ঝুমরিতালাইয়া থেকেই যেত গানের অনুরোধ
জায়গাটা কোডারমা স্টেশনের কাছে, ঝুমরিতালাইয়া! একদা এই শহর থেকেই হরেক রেডিয়ো স্টেশনে পাঠানো হত গানের অনুরোধ। রেডিয়োতে চিঠি পাঠানোর জন্য কেনা হত বান্ডিল বান্ডিল পোস্টকার্ড।
‘‘দো হংসো কা জোড়া বিছর গায়ো রে
গজব ভায়ো রামা, জুলম ভায়ো রে’’
১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘গঙ্গা যমুনা’ ছবির সুপারহিট এই গানটি এক শ্রোতার অনুরোধে বাজানো হল রেডিয়োয় বিবিধ ভারতীর একটি অনুরোধের আসরে। গানটি শেষ হতেই ঘোষক জানালেন, ‘‘এইমাত্র আমার হাতে ঝুমরিতালাইয়ার রামেশ্বর প্রসাদ বার্নওয়ালের পোস্টকার্ডের অনুরোধ এসে পড়েছে। উনিও এই ‘দো হংস কা জোড়া’ গানটি শুনতে চেয়েছেন। উনি আমাদের নিয়মিত গানের অনুরোধ পাঠান। তাই রামেশ্বরবাবুর অনুরোধ আমরা ফেলতে পারছি না। আপনারা আবার এই গানটি শুনুন।’’ বিবিধ ভারতীর আসরে ফের বাজতে শুরু করল, ‘‘দো হংসো কা জোড়া বিছর গায়ো রে।’’
একই গান পর পর দু’বার বাজানোর মতো ঘটনা বিবিধ ভারতীতে আগে ঘটেনি। ঝুমরিতালাইয়ার নিজের বাড়িতে বসে স্মৃতিচারণ করতে করতে বলছিলেন রামেশ্বর প্রসাদের ছেলে অজিত কুমার বার্নওয়াল। বলছিলেন, ‘‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি গানটা ছিল বাবার খুব প্রিয়। বাবা প্রতিদিন এই ‘জুতা হ্যায় জাপানি’ গানটা পোস্টকার্ডে অনুরোধ করে লিখে পাঠাতেন। এক-এক দিনে পাঁচটা-ছ’টা করে ‘জুতা হ্যায় জাপানির’ অনুরোধ যেত বাবার কাছ থেকে। আর গানটা বারবার রেডিয়োর বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে বাজত। গান বাজার আগে বাবার নামটা যখন ঘোষক বলতেন, বাবার মুখে এক অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠত।’’
সেটা ছিল ষাটের দশকের প্রথম দিক। তৎকালীন বিহারের এক ছোট্ট জনপদ ছিল ঝুমরিতালাইয়া। ছোট্ট জনপদ হলে কী হবে, এখানে থাকতেন অনেক কোটিপতি মানুষ। ১৮৯০ সালে ব্রিটিশরা এখানে অভ্রের খনি আবিষ্কার করেন। এই অভ্রের খনি ঘিরেই ধীরে ধীরে লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে ঝুমরিতালাইয়াতে। অভ্রের খোঁজে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। এ রকমই এক অভ্র-ব্যবসায়ী ছিলেন রামেশ্বর প্রসাদ। রামেশ্বরের আর এক ছেলে চন্দন বললেন, ‘‘বাবা সকাল থেকে সারা দিন পড়ে থাকতেন কারখানায়। কয়েক জন কারিগর ছিলেন, যাঁরা কাজ করতে করতে শুনতেন বিবিধ ভারতীর গানের অনুষ্ঠান। বাবাও ছিলেন গানপাগল মানুষ।’’
আরও পড়ুন: নুড়ি পাথরের দিনগুলি
গানবন্ধু: প্রিয় রেডিয়োর পাশে রামেশ্বর প্রসাদের ছবি
এই গান শুনতে শুনতেই রামেশ্বর জানতে পারলেন, রেডিয়োতে নিজের নামে গানের অনুরোধ পাঠানো যায়। তিনি এক দিন কয়েক জন কর্মীকে ঝুমরিতালাইয়ার পোস্ট অফিস থেকে কয়েকটা পোস্টকার্ড কিনে আনতে বললেন। সেই পোস্টকার্ডে কয়েকটা গানের অনুরোধ লিখে পাঠিয়ে দিলেন রেডিয়ো স্টেশনে। আর কয়েক দিন পরেই রামেশ্বরকে অবাক করে রেডিয়োতে তাঁর নাম ঘোষণা করলেন ঘোষক। বললেন, ‘‘ঝুমরিতালাইয়া সে রামেশ্বর প্রসাদ বার্নওয়াল কা এ গীত ফরমাইসি হ্যায়।’’
‘‘রেডিয়োতে নিজের নাম শুনে নেশা ধরে গেল বাবার,’’ বলছিলেন রামেশ্বর প্রসাদের ছেলে চন্দন। চন্দন বলেন, ‘‘বাবা বান্ডিল বান্ডিল পোস্টকার্ড কিনতেন। পোস্টকার্ডে নিজের নাম-ঠিকানা ছাপিয়ে নিয়েছিলেন। কোথায় পাঠানো হবে তাও ছাপিয়ে নিয়েছিলেন। শুধু গানের অনুরোধ লিখে পাঠিয়ে দেওয়া হত রেডিয়ো স্টেশনে। এক-এক দিন তিরিশ-চল্লিশটা করে পোস্টকার্ড যেত বিভিন্ন রেডিয়ো স্টেশনে।’’ রামেশ্বরের নাতি প্রবীণ বলেন, ‘‘দাদুর মৃত্যু হয় ১৯৯৫ সালে। মৃত্যুর বেশ কিছু বছর পরে আমাদের বাড়িতে এক বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় দাদুর ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে খাটের তলা থেকে বেরিয়েছিল পেটি পেটি পোস্টকার্ড।’’
রামেশ্বর প্রসাদের এই নেশা তাঁর ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না। ঝুমরিতালাইয়াতে তো ব্যবসায়ী অনেক আছে, কিন্তু ক’জনের নাম রেডিয়োতে শোনা যায়? সপ্তাহে এক দিন সন্ধ্যায় বিনাকা গীতমালায় আমিন সায়ানির মতো বিখ্যাত ঘোষক রামেশ্বর প্রসাদের নাম বলেন, তাঁর অনুরোধে গান বাজান এটা শুনে অবাক হয়ে গেলেন শহরে পানের দোকানদার গঙ্গাপ্রসাদ মগোধিয়া। ঝুমরিতালাইয়া স্টেশন রোডের ওপর গঙ্গার দোকানে পান খেতেন রামেশ্বর। তাঁর সঙ্গে গঙ্গার বন্ধুত্বও ছিল। এক দিন গঙ্গা রামেশ্বরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আমিও অনুরোধ পাঠালে রেডিয়ো বাজাবে আমার অনুরোধের গান?’’ রামেশ্বর মুচকি হেসে বললেন, ‘‘পাঠাতেই পারো। দেখো কী হয়। বাজায় কি না।’’ গঙ্গা তাঁর কর্মচারীকে দিয়ে কিনিয়ে আনালেন একগোছা পোস্ট কার্ড। কয়েকটা গানের অনুরোধ লিখে সে দিনই পাঠিয়ে দিলেন বিবিধ ভারতীতে।
পানের দোকান আর নেই। সেটি আজ নানাবিধ ভুজিয়ার দোকান। গঙ্গার ছেলে অঞ্জনিকুমার মগোধিয়া ওই দোকানে বসে স্মৃতিচারণ করতে করতে বলেন, ‘‘পর পর কয়েক বার বাবার নাম রেডিয়োতে আসার পরে বাবাকেও এই নেশা ভয়ংকর ভাবে পেয়ে বসল। বান্ডিল বান্ডিল পোস্টকার্ড কিনে আনতে শুরু করেন পোস্ট অফিস থেকে। পাঠাতে থাকলেন একের পর এক গানের অনুরোধ।’’ অঞ্জনি জানান, তাঁর বাবার প্রিয় গান ছিল ‘জো ওয়াদা কিয়া ও নিভানা পড়েগা’ আর ‘বাহারো ফুল বরসাও মেরা মেহবুব আয়া হ্যায়।’ বাবার অনুরোধেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি বার রেডিয়োতে এই গান দু’টো বেজেছে। যখন রেডিয়োতে বাজত, পানের দোকানের সামনে ভিড় বেড়ে যেত। বাবাও দোকানদারি বন্ধ করে মুগ্ধ হয়ে শুনতেন গান। যে দিন রেডিয়োতে বাবার নাম বলত, সে দিন বাবা কয়েক জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ফ্রিতে পানও খাওয়াতেন।’’
ষাটের দশকে গানের অনুরোধের প্রতিযোগিতায় ধীরে ধীরে রামেশ্বরের প্রধান প্রতিযোগী হয়ে উঠলেন গঙ্গাপ্রসাদ। সারা দিনে কে কত বেশি গানের অনুরোধ পাঠাতে পারেন তার প্রতিযোগিতা। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী যেন ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। গঙ্গার ছেলে অঞ্জনি বলেন, ‘‘তখন শুধু বিবিধ ভারতী বা রেডিয়ো সিলোনের বিনাকা গীতমালা নয়, দেশের বাইরের রেডিয়ো স্টেশন যেমন রেডিয়ো নেপাল, রেডিয়ো আফগানিস্তান, রেডিয়ো লন্ডন, রেডিয়ো শ্রীলঙ্কা, যেখানে যেখানে হিন্দি সিনেমার গানের অনুরোধের আসর বসত সেখানেই বাবা গানের অনুরোধ পাঠাতে শুরু করেন। সারা দিন ধরে পানের দোকানে হিন্দি গান বাজছে আর বিভিন্ন সময়ে বাবার নাম রেডিয়োতে ঘোষণা হচ্ছে। এ এক অদ্ভুত নেশা।’’
গঙ্গাপ্রসাদ বছর কয়েক আগে মারা গিয়েছেন। কিন্তু দোকানের পিছনে ছোট্ট ঘর জুড়ে তাঁর হরেক স্মৃতি। অঞ্জনি ওই ঘরে একটা স্টিলের আলমারি থেকে বের করলেন বেশ কিছু পুরনো কাগজপত্র ও খাতা। একটি জরাজীর্ণ মোটা খাতা বের করে জানান, এটা তাঁর বাবার গানের খাতা। সেই জরাজীর্ণ মোটা খাতা উলটে দেখা গেল, পাতার পর পাতা গঙ্গার হাতের লেখা। তিনি লিখে রেখেছেন বিভিন্ন হিন্দি গানের প্রথম লাইন, ওই গান কোন ছবির, তার গায়ক, গীতিকার এবং সুরকারের নাম। কেন এ ভাবে গানের লাইন লিখে রেখেছিলেন গঙ্গা? অঞ্জনি বলেন, ‘‘সেই সময় রেডিয়ো শ্রীলঙ্কায় গানের অনুরোধের অনুষ্ঠানে একটা অভিনব প্রতিযোগিতা হত। অনুষ্ঠানের শেষে একটা বাক্য বলা হত। সেই বাক্যের যে ক’টি শব্দ রয়েছে সেই প্রতিটি শব্দ দিয়ে কী হিন্দি গান আছে তা লিখে পাঠাতে হত। যেমন, হয়তো এমন কোনও বাক্য বলা হতো যে বাক্যে রয়েছে সাতটা শব্দ। সেই সাতটা শব্দ দিয়ে হিন্দি সিনেমার কোনও গানের লাইন লিখে পাঠাতে হত। ঠিক বলতে পারলে তবেই রেডিয়োতে নাম উঠত।’’ গঙ্গা জানান, প্রতি সপ্তাহে তাঁর বাবা এই খেলায় যোগ দিতেন। গানের খাতা দেখে তড়িঘড়ি উত্তর লিখে পাঠিয়ে দিতেন রেডিয়ো স্টেশনে।
রামেশ্বর আর গঙ্গার এই নেশা ধীরে ধীরে পেয়ে বসল পুরো ঝুমরিতালাইয়াকেই। শহরের বাসিন্দারা দেখলেন, রেডিয়োতে গানের অনুরোধে কোনও শ্রেণিবিভাজন নেই। অভ্রের খনির মালিক থেকে পানের দোকানদার, সবার গানই শোনানো হচ্ছে এবং তাঁদের নাম বারবার ঘোষণা করছেন ঘোষক। তা হলে তাঁরাই বা পাঠাবেন না কেন গানের অনুরোধ? নেশা পেয়ে বসল অনেককেই। পোস্টকার্ড কেনার হিড়িক বেড়ে গেল শহরে। এতে শামিল হলেন ঝুমরিতালাইয়ার বাঙালিরাও।
এ রকমই এক বাঙালি রবীন্দ্রনাথ গুহ’র সঙ্গে দেখা ঝুমরিতালাইয়াতে। রবীন্দ্রনাথবাবু গঙ্গা ও রামেশ্বরকে অনুসরণ করে গানের অনুরোধ পাঠাতে শুরু করলেন। প্রায় আশির কাছাকাছি বয়স এখন রবীন্দ্রবাবুর। তাঁর মুদির দোকান আছে। সেই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রবাবু বলেন, ‘‘আমি ডি রবীন্দ্র নামে গানের অনুরোধ পাঠাতাম। আমার বলা গানও মাঝেমধ্যে বাজানো হত। তবে গঙ্গা বা রামেশ্বরের সঙ্গে পেরে উঠতাম না। সবাই তো ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হয় না।’’
রেডিয়োতে নাম তোলার প্রতিযোগিতাটা ঝুমরিতালাইয়াতে যে কী তীব্র হয়ে উঠেছিল সে সময়! রবীন্দ্রবাবু জানালেন, তিনি বলেন, ‘‘অনেক সময় পোস্ট অফিসে গিয়ে শুনতাম, পোস্টকার্ড শেষ! সব বান্ডিল বান্ডিল পোস্টকার্ড কিনে নিয়ে গিয়েছেন রামেশ্বর, গঙ্গা, জগন্নাথ সাহুর মতো হেভিওয়েটরা। পোস্ট অফিসে একটু দেরি করে গেলে পোস্টকার্ড অনেক সময়ই পাওয়া যেত না। যারা পেতেন না, তাঁরা তখন অভিযোগ করতেন, পোস্টমাস্টারকে ঘুষ দিয়ে সব পোস্টকার্ড কিনে নিয়েছে ওরা।’’
ঘুষ শুধু পোস্টমাস্টারকেই নয়, ঘুষ দেওয়া হত ঝুমরিতালাইয়া পোস্ট অফিসে যে কর্মীটি চিঠি বাছাই করতেন, তাঁকেও!
বললেন শহরের আর এক বাসিন্দা অশোক দাশগুপ্ত। তিনিও এই গানের অনুরোধ পাঠানোর প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছিলেন। রবীন্দ্রবাবুর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘যিনি চিঠি বাছাই করছেন তাকে দশ-কুড়ি পয়সা ঘুষ দিয়ে বলা হত, অন্যদের পোস্টকার্ড আজকে না বাছাই করে দু’দিন পরে করতে।’’
পোস্ট অফিসে ঘুষ বা একটা অশুভ আঁতাত যে চলছে, তা বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রবাবু বা অশোকবাবুরা। তাঁরা বুঝতে পারলেন, আসলে পোস্ট অফিস থেকে চিঠিটা যেতেই দেরি হচ্ছে। তখন তাঁরা একটা নতুন রাস্তা নিলেন। রবীন্দ্রবাবু বলেন, ‘‘আমরা তখন ঝুমরিতালাইয়া পোস্ট অফিস থেকে নয়, ট্রেনে চেপে পোস্টকার্ড পোস্ট করতে যেতাম হাজারিবাগ, গয়া, গিরিডিতে। সেখানে তো আর আঁতাত নেই, ঘুষ নেই। ভাবুন কী পাগলামিটাই না করেছি তখন!’’ ঝুমরিতালাইয়ার আর এক বাঙালি ব্যবসায়ী অলোককুমার সরকার বলেন, ‘‘এমনিতেই ওদের সঙ্গে পেরে উঠতাম না। তখন পোস্টকার্ডের দাম ছিল ৫ কি ১০ পয়সা। বান্ডিল বান্ডিল পোস্টকার্ড কেনার পয়সা কোথায় পাব? বাজার, দোকানে এক পয়সা এক পয়সা করে জমিয়ে পোস্টকার্ড কিনতাম। তার পর মা-বাবাকে লুকিয়ে পোস্ট করতাম।’’
তবে রামেশ্বর, গঙ্গা, বা জগন্নাথ সাউয়ের মতো হেভিওয়েটদের কিছু যায়-আসেনি। ঝুমরিতালাইয়ার আর এক বাসিন্দা সুদেবকুমার সিংহ। প্রবীণ এই মানুষটি বলেন, ‘‘ওরাই তখন পুরো শহরের হিরো। আমি মনে করি কয়েকটা হিন্দি গান হিট হয়েছে রামেশ্বর, গঙ্গাদের জন্যই। একই গানের অনুরোধ দিনের পর দিন পাঠিয়ে গিয়েছে ওরা সবাই মিলে। বারংবার একই অনুরোধ আসায় সেই গান বাজাতে বাধ্য হত রেডিয়ো স্টেশন। আর বহু বার শুনতে শুনতে সেই গান সবার মনে গেঁথে যেত।’’
রামেশ্বরের ছেলে চন্দন জানালেন আর এক তথ্য। এমনও ঘটেছে যে তাঁর বাবার অনুরোধের দু’টো গান দু’টো ভিন্ন রেডিয়ো স্টেশনে একই সময়ে বাজছে। চন্দন বলেন, ‘‘লন্ডন রেডিয়োতে হিন্দি সিনেমার গান পাঠিয়ে পাঠিয়ে বাবা ওই রেডিয়ো স্টেশনের কর্মীদের কাছে এত পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, প্রতি বছর পয়লা জানুয়ারি লন্ডন থেকে বাবার নামে নতুন বছরের শুভেচ্ছা কার্ড আসত। তবে বাবা সম্পর্কে সেরা কথাটা বলেছিলেন অভিনেতা জনি ওয়াকার। তিনি বলেছিলেন, ‘ভগবান আমাদের দু’টো কান কেন দিয়েছেন জানেন? দুই কান দিয়ে রামেশ্বরের দু’টো অনুরোধের গান একসঙ্গে শোনার জন্য।’ ’’
সাধারণত ঝুমরিতালাইয়ার মানুষেরা একটা গানের অনুরোধ অনেকে মিলে করতেন। অনেকের নাম লিখে দেওয়া হত পোস্টকার্ডে। যেমন গঙ্গা শুধু নিজের নামই পাঠাতেন না। মাঝেমধ্যে জুড়ে দিতেন তাঁর স্ত্রী মালতী দেবীর নামও। কেউ আবার জুড়ে দিতেন তাঁর প্রেমিকার নামও। ঝুমরিতালাইয়ার এক প্রবীণ মানুষ জানালেন, তিনি ভালবাসতেন পাড়ার একটি মেয়েকে। মেয়েটির নজরে আসার জন্য তিনি যখন গানের অনুরোধ পাঠাতেন সেই সঙ্গে জুড়ে দিতেন ওই মেয়েটিরও নাম। প্রবীণ মানুষটি বলেন, ‘‘রেডিয়োতে দু’জনের নাম একসঙ্গে উচ্চারণ হলে এত ভাল লাগত! আমি বারবার অনুরোধ করতাম ‘জব পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’ গানটার। রেডিয়োতে ওর নাম বারবার বলাকে কেন্দ্র করেই ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, পরে ভালবাসাও। তখন একসঙ্গে দু’জনে গানের অনুরোধ পাঠাতাম আর একসঙ্গে বসে গান শুনতামও। কিন্তু বাস্তব জীবনে এক হতে পারলাম না। ওর বিয়ে হয়ে গেল অন্য জায়গায়।’’
বারবার রেডিয়োতে নিজের নাম তুলে এই ভাবেই ঝুমরিতালাইয়াকে বিখ্যাত করে তুলেছিলেন এখানকার সাধারণ মানুষ। অশোকবাবু বলেন, ‘‘তখন বছরের শেষে বুধবার বিনাকা গীতমালার একটা অনুষ্ঠান হত। সারা বছরের জনপ্রিয় গানগুলো বাজত। আর যে গানটা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হত, সেই গানটা শেষের গান হিসাবে বাজত। কোনটা সেরা গান হবে তা নিয়ে আমরা রীতিমত বাজি লাগাতাম।’’
ষাটের দশকেই ঝুমরিতালাইয়াতে তৈরি হয়েছিল রেডিয়োর প্রথম ক্লাব ‘বারুদ রেডিয়ো শ্রোতা সঙ্ঘ।’ গঙ্গার ছেলে অঞ্জনি বলেন, ‘‘সম্ভবত এটাই ছিল দেশের প্রথম রেডিয়ো ক্লাব। ঝুমরিতালাইয়ার গানপ্রিয় মানুষরা সবাই সপ্তাহে এক দিন এই ক্লাবে আসতেন। গান নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হত। কোন কোন রেডিয়ো স্টেশনে কী গান সামনের সপ্তাহে পাঠানো হবে, তার একটা তালিকা তৈরি হত।’’ আশির দশকের মাঝামাঝি সময় টিভি আসার পরে আস্তে আস্তে এই ক্লাব উঠে যায়। রেডিয়ো নিয়ে উন্মাদনা কমতে থাকে। তবে ঝুমরিতালাইয়ার নাম কিন্তু মানুষের মনে তত দিনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিল।
কিন্তু শহরটার অস্তিত্ব নিয়ে অনেকে সন্দেহ করতেন। সত্যিই কি ঝুমরিতালাইয়া নামে কোনও জায়গা আছে? অনেকে আবার ভাবতেন, ঝুমরিতালাইয়া বোধহয় মুম্বই শহরের আশপাশের কোনও এলাকা। ঝুমরিতালাইয়ার অশোকবাবু বলেন, ‘‘এক বার আমি বাড়ি আসার জন্য হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠেছি। পাশের সহযাত্রীর সঙ্গে ভাব হওয়ার পরে তাঁকে জানালাম, আমার বাড়ি ঝুমরিতালাইয়া। তিনি আবার বললেন, যেখান থেকে প্রচুর গানের অনুরোধ আসে? আপনি তা হলে ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছেন। এই ট্রেন মুম্বই যাচ্ছে না। বুঝুন অবস্থা!’’ আর এক বাসিন্দা অলোকবাবুর অভিজ্ঞতাও সে রকম: ‘‘এক বার আমাকে এক জন বলেছিলেন, ঝুমরিতালাইয়া আসলে নীললোহিতের দিকশূন্যপুরের মতো একটা কাল্পনিক নাম। যেখানকার বাসিন্দাদের কোনও কাজ নেই, কোনও চিন্তা নেই, নেই কোনও ঝুটঝামেলা। তাদের ভাত-কাপড় নিয়েও কোনও চিন্তা করতে হয় না। তারা সারাদিন রেডিওতে, রফি, কিশোর, মুকেশ, লতা, আশা, মান্না দের গান শোনেন।’’
ঝুমরিতালাইয়া শহর ঘেঁষেই কোডারমা স্টেশন। ওভারব্রিজ থেকেই দেখতে পাওয়া যায় ঘিঞ্জি শহরটাকে। এখন স্মার্টফোন থেকে গান ডাউনলোড করেই গান শুনে নেন এই শহরের বেশির ভাগ মানুষ। তবু একদা পেটি পেটি পোস্টকার্ড কিনে গানের অনুরোধ পাঠিয়ে যাঁরা একটা অখ্যাত গঞ্জ শহরকে বিখ্যাত করে তুলেছিলেন, তাঁদেরকেও ভুলে যায়নি এই প্রজন্ম। গঙ্গাপ্রসাদ বলতেন, ‘‘আমাদের যৌবনের পাগলামি হয়তো আমাদের কাজের ক্ষতি করে দিয়েছে, কিন্তু এই পাগলামিটাই তো এক সাধারণ গঞ্জ শহরকে বিখ্যাত করে দিয়েছে!’’
https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/the-largest-number-of-requests-for-film-songs-addressed-to-the-channel-came-from-jhumri-telaiya-1.743324?ref=archive-new-stry
No comments:
Post a Comment