তিনশো বছর আগে এক বসন্তদিনে কয়েক জন ইংরেজ যুবক গঙ্গার তীরে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। কলকাতা তখন গণ্ডগ্রাম। সে দিন ছিল দোল। গঙ্গার তীর থেকে গ্রামের ভিতরে হাঁটতে হাঁটতে তাঁদের কানে এল গানের এক অদ্ভুত সুর। সেই সুরের টানে তাঁরা পৌঁছলেন এক দিঘির পাড়ে। বিশাল দিঘির দু’দিকে দু’টি মঞ্চ। একটিতে রাখা গোবিন্দজি, অন্যটিতে রাধিকার বিগ্রহ। মাঝখানে দোল খেলা চলছিল। দিঘির উত্তর পাড়ে রাধাবাজারে স্তূপ করে রাখা আবির। পথঘাট, দিঘির জল লাল।
গোপিনীদের নাচগান আর চারপাশের পরিবেশ সেই  সাহেব যুবকদের প্ররোচিত করেছিল। এই গোপিনীরা যে আসলে পুরুষ, ভাবতে পারেননি তারা। প্রাচীন গ্রিসের ‘স্যাটারনালিয়া’র সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়ে তারা ভেবেছিল এ বুঝি ‘কামোৎসব’। ভিড়ের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করতেই, নেটিভরা তাদের বাধা দিলেন। বাধা না মানায় সাহেবদের ভাগ্যে চড়থাপ্পড়ও জুটেছিল!
এ তো গল্প। পরে ঔপনিবেশিক প্রভাবে যে নব্য বাবুসমাজ গড়ে উঠেছিল, হোলি উৎসব তাতে প্রাধান্য পেয়েছিল। এই উদ্‌যাপনও ছিল বিচিত্র। রুপোর রেকাবি থেকে আতর মেশানো আবির উড়িয়ে, রুপোর পিচকারির সুগন্ধী রঙিন জল ছিটিয়ে, গেলাসে রঙিন পানীয় হাতে, হোলির ঠুমরি বা দাদরার তালে ইয়ারদের নিয়ে মাতাল হয়ে ওঠার আনন্দটা কেমন, বাবুরাই জানতেন! বাবু কালচারের হোলির বিবরণ দিতে গিয়ে কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন ‘ক্রমেতে হোলির খেলা, নবীনা নাগরী মেলা, ছুটে মুটে যায় এক ঠাঁই। উড়ায় আবির যত, কুড়ায় লোকেতে কত, জুড়ায় দেখিলে মন তায়। ঢালিয়া গোলাপ জল, অঙ্গ করে সুশীতল, মাঝে মাঝে হয় কোলাহল।’
‘কলিকাতার ইতিবৃত্ত’ বইতে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত লিখছেন, ‘সে সময়ে কোনও ব্যক্তির বেদাগ বস্ত্র থাকিত না, দলে দলে মিছিল বাহির হইতেছে, পিচ্কারি ও আবিরে পথঘাট ঘরবাড়ি লালে লাল হইয়া যাইতেছে।’ চিৎপুর অঞ্চলের দোল সম্পর্কে লেখা: ‘মিছিলওয়ালারা সুশ্রাব্য ও অশ্রাব্য গীতিতে পাড়া মাতাইয়া এবং নরনারী যাহাকে সম্মুখে পাইত, তাহাকে আবির ও পিচকারিতে ব্যতিব্যস্ত করিয়া চলিয়া যাইত। এমন অশ্রাব্য গীত এবং কুৎসিত সং প্রকাশ্যে পথে বাহির করিতেন যে, এখনকার লোকে তাহা কল্পনা করিতে পারে না। কর্তারা কিন্তু তাহা লইয়া আমোদ করিতেন। গৃহিণীও বালক-বালিকাদের সহিত শ্রবণ করিতেন।’
প্রাচীন ভারতে বসন্তে উদ্‌যাপিত হত মদনোৎসব ও কামমহোৎসব। কামসূত্রে, ‘রত্নাবলী’ বা ‘মালতী মাধব’ নাটকে এর উল্লেখ আছে। একাদশ শতকে আল বিরুনির ভারত বিবরণেও এর উল্লেখ রয়েছে। উৎসবে পুজো হত মদন ও রতির। তবে তা হত চৈত্র মাসে, ফাল্গুনে নয়। গবেষকদের মতে, সাবেক কলকাতার দোল উৎসব প্রাচীন মদনোৎসবের আদলে গড়া। সে কালেও দোলে চটুলতা ছিল। প্রমাণ মেলে ইতিহাসের পাতায়।
দোল উপলক্ষে বাবুদের বাড়িতে পুজো হত, তৈরি হত মিষ্টি, শরবতও। কিছু কিছু পুরনো পরিবারে আজও এই সব রীতি দেখা যায়। শোভাবাজার রাজপরিবারের বড় তরফে গৃহদেবতা রাধাগোবিন্দজিউয়ের দোল হয় দোলের পরের দিন প্রতিপদে। দোলের দিন সন্ধ্যায় হয় চাঁচর। পর দিন বিশেষ পুজো। দোলের আগের দিন হয় নারায়ণের চাঁচর। আগে সন্ধেবেলা ঠাকুরদালানে বসত গানের আসর। গানের শেষে উড়ত ফাগ।
মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে রামচাঁদ শীলের পরিবারে গৃহদেবতা দামোদর জিউয়ের দোল উৎসবে গান গাইতেন গহরজান, মালকাজান। এখানকার দোলে গান রচনা করেছেন গিরিশ ঘোষও। রাজা রাজেন্দ্র মল্লিকের মার্বেল প্যালেসেও দোল হয়ে আসছে অতীতের ধারা বজায় রেখেই।
ব্যতিক্রমী ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে গোলাপজলের পিচকিরি, কাচের গড়গড়া, ফুল দিয়ে বৈঠকখানা সাজানো হত। প্রায় আধ হাত উঁচু আবিরের ফরাসের উপর বিছিয়ে দেওয়া হত পাতলা কাপড়, তাতে ফুটে উঠত রক্তিমাভা। গানের আসর বসত, তানপুরা হাতে আসতেন অক্ষয় চৌধুরী এবং শ্যামসুন্দর। গুণেন্দ্রনাথের সামনেই থাকত গোলাপজলের পিচকিরি। কাচের গড়গড়ায় টান দিলে দেখা যেত তার মধ্যে গোলাপ পাপড়ির ওঠানামা।
কলকাতার বেশ কিছু বনেদি পরিবারের নাচঘরে বা বৈঠকখানায় বিছিয়ে দেওয়া হত পুরু আবির। উপরে পাতা হত পাতলা কাপড়। নর্তকীর নাচ শেষে যখন কাপড়টি তুলে নিলে দেখা যেত, নর্তকীর পায়ের চাপে আবিরের উপরে ফুটে উঠেছে পদ্মফুল, আরও কত নকশা।
নজর টানত হোলির গানও। রেকর্ড কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হত নতুন রেকর্ড। পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যন্ত বজায় ছিল এই ট্রাডিশন। শিল্পী-তালিকায় কে না ছিলেন— গহরজান, মৈজুদ্দিন খান, জোহরাবাই থেকে শুরু করে আখতারিবাই, বড়ে গুলাম আলি খান, কমলা ঝরিয়া, কৃষ্ণচন্দ্র দে, যূথিকা রায়।

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/how-aristocratic-families-of-kolkata-celebrated-holi-1.761744?ref=archive-new-stry