ভাষাতত্ত্ব আর সেমিয়োটিক্স–এর পথিকৃৎ ফার্দিনান্দ দ্য সাস্যুর । 
কে এই পাণিনি আর কেমন-ই বা তাঁর সেই ‘অত্যাশ্চর্য’ ব্যাকরণ, যা নিয়ে এত মাতামাতি এই একবিংশতি শতকেও? এ বিষয়ে আলোচনা একটু গোড়া থেকে শুরু করা ভালো। 
প্রাচীন ভারতের প্রায় সমস্ত শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যের রচনাকাল নিয়েই বিতর্কের যেমন শেষ নেই, পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ও তার ব্যতিক্রম নয়। খ্রিস্টজন্মের মোটামুটি চারশো বছর আগে পাণিনির জন্ম হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এ-মতের বিপক্ষেও অবশ্য কিছু কম যুক্তি নেই, আর সেগুলির মধ্যে কয়েকটি আবার নেহাত ফেলনাও নয়, সেগুলি গ্রহণ করলে আরও পিছিয়ে যাবে পাণিনির কাল।
বেদের যুগের শেষ স্তরে পাণিনির আবির্ভাব; তাঁর অন্তত দেড় হাজার বছর আগে থেকে যে বৈদিক সাহিত্য সঙ্কলিত হতে শুরু করে, তার ভাষা পাণিনির সময়ে আমজনতার কাছে ক্রমশ অতিপ্রাচীন এবং দুর্বোধ্য হয়ে উঠতে থাকে— যেমনটা হাজার বছরের পুরনো চর্যাপদের ভাষা আধুনিক বাংলাভাষীর কাছে হয়েছে। বেদের ভাষার ব্যাপারটা অবশ্য অনেক গুরুতর ছিল কারণ সুবিপুল বৈদিক সাহিত্য ছিল সম্পূর্ণই শ্রুতিনির্ভর, অর্থাৎ শুধুমাত্র শুনে শুনে তা মনে রাখতে হত। বৈদিক সাহিত্য হল আর্যসংস্কৃতির ভিত্তিস্তম্ভ, তাই তাকে অতি যত্নে রক্ষা করাটা ধর্ম বলে মনে করা হত। কোনও ভাবে বেদের একটুও বিকৃতি ঘটতে দেওয়া যাবে না, তার একটি বর্ণ, মাত্রা বা অক্ষরও হারিয়ে গেলে চলবে না। এই প্রয়োজনীয়তা থেকে জন্ম নিল বেদাঙ্গ সাহিত্য। বৈদিক সাহিত্য যে কত বিশাল, তা এটুকু বললেই পরিষ্কার হবে যে চার বেদের মধ্যে শুধু ঋগ্বেদ-সংহিতার মন্ত্রসংখ্যাই হল প্রায় সাড়ে দশ হাজার, এর পরে আছে তার ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ, সবই আবার একাধিক শাখায়। এ হেন বেদকে সম্পূর্ণ অলিখিত অবস্থায় সংরক্ষণ করতে হলে বিশেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। সেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পূর্ণ বিকাশ আমরা বেদাঙ্গগুলির মধ্যে দেখি। অঙ্গ বা অবয়ব যেমন অঙ্গী বা প্রাণধারীকে বাঁচিয়ে রাখে আর রক্ষা করে, সে রকম এই বেদাঙ্গগুলিও বেদের রক্ষাকবচের কাজ করেছে।
ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, শিক্ষা, কল্প, নিরুক্ত, ছন্দ, ব্যাকরণ আর জ্যোতিষ— এই ছয়টি বেদাঙ্গ কী অসাধারণ কৌশলে ধরে রেখেছে বেদের ত্রিমূর্তি— শব্দ, অর্থ, উচ্চারণ। এ ছাড়াও, বেদের প্রধান উপযোগ যে যজ্ঞকর্মে, তাকেও পুঙ্খানুপুঙ্খ ধরে রেখেছে কল্প নামে বেদাঙ্গটি। বেদের মতো বেদাঙ্গগুলিও কিন্তু লিখিত হত না, তাদেরকেও ধারণ করতে হত স্মৃতিতেই। বিশালাকৃতির বেদ মুখস্থ করার পর বেদাঙ্গগুলির জন্য মস্তিষ্কে আর বেশি স্থান রাখা মুশকিল, বোধহয় এই রকম একটা ধারণা থেকেই বেদাঙ্গগুলিকে খুব সংক্ষিপ্ত আকারে রচনা করার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছিল; যার ফলে গদ্য ও পদ্য, সাহিত্যরচনার এই দুই প্রচলিত মাধ্যমের অতিরিক্ত এক নতুন ধারার উদ্ভব ঘটে— যার নাম সূত্রসাহিত্য।
সব বেদাঙ্গসূত্রের মধ্যে সেরা সূত্র হল পাণিনির ব্যাকরণ ‘অষ্টাধ্যায়ীসূত্র’। কত বড় বই এই অষ্টাধ্যায়ী তা দেখা যাক: এর আটটি অধ্যায়ে চারটি করে পরিচ্ছেদ বা পাদ, প্রতি পাদে রয়েছে শতাধিক সূত্র, এ ভাবে সব মিলিয়ে মোট ৩৯৯৫টি সূত্র। পর পর লিখলে একটা এক ফর্মার লিটল ম্যাগাজিনে ধরে যাবে গোটা অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ! কিন্তু সে বই আজও বিশ্বের পণ্ডিতদের বিস্ময়। এতে রয়েছে বেদের সেই প্রাচীন ভাষার ব্যাকরণ, অর্থাৎ সে ভাষার শব্দগুলির বিভিন্ন ধ্বনির উচ্চারণ, সন্ধির ফলে তাদের নানান বিকার ও পরিবর্তন (ধ্বনিতত্ত্ব), শব্দের গঠনপদ্ধতি-বিশ্লেষণ (রূপতত্ত্ব), যার মধ্যে আছে শব্দরূপ, ধাতুরূপ, প্রত্যয়, সমাস প্রভৃতির আলোচনা, এবং বাক্যে পদগুলির পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ নির্ণয়, যাকে আমরা ‘কারক’ বলে জানি— ইত্যাদি বিষয়ে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ।
মজার কথা এই যে, পাণিনির ব্যাকরণ বেদের অঙ্গ হলেও সেটি কিন্তু তাঁর সময়ে প্রচলিত লৌকিক ভাষারও ব্যাকরণ। এক কথায়, পাণিনি একই সঙ্গে দুটি ভাষার জন্যে ব্যাকরণ রচনা করেছেন, তারা হল যথাক্রমে ‘ছন্দস্‌’ অর্থাৎ বৈদিক সংস্কৃত এবং ‘ভাষা’, যেটি ছিল তাঁর সময়ে প্রচলিত লোকব্যবহারের ভাষা অর্থাৎ লৌকিক সংস্কৃত। প্রাচীন ভারতের সাহিত্য, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি, আইন-কানুন, মামলা-মোকদ্দমা, ধর্ম-কর্ম ইত্যাদি সব কিছুর প্রধান মাধ্যম ছিল এই সংস্কৃত। অবশ্য ভাষা হিসেবে সংস্কৃত নামটির প্রচলন হয় পাণিনির অনেক পরে। প্রাচীন স্তরে বৈদিক ও পরবর্তীতে লৌকিক বলে পরিচিত এই ভাষার ব্যাকরণ পাণিনি এমন নির্দিষ্ট করে বেঁধে দিয়েছিলেন যে প্রায় আড়াই হাজার বছরেও সে ভাষার মৌলিক কোনও পরিবর্তন হয়নি।
পাণিনি এক আশ্চর্য কৌশলে গেঁথেছেন সূত্রগুলিকে, যার ফলে সব চেয়ে কম শব্দে বোঝানো গিয়েছে ভাষা-বিষয়ক সর্বাধিক নিয়ম, এই কৌশলে প্রধান হাতিয়ার তাঁর এক বিশেষ সাংকেতিক ভাষা, আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকরা যাকে বলছেন পাণিনির অধিভাষা বা মেটাল্যাংগোয়েজ। যেমন ধরুন একটি সূত্রে ব্যবহৃত একটি শব্দ পর পর বেশ কয়েকটি সূত্রেই প্রয়োগ করতে হবে, কিন্তু প্রতি বার তার পুনরাবৃত্তি না করে ধরে নেওয়া হয় যে সেটি আগের সূত্রটি থেকেই পরের সূত্রগুলিতে চলে আসছে, এ ব্যবস্থার নাম হল অনুবৃত্তি। পাণিনির ব্যাকরণ দাঁড়িয়ে আছে বর্ণবোধক চোদ্দোটি প্রত্যাহার সূত্রের ওপরে, যেগুলি ‘শিবসূত্র’ নামে প্রসিদ্ধ। এগুলি পাণিনির নিজের রচনা বলেই অনুমান, যদিও প্রাচীন কিংবদন্তি বলে যে এগুলির উৎপত্তি নাকি শিবের ঢক্কানিনাদ থেকে। এগুলি আসলে সংস্কৃতের যাবতীয় স্বর ও ব্যঞ্জনধ্বনি, এমন সুকৌশলে সাজানো যে বীজগণিতের (a+b)2 ফর্মুলার মতো অতি সংক্ষেপে জুগিয়ে দেয় অনেক বড় তথ্য। যেমন, ‘অচ্‌’ বললে বোঝায় যাবতীয় স্বরবর্ণকে, ‘হল্‌’ হল সমস্ত ব্যঞ্জন, আর ‘অল্‌’ মানে সব স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণ একত্রে। এই অধিভাষার জোরে ‘ইকো যণচি’— এইটুকু পাণিনিসূত্রের মানে দাঁড়ায় “ই, উ, ঋ, ৯ – এই চারটি বর্ণের পরে যদি এরা নিজেরা ছাড়া অন্য কোনও স্বরবর্ণ থাকে তবে তারা যথাক্রমে য্‌, ব্‌, র্‌, ল্‌ হয়ে যায়”; এরই ফল হিসেবে আমরা পাই অতি+অন্ত = অত্যন্ত, ইতি+আদি = ইত্যাদি জাতীয় সন্ধি।
আজকের যুগের ভাষাতাত্ত্বিকদের সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে পাণিনির ব্যাকরণের নির্মাণকৌশল। দেখা গিয়েছে কম্পিউটার যে-কোনও ভাষা শেখার জন্যেই সব থেকে বেশি গ্রহণীয় মনে করছে পাণিনির কৌশলকে, তাঁর ভাষা-বিশ্লেষণের পদ্ধতিকে। প্রাচীন ভারতে পাণিনির ব্যাকরণ ভাষাচর্চার একটা ধারা তৈরি করেছিল, যার ফলে পরবর্তী কালে তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দে কাত্যায়ন পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ ব্যাকরণকে আরও সম্পূর্ণতা দিতে রচনা করলেন ‘বার্ত্তিক’, এবং তাঁরও প্রায় দেড়শো বছর পরে পতঞ্জলি লিখলেন ‘মহাভাষ্য’। এই তিন বৈয়াকরণের গ্রন্থ সম্মিলিতভাবে ‘ত্রিমুনি ব্যাকরণ’ নামে পরিচিত।   
তক্ষশিলার অধিবাসী ছিলেন পাণিনি, এমনটাই প্রচলিত মত। আর কে না জানে, অধুনা পাকিস্তানের সেই জায়গাটিতে ছিল প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। সপ্তম শতকে ঝুয়ান ঝাং তাঁর বিবরণে উল্লেখ করেছেন, তিনি নাকি লাহুরে (লাহৌর) পাণিনির মূর্তি দেখেছেন। আশ্চর্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা পাণিনির, তাঁর কান এড়িয়ে যায়নি হাটে আসা মানুষদের কথা, পানশালার খদ্দেরদের হাঁক অথবা বিপাশা নদীর উত্তরের আর দক্ষিণের বুলির মধ্যে আঞ্চলিক টানের তফাত। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে তাই তখনকার ভাষাই শুধু নয়, ধরা পড়েছে সেই যুগের সমাজ, সাধারণ মানুষ আর তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ছবিও। 
শেষ কালে বলতে চাই সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘বৈয়াকরণ’ নামে একটি অসাধারণ গল্পের কথা, যেখানে একটি মেয়ে-স্কুলের সংস্কৃতের বৈয়াকরণ পণ্ডিত এক বৃদ্ধ মৈথিলি ব্রাহ্মণ গভীর আত্মসংকটে পড়ে তাঁর আজীবনের সঙ্গী পাণিনির ব্যাকরণ দিয়েই করেন নিজের মনঃসমীক্ষণ, এবং শিউরে ওঠেন সদাচারের আড়ালে ঢাকা নিজের কামাতুর পুরুষমুখটি দেখে। পাণিনির ব্যাকরণের এমন প্রয়োগ কে-ই বা ভাবতে পেরেছিল?

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/p%C4%81%E1%B9%87ini-s-grammar-formed-the-foundation-of-rigorous-intellectual-work-in-india-1.802096?ref=archive-new-stry