ব্রাহ্মণরা বাংলার আদি অধিবাসী নয়। বস্তুত দীর্ঘ দিন বাংলা ব্রাহ্মণদের প্রভাবসীমার বাইরে ছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকেরা লক্ষ করেছিলেন, ‘আর্য’রা পূর্ব ভারতে কিছুটা দেরিতে পৌঁছেছিল এবং তাদের অগ্রগতি স্থানীয় মানুষ প্রতিরোধ করেছিল। বাংলা অবশ্য শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্য বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, কিন্তু প্রক্রিয়াটি খুব সহজ হয়নি।
ব্রাহ্মণ্যবাদ যে ক্রমশ পূর্ব দিকে বিস্তৃত হচ্ছিল, প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অথর্ব বেদেই মগধ ও অঙ্গের প্রথম নিঃসংশয় উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থটির মতে এ দুটি ছিল ব্রাত্যদের দেশ। বঙ্গের প্রথম দ্বিধান্বিত উল্লেখ পাই ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে, যেখানে বৈদিক বৃত্তের বাইরে তার স্থান নির্দেশ করা হয়েছে। বৈদিক সাহিত্যে বাংলার প্রাথমিক উল্লেখগুলিতে এই অঞ্চলের প্রতি ব্রাহ্মণদের অবজ্ঞাই প্রকাশ পেয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির আরও স্পষ্ট প্রকাশ দেখি ঐতরেয় ব্রাহ্মণের সেই কাহিনিতে যেখানে বিশ্বামিত্র তাঁর পুত্রদের অভিশাপ দিয়েছিলেন যে তাদের উত্তরপুরুষরা পৃথিবীর পূর্বতম প্রান্ত উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করবে এবং তাদের স্থান হবে বর্ণ-শ্রেণিবিভাগের সর্বনিম্ন ধাপে। মহাভারতে বাংলার উপকূলবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীদের ম্লেচ্ছ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বৌধায়ন ধর্মসূত্র অনুযায়ী পুন্ড্র ও বঙ্গে পা রাখা অপরাধ বলে গণ্য হত এবং এই বিধিভঙ্গের জন্য প্রায়শ্চিত্তের বিধান দেওয়া হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, সূত্রগুলির রচনাকালে বাংলা ব্রাহ্মণদের কাছে পরিচিত হতে শুরু করেছিল, কিন্তু তা তখনও নিষিদ্ধ দেশ।
তবে বাংলার প্রতি ব্রাহ্মণ্য উপেক্ষা যে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, সে কথা সত্যি। মধ্য-গাঙ্গেয় উপত্যকার অধিবাসীরা ক্রমশ পূর্বদেশের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিল, রঘু, কর্ণ ও ভীমের বিজয় অভিযানের কাহিনিতে তার পরিচয় আছে। রামায়ণ অনুযায়ী মৎস্য, কাশী ও কোশলের রাজপরিবারগুলি অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধে বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপন শুরু করেছিল। আরও ইঙ্গিতপূর্ণ কাহিনিটি পাওয়া যায় বায়ু ও মৎস্য পুরাণে। ঋষি দীর্ঘতমস অসুররাজ বলির স্ত্রীর গর্ভে পাঁচটি পুত্র উৎপাদন করেন, তাদের নাম হয় অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সুক্ষ্ম। কাহিনি অনুযায়ী যে পাঁচটি জনপদ এই নামে পরিচিত, সেগুলি দীর্ঘতমসের সন্তানদের নাম থেকেই গৃহীত।
দেখা যাচ্ছে, বাংলা ক্রমশ গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছিল এবং ব্রাহ্মণ্য বৃত্তের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ছিল। ধর্মসূত্রগুলি রচনাকালে আর্যাবর্তের পূর্ব সীমা ছিল প্রয়াগ; মানব ধর্মশাস্ত্র রচনার সময় তা পূর্ব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল। মনু পৌন্ড্রদের পতিত ক্ষত্রিয় বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মহাভারতে বঙ্গ ও পৌন্ড্রদের এবং মৎস্য ও বায়ু পুরাণে বঙ্গ, সুক্ষ্ম ও পৌন্ড্রদের ক্ষত্রিয় বলেই বর্ণনা করা হয়েছে। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে ব্রাহ্মণ পরিবারের উল্লেখ থেকে বোঝা যায়, জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশ ব্রাহ্মণ বলেও স্বীকৃত হচ্ছিল। সুতরাং খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে বাংলায় ব্রাহ্মণদের অগ্রগতি একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
তথ্য-প্রমাণ থেকে নিশ্চিত ভাবে বলা চলে, গুপ্ত যুগ থেকেই ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ব্যাপক ভাবে বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। গুপ্ত যুগের গোড়াতেও কিন্তু এই যোগাযোগ খুব স্পষ্ট ছিল না। গুপ্ত লেখমালায় সমতটের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলিপিতে। ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে সেখানে সমতটকে ডবাক ও কামরূপের সঙ্গে বন্ধনীভুক্ত করে প্রত্যন্ত প্রদেশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা সমুদ্রগুপ্ত প্রত্যক্ষ ভাবে শাসন করতেন না। বাংলায় যখন গুপ্তদের দৃঢ় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম হল, তখনও এখানে ব্রাহ্মণরা সেই সব সুবিধা ও সম্মান ভোগ করত না যা সমসাময়িক উত্তর ভারতে তাদের প্রাপ্য বলে গণ্য হত। গুপ্তদের রাজত্বকালে বাংলায় ব্রাহ্মণরা শাসন-বিভাগের কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয়নি। এমন কোনও পরিচয় নেই যে, গুপ্তরাজারা বাংলায় ব্রাহ্মণ্য উপনিবেশ স্থাপন করতে সচেষ্ট ছিলেন। ভূমিদান সংক্রান্ত লেখগুলিতে ব্রাহ্মণদের কোনও বিশেষ যোগ্যতার উল্লেখ নেই। এমনকী তাদের গোত্র-নাম পর্যন্ত অনুক্ত থেকে গিয়েছে।
গুপ্তোত্তর যুগ থেকে বাংলায় ব্রাহ্মণ্য প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং পাল-চন্দ্র-কাম্বোজ রাজাদের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রসারের প্রক্রিয়াটি আরও গতি পায়। ব্রাহ্মণরা নিয়মিত রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতেন, শাসনবিভাগের উচ্চপদে নিযুক্ত হতেন, বিশেষ সামাজিক সুবিধা ভোগ করতেন। ব্রাহ্মণরা বাংলায় যে শাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থ প্রণয়ন শুরু করেন, যেমন বাংলার প্রাচীন পুরাণগুলি, তা এই সময়ই আরম্ভ হয়। এই গ্রন্থগুলিতেই প্রথম বাঙালির সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস এবং ধর্মীয় বিধি সুনির্দিষ্ট রূপ পায়। যারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুগামী ছিল, তারা যে বাংলায় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যেই বৌদ্ধদের থেকে সংখ্যায় বেশি হয়ে গিয়েছিল, চৈনিক পরিব্রাজক জুয়ান ঝাং (হিউয়েন সাঙ)-এর সাক্ষ্য থেকে তা জানা যায়।
সেন-বর্মণ যুগে সক্রিয় রাজকীয় পোষকতার প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত রূপ পায়।  স্থানীয় রাজবংশগুলিও প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করেছিল। সেন ও বর্মণ রাজবংশ দক্ষিণ ভারত থেকে বাংলায় এসেছিলেন। তাঁরা ব্রাহ্মণ্য আদর্শ ও প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি গভীর দায়বদ্ধ ছিলেন। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রসার ও বর্ণাশ্রম বিধির প্রয়োগ তাঁরা কর্তব্য বলে মনে করতেন। তাঁদের নানা কর্মোদ্যোগে এই প্রবণতার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। যেমন, এই সময় থেকে ব্রাহ্মণদের প্রতি রাজকীয় দানের মাত্রা ও সংখ্যা দুই-ই বেড়ে গিয়েছিল। এই সময়কালেই বাংলায় বহু শাস্ত্রগ্রন্থ রচিত হয়েছিল, যাতে ব্রাহ্মণ্য বিধিনিষেধের মূল সূত্রগুলি গ্রন্থবদ্ধ হয়। এই সময় থেকে ভূমিদান সংক্রান্ত লেখমালায় ব্রাহ্মণ গ্রহীতাদের গোত্র, প্রবর, বৈদিক শাখা ইত্যাদির উল্লেখ হতে থাকে, যা থেকে বোঝা যায় তারা সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। বৈদিক ও পৌরাণিক আচার-অনুষ্ঠান পালনেও জোর দেওয়া হতে থাকে।
সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের যে ব্রাহ্মণ্য আদর্শ তা এই স্মৃতিগ্রন্থগুলিতেই প্রথম সুষ্ঠু ভাবে প্রণালীবদ্ধ হয়। সেন-রাজা বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেনের মহাধর্মাধ্যক্ষ হলায়ুধ, হরিবর্মণের মন্ত্রী ভট্ট ভবদেব, জীমূতবাহন ও অনিরুদ্ধ ভট্ট এই সময়কার স্মৃতিকারদের অগ্রগণ্য ছিলেন। তাঁরা যে সব গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাতে বর্ণ-জাতির ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও বণ্টন সংক্রান্ত আইন, প্রাত্যহিক আচার ও প্রায়শ্চিত্ত, গ্রহণযোগ্য ও নিষিদ্ধ খাদ্য, শুভ ও অশুভ কর্ম এবং সর্বোপরি ব্রাহ্মণদের কর্তব্য ও তাঁদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা আলোচিত হয়েছে। পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণরা যে হিন্দু বাঙালি জনসাধারণের ধর্মীয়-সামাজিক জীবনের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল, এই স্মৃতিগ্রন্থগুলিকে তার অন্যতম ভিত্তি বলা চলে।
বস্তুত ভূমিদান সংক্রান্ত লেখগুলি থেকে মনে হয়, পালযুগ থেকেই বাংলার রাজারা বৈদিক ভাবধারা ও আচার-অনুষ্ঠানের পোষকতা করছিলেন। কাম্বোজ-রাজ নয়পালের ইর্দা তাম্রশাসনে তাঁর রাজধানী প্রিয়ঙ্গুর একটি বর্ণনা আছে। সেখানে দেখি, যজ্ঞে আহুতিরূপে নিক্ষিপ্ত পূণাসীর ধোঁয়ার সঙ্গে উপরে উঠে প্রিয়ঙ্গুর আকাশকে মেঘের মতো আচ্ছাদিত করে রাখত। ভট্ট ভবদেবের ভুবনেশ্বর লেখ-এ দাবি করা হয়েছে, রাঢ় দেশের সিদ্ধল গ্রামের সৌন্দর্য বেদের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শী ব্রাহ্মণদের উপস্থিতিতে আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তিতে রাঢ়দেশের সামন্তসেনের সময়কার একটি আশ্রমের বর্ণনা আছে। সেখানে দেখি, ঋষিরা নিয়মিত যে সব যজ্ঞানুষ্ঠান করতেন, তা থেকে নিঃসৃত সুগন্ধ বাতাসকে পরিশুদ্ধ রাখত, হরিণশিশু ঋষিপত্নীদের স্তন্যপান করত, শুকপাখি বেদের স্তোত্র আবৃত্তি করত। এ সব সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার বাংলাকে ‘বৈদিক সংস্কৃতির একটি সুরক্ষিত আশ্রয়’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
তা সত্ত্বেও কিন্তু হলায়ুধ, যিনি লক্ষ্মণ সেনের সমসাময়িক এবং তাঁর যুগের প্রধান স্মৃতিকার ছিলেন, তাঁর ব্রাহ্মণসর্বস্ব গ্রন্থরচনার সমর্থনে এই যুক্তি দিয়েছিলেন যে রাঢ় ও বরেন্দ্রর ব্রাহ্মণরা বেদ পাঠ করে না, এবং ফলত তারা বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানের নিয়মাবলির সঙ্গে পরিচিত নয়। এই মন্তব্যের নিহিতার্থ অন্য রকম ভাবে বুঝতে হবে। জানতে হবে আদিশূরের কাহিনি।
প্রথম যে ব্রাহ্মণ গোষ্ঠী বাংলায় বসতি স্থাপন করেছিল তারা খ্রিস্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারত থেকে এসেছিল। সমসাময়িক লেখগুলি থেকে জানা যায়, মধ্যদেশ থেকে বাংলায় ব্রাহ্মণদের অভিপ্রয়াণের এই ধারা অব্যাহত ছিল এবং অষ্টম শতাব্দী থেকে ব্রাহ্মণ অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ব্রাহ্মণরা উত্তর ভারতের নানা প্রদেশ, এমনকী গুজরাতের লাট অঞ্চলের মতো দূর দেশ থেকেও আসত। পাল রাজারা যে এই সব ব্রাহ্মণদের শাসনবিভাগের উচ্চপদে নিযুক্ত করতেন তা থেকে মনে হয়, বহিরাগত ব্রাহ্মণরা সমাজে বেশি মাননীয় বলে গণ্য হত। ব্রাহ্মণ অভিপ্রয়াণের এই অবিচ্ছিন্ন ধারাই প্রমাণ করে, তারা সমাজের বিশেষ প্রয়োজন সাধন করত। না হলে তারা জমির অনুদান এবং এত সম্মান ও সুযোগ-সুবিধার প্রাপক হতে পারত না। এই সব তথ্যই সেই সামূহিক স্মৃতিভাণ্ডার নির্মাণে সাহায্য করেছিল, যার কল্পরূপ মধ্যযুগের শেষ ভাগে রচিত কুলজি গ্রন্থগুলিতে প্রকাশ পায়।
কুলজিগুলি বাংলার ব্রাহ্মণদের বংশবৃত্তান্ত। ধ্রুবানন্দ মিশ্রের মহাবংশাবলী, নুলো পঞ্চাননের গোষ্ঠীকথা, বাচস্পতি মিশ্রের কুলরাম, ধনঞ্জয়-এর কুলপ্রদীপ, হরি মিশ্র ও এড়ু মিশ্রের কারিকা, সর্বানন্দ মিশ্রের কুলতত্ত্বার্ণব, বরেন্দ্র কুলপঞ্জিকা ও কুলার্ণবই সর্বাধিক পরিচিত। বেশির ভাগই আধুনিক যুগের গোড়ার দিকে লেখা, যদিও পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকেই কয়েকটির রচনার সূত্রপাত।
কুলজি গ্রন্থগুলি যে সব কাহিনি বর্ণনা করে, তারা প্রায়ই পরস্পরবিরোধী ও নানা অসঙ্গতিতে পূর্ণ। কিন্তু রূপভেদ থাকলেও এদের একটি কেন্দ্রীয় কাহিনি আছে, যা মোটামুটি এক রকম। আদিশূর নামে বাংলার এক রাজা ছিলেন। তিনি কান্যকুব্জের রাজকন্যা চন্দ্রমুখীকে বিবাহ করেছিলেন। চন্দ্রমুখীর চান্দ্রায়ণ ব্রত পালনের ইচ্ছে হল। কিন্তু দেখা গেল, এই ব্রতানুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করতে পারেন এমন ব্রাহ্মণ বাংলায় নেই। আদিশূর তখন তাঁর শ্বশুর মহাশয়কে পাঁচ জন সাগ্নিক ব্রাহ্মণ পাঠাতে অনুরোধ করেন, যাঁরা এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারবেন। সেই অনুযায়ী শাণ্ডিল্য, কাশ্যপ, বাৎস্য, ভারদ্বাজ এবং সাবর্ণ গোত্রধারী পাঁচ ব্রাহ্মণ গৌড়ে আসেন ও পরে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। তাঁরা স্থানীয় সপ্তশতী ব্রাহ্মণ-কন্যাদের বিবাহ করেন এবং কালক্রমে তাঁদের ঊনষাটটি পুত্রসন্তান জন্মায়। ক্ষিতিশূর এঁদের প্রত্যেককে একটি করে গ্রাম দান করেন যা থেকে বাংলার রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের ৫৯টি গাঞীর উৎপত্তি বলে চিহ্নিত করা হয়। পরে ধরাশূর লক্ষ করেন, এই সব রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের চরিত্রের অবনতি ঘটছে। তাই তিনি তাঁদের আনুষ্ঠানিক শুদ্ধতা অনুযায়ী তিনটি ক্রমনিম্ন শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেন— মুখ্য ও গৌণ কুলীন এবং শ্রোত্রিয়। কুলজি গ্রন্থগুলি দাবি করে, পরে রাজা বল্লাল সেনও একই কারণে বাংলার ব্রাহ্মণদের মধ্যে একই শ্রেণিবিন্যাস প্রতিষ্ঠা করেন। কুলজি গ্রন্থগুলিতে ছ’টি আলাদা অনুষ্ঠানের উল্লেখ আছে যে জন্য পাঁচ জন কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণকে আনানো হয়েছিল। যে ভাবে এই ব্রাহ্মণদের নিযুক্ত করা হয়েছিল, সেই বর্ণনাও পরস্পরের সঙ্গে মেলে না। ঘটনাটি কবে ঘটেছিল, তা নিয়েও মতভেদ আছে— শক ৬৫৪ থেকে ৯৯৯ পর্যন্ত নানা তারিখের উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রাহ্মণদের নামও এক-একটি কাহিনিতে এক-এক রকম। তবে মোটের ওপর মূল কাহিনি নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই।
অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন, আদিশূরের কাহিনির কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। নৃপেন্দ্র কুমার দত্ত দেখিয়েছেন, কোনও বিখ্যাত পাল বা সেন রাজার নামের সঙ্গেই যে কুলজি গ্রন্থ প্রণেতারা পরিচিত ছিলেন, এমন নিদর্শন নেই। অন্য পক্ষে, সমসাময়িক লেখমালায় এবং পুঁথিপত্রে আদিশূর বলে কোনও রাজার উল্লেখ পাওয়া যায় না। এমন কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণও নেই যে এই ব্রাহ্মণদের আসা থেকে বল্লাল সেনের রাজত্বকাল পর্যন্ত অন্তবর্তী শতাব্দীগুলিতে বাংলার ব্রাহ্মণরা কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ থেকে তাঁদের বংশপরম্পরা দাবি করেছেন। কাজেই নৃপেন্দ্র কুমার এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, আদিশূরের কাহিনি কল্পিত ও নানা টুকরো ঘটনা জোড়াতালি দিয়ে অনেক পরে নির্মিত হয়েছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদারও কুলজি গ্রন্থগুলির গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে তাঁর গবেষণাগ্রন্থে বলেছেন, এই কাহিনির ঐতিহাসিকতা নিয়ে এতটাই সন্দেহের অবকাশ আছে যে, একে বাংলার সামাজিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে একেবারেই গ্রহণ করা যায় না।
সাক্ষ্যপ্রমাণের এই বিশৃঙ্খল এবং স্পষ্টতই পরস্পরবিরোধী চরিত্র সত্ত্বেও এমন ঐতিহাসিকের কিন্তু অভাব নেই যাঁরা আদিশূরকে ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। নগেন্দ্রনাথ বসু ও লালমোহন বিদ্যানিধি কুলজি কাহিনির ঐতিহাসিকতা সমর্থন করেছিলেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্র জটিল অঙ্ক কষে দাবি করেছেন, কান্যকুব্জের ব্রাহ্মণরা ঠিক ৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় এসেছিলেন। এ ছাড়াও কিছু ঐতিহাসিক আদিশূরকে নানা ঐতিহাসিক চরিত্রের সঙ্গে চিহ্নিত করার প্রয়াস করেছেন। প্রমোদলাল পাল, যিনি কুলজিগুলিকে অসত্য ও উদ্দেশ্যমূলক বলে বর্ণনা করেছেন, তিনিও বলেছেন, দুধপানি শিলালেখ থেকে মগধের আদিসিংহ নামে যে রাজার কথা জানা যায় তিনি আদিশূর হতে পারেন। নামের খানিকটা মিল আছে এবং বাংলা ও বিহার পাশাপাশি— এ ছাড়া এই প্রস্তাবের আর কোনও ভিত্তি নেই। দীনেশচন্দ্র সরকার স্বীকার করেছেন, বাংলার শূর রাজবংশের বংশতালিকায় আদিশূরের নাম পাওয়া যায় না। তা সত্ত্বেও তিনি মনে করেন, মিথিলার পণ্ডিত বাচস্পতি মিশ্রের ন্যায়কণিকা গ্রন্থে এই আদিশূরের উল্লেখ আছে। তিনি ৮৪২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ন্যায়সূচি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন এবং তিনি আদিশূরের সমসাময়িক ছিলেন। এ থেকে দীনেশচন্দ্র সিদ্ধান্ত করেন, পূর্ব ভারতের আদিশূর খ্রিস্টীয় নবম শতকের মাঝামাঝি মিথিলা ও তৎসংলগ্ন উত্তরবঙ্গে পালদের সামন্তরাজা হিসেবে রাজত্ব করতেন।
আদিশূরের ঐতিহাসিকতা নিয়ে যে বিতর্ক তা হয়তো এই আলোচনার জন্য খুব প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু কৌলীন্য প্রথা, যার উৎস এই কাহিনির সঙ্গে জড়িত, যা একদা অনেক হিন্দু বাঙালির জীবনে এমন অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছিল এবং মুষ্টিমেয় সংখ্যক ব্রাহ্মণের এমন অযৌক্তিক আস্ফালনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, বাংলার ব্রাহ্মণদের নিয়ে আলোচনায় এর উল্লেখ জরুরি। যতই অসঙ্গত ও বেমানান হোক, সামাজিক স্তরবিন্যাসে তাদের অবস্থানের উন্নতি ঘটাতে অ-কুলীন ব্রাহ্মণরা কুলীন পাত্রের সঙ্গে তাদের কন্যার বিবাহ দিত। কুলীন ব্রাহ্মণদের বিবাহের সংখ্যার ওপর কোনও বিধিনিষেধ ছিল না এবং অনেকে বিবাহকেই তাদের জীবিকা করে নিয়েছিল। এই ব্যবস্থার কুৎসিত নিষ্ঠুরতার দিকটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বামুনের মেয়ে’ উপন্যাসে নির্মোহ দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র প্রথম পর্ব ‘বল্লালী বালাই’, দরিদ্র, পরিত্যক্ত কুলীন বিধবা ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যুতে শেষ হয়েছে যা, লেখকের ভাষায়, নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে ‘সেকাল’-এর অবসান ঘটিয়েছিল। দীনবন্ধু মিত্রের ঊনবিংশ শতকে রচিত প্রহসন ‘সধবার একাদশী’র নায়ক নিমচাঁদ দত্ত মত্ততার সুযোগে অনেক অপ্রিয় সত্য বলতেন। তিনি যে এক বার একটি কুলীন কায়স্থ সন্তানকে বলেছিলেন, ‘তুমি পাজী, তোমার বাবা পাজী, তোমার বাবার বাবা পাজী, তোমার সাত পুরুষ পাজী, তোমার আদিশূরের সভা পাজী,’ তা বিনা কারণে নয়।
দুর্ভাগ্যবশত কল্পিত আদিশূর বাঙালি হিন্দু সমাজে সত্য হয়েই দেখা দিয়েছিল। তা ছাড়া উচ্চবর্ণের মানুষদের সামাজিক বৈষম্যকে বৈধতা দিতেই যদিও এই কাহিনিটি উদ্ভাবিত হয়েছিল, এটি বাংলার সামাজিক সংগঠনের বিকাশের প্রক্রিয়াটি প্রায় নিখুঁত ভাবে প্রতিফলিত করে। নীহাররঞ্জন রায় বিশ্বাস করেন, কুলজি গ্রন্থগুলির সাক্ষ্য ইতিহাসে প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হওয়ার যোগ্য নয় ঠিকই, তবু পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বাঙালি সমাজে বর্ণ ও জাতির যে জটিল বিন্যাস, যা স্মৃতিগ্রন্থগুলির নির্দেশ দ্বারা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হত, তার একটি সুনির্দিষ্ট ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসকে কেন্দ্র করে যে লোক-স্মৃতি গড়ে উঠেছিল, তাই-ই এই কাহিনিটির উদ্ভব ও বিকাশের জন্য দায়ী।
আদিশূরের কাহিনি বাংলার সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন, কেন না এই বঙ্গভূমিতে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই অন্তবর্তী বর্ণ দুটি কখনও ছিল না। প্রথম অভিবাসী ব্রাহ্মণ গোষ্ঠী বাংলার সমস্ত স্থানীয় অধিবাসীকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেন— সৎ শূদ্র এবং অসৎ শূদ্র। আদিশূরের কাহিনিতে সেন যুগের যে উল্লেখ আছে, তা সেই অস্পষ্ট কালসীমার মধ্যে পড়ে যেখানে বস্তুগত ইতিহাস ও কল্প-ইতিহাস জড়িয়ে যায় এবং পরস্পরের অবলম্বন হয়ে ওঠে। শেষ-মধ্যযুগে বাংলার সামাজিক বিন্যাসের যে পুনর্গঠন হয়েছিল তা প্রমাণভিত্তিক ইতিহাস এবং সামূহিক স্মৃতি— এ দুইয়ের মধ্যেই পড়ে। অর্থাৎ কুলজিগুলিতে কল্প-ইতিহাসের মোড়কে এই পুরো ইতিহাসটাই ধরা আছে।
সর্বোপরি, কুলজি গ্রন্থগুলি একটি জরুরি তথ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাংলার পুরাণগুলি স্বীকার না করলেও, ব্রাহ্মণরা যে সকলেই এক অভিন্ন শ্রেণিভুক্ত ছিলেন না, কুলজিগুলি সেই সাক্ষ্যই বহন করে। ব্রাহ্মণদের মধ্যে রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ— এঁরা আবার কুলীন ও ভঙ্গ— এই দুই ভাগে বিভক্ত, শ্রোত্রিয় ও বৈদিক ব্রাহ্মণ, সপ্তশতী, মধ্যশ্রেণী, গৌড়ীয় ও বঙ্গজ ব্রাহ্মণ, গ্রহ-বিপ্র,বর্ণ ও অগ্রদানী ব্রাহ্মণ— এদের অসংখ্য উপভেদ এবং গোত্র, প্রবর, চরণ, শাখা, মেল, গাঞী ও আরও নানা বিভাগ— যদিও সকলেই ব্রাহ্মণ বন্ধনীভুক্ত। এদের অভ্যন্তরীণ স্তরবিন্যাস এমনই সুদৃঢ় ও অনমনীয় ছিল যে, উঁচু থাকের কোনও ব্রাহ্মণ অগ্রদানীর মতো নিচু থাকের ব্রাহ্মণের কাছে জল পর্যন্ত গ্রহণ করতেন না। বিবাহের ব্যাপারেও অনুরূপ বাধানিষেধ ছিল। বাংলার ব্রাহ্মণদের এই বিভিন্নতা পুরাণগুলি গোপন রাখতে চেষ্টা করলেও এ সম্পর্কে যে তারা সম্পূর্ণ অবহিত ছিল, কলিযুগের অধঃপতিত ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে তাদের বদ্ধমূল ভীতিতেই তার প্রমাণ।
মধ্যযুগ পর্যন্ত বাংলায় ব্রাহ্মণদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে কয়েকটি তথ্য অনস্বীকার্য ভাবে উঠে আসে। প্রথম, বাংলায় ব্রাহ্মণরা বহিরাগত। দ্বিতীয়, এদের অধিকাংশেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা যথেষ্ট ছিল না। তৃতীয়, এদের আভ্যন্তরীণ বিভিন্নতা এতই ব্যাপক ও প্রকট ছিল যে এদের ব্রাহ্মণ— এই একটিমাত্র অভিধায় চিহ্নিত করাই কঠিন। তবু ব্রাহ্মণরা বাঙালি হিন্দুর ধর্মীয়-সামাজিক জীবনে দীর্ঘ দিন তাঁদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। তা কী করে সম্ভব হয়েছিল, সেই ইতিহাস অনুসন্ধানের সময় এসেছে।

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/brahmins-are-not-the-original-inhabitants-of-bengal-actually-they-are-outsiders-1.806224?ref=rabibashoriyo-new-stry