Thursday, 28 June 2018

২৫ বছর পরেও মোছেনি সে দিনের কলঙ্কের স্মৃতি (On Babri Demolition)

২৫ বছর পরেও মোছেনি সে দিনের কলঙ্কের স্মৃতি

ফের শুরু হয়েছে অযোধ্যা নিয়ে হিন্দুত্ববাদী আস্ফালন। দুনিয়া কিন্তু জানে, আগামী বুধবারই ঐতিহাসিক সেই সৌধ ভাঙার পঁচিশ বছর। কলঙ্কিত সেই দিনের ফ্ল্যাশব্যাক।

Babri Masjid
দেবব্রত ঠাকুর
 
Babri Masjid

উন্মত্ত: অযোধ্যায় বাবরি মসজিদে করসেবকদের দল। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২

বার্তা সম্পাদক গৌরীদি বললেন, ‘‘ধর। চিফ এডিটর কথা বলবেন।’’ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফোনের ও পারে অভীকবাবুর গলা, ‘‘কপিটা কী? এক লাইনে বল।’’ মাথা পুরো ফাঁকাই ছিল এত ক্ষণ। সকাল থেকে ঘটে যাওয়া অতিদ্রুত ঘটনাপ্রবাহে এবং প্রভাবে হতচকিত। প্রধান সম্পাদকের প্রশ্নে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘‘ক্যাডার লিডস দ্য লিডার। নেতাদের নেতৃত্ব দিলেন ক্যাডাররাই।’’ মুহূর্তেই ভেসে এল তাঁর অনুমোদন, ‘‘ঠিক। ওটাই কপি। দ্রুত লিখে ফেল। যে কোনও সময় কিন্তু সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।’’
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। স্থান: অযোধ্যা। ২৫ বছর অতিক্রান্ত। কিন্তু সে দিনের স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে আজও। কমণ্ডল রাজনীতির সুবাদে ১৯৯১ থেকে ১৯৯২, দু’বছরে বার পনেরো অযোধ্যায় আসা-যাওয়া। প্রতি বারই ‘কী হয় কী হয়’ ভাব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধর্মগুরু ও রাজনীতিকদের যৌথ প্রয়াসে লেখা চিত্রনাট্য মেনেই বিতর্ক জিইয়ে রেখে নেতাদের হম্বিতম্বিতে শেষ হয়েছে এক এক পর্ব। প্রতি বারই বিফলমনোরথ হয়ে ফিরেছে দাবার বোড়ে, করসেবকরা। সঙ্গে নিয়ে নেতাদের প্রতি পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। ৯২’-এর ৬ ডিসেম্বরের আগেও একাধিক বার করসেবকদের একাংশ চড়াও হয়েছে বিতর্কিত কাঠামোটির উপর। তবে প্রতি বারই নেতারা শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে এনেছেন তাদের। আর গালাগালি দিতে দিতে ফিরেছে তারা।

এ বার তারা যেন প্রথম থেকেই বেশ রাগী। মহারাষ্ট্র থেকে আসা এক দল করসেবকের গেরুয়া টি-শার্টের সামনে স্পষ্ট করে ইংরেজিতে লেখা ‘আয়্যাম অ্যান অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’। পিছনে বিশুদ্ধ দেবনাগরীতে ‘জয় শ্রীরাম’। তাদের মুখের ধ্বনিও সেই ‘জয় শ্রীরাম’। প্রতিসম্ভাষণে ‘জয় শ্রীরাম’ না বললেই পাল্টা হুমকি, ‘‘আবে বোল!’’ ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে প্রতিদিনই করসেবকদের ঢল অযোধ্যায়। নেতাদের পরিকল্পনা ছিল, এক একটা দল আসবে। করসেবাস্থল ঘুরে রামলালার দর্শন করে ফিরে যাবে নিজ গন্তব্যে। রামমন্দিরের পয়লা নম্বর প্রবক্তা অশোক সিঙ্ঘল এবং তাঁর লেফটেন্যান্ট, বজরং দল প্রধান বিনয় কাটিয়ার সাংবাদিকদের জানালেন, করসেবকদের যাওয়া-আসা চলতেই থাকবে। ৬ ডিসেম্বর করসেবার ‘ডি-ডে’তে হাজার পঞ্চাশেক সেবক অযোধ্যায় হাজির থাকবেন। তাঁরাই সরযূ নদীর চর থেকে মুঠি-ভর বালি নিয়ে সুশৃঙ্খল ভাবে বিতর্কিত ২.৭৭ একর এলাকার বাইরে, কংক্রিটের চাতালের চার পাশে ছড়িয়ে দেবেন।
কিন্তু নেতারা ভাবেন এক, ক্যাডাররা আর এক। প্রতিদিনই করসেবকরা আসছে দলে দলে। কিন্তু ফিরছে না কেউই। সকলেই চায়, মূল দিনের করসেবায় অংশ নিতে। এর আগে করসেবকরা মূলত এসেছে উত্তরপ্রদেশ থেকেই। কিন্তু এ বার করসেবকরা বিভিন্ন রাজ্য থেকে। বাংলা, অসম, মহারাষ্ট্র তো আছেই, দলে দলে করসেবকরা আসছে বিন্ধ্যর দক্ষিণ দিক থেকেও। অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, কেরল থেকেও করসেবকদের এমন ঢল নতুন ঘটনা বইকী। সব রাজ্যের শিবির আলাদা। সেই সব শিবিরে শিবিরে ঘুরছেন সাংবাদিকরা। কিন্তু ঠোক্কর খেতে হল অন্ধ্রের শিবিরে যেতেই। প্রবেশ নিষেধ। খানিকটা তর্কাতর্কি, এবং তাদের রক্তচক্ষু দেখে শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকদের পিছু হঠা। সে দিনই বিকেলে অন্ধ্রের সেই দলটিকে দেখা গেল রামকথাকুঞ্জ-সহ বিতর্কিত এলাকার চারপাশে ‘পরিক্রমা’ করতে। সুঠাম চেহারা, চোখের কোণে রক্তিম আভা। রশি, গাঁইতি, শাবল, কোদালে সুসজ্জিত জনা পঞ্চাশেক যুবক। 
পাঁচ তারি‌খ সকাল সকাল বার্ব ওয়্যার, জিআই পাইপের বেড়ার মধ্যে শ’দুয়েক সিআরপিএফ প্রহরায় থাকা রামলালাকে ‘দর্শন’। আসলে ভিতরের ব্যবস্থা সাংবাদিকরা যে যাঁর মতো জরিপ করতে ব্যস্ত। বাস্তবিকই ইনস্যাস রাইফেল আর কার্বাইনে সুসজ্জিত নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আস্থাশীল সকলেই। ঘেরাটোপের এক পাশে প্রচুর বেতের ঢাল আর বেতের লাঠি। বিতর্কিত কাঠামোর পিছনে অন্তত দু’ফুট চওড়া, পনেরো ফুট উঁচু প্রাচীর। লক্ষ্মণ টিলার দিকে, কাঠামোর পিছন দিক থেকে ঢালু নয়, একেবারে খাড়া মাটির টিলা। চার-পাঁচ তলা বাড়ির সমান উঁচু। তার উপরে প্রাচীর-ঘেরা কাঠামো। কেউ বলেন বাবরি মসজিদ, কেউ বা বলেন রামমন্দির। সাংবাদিকরা লেখেন, বিতর্কিত কাঠামোয় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা!!! হায় রে, তখনও কি তাঁরা জানতেন, এই নিরাপত্তা কত ঠুনকো!
৬ ডিসেম্বর দিন শুরু হল সকাল পাঁচটায়। ফৈজাবাদের হোটেল থেকে বেরিয়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরের অযোধ্যার পথে যখন, তখন ঘড়ির কাঁটায় ছ’টা। উত্তরপ্রদেশের শীতের সকাল। ফৈজাবাদের মানুষরা রাস্তার দু’পাশে। হাত দেখিয়ে গাড়ি থামাল এক দল যুবক। মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। এ আবার কী গেরো! গাড়ির কাচ নামাতেই পোয়া-ভাঁড় ভর্তি দুধেল চা, লেড়ো বিস্কুট। যুবকদের বক্তব্য, অযোধ্যায় ভিড় বাড়াবেন না তাঁরা। শীতের সকালে মানুষকে চা খাইয়েই তাঁদের করসেবা চলছে।
লক্ষ মানুষের ভিড় ঠেলতে ঠেলতে গাড়ির প্রথম গন্তব্য সরযূ নদীর তীর। এখান থেকেই ‘মুঠিভর বালি’ সংগ্রহ করে করসেবকদের জন্মভূমি-যাত্রার কথা। কিন্তু কোথায় কী!
ধু ধু সরযূ তীর। সব পথের লক্ষ্যই করসেবাস্থল। পার্কিং-এ গাড়ি রেখে সেই ভিড়ে ভাসতে ভাসতে করসেবাস্থলে। আগের দিনের মতোই সেই ‘নিশ্ছিদ্র’ নিরাপত্তা। অবাধ প্রবেশের অধিকার নেই। সাংবাদিকদের গলায় ঝোলানো রাম জন্মভূমি ন্যাসের গোলাপি পরিচয়পত্র। প্রেস কার্ড। রুটিন মতোই আবার রামলালা সকাশে ঢু মারা। সেখানেই দেখা হয়ে গেল ফৈজাবাদের সিনিয়র সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ (এসএসপি) ডি বি রাই-এর সঙ্গে। বললেন, মাছিও গলতে পারবে না।
এর মধ্যেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্বেচ্ছাসেবকরা দেখালেন, পাশের মানস কুঞ্জের তিন তলার ছাদ হচ্ছে ‘প্রেস গ্যালারি’। সেখান থেকে সামনে তাকালে বিতর্কিত কাঠামো। নীচে তাকালেই উন্মুক্ত করসেবাস্থল। বাঁ দিকে রামকথাকুঞ্জের অস্থায়ী একতলা অফিস। তার ছাদই আজকের ভিভিআইপি মঞ্চ। সেখান থেকেই ভাষণ দেবেন লালকৃষ্ণ আডবাণী, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরকার্যবাহ (সাধারণ সম্পাদক) এইচ ভি শেষাদ্রি, সঙ্ঘের গুরুত্বপূর্ণ নেতা কে এস সুদর্শন, মুরলী মনোহর জোশী, রাজমাতা বিজয়রাজে সিন্ধিয়ারা। সুতরাং প্রেস গ্যালারিতে ‘পজিশন’ নেওয়ার জন্য সাংবাদিকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ছাদে পজিশন নিয়েও কী মনে হতে নেমে এলাম নীচে। সামনের দরজায় স্বেচ্ছাসেবকরা আর সাংবাদিকদের বেরোতে দিচ্ছেন না। অতএব খিড়কি দোরই ভরসা। বেরিয়ে এসে গোলাপি প্রেস কার্ড দেখিয়ে করসেবাস্থলে প্রবেশ। দেখা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সহ-সভাপতি পি পি তোষনিওয়ালের সঙ্গে। তিনিই জানালেন, কোনও করসেবকই অত দূরে সরযূ তীরে যেতে রাজি হয়নি। সে কারণেই পরিকল্পনায় ‘ছোট বদল’ করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। তাঁর সঙ্গে কথা শেষ হতেই দেখা গেল, রামকথাকুঞ্জ আর সংলগ্ন অ্যাপ্রোচ রোডে করসেবকদের ভিড় উপচে পড়ছে। সঙ্গে গগনভেদী হুংকার ‘জয় শ্রীরাম’। ভিড় সামলাতে সঙ্ঘের স্বেচ্ছাসেবকরা ওই শীতেও খাকি হাফপ্যান্ট আর সাদা হাফশার্ট বা টি-শার্ট পরে মানবশৃঙ্খল রচনা করে দাঁড়িয়ে। বিশৃঙ্খল করসেবকদের সামলানোর দায়িত্ব তাঁদেরই। তার মধ্যেই তদারকি করে বেড়াচ্ছেন ‘পহেলবান ধরমদাস’। একদা বিনয় কাটিয়ারের ছায়াসঙ্গী পহেলবান তত দিনে গেরুয়া বসনধারী ‘স্বামী ধর্মদাস’ হয়ে গিয়েছেন। তত ক্ষণে তাঁর শিষ্যদের নিয়ে হাজির আচার্য বামদেব। পুজোপাঠের প্রয়োজনীয় সাজসজ্জা শুরু হয়েছে। নজরে পড়ল, সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত পর্যবেক্ষক তেজশঙ্কর এক কোণে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে সব পর্যবেক্ষণ করছেন। কয়েক দিন আগেই এই তেজশঙ্করের সঙ্গে আলাপ হয়েছে দিল্লিতে, সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি বেঙ্কটচালাইয়ার এজলাসে। করসেবার অনুমতি দিয়ে সে দিনই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ তাঁকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেন।
তেজশঙ্করকে প্রশ্ন করি, কেমন বুঝছেন? হাসলেন, ‘‘এভরিথিং ইজ ফাইন।’’ ঘড়ির কাঁটায় তখন ন’টা।
রামকথাকুঞ্জের মঞ্চ থেকে তখন ভেসে আসছে রাম-ভজন। করসেবা পরিসরের এক কোণে, বিতর্কিত এলাকা ঘেঁষে একটা মাটির ঢিবি। সেখান থেকে চারপাশটা পরিষ্কার দেখা যায়। এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে সেই ঢিবির উপরে দাঁড়ালাম। সেখানে ইটের উপরে বসে উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন ডিরেক্টর-জেনারেল অব পুলিশ তথা বারাণসীর বিজেপি সাংসদ শ্রীশচন্দ্র দীক্ষিত। তিনি আবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদেরও সহ-সভাপতি। পাশেই ফৈজাবাদ ডিভিশনের ডিআইজি উমাশঙ্কর বাজপেয়ী। তিনিও জানালেন, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।
এরই মধ্যে সপার্ষদ হাজির চিত্রকূটের বৈষ্ণবাচার্য হরিচরণ দাস। সঙ্গে ‘টিন-এজ’ সাধু রঘুনন্দন, হরিচরণের শিষ্য। ফর্সা, দোহারা চেহারা। নির্দিষ্ট আসনে বসে রঘুনন্দন তাঁর গেরুয়া ঝোলা থেকে দু’টি ছোট কর্ণিক বের করতেই তেড়ে এলেন পহেলবান। কর্ণিক নিয়ে টানাটানি চলতে চলতেই ছেলেটিকে কাঁধে তুলে নিয়ে পহেলবান ধরমদাস ধেয়ে গেলেন উত্তর-পূর্ব কোণের গেটের দিকে। কার্যত পরিসরের বাইরে ছুড়ে ফেললেন তাঁকে। সঙ্গে সঙ্গে আগুনে যেন ঘি পড়ল। করসেবকদের জমাট ভিড় আছড়ে পড়ল গেটের উপর। স্বেচ্ছাসেবকরা সামলাতে পারলেন না, শ’দুয়েক যুবকের দল ঢুকে পড়ল করসেবাস্থলের মধ্যে। হাতে তাদের কর্ণিক নয়, প্রমাণ মাপের ত্রিশূল। শুরু হল উন্মত্ত নাচ। বোল একটাই, ‘জয় শ্রীরাম’। সঙ্ঘের লাঠিধারী বাহিনী তেড়ে গেল তাদের দিকে। ধাক্কা দিতে দিতে বের করে দিল।
ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁয়েছে। এত ক্ষণ নোটবই, পেন হাতেই ছিল। গলায় ঝুলছিল প্রেস কার্ড। কী মনে হতে সে সব গুটিয়ে পকেটে চালান করলাম। অন্য পকেট থেকে টেনে বের করলাম ‘জয় শ্রীরাম’ লেখা সিল্কের ফেট্টি। রামকথাকুঞ্জের মাইকে তখন ভজন থেমে গিয়েছে। বার বার ‘অনুশাসন’-এর হুঁশিয়ারি আসছে। ভেসে আসছে সিঙ্ঘলের গলা, কাটিয়ারের গলা, ‘‘যাঁরা বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন তাঁরা আমাদের লোক নন। করসেবা ভন্ডুল করতে আসা ষড়যন্ত্রী। পিভি, মুলায়ম, ভিপির পাঠানো লোক। কোনও প্ররোচনায় পা দেবেন না।’’  
স্তব্ধ: কলকাতার রাজপথে সেনা প্রহরা। ১১ ডিসেম্বর, ১৯৯২
করসেবক বনাম স্বেচ্ছাসেবকদের এই টানাপড়েনের মাঝে ছিল উত্তরপ্রদেশের ‘কুখ্যাত’ পিএসি, প্রভিনশিয়াল আর্মড কনস্টেবুলারি। এদের হিন্দু-প্রীতি সুবিদিত। টানাপড়েনের মধ্যে তারা কখন এক পাশে সরে গিয়েছে। চারদিকে সমুদ্রের মতো গর্জন, জয় শ্রীরাম।
বেলা সাড়ে এগারোটা। হঠাৎই বিতর্কিত কাঠামোর পিছন দিক থেকে রশি বেয়ে গম্বুজের মাথায় উঠে এল এক দল করসেবক। পিঠে বাঁধা গাঁইতি, শাবল। অন্ধ্রের সেই দলটি। মুহূর্তে বদলে গেল ছবিটা। সঙ্ঘের তথাকথিত অনুশাসনকে পায়ে দলে করসেবাস্থল হয়ে কাঠামোর দিকে ধেয়ে চলেছে করসেবকরা। এই জনজোয়ারকে আটকাতে বেতের লাঠি হাতে এগিয়ে গেলেন পহেলবান ধরমদাস। কিন্তু জনস্রোতে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলেন তিনি। তার পরই লাফিয়ে ফের দৌড়লেন রামকথা কুঞ্জের দিকে। করসেবকদের কয়েক জন তাড়া করল পহেলবানকে। হাতে ত্রিশূল, মুখে বিশুদ্ধ হিন্দিতে গালি। তত ক্ষণে পহেলবান পগার পা়র।
কোন দিকে যাব বুঝতে পারছি না। রামকথাকুঞ্জে, না কি এখানেই। কী ভেবে করসেবকদের সঙ্গে দৌড়ে গেলাম। ঢুকে পড়লাম বিতর্কিত কাঠামোর মধ্যে। এসএসপি ডি বি রাই চিৎকার করছেন, ‘‘চার্জ টিয়ার গ্যাস!’’ বার বার চিৎকারে তাঁর মুখে দৃশ্যতই ফেনা উঠে গিয়েছে। কিন্তু কাঁদানে গ্যাস যাদের হাতে, সেই পিএসি বাহিনী তখন এসএসপি-র নির্দেশ উপেক্ষা করেই চত্বর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। গোটা কাঠামো তখন করসেবকদের দখলে। শুরু হয়ে গিয়েছে ইটবৃষ্টি। এ বার এসএসপি-র শেষ ভরসা সিআরপিএফ-ও বেতের ঢালে মাথা ঢেকে ছেড়ে যাচ্ছে চত্বর। এক জওয়ান বললেন, ‘‘আপ ভি চলিয়ে, নেহি তো মর যাওগে।’’ তাঁর ঢালে মাথা বাঁচিয়ে নেমে এলাম সীতা রসুইয়ের সামনের রাস্তায়।
এগোলাম রামকথাকুঞ্জের দিকে। সহকর্মী সাংবাদিকরা কে কোথায় ছিটকে পড়েছে। প্রাক্-মোবাইল যুগ। উপরে তাকিয়ে দেখলাম, মানস কুঞ্জের ছাদের প্রেস গ্যালারিতে শুধু থিকথিকে মাথা। কাঠামোর গম্বুজ ভাঙার কাজ তখন শুরু হয়ে গিয়েছে। কংক্রিট নয়, চুন-সুরকির শক্ত পাঁচশো বছরের পুরনো গাঁথনির গম্বুজ। সাড়ে বারোটা নাগাদ সবসুদ্ধ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল বাঁ দিকের প্রথম গম্বুজটি। মীর বাঁকির গড়া ‘বাবরি মসজিদ’-এর ধুলোয় মিশে যাওয়া তখন মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা।
রামকথাকুঞ্জের মাইক এত ক্ষণ ছিল স্তব্ধ। হঠাৎ ঘড়ঘড় আওয়াজ করে সচল হল। এক এক করে ভেসে আসছে আডবাণী, যোশী, রাজমাতা, সুদর্শন, সিঙ্ঘলদের গলা। সকলের অনুরোধ, এ বার নেমে আসুন। কিন্তু কে শোনে সে কথা!
রামকথাকুঞ্জের দিকে এগনোর বৃথা চেষ্টা করে ক্ষান্ত দিয়েছি। দেখা এক সিনিয়র সহকর্মীর সঙ্গে। রামকথাকুঞ্জেই ছিলেন এত ক্ষণ। জানালেন, আডবাণীজি খুবই বিভ্রান্ত। প্রমোদ মহাজন মাথা চাপড়াচ্ছেন, ‘আরে ইয়ে ইস্যু হমারা হাথ সে নিকাল গয়া।’ সকলেই আশঙ্কায়, যে কোনও সময় রাজ্যের বিজেপি সরকারকে ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করবে কেন্দ্র। নরসিংহ রাও সরকার বাকি কাঠামোর সুরক্ষায় ঢোকাবে সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনী। কিন্তু কোথায়
কী! বেলা তিনটেয় ভেঙে পড়ল দ্বিতীয় গম্বুজটিও।
আবার সরব হল মাইক। এ বার ভেসে এল জ্বালাময়ী ভাষণের জন্য বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত) সাধ্বী ঋতম্ভরা ও উমা ভারতীর গলা। এত ক্ষণের ‘স্টান্স’ পালটে ফেলে হিন্দুত্ববাদ এ বার স্লোগান তুলল, ‘‘এক ধাক্কা অউর দো/ বাবরি মসজিদ তোড় দো।’’ নেতারা ভেসে গেলেন ক্যাডারদের স্রোতে।
ইতিমধ্যে হঠাৎই এক করসেবক লাঠি নিয়ে তাড়া করল। তাড়া খেয়ে উঠে গেলাম বিতর্কিত কাঠামোর ঠিক পাশের বাড়ি, সীতা রসুই ভবনে। রামভক্তদের বিশ্বাস, এখানেই ছিল সীতা মাইয়ার রন্ধনশালা। ছাদে দেখা কয়েক জন সহকর্মী সাংবাদিকের সঙ্গে। অনেকেই তখন অযোধ্যা ছেড়ে ফৈজাবাদের পথ ধরেছেন। কিন্তু ঠিক করেছি, শেষ গম্বুজটি ভেঙে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব। শীতের সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। বিকেল ৪টে ৪৯ মিনিট। ভেঙে পড়ল মূল গম্বুজ। মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেল। ভাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুই ভাবতে পারছি না। সকাল থেকে পেটে দানাপানি পড়েনি। খিদের বোধও চলে গিয়েছে।
নেমে এলাম সীতা রসুইয়ের তিন তলার ছাদ থেকে। চার দিকে থিকথিক করছে করসেবক। কেউ বিতর্কিত কাঠামোর ইট সংগ্রহ করছে। কয়েক জন সহকর্মীও ইট নিল। স্মারক। নিতে গিয়েও নিলাম না। এদিক-ওদিক করে ফৈজাবাদ রোডে। সব গাড়ি পালিয়ে গিয়েছে ফৈজাবাদে। আমাদের গাড়িও। স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদপত্রের ‘বহেনজি বাহিনী’ ডাক দিল, ‘‘ভাইয়া, হমারা গাড়ি মে আইয়ে।’’ ওমনি ভ্যানের পিছনের ডিকির দরজা খোলা। স্টেপনির উপর বসে ফিরছি। রাস্তার এ পাশে, ও পাশে টায়ার জ্বলছে। কোথাও দোকান জ্বলছে। গলির মুখে ভয়ার্ত মুখের জটলা। কপি ভাবার চেষ্টা করছি, ইন্ট্রো কী হবে? দূর, কিছু ভাবতেই পারছি না। মাথা ফাঁকা।

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/25-years-of-the-demolition-of-the-babri-masjid-flashback-of-babri-demolition-1.717271?ref=archive-new-stry

র‌্যাচেল থেকে রমলা হয়ে উঠলেন তিনি (On A Jews-Indian actress)

র‌্যাচেল থেকে রমলা  হয়ে উঠলেন তিনি

র‌্যাচেল কোহেন। জন্ম একশো বছর আগে। বাংলা নাটকে, রবীন্দ্রনাথের কাহিিন নিয়ে তৈরি নির্বাক ছবিতে নায়িকা। তার পর মুম্বই, হিন্দি ছবির তারকা। বাঙালির চলমান ইতিহাসে উজ্জ্বল এক ইহুদি কন্যা।

সোমেশ ভট্টাচার্য
 
Ramala Devi
টালিগঞ্জের দিকে হনহন করে হাঁটছিল মেয়েটা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই অত বড় পরিচালকের অফিস পর্যন্ত পৌঁছনো। যে সে লোক নয়, গোটা ইন্ডাস্ট্রি এক ডাকে চেনে। তাঁর মুখে এই কথা! মেয়েটা ভাবতেই পারছিল না।
সেই ছোট বয়স থেকে সে স্টেজে উঠছে। চাইল্ড আর্টিস্ট হিসেবে মুখ দেখানো হয়ে গিয়েছে কয়েকখানা নির্বাক ছবিতেও। কিন্তু আর খুদে অভিনেতা নয়, পুরোদস্তুর নায়িকা হতে চায় সে। বাঙালি নাম একটা জুটেছে ঠিকই, এ বার বাংলাটাও আর একটু ভাল বলতে হবে! তবে সবার আগে চাই একটা সুযোগ। সে জন্যই আসা। তার বদলে এই? দুর্ব্যবহার, উপেক্ষা, মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া তার কাছে নতুন নয়। তাই বলে ইটের উপর দাঁড়াতে হবে!
ইহুদি স্কুলটিচার হায়াম কোহেন যখন বোম্বাই ছেড়ে কলকাতায় আসেন, মেয়ে র‌্যাচেল তখন ফ্রক পরে। চৌরঙ্গির একটা স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়ের মন নাচগান-নাটকের দিকে। স্কুলে ফাংশন হলেই র‌্যাচেল স্টেজে। হায়াম বেশ বুঝছিলেন, এ মেয়ের লেখাপড়া হবে না। বরং সে যা ভালবাসে, তা করতে দেওয়াই ভাল। তার দুই বোনেরও একই রকম মতিগতি। তিন মেয়েকেই করিন্থিয়ান থিয়েটারে পাঠিয়েছিলেন বাবা। বাংলার পেশাদার রঙ্গমঞ্চ তখন জমজমাট। তিন কন্যা ভিড়ে গিয়েছিল সেই দলে।
–– ADVERTISEMENT ––
তখনও এ দেশে সিনেমার বুলি ফোটেনি। অভিনেতারা বাংলায় কথা বলতে না পারলেও তাই ক্ষতি ছিল না। সাহেবসুবোরা দিব্যি দিশি রাজরাজড়া সেজে চালিয়ে দিত। তাতে সুবিধে হয়েছিল র‌্যাচেলেরও। এমনিতে মাতৃভাষা আরামাইক আর বোম্বাইয়া হিন্দিতে অভ্যস্ত সে। কলকাতায় এসে বাংলা বলছে একটু-আধটু। ছটফটে মেয়েটা চোখে পড়ে গেল ছবিওয়ালাদের। তেরো বছর বয়সেই ক্যামেরার সামনে। ছবির নাম ‘দালিয়া’। পরিচালক মধু বসু, কাহিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। র‌্যাচেল হয়ে উঠল ‘রমলা’— রমলা দেবী। 
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আরও তিনটে ছবিতে মুখ দেখিয়ে ফেলল, ‘মৃণালিনী’, ‘চরিত্রহীন’, ‘গুপ্তরত্ন’। ওই ১৯৩১-এই হইহই করে শব্দ এসে পড়ল সিনেমায়। মুভি হয়ে গেল ‘টকি’। মার্চে মুক্তি পেল হিন্দি টকি ‘আলম আরা’, এপ্রিলে বাংলা ‘জামাইষষ্ঠী’। রুপোলি পরদায় নতুন যুগ শুরু হল। রমলা পড়ল চ্যালেঞ্জের মুখে। টিকে থাকতে গেলে এ বার শান্তিপুরি বাংলায় সংলাপ বলতে হবে! মেয়ে আর কাজ পায় না! ১৯৩২ সালে ‘গৌরীশঙ্কর’ নামে একটা ছবিতে কাজ পেল বটে, কিন্তু সে-ও নির্বাক।
কে নেবে তাকে টকিতে? কার কাছে গেলে মিলবে সুযোগ? ভাবতে-ভাবতেই হঠাৎ মনে হয় র‌্যাচেলের— নীতিন বসু! ১৯৩৫ সালে দিশি সিনেমায় প্লেব্যাক এনে তিনি হইচই ফেলে দিয়েছেন। নিউ থিয়েটার্স স্টু়ডিয়োয় রেকর্ড হচ্ছে গান। সেই থেকে খোঁজ খোঁজ। কত অনুনয়-বিনয়, চোখের জল ফেলে তবে এই অবধি আসা। এই তার পাওনা?
‘‘রমলা, স্টপ...’’ পিছন থেকে ভেসে আসছে কিদার শর্মার গলা। চোখের জলে চারদিক ঝাপসা। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে রুমালে মুখ ঢাকল মেয়েটা। ওরা কি কেউ জানে, কোন চোরাটানে তলিয়ে গিয়ে অসম্ভব জেদে ফের ভেসে উঠেছে সে? কত কেঁদেছে ব্রেবোর্ন রোডের পুরনো সিন্যাগগে শুক্রবারের প্রার্থনায়?
কখন তার বালিকা বয়স ফুরিয়েছে, কখন ঢেউ তুলে এসেছে জোয়ার, র‌্যাচেল ছাড়া বাকি সকলেই বোধহয় খেয়াল করছিল। ক্রমশ আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছিল সে। রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ছিল যেন। জীবনে আসা-যাওয়া করছিল প্রেম।
হঠাৎই এক দিন টের পেল, সে মা হতে চলেছে। বয়স মোটে ষোলো। প্রেমিকটি ইহুদি নয়, র‌্যাচেলের বাড়ির লোক তাকে মানতে নারাজ। মেয়ের বিয়ে না দিলে কেচ্ছার একশেষ। ছেলেটিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, চাপ দিয়ে ধর্মান্তরিত করা হল। হয়ে গেল বিয়ে। ক’মাস বাদে জন্মাল পুত্র— স্যাম। কিন্তু র‌্যাচেলের এক আকাশ স্বপ্ন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা। অযাচিত সন্তান এসে পায়ে পরিয়েছে পিছুটানের বেড়ি। সে চুপিচুপি কাঁদে, ঈশ্বর, আমি কি এ ভাবেই শেষ হয়ে যাব? কোনও দিনই আর ফিরতে পারব না সিনেমায়?
‘আলম আরা’ ছবির অভিনেতা জগদীশ শেঠির সঙ্গে রমলার পরিচয় ছিল। তিনিই রমলাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন কিদার শর্মার সঙ্গে। পঞ্জাব থেকে কলকাতায় চলে আসা কিদার তখন নিউ থিয়েটার্সে দেবকী বসুর ছবিতে ব্যাক সিন আঁকেন, স্টিল তোলেন, টুকটাক ডায়লগ লেখেন আর ডিরেক্টর হওয়ার খোয়াব দেখেন। সেই কিদারকেই ধরে বসল রমলা, যে ভাবেই হোক এক বার নীতিন বসুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে হবে।
নীতিন তখন তাঁর পরের ছবির জন্য অভিনেত্রী খুঁজছেন। রমলাকে নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হলেন কিদার। রমলার বুক দুরদুর, তাকে পছন্দ হবে তো ওঁর? দেবেন তো পার্ট? একটু বেঁটে বটে সে, কিন্তু এ রকম মিষ্টি মুখ তিনি আর পাবেন ক’টা? কিদার যখন গড়গড় করে রমলার গুণপনার কথা বলে চলেছেন, ডিরেক্টর আগাগোড়া মেপে নিলেন নবাগতাকে। তার পর কিদারের দিকে ফিরে বললেন, ‘‘ওকে আমার কাছে আনলেই যখন, উঁচু করে দাঁড় করানোর জন্য কয়েকটা ইট আনলে না কেন?’’
একটা ছুরি যেন বিঁধে গেল রমলার বুকে। কোনও রকমে ‘গুডবাই’ বলে মুখ নিচু করে বেরিয়ে এল সে। পিছু-পিছু কিদার। নিজে এক জন স্ট্রাগলার হয়ে বিলক্ষণ জানেন, অপমানের হুল কী তীব্র হয়ে বেঁধে? বললেন, ‘‘রমলা, ভেঙে পোড়ো না। যে দিন আমি ডিরেক্টর হব, তুমিই হবে আমার প্রথম হিরোইন।’’ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল সে, ‘‘বেচারা ডায়লগ রাইটার কিদারনাথ কোনও দিনই ডিরেক্টর হবে না, আর আমিও কোনও দিন হিরোইন হব না!’’
কিদার কিন্তু কথা রেখেছিলেন। ১৯৩৯ সালে তিনি বানান তাঁর প্রথম ছবি ‘আওলাদ/ দিল হি তো হ্যায়’। নায়িকা রমলা দেবী। তবে তার আগেই ১৯৩৭-এ চারু রায়ের ‘গ্রহের ফের’ টকি-তে শুভ মহরত হয়ে গিয়েছে র‌্যাচেলের। ডায়লগ লিখেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। ‘সচিত্র শিশির’ পত্রিকা লিখল, ‘‘শ্রীমতী লছমীর ভূমিকায় শ্রীমতী রমলা দেবীকে (ইহুদী-বালা?) আবিষ্কার করে চারুবাবু তার সুদ শুদ্ধ উসুল করেছেন। এই নূতন অভিনেত্রীটি দেখতেও যেমন সুন্দর, তার অভিনয়ও তেমনি অপরূপ।’’
পরের বছর রবি ঠাকুরের উপন্যাস নিয়ে তৈরি হল ‘গোরা’। তাতেও রমলা। কোথায় গ্রহের ফের, বৃহস্পতি তখন তুঙ্গে। একের পর এক হিন্দি ছবিও আসছে হাতে। নাম হচ্ছে। ১৯৪০ সালে ‘তটিনীর বিচার’ ছবিতে অভিনয়ের সঙ্গে প্লেব্যাকও করে ফেললেন রমলা। আর সবচেয়ে বড় কাণ্ডটা ঘটল তার পরেই। পরের বছর রিলিজ করল ‘খাজাঞ্চি’। মোতি বি গিদওয়ানির ছবিতে গুলাম হায়দারের ছক-ভাঙা সুর আর সামশাদ বেগমের গলা ভাসিয়ে নিয়ে গেল ভূ-ভারত। ভাসিয়ে দিল রমলার অভিনয়ও।
রাতারাতি স্টার বনে গেলেন রমলা। ক’বছর আগেও যাকে কাজের জন্য দোরে-দোরে ঘুরতে হত, প্রযোজকরাই তখন তাঁর দরজায় লাইন লাগাচ্ছেন। পর পর হিট ‘মাসুম’, ‘খামোশি’, ‘জজসাহেবের নাতনি’। ’৪৩-এ ‘মনচলি’-তে অভিনয়ের জন্য বিএফজেএ সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার।
’৪৭-এ দেশ স্বাধীন হল। ক’বছর আগেই লাহৌর থেকে বোম্বাই চলে এসেছিলেন এক যুবক। কিছু দিন ইতিউতি ঘোরাঘুরির পর, দেশভাগের ঠিক আগের বছর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির চাবিটা খুঁজে পেলেন তিনি— দেব আনন্দ! আর দু’বছর পর তিনিই হলেন রমলার হিরো। বক্স অফিসে হইচই ফেলে দিল ‘হাম ভি ইনসান হ্যায়’। মান্না দে-র গলায় ‘হম তেরে হ্যায় হমকো না ঠুকরানা’ তখন লোকের মুখে মুখে।
এরই মধ্যে ফের উথালপাথাল র‌্যাচেলের ব্যক্তিগত জীবন। বিয়েটা অনেক দিন ধরে নড়বড় করছিল। ছেলের দিকেও নজর দেওয়ার সময় ছিল না। বিয়েটা ভেঙেই গেল। র‌্যাচেলের অবশ্য তা নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। শুধু কাজ, আর স্বপ্ন, আরও উপরে উঠতে হবে।
পুরুষেরও অভাব নেই জীবনে। তবে র‌্যাচেলের মনে ধরেছিল এ দেশে পাইলটদের ট্রেনিং দিতে আসা এক ব্রিটিশ অফিসারকে। সেই দাঁড়েই ডানা গুটিয়ে বসা হল। আর মায়ের থেকে আরও দূরে ছিটকে গেল স্যাম। শেষে ’৫০-এর গোড়ায় মা’কে ছেড়ে ইজরায়েলে ফিরে গেল ছেলে। সেখানেই বিয়ে করে থিতু হল। স্যামের স্ত্রী বারবারার বয়ান অনুযায়ী, দ্বিতীয় বিয়ের পর ছেলেকে চোখের আড়ালে ঠেলে দিয়েছিলেন র‌্যাচেল। গুটিকয় চিঠি লেখা, ওই পর্যন্তই।
ওই ১৯৫০-এর গোড়াতেই আচমকা গুটিয়ে গেল রমলার কেরিয়ার গ্রাফ। তত দিনে এক ঝাঁক নতুন মুখ এসে গিয়েছে— নার্গিস, মধুবালা, মীনাকুমারী, নূতন। আসতে চলেছে সাবিত্রী, সুপ্রিয়া, সুচিত্রা, ওয়াহিদা রহমান; আর এক তরতাজা ইহুদি মুখ নাদিরাও, যাকে পরে দেখব ‘শ্রী ৪২০’, ‘পাকিজা’, ‘জুলি’-তে।
’৫১ সালে হিন্দি ছবি ‘স্টেজ’-এর পরেই রমলার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় চিত্রজগৎ। শেষ বার তিনি ফিরেছিলেন ১৯৬০-এ, ‘রিক্তা’ ছবিতে, অহীন্দ্র চৌধুরী, নৃপতি, ছায়া দেবীদের সঙ্গে। নিভে যাওয়ার আগে যেন সব শক্তি জড়ো করে জ্বলে ওঠা।
এত দিনে সংসারে ফিরলেন রমলা। ক্লান্ত, অবসন্ন। কিছুই ভাল লাগে না। স্যামের কথা মনে পড়ে, কিন্তু সেই ফাঁক আর জোড়া লাগার নয়। চল্লিশ পার করে ফের মা হলেন র‌্যাচেল। এ বার মেয়ে, নাম দিনা। টিনএজার বম্বশেল হয়ে সে-ও সত্তরের দশকের শেষে নামবে সিনেমায়। একটা মাত্র ছবি— ‘অ্যাহসাস’। পরিচালক জি পি সিপ্পি।
র‌্যাচেল যে বছর জন্মেছিলেন, সেই শীতেই জন্ম রুশ বিপ্লবের। ইলাহাবাদে জন্মালেন ইন্দিরা, ব্রুকলিনে জন এফ কেনেডি। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে। র‌্যাচেল বেঁচে ছিলেন সত্তর পেরিয়ে। ১০ ডিসেম্বর ১৯৮৮ যে চোখ বুজল তার নাম রমলা নয়, শুধুই র‌্যাচেল।

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/unknown-stories-about-jewish-indian-actress-ramala-devi-1.724937?ref=archive-new-stry

চুপিচুপি ৮৪ (Memoir by Shankar)

চুপিচুপি ৮৪

মন্বন্তর, মহাযুদ্ধের এয়ার রেড, বাবার মৃত্যুর দিনে শহর জুড়ে কারফিউ। দেখা হল ব্যারিস্টারের লাইব্রেরির তাকে নাটক, নভেল। অতঃপর কত অজানারে পেরিয়ে এসে এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে চৌরঙ্গীতে দাঁড়িয়ে গ্র্যান্ড হোটেলের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকা।

Shankar
শংকর
 
Shankar
জন্মদিনের ক’দিন আগেই এই লেখা লিখতে বসেছি, তেমন কিছু না ঘটলে, ৭ ডিসেম্বরে (২০১৭) পৌঁছে, চুরাশিতম জন্মদিনের কৃতিত্ব উপভোগ করা যাবে। বঙ্গজীবনে ব্যাপারটা ছোট কিছু নয়, আমাদের বাল্যবয়সে কলেরা, বসন্ত, প্লেগ ও যক্ষ্মাকে ডোন্ট কেয়ার করে তিরিশ বছরের পরমায়ুটাই বেশ বড় কথা ছিল। তখন ঘরে ঘরে অকালবৈধব্যের বেদনাময় উপস্থিতি, কবিরা মনের দুঃখে লিখছেন— ‘যৌবনে মাতা যোগিনী সেজেছে তাই’। তখন ঘরে ঘরে, মন্দিরে মন্দিরে বাঙালি মায়েদের প্রধান প্রার্থনা, স্বামীপুত্রদের বাঁচিয়ে রাখো হে পরমেশ্বর, এবং তাঁকে প্রশ্ন, হাতের নোয়া এবং সিঁথির সিঁদুর টিকিয়ে রাখতে কত পূজা এবং উপবাস পালন করতে হবে বলো।
এক সময় নন্দনকাননের দেবদেবীরা বাঙালির বেঁচে থাকার মেয়াদ তিরিশ থেকে চল্লিশে বাড়াতে আগ্রহী হলেন। হিটলারের মহাযুদ্ধ এবং পঞ্চাশের মন্বন্তর তখন সব কিছু ভন্ডুল করবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, দুর্ভিক্ষের নাম করে এক কোটি বাঙালি নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগে ‘ফ্যান দাও ফ্যান দাও’ বলে আমাদের এই সোনার বাংলায় কেঁদে বেড়াচ্ছে। দুর্জনরা তখনই বলছে, পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও বিদেশি শাসক কখনও পরাধীন দেশের অনশন-মৃত্যু ঠেকাতে পারেনি, অতএব ক্ষুধার্তকে স্বাধীনতা দেওয়া ছাড়া পথ নেই, সব গোলমাল সহজেই মিটে যাবে।
বিশ শতকের এই তিরিশের দশকে এবং চল্লিশের দশকে বাঙালির জীবনে অন্তহীন অমাবস্যা, সর্বত্র মানুষের তৈরি নন-স্টপ বর্বরতা, ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের সুবিশাল বঙ্গভূমে শ্মশানকালীর উলঙ্গ নৃত্য। সেই সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের নেই-নেই ডাক। বাংলা ভাষায় নতুন শব্দ ‘ব্ল্যাক মার্কেট’, ‘ব্ল্যাক আউট’ এবং সেই সঙ্গে ‘ব্ল্যাক মানি’। ভদ্দরলোকদের ভাষায় ‘কাঁচা টাকা’, যার আছে তার যত কষ্ট, যার নেই তারও তত কষ্ট।
আমার জন্মের তিন দশক আগে বেলুড় মঠের এক সন্ন্যাসী বলে গিয়েছিলেন— জন্মালি তো দাগ রেখে যা, বোকা বাঙালি তা বিশ্বাসও করেছিল। তার পরের শিক্ষা হল— জন্মালি তো টিকে থাকো, এই দুনিয়া প্যাঁচপয়জারে ভরা ‘ডেভিলিশ’ শয়তানিতে ভরা, যেন তেন প্রকারেণ হাজার হাঙ্গামাকে কলা দেখিয়ে বলো, কোনও রকমে বেঁচে থাকাটাই মানুষের সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার, দুনিয়া জাহান্নমে গেলেও তোমার কিছু এসে যায় না, তমসো মা জ্যোতির্গময় এ কালের ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির স্লোগান, বাংলায় আমাদের একমাত্র মন্ত্র চাচা আপন প্রাণ বাঁচা! অতএব এয়ার রেড, মন্বন্তর, মহামারী পেরিয়ে বাঙালির নতুন সমস্যা চাচা-কাকার দাঙ্গা। আমাদের প্রিয় কলকাতায় কত লোক হত এবং আহত হল তার কোনও হিসেব নেই, আমাদের পাড়ার বাদলকাকু বললেন, ওয়ার্ল্ডের হিস্ট্রিতে কস্মিনকালে কোনও শহরে ভায়ে-ভায়ে নাগরিকদের মধ্যে এমন ‘মহারায়ট’ হয়নি, দেশভাগ ছাড়া নান্যপন্থা বিদ্যতেয়ম্‌! বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীদেরও কেউ কেউ সব বিশ্বাস সাময়িক ভাবে হারিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন— ওঠো জাগো, হে মোর চিত্ত পুণ্যতীর্থে জাগো রে ধীরে। কিন্তু মহামানবের সাগরতীরে, এই সব অমৃতবাণী নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে পরবর্তী পাঁচশো বছরের জন্য।
ছেচল্লিশের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর সময় যে দু’টি ইংরিজি শব্দ বাংলা অভিধানে স্থায়ী স্থান লাভ করল তা হল ‘স্ট্যাবিং’ ও ‘কারফিউ’, শেষোক্ত শব্দটি দিনদুপুরে সন্ধ্যা ডেকে নিয়ে এসেও লুঠ, আগুন ও নরহত্যা আটকাতে পারল না, ছুরি ও খাঁড়ার দাম দশগুণ বাড়িয়ে দিল, সেই সঙ্গে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্তরের দাম দশগুণ হাইজাম্প করল। বাড়ির মেয়েদের সারা ক্ষণের দুশ্চিন্তা, রোজগেরে স্বামী ও পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা কখন পৃষ্ঠে ছুরিকাহত না হয়ে বাড়ি ফিরবেন।
ছেচল্লিশের সেই অশুভ অগস্ট মাসের ব্যাপারে কেউ কেউ বলত, বড্ড অপয়া এই অগস্ট— পাঁজিফাঁজি না দেখে এই অগস্টেই গাঁধী ‘কুইট ইন্ডিয়া’ ডেকেছিলেন, এই অগস্টেই মুসলিম লিগের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, আবার এই অগস্টেই ‘পার্টিশন’, এবং পাঁজিপত্তর না ঘেঁটেই ১৫ অগস্ট, যার স্বদেশি নাম ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ এবং ব্রিটিশ নাম ‘ট্রান্সফার অব পাওয়ার’। ছেচল্লিশের অগস্টে হাওড়া চৌধুরীবাগানের মুখার্জিদের বৃহত্তম দুঃসংবাদ হরিপদ উকিলের অসুস্থতা, যা নিশ্চিত হল সাতচল্লিশের গোড়ার দিকের এক মধ্যরাত্রে, যখন মহানগরে পুরোদস্তুর ‘কারফিউ’ চলছে। তখন মৃতদের নিয়ে শোকযাত্রাও নিষিদ্ধ, মরা মানুষকেও তখন সরকারি সন্দেহের বাইরে রাখা যাচ্ছে না।
তখনকার পাঠ্যপুস্তকে ‘আমরা’ বলে একটা কবিতা ছিল, কবি সত্যেন দত্ত সগর্বে ঘোষণা করছেন, ‘বাঁচিয়া গিয়াছি, বিধির বিধানে অমৃতের টিকা পরি’। এই অমৃতের টিকায় হতভাগা বাঙালির তখন তেমন ভরসা নেই, বিশ্বে বাঙালি বলে কিছুই থাকবে না এমনই আশঙ্কা মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে। অমৃত যে টিকে হিসেবে বাঙালিকে দেওয়া যায় সে বিশ্বাস তখন কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু এত বিপদের মধ্যেও আত্মঘাতী বাঙালি যে অমৃতটিকা থেকে বঞ্চিত হয়নি তার প্রমাণ, দাম্ভিক সায়েবরা যে সাত কোটি বাঙালিকে বিলুপ্ত করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা বেড়ে বেড়ে আমার মতন নগণ্য মানুষের চুরাশিতম জন্মদিনে পঁচিশ কোটি অতিক্রম করেছে। যুদ্ধবিগ্রহ, অনাহার, রায়ট, পার্টিশন কিছুই বাঙালির বাড় রুখতে পারেনি, শুধু কয়েক কোটি লোক তাদের জন্মস্থান থেকে উৎপাটিত হয়েছে, নতুন ইহুদি রূপে নানা রঙের পাসপোর্ট নিয়ে এই বাঙালিরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার অশেষ ভাগ্য, হাওড়ার গলি থেকে আমাকে ঘরছাড়া দেশছাড়া হতে হয়নি, আমি সাহস করে বলতে পেরেছি, আমার এই দেশেতে জন্ম, যেন এই দেশেতেই মরি।
সাতচল্লিশের শুরুতে বাবার অকালমৃত্যুর পরে আট নাবালক ও নাবালিকা নিয়ে আমার মা ভাড়াবাড়িতে বাস করেও কী ভাবে তাদের প্রাণ রক্ষা করেছিলেন, তা আজও আমার বুদ্ধির অগম্য। যে পিতৃদেব এই কন্যার নাম ‘অভয়া’ রেখেছিলেন তিনি হয়তো জানতেন, কিন্তু আমাদের বলে যাননি, আর এত যুগ পরে ব্যাপারটাকে দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই মনে হয় না।
এই পর্বে মা এক দিন যখন আড়ালে ডেকে বললেন, তোমাকে উপার্জন করতে হবে, তখন আমার বয়স পনেরো। সেই বয়সেই টুকটাক পার্ট-টাইম রোজগার শুরু হল, কিন্তু সে টাকায় চৌধুরীবাগানের সংসার উদ্ধার হয় না। উকিলবাবুর ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে টুকটাক জিনিসপত্তর বিক্রি করে, সেটা ভাল দেখায় না। তার পরের বছর লেখাপড়ায় ইস্তফা দিতে হল। শিয়ালদহ সুরেন্দ্রনাথ কলেজে মাইনে বাকি। ছোট্ট একটা অঘটন ঘটে গেল। কলেজের সাহিত্যসভায় একটা রম্যরচনা-কাম-গল্প দুম করে শুনিয়ে ভাইস-প্রিন্সিপালের নজরে পড়ে গেলাম, তিনি সমস্ত দেনাপাওনা মকুব করে দিয়ে আইএ পরীক্ষায় বসবার পথ সুগম করে দিলেন। এবং তার পরেই হাওড়ায় নিজের ইস্কুলের প্রধানশিক্ষকের কৃপাদৃষ্টি লাভ করা গেল। আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে, সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্য আমাকে একটা অস্থায়ী মাস্টারির সুযোগ করে দিলেন। দুঃখ করলেন, তোমার কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। কেন জানি না, তাঁর প্রত্যাশা ছিল, আমি এক দিন কেষ্টবিষ্টু লেখক হব।
আমার মা অত অভাবের মধ্যেও আমার একটা কুষ্ঠি তৈরি করিয়েছিলেন, সেখানে জাতক সম্বন্ধে অনেক কিছু প্রত্যাশার ইঙ্গিত এবং সেই সঙ্গে মন্তব্য— জাতকের জীবনে এক কর্ম হইতে বারবার আর এক কর্মের উৎপত্তি। এই মন্তব্য আমার মা অন্ধবিশ্বাসে গ্রহণ করেছিলেন। আমি এর তাৎপর্য বুঝতে পারিনি, শুধু আন্দাজ করেছি— জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা। মায়ের ব্যাখ্যা, হাতের গোড়ায় যা কাজ পাওয়া যাবে তা-ই খুব ভাল ভাবে করতে হবে, কারণ এক কর্ম থেকে আর এক কর্মের উৎপত্তি কখন হবে তা কালীবাড়ির পণ্ডিতমশাইও জানেন না।
হাতের লক্ষ্মীকে পায়ে না-ঠেলবার যে উপদেশ মা দিয়েছিলেন তা নিজের অজান্তেই আমার জীবনে বেশ কাজে লেগে গিয়েছিল। ইস্কুলের এক অনুষ্ঠানে পুরনো সহপাঠী অনিলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে বলল, আমার দাদা ব্যারিস্টার বারওয়েলের বাবু, পুরনো শর্টহ্যান্ডের স্পিড বাড়িয়ে নেবার জন্য এক জন কাউকে খুঁজছেন। আমি তখন শর্টহ্যান্ড শেখা শেষ করলেও তেমন দক্ষ হয়ে উঠতে পারিনি, সুযোগটা নিয়ে নিলাম।
পাকেচক্রে বিভূতিদা অন্য এক চাকরি জোগাড় করে হাইকোর্ট থেকে বিদায় নেওয়ার আগে আমাকে বারওয়েল সায়েবের কাছে নিয়ে গেলেন। একটু আশঙ্কা, একটু দ্বিধা ছিল, উকিলের ছেলে ভাগ্যদোষে মুহুরি হতে চলেছে। কিন্তু বিভূতিদা বললেন, যে মানুষ যে কাজটা করে তা খুব ভাল ভাবে করতে পারলে সারা দুনিয়া তার সম্মান করে। বিভূতিদাও হঠাৎ বললেন, এক কর্ম থেকে অন্য কর্মের উৎপত্তি সত্যিই হয়— এই আমি আইনপাড়ার বাবু থেকে সায়েবি অফিসের কোটপ্যান্ট-পরা সায়েব হতে চলেছি, খোদ সায়েবের কাছ থেকে নিজের কাজটা ঠিকমত শিখেছি বলে।
আমার মা একই কথা বলতেন। আমাদের জানাশোনা কেউ নেই, সুতরাং অফিসের সব কাজেই এক নম্বর হতে হবে। এই মাতৃনির্দেশ কর্মক্ষেত্রে খুব কাজে লেগেছিল। এক সময় টেম্পোরারি বেয়ারার কাজ পেয়ে আমি এমন মন দিয়ে কাজ করেছিলাম যে এক জন অফিসার চেষ্টা করেছিলেন আমার কাজটা পাকা করে দিতে, কিন্তু পারেননি। তখন ভাটার সময়, কাজের সংখ্যা এই দুর্ভাগা দেশে তখন ক্রমশই কমে যাচ্ছে।
এ সব নিয়ে দুঃখ করে তখন লাভ নেই। তবে সুযোগের সন্ধানে থেকেছি, টেম্পল চেম্বার্সে বারওয়েল সায়েবের ব্রিফ ও বইয়ের থলে প্রতিদিন হাইকোর্টে নিয়ে এসেছি, আবার যখন হাতে কাজ নেই, তখন কৌতূহলে সায়েবের লাইব্রেরির বইগুলো নেড়েচেড়ে আবিষ্কার করেছি— চেম্বারের আইনের বইগুলো নাটকে-নভেলে ভরা। কত আশ্চর্য ব্যাপার যে আদালতে এবং আইনজ্ঞের অফিসে ঘটে যায়! আবার আমার অজান্তে এক কর্ম থেকে আর এক কর্মের উৎপত্তি, ব্যারিস্টারের বাবুর কোন সময়ে গল্পলেখক হওয়ার সাধ হল!
১৯৫৩ সালের অগস্ট মাসে বারওয়েল সায়েব মাদ্রাজে মামলা করতে গিয়ে হার্ট অ্যাটাকের বলি হলেন। তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। অনাগতকে আন্দাজ করেই তিনি আমাকে ছোট্ট একটা চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিলেন ডালহৌসিপাড়ায়। কয়েক মাস দু’টো কাজই করতাম। কিন্তু নতুন জায়গায় পদে পদে কনিষ্ঠ কেরানির অবহেলা ও অবমাননা। মনের দুঃখ মুছে ফেলার জন্যে চুপিচুপি লেখক হওয়ার মুসাবিদা শুরু হল। উৎসাহ দিতেন সহকর্মী আর এক কেরানি ভবানী ঘোষ। যে সব চরিত্রকে হাইকোর্টে জলজ্যান্ত দেখেছি, ভবানীবাবু তার বিস্তারিত খোঁজখবর নিতেন এবং তিনিই এক দিন তাঁর বন্ধু ও লেখক রূপদর্শীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের টেবিলে বসে। সাহিত্যিক বন্ধুকে তিনি বললেন, এই ছোকরার যে সব ঘটনা রয়েছে, তা এক দিন পাঠকদের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। তার পর এক সময় রূপদর্শী আমাকে পৌঁছে দিলেন মেছুয়াবাজারে দেশ পত্রিকার দফতরে। আবার এক কর্ম থেকে আর এক কর্মের উৎপত্তি— জুনিয়র টাইপিস্টের সাহিত্যের নন্দনকাননে বিনা অনুমতিতে প্রবেশের দুঃসাহস।
এর পরও এক জন কনিষ্ঠ কেরানির জীবনে কত কী যে ঘটে গেল! কনিষ্ঠ কেরানির হাজিরা খাতায় সই করে, বদমেজাজি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সায়েবের দাঁতখিঁচুনি কয়েক ঘণ্টা নিঃশব্দে সহ্য করে, চারটের পরে স্বয়ং চিফ জাস্টিসের কক্ষে বইয়ে অটোগ্রাফ দেওয়া! তার পর সেকেন্ড ক্লাসের ট্রামে চড়ে হাওড়ায় রওনা দেওয়া। একই দিনে কত রকম ঘটনা ঘটে যাওয়া, যার ওপরে আমার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, এক কর্ম থেকে নিরন্তর আর এক কর্মের চলচ্চিত্র একই গতিতে প্রবাহিত হয়ে চলেছে।
ছোটখাটো স্বীকৃতি এলেও সাহিত্যের যাত্রাপথ যে সব সময় সুখবর হয়নি তার বিস্তারিত বিবরণ জন্মদিনের এই লেখায় পেশ করার সময় নেই। তবু বলতে হয়, সাহিত্যের স্টকমার্কেট যাঁরা হাতের মুঠোর মধ্যে রেখে নবাগতদের নিগৃহীত করে অকারণ আনন্দ পেতেন, তাঁদের রোষদৃষ্টি থেকে দূরে থাকতে পারিনি। তাঁরা আমার পিঠে ‘ওয়ান বুক অথর’-এর রবার স্ট্যাম্প মেরে দিতে প্রবল উৎসাহী হয়ে উঠলেন। তাঁদের হৃদয়হীন প্রচার: উকিলের বাবু একখানা বই কোনওক্রমে লিখে ফেলেছে, তার ওইখানেই শেষ, এ বছরের গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকা সামনের বৈশাখে সের দরেও কেউ কিনবে না! অভিমান ও আতঙ্ক জোড়াসাপের মতন আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল।
আমার মা ভরসা দিতেন, তেমন তেমন বই একখানা লিখলেই হাজার বছর বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু মন সায় দেয় না। পথেঘাটে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মনে পড়ে গেল মায়ের পুরানা কথা, এক কর্ম থেকে আর এক কর্মের উৎপত্তি হওয়াটাই আমার কুষ্ঠির ইঙ্গিত। বর্ষায় ভেজা এসপ্ল্যানেডে দাঁড়িয়ে দূরের গ্র্যান্ড হোটেলকে দেখতে দেখতে মনে হল, বারওয়েল সায়েব তো মিডলটন স্ট্রিটের ঘর-সংসার তুলে দিয়ে, অনেক দিন একটা হোটেলে থাকতেন, এবং সেই সুযোগে আমি স্পেনসেস হোটেলের নাড়িনক্ষত্র জানি এবং সেই সূত্রে মহানগরীর আরও একটা বৃহৎ হোটেলে আমার অবাধ যাতায়াত আজও রয়েছে। আমি চোখ বুজে চৌরঙ্গী এবং শাজাহান হোটেলকে দেখতে পেলাম, আমার সমস্ত আশঙ্কা দূর হয়ে গেল।
‘চৌরঙ্গী’-র সাফল্যের পরেও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছে, এ সবই বানানো। হাওড়ার কানাগলিতে বিদ্যুৎবিহীন বাড়িতে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ফাইভ স্টার গল্প কী করে লেখা হয়? নিশ্চয়ই কোনও বিখ্যাত সায়েবের অখ্যাত ইংরিজি বই থেকে চুরি করা! পরবর্তী কালে লন্ডনের বইমেলায় কেউ সে প্রশ্ন তোলায় কী উত্তর দেব ভাবছি, সেই সময় এক জন ইংরেজ ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, আপনি যে বইয়ের ইঙ্গিত করছেন, সেটি ‘চৌরঙ্গী’ প্রকাশের চার বছর পরে প্রকাশিত, তা হলে উলটো সন্দেহও করা যেতে পারে! এই অপরিচিত ইংরেজকে যা বলা হয়নি, কোনও পাঁচতারা হোটেলে রাত না কাটিয়েও সেখানে নিত্য যাতায়াত আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল ভাগ্যচক্রে, স্পেনসেস হোটেলে এক বছরের বেশি সময় বসবাস করে বারওয়েল সায়েব যে ক্লাবে উঠেছিলেন সেখানেও নিত্য যাতায়াতের সুযোগ হয়েছিল। সেখানকার গল্প লিখব-লিখব করেও লেখার সাহস হয়নি, কারণ সেখানেই আমার পুনর্জন্ম হয়েছিল— শেষ বিদায়ের সন্ধ্যায় মাদ্রাজগামী বিদেশি ব্যারিস্টার হঠাৎ বলেছিলেন, মাই ডিয়ার বয়, কখনও ভুলো না, তুমি এক জন একসেপশনাল পার্সন, তার পর রসিকতা করে আমার কানটা মলে দিয়েছিলেন। সে দিন হাওড়ার ভাঙা বাড়ির ছাদে বসে স্থির করেছিলাম, যার কিছু নেই তার কাগজ-কলম আছে, এ সব কেনার মতো সামর্থ্য আমার কাছে, আমি পাগল সায়েবের পাগলামির কথা লিখে রেখে যাব।
সে ভাবেই শুরু করে সেই ১৯৫৩-র অগস্ট থেকে দশকের পর দশক কলম চালিয়ে এই ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে কখনও পৌঁছনো যাবে ভাবিনি। প্রথম বই প্রকাশের পর অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সঙ্গে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় দেখা হয়েছিল, আমার নিতান্ত কম বয়স দেখে উদারহৃদয় লেখক চিন্তিত হয়ে উঠে বলেছিলেন, ‘‘এত কম বয়সে মাঠে নামলে কেন? দীর্ঘায়ু হলে বড্ড কষ্ট পাবে, বছরের পর বছর লেখার মালমশলা পাবে কোথা থেকে? ভগবান তো প্রত্যেক মানুষের বুকের মধ্যে একখানা উপন্যাস আর পাঁচ-ছ’খানা ছোটগল্প পুরে পাঠিয়ে দেন, প্রত্যেক মানুষ ইচ্ছা করলেই তাই একটা নভেল লিখতে পারে, কিন্তু তার পর? মা সরস্বতীর রাজত্বে রেপিটিশনের কোনও কদর নেই।’’ বলেছিলাম, ‘‘কুষ্ঠি দেখে আমার মা জেনে গিয়েছেন, আমার জীবনে বারবার এক কর্ম থেকে আর এক কর্মের উৎপত্তি!’’ খুব হেসেছিলেন অচিন্ত্য, বলেছিলেন, ‘‘তা হলে খুব ভাল কুষ্ঠি তোমার, এক জন লেখকের পক্ষে আদর্শ গ্রহ-নক্ষত্র যোগ।’’
নিশ্চয়ই তাই, না হলে, সেই ১৯৫৩ থেকে এত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হল কেন? তাঁরা কেন তাঁদের বিচিত্র জীবনকথার ভাণ্ডার কোনও কিছু প্রত্যাশা না করেই আমার হাতে তুলে দিলেন?
তবে কিছু বোকামি করেছি। সুরসিক বারওয়েল সায়েব এক বার বাঙালি শাশুড়িদের প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, ‘‘পরের জন্মে আমি এ দেশে বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করব, তাদের পদ্মফুলের মতো চোখের জন্যে নয়, স্রেফ এ দেশের শাশুড়িদের জন্যে— শ্বশুরবাড়িতে এসে জামাইরা যত টাকা দিয়ে নমস্কার করে তা একটু পরে শাশুড়িরা ডবল করে ফেরত দেয় বলে! আমি লাখ টাকা দিয়ে নমস্কার করে বিকেলে দু’লাখ টাকা নিয়ে বড়লোক হয়ে ফিরে যাব।’’ আমি ভেবেছিলুম, এটা তাঁর রসিকতা, কিন্তু পরে দেখলাম একেবারেই নয়। লেখার মাধ্যমে এক জন সায়েবকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আমি নিজেই অনেকের কাছে শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠলাম, পরে বুঝলাম ঠিকমত বুঝিনি। চেষ্টাচরিত্র করে যদি লাখ টাকার শ্রদ্ধা জানাতাম, তা হলে মরণসাগরের ওপার থেকে তিনি আরও কত আমাকে ফিরিয়ে দিতেন। এক বার নয়, কলম ধরে একই ভুল কত বার করলাম, সাধ্যের অতীত দিয়ে কাউকে ভালবাসা বা শ্রদ্ধা জানানো হল না, তাই যা পাওয়া যেত এই জীবনের শ্রদ্ধাযাত্রায় তা হাতের কাছে পেয়েও পাওয়া হল না।
ভুল শুধরাবার ইচ্ছা প্রবল হলেও, সময় আর নেই। সুযোগ এ বারের মতন হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। যা এখন করতে ইচ্ছে করে, সাহিত্যপথের নতুন যাত্রীদের বলতে, এ ভুল তোমরা কেউ কোরো না, যা সাধ্যের অতীত তাই দিয়েই মা সরস্বতীর সোনার পা দু’টি ভরিয়ে দাও, তিনিও তোমাকে প্রত্যাশার অতীত ফিরিয়ে দেবেন।
এ বার একটু হিসেবপত্তরে মন দেওয়া যাক। বই লেখার তোড়জোড় শুরু হল বারওয়েল সায়েবের আকস্মিক দেহাবসানের পরই— তখন চলছে অগস্ট ১৯৫৩। প্রথম বই হাতে নিয়ে বিভূতিদার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম ১৯৫৫-তে। মা বলতেন, যখন দিবি তখন হিসেবপত্তর করে হাত টান হবি না, যা বুকের মধ্যে আছে সব ঢেলে দিবি, তার পর যা হয় হবে। আশ্চর্য ব্যাপার, দেওয়ার পাত্রটা কখনও শূন্য হয় না, দেওয়া মাত্রই আবার পূর্ণপাত্র হয়ে ওঠে। কী ভাবে? তখন তা ঠিক বুঝিনি, বোধহয়— এক কর্ম থেকে আর এক কর্মের উৎপত্তি যোগের কুষ্ঠি যোগে। ওই যে আমার মা বলেছিলেন, কখনও দরজা বন্ধ করবি না, কখন কে যে মানুষের ভিক্ষাপাত্রে কী দিয়ে যাবে তার ঠিক নেই। এই ভাবেই তো এত বছর ধরে একের পর এক ঘটনা বুকের মধ্যে জড়ো হয়ে উঠেছে পাঠককে নিবেদন করার জন্য।
এমনি করেই তো এক বার ভয়ে ভয়ে ষাটে পদার্পণ করা গিয়েছিল। বংশের রেকর্ড— পিতৃদেব পিতামহ কেউই হীরকজয়ন্তীর সুখ দেখে যেতে পারেননি। বয়স নিয়ে গর্ব মা মোটেই পছন্দ করতেন না, প্রিয় সন্তানদের বয়স নিয়ে কথা উঠলে খুব রাগ করতেন। তার পর এক দিন সত্তর এল, তখনও খুব কিছু লক্ষ করিনি। বিমল মিত্র বলতেন— বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল, জাত লেখকের বয়স কমেও না, বাড়েও না।
তার পর আর একটা জন্মদিন এল। সাতসকালে ফোন করলেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের অনিল বিশ্বাস, নবদ্বীপ হালদারের মস্ত ভক্ত। বললেন, এখন একটু সাবধানে থাকতে হবে, কিছু লোকে বাহাত্তুরে বলবে, তবে ওনলি ওয়ান ইয়ার, তার পর আবার মেন স্ট্রিমে সহজেই চলে আসতে পারবেন! আচারে-আচরণে একটু সাবধানতা অবলম্বন করেছি, বছরের শেষ দিনে অনিল বিশ্বাস ফোনে বলেছেন, সে কালের নড়বড়ে বাহাত্তুরেদের এ কালে তেমন পাওয়া যাচ্ছে না, দিনকাল সত্যিই খারাপ।
তার পরের গাঁট আশি। বঙ্গবিজ্ঞরা সেই কবে থেকে সাবধান করে দিচ্ছেন, ৮০তে ৮০ও না! কিন্তু সুরসিক বঙ্গীয় লেখকরা প্রাইভেট আলোচনায় বলতেন, আশিতে আসাটা প্রত্যেক লেখকের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এক বার ‘বিট’ করার একমাত্র উপায়! শিব্রাম চক্রবর্তী বলতেন, মরার মস্ত বড় অ্যাডভান্টেজ, লেখকের বয়স আর বাড়ে না! সুকুমার রায় সুকান্ত ভট্টাচার্য এঁরা চিরকাল তরুণ লেখক থেকে যাবেন, রবিঠাকুর ওঁদের কোনও ক্ষতি করতে পারবেন না।
আশি বছরে পা দিয়ে নির্বাক হয়েই থেকেছি, তার পরের বছর সমসাময়িক লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলনায় বয়োজ্যেষ্ঠতা নিশ্চিত করে একটা আত্মকথা ও বই লিখে ফেলেছি— একা একা একাশি। ওই বয়সে আশ্চর্য এক একাকিত্ব ঘন কুয়াশার মতন নেমে এসে মানুষকে নির্দয় ভাবে ঘিরে ধরে। লক্ষ লোকের ক্রীড়াঙ্গনে আপনি যেন একা একা নিজের উইকেট রক্ষা করছেন, কেউ কাছাকাছি নেই নিন্দা বা প্রশংসা করতে। পরেই একটু ধৈর্য ধরে এই সামনের সাত তারিখে ৮৪। এই জন্মদিনটায় সুখদুঃখ সাফল্য-ব্যর্থতা মান-অভিমান সব কিছু নতমস্তকে বিসর্জন দিয়ে যা একমাত্র বলা যায় তা হল ‘চুপিচুপি চুরাশি’।

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/writer-shankar-to-celebrate-his-84th-birthday-this-year-1.717259?ref=archive-new-stry

ভিড় আছে, গান নেই (On Park Street Cabaret)

ভিড় আছে, গান নেই

বর্ষশেষের পার্ক স্ট্রিট। ষাটের দশকেও এই রাতে গানে গানে আলো ঝরাতেন প্যাম ক্রেন, লুই ব্যাঙ্কস, ঊষা উত্থুপ। ক্যাবারে নাচে মাতিয়ে দিতেন মিস শেফালি। এখন শুধুই তালপাতার ভেঁপু বাজানো ধুমধাড়াক্কা ভিড়।

অময় দেব রায়
 
Miss Shefali

লাস্য: ক্যাবারে নাচের ফ্লোরে কিংবদন্তি মিস শেফালি।

নতুন বার-কাম-রেস্তরাঁ খুলবে কলকাতায়। তাই জার্মানি থেকে আনা হয়েছে ইন্টিরিয়র আর্কিটেক্ট। সাদা দেওয়াল, লাল ল্যাম্প শেড, কাঠের ফ্রেমে সুন্দর নকশা করা ছবি। কিন্তু মালিক শিবজি ডি কোঠারির তাতেও মন ভরল না। নির্দেশ দিলেন, তাঁর সাধের এই নতুন রেস্তোরাঁ মোকাম্বো-র জন্য এক জন সুন্দরী গাইয়ে চাই। ১৮ বছরের এক তরুণী চৌরঙ্গির ছোটখাটো বার-এ গান গেয়ে বেড়াত। অল্প সময়েই বেশ নাম কুড়িয়েছে। ডাক পড়ল মোকাম্বোতে। এক ঝলক দেখে, প্রাণবন্ত কণ্ঠ শুনে আর চোখ ফেরানো গেল না। শিবজি সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন মেয়েটি নতুন বারে গান গাইতে রাজি কি না! পলকে উত্তর এল, হ্যাঁ। মোকাম্বোর প্রথম ‘ক্রুনার’ বা বার গায়িকা হিসাবে ১৯৫৫ সালেই তাই চাকরি পেয়ে গেল সোনালি চুলের সেই অষ্টাদশী। মোকাম্বোর বর্তমান মালিক, শিবজির ছেলে নীতিন কোঠারির কথায়, ‘‘অমন লাস্যময়ী নারী খুব কম দেখেছি।’’ ধীরে ধীরে সেই অষ্টাদশীই হয়ে উঠল পার্ক স্ট্রিটের হৃৎস্পন্দন। কলকাতার রাত-কাঁপানো জ্যাজ সম্রাজ্ঞী প্যাম ক্রেন।
শুধু গাইলে হবে না। সাজপোশাকও হওয়া চাই সর্বাধুনিক। প্যাম ক্রেনকে প্রস্তুত করে তুলতে কোনও ত্রুটি রাখলেন না বার কর্তৃপক্ষ। কিটি ব্রানান নামের এক ইহুদি মহিলাকে তাঁর ফ্যাশন ডিজাইনার করা হল। মৎস্যকন্যার মতো এক ধরনের ফোলানো গাউন ছিল তাঁর প্রিয় পোশাক। প্রায় হাফ ডজন ‘ফিন টেল’ বানানো হল স্বর্ণকেশীর জন্য। রাখা হল আলাদা হেয়ার ডিজাইনার। প্রায় এক বছর ধরে তাঁকে প্রস্তুত করে ‘মোকাম্বো’ দরজা খুলল পরের বছর, ’৫৬ সালে। এই শহর জানত, বার-গায়িকা শুধু মদিরাবিভোর দর্শকদের সামনে গানের জন্য নন। পোশাক, লাস্যময় বিভঙ্গ, চুলের কায়দা, সব মিলিয়েই আলো ছড়াবে তাঁর উপস্থিতি।
প্যাম ক্রেনকে ঘিরে মোকাম্বোতে তখন রোজ সাজ সাজ রব। এক দিকে সিক্স-পিস লাইভ ব্যান্ড। ব্যান্ড লিডার আঁতো মেনেজেস। তাঁদের সঙ্গে জুড়ে গেলেন স্বর্ণকেশী গায়িকা। রোজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় শুরু হত গান, চলত রাত একটা-দেড়টা অবধি। জ্যাজ, পপ, ব্লুজ... টানা দশ বছর প্রতি রাতে প্যাম ক্রেনের স্বপ্নের মতো গলায় বিভোর হয়ে থাকত মোকাম্বো।
এর পর এক সময় কলকাতা ছাড়লেন প্যাম। ‘ইন্ডিয়া ফয়েলস’-এর তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর জন ডানকানকে বিয়ে করে চলে গেলেন ইউরোপ। কিন্তু বিয়েটা টিকল না। কন্যা আইলিনকে নিয়ে গায়িকা আবার ফিরে এলেন নিজের শহর কলকাতায়। সত্তরের দশকে ফের শুরু হল প্যাম ক্রেনের ম্যাজিক। এ বার মোকাম্বোর অনতিদূরে ব্লু ফক্স। এখানে এসেই পরিচয় হল কিংবদন্তি বাজিয়ে লুই ব্যাঙ্কসের সঙ্গে। যোগ দিলেন লুইয়ের দল ‘ব্যাঙ্কস ব্রাদারহুড’-এ। আগের তুলনায় প্যাম এখন আরও শাণিত। আরও নিখুঁত। ব্লুজ, ফক্সট্রট, ওয়াল্টজ-এও ছিলেন সমান পারদর্শী। দ্বিতীয় বিয়ে কলকাতায়, ডন সায়গলের সঙ্গে। প্যাম ক্রেনের গান, লুই ব্যাঙ্কসের গিটার আর ব্রাজ গনজালভেস-এর স্যাক্সোফোন শোনার জন্য তখন মাঝেমধ্যেই ব্লু ফক্সে হানা দিতেন আর ডি বর্মন। এসেছিলেন দেব আনন্দও! পার্ক স্ট্রিটের সেই তরুণী গায়িকার গানে তখন দেব ও আর ডি এতই মুগ্ধ যে, ছবিতে গান গাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হল তাঁকে। তার পরই ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম।’ বাকিটা ইতিহাস।
বেটি কার্টারের গান গাইতে ভালবাসতেন প্যাম। মুম্বইয়ের ‘জ্যাজযাত্রা’য় গাইতে এসেছেন বেটি, দর্শকাসনে প্যাম। অনুষ্ঠানশেষে লুই ব্যাঙ্কস প্যামকে ব্যাকস্টেজে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন বেটির সঙ্গে। খানিক কথাবার্তার পর বেটি জড়িয়ে ধরেছেন প্যামকে। ভারতবর্ষেও যে কেউ তাঁর গান গায়, বিশ্বাসই করতে পারছেন না বেটি। পর দিন দুই গায়িকা একসঙ্গে লাঞ্চে, শপিং-এ। সেই পার্ক স্ট্রিট, সেই প্যাম ক্রেন আজ শুধুই স্মৃতি। ১৪ অগস্ট ২০১৩, চিরবিদায় নিলেন। তাঁকে সমাধিস্থ করা হল এই কলকাতাতেই।
ওবেরয় গ্র্যান্ডে কাজ করতেন ইলেস জোসুয়া আর ওমপ্রকাশ পুরি। তাঁরা কিছু দিন আগেই ট্রিঙ্কা আর ফ্লুরি-র কাছ থেকে পার্ক স্ট্রিটের টি-রুমটি কিনেছেন। ইতিমধ্যে জোসুয়া বেড়াতে গেলেন মহীশূরে। ঊষা আইয়ার নামে এক তরুণীর গান ভাল লেগে গেল। নিয়ে এলেন কলকাতায়। টি-রুমটিও বদলে গেল বার-কাম-রেস্তরাঁয়। নাম হল ট্রিঙ্কা’জ। ১৯৬৮, দক্ষিণ ভারতীয় শাড়িতে দুলে উঠল ট্রিঙ্কা’জ।  ঊষা আয়ার পরে এ শহরেরই পাকাপাকি বাসিন্দা হবেন, শুধু বিবাহসূত্রে নামটা বদলে যাবে: ঊষা উত্থুপ।
ঊষা তখন কলকাতায় সবে এসেছেন। লোকে তাঁর গান শুনে প্যাম ক্রেনের নাম করে। কে এই প্যাম ক্রেন? দেখা করার ইচ্ছে হল। এক দিন শো শেষে ট্রিঙ্কা’জ থেকে সোজা হাঁটা লাগালেন ব্লু ফক্সের দিকে। প্যাম ক্রেন তখন গাইতে উঠছেন। বাদামের মতো চোখ। সোনালি চুল। কালো গাউন পরা ছিপছিপে শরীর মাদকতায় ভরপুর। এক ঝলক দেখেই প্যাম ক্রেনের ফ্যান হয়ে গেলেন ঊষা। উত্তরসূরি ঊষার কথায়, ‘‘ক্রেনের ড্রেস সেন্স ছিল অনবদ্য। এক কথায় তিনি এক জন কমপ্লিট পারফর্মার।’’ তখন ট্রিঙ্কা’জ-এ বাজাত ‘ট্রোজান্স’ নামে একটা দল। তাদের প্রধান মিউজিশিয়ান ছিলেন বিড্ডু। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গৌতম চট্টোপাধ্যায় জীবদ্দশায় প্রায়ই এক স্মৃতিচারণ করতেন। অশান্ত সত্তরের দশক। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র গৌতম ও বন্ধুরা পার্ক স্ট্রিটে লেননের ‘ইমাজিন দেয়ার ইজ নো হেভেন’ গাইতে গাইতে ফিরছেন। পার্ক স্ট্রিটে তখন এক নতুন পঞ্জাবি গায়কও সাড়া জাগাচ্ছেন, অমৃক সিংহ অরোরা।
প্যাম ক্রেন। যাঁর রূপে আর গানের সুরে বুঁদ হয়ে থাকত সে কালের পার্ক স্ট্রিট
বন্ধুবান্ধব নিয়ে মোকাম্বো কিংবা ট্রিঙ্কা’জ-এ মাঝেমধ্যেই হানা দিতেন মিস শেফালি। রোজ রাতে ফিরপো’জ-এ তাঁর পারফরম্যান্স নিয়ে শোরগোল পড়ে যেত। এক দিনের কথা আজও ভুলতে পারেন না শেফালি। সে দিন মোকাম্বো থেকে ফিরপো’জ-এ গিয়েছেন। নাচগান হয়েছে প্রচুর। দুদ্দাড়িয়ে ফিরতে গিয়েও দেরি। কোনও মতে স্ল্যাক্সটা খুলে, ঘাসের ঘাঘরা আর বিকিনি পরে সোজা ফিরপো’জ-এর ফ্লোরে।
হাওয়াইয়ান নাচের ফ্লোরে প্রথমেই তিনি সুইং করতেন। সে দিন সুইং করতেই বুঝলেন, নীচ দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। ব্যাপার কী? তাড়াহুড়োয় স্ল্যাক্স খোলার সময় নীচের অন্তর্বাসও খুলে ফেলেছেন, কিন্তু হাওয়াইয়ান নাচের অন্তর্বাস পরেননি! এ তো মহাবিপদ! নাচ আর স্ট্রিপটিজের ককটেল হয়ে গেল যে! জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন শেফালি। কোনও রকমে নাচ সেরে দে ছুট। কী সব দিন গেছে! এখনও ভাবলে চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে পার্ক স্ট্রিটের রাতপরির।
প্যাম ক্রেনের আর এক দোসর লুই ব্যাঙ্কসের জীবনও এগিয়েছে অদ্ভুত গতিতে। বাবা বাজাতেন ট্রাম্পেট। ১৯৪০ সালে কাঠমান্ডু থেকে কলকাতায় আসেন তিনি। যোগ দেন এক ইউরোপিয়ান ব্যান্ডে। পরে ফের কাঠমান্ডু। ছেলে ডম্বর বাহাদুরের ছোটবেলা থেকে গানবাজনার শখ। বাবার দেখাদেখি ১৩ বছর বয়সে গিটার, ট্রাম্পেটে হাতেখড়ি। ছেলের নাম দিলেন বদলে। ডম্বর বাহাদুর থেকে লুই ব্যাঙ্কস। তাতেই নাকি আত্মবিশ্বাস দ্বিগুণ বেড়ে গেল। গিটার, ট্রাম্পেটের পাশাপাশি পিয়ানো শিখতে শুরু করলেন। কলেজ শোয়ে দার্জিলিং‌ থেকে কাঠমান্ডু। বাবার ব্যান্ডে হাত মকসো করে পাড়ি দিলেন কলকাতা। শুরুতে কিছু দিন হোটেল হিন্দুস্তান। তার পরই ব্লু ফক্স!
আচমকা লাইভ এন্টারমেন্টের উপর চাপানো হল বিপুল কর। অচিরেই বিভিন্ন রেস্তরাঁয় লাইভ গানবাজনা বন্ধ হয়ে গেল। যাঁরা গাইতেন তাঁরা অনেকেই কলকাতা ছাড়লেন। ব্যান্ডগুলি ভেঙে ছত্রখান। যন্ত্রীরা বেরোলেন অন্যত্র। অভিমানী ব্যাঙ্কসও শহর ছাড়লেন। কলকাতাকে ভালবেসে এক সময় আর ডি বর্মনের প্রস্তাব ফিরিয়েছিলেন। এ বার নিজেই আবেদন জানালেন। সানন্দে বম্বেতে ডেকে নিলেন আর ডি। ১৯৮৮-তে ব্যাঙ্কসের ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’ ছড়িয়ে পড়ল লোকের মুখে মুখে। পেলেন জাতীয় পরিচিতি।
অভিমানে শহর ছেড়েছিলেন লুই ব্যাঙ্কস। কার্লটন কিটো তা পারেননি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের স্যাঁতসেঁতে দু’কামরার ঘরটাই ছিল তাঁর প্রিয় আস্তানা। নন্দন বাগচীর কথায়, ‘‘লোকটা নোবেল পেতে পারতেন। অনেক কিছু দিয়েছেন। আমরা কিছু ফিরিয়ে দিতে পারিনি।’’
পার্ক স্ট্রিটের জ্যাজ কিং কিটোর ১০ হাজারের উপর নোটেশন ছিল মুখস্থ। জ্যাজ নিয়ে কেউ কোনও সমস্যায় পড়লে সঙ্গে সঙ্গে উপায় বাতলে দিতেন। দীর্ঘ দিন ‘ক্যালকাটা স্কুল অব মিউজিক’-এ পড়িয়েছেন।
পার্ক স্ট্রিট তখন ক্রমশ জৌলুস হারাচ্ছে। লুই ব্যাঙ্কস এক বার বললেন, ‘‘আমার সঙ্গে এস। দেখবে, জীবনটা বদলে গেছে।’’ কিটো বললেন, ‘‘আমি কলকাতাতেই ভাল আছি। পার্ক স্ট্রিটের সমস্ত রেস্তরাঁয় বাজিয়েছি। এই স্মৃতি নিয়েই চলে যেতে চাই।’’
আর এক জনের কথা না বললে ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাঁর কাজ ছিল হারমোনিকা বা মাউথ অর্গান বাজানো। বন্ধুদের ব্যান্ডে হঠাৎ এক দিন মহড়ায় এসে হাজির এক স্যাক্সোফোনবাদক। তাঁর বাজনায় মুগ্ধ হয়ে মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেন, হারমোনিকা নয়, স্যাক্সোফোন বাজাবেন এ বার থেকে। তিনি পল মল্লিক।
কলকাতায় আসতেন  পল স্যাক্সোফোন শিখতে। এ ভাবেই এক দিন ফিরপো’জ-এ আত্মপ্রকাশ। ফিরপো’জ-এ ব্যান্ডমাস্টার ছিলেন রনি লাইক। রনি ও জো পেরেরার বন্ধুত্ব ছিল দেখার মতো। পলের বাজনা পছন্দ হল পেরেরার। নিয়ে এলেন দ্য পার্ক-এ। তার পর দীর্ঘ সময় জুড়ে পল ছিলেন পার্ক-এর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সে সব সোনালি দিন পল মল্লিককে আজও স্মৃতিমেদুর করে তোলে। ‘‘তখন ফ্লুরি’জ-এ স্যাক্সোফোন বাজাই। বাজনা শুনে এক তরুণী এসে জড়িয়ে ধরল। বলল, আই লাভ ইয়োর মিউজিক। আই ওয়ান্ট টু কিস ইউ।’’
জ্বলজ্বল করে ওঠে পলের চোখ, ‘‘তখন এক দিকে জ্যাজ মিউজিক, অন্য দিকে ক্যাবারে। সে সব বোঝার, কদর করার লোকও ছিল প্রচুর। ধীরে ধীরে সবাই বিদায় নিল। পড়ে থাকলাম শুধু আমি, আর পার্ক স্ট্রিট!’’
পল জানেন, এই পার্ক স্ট্রিটে বর্ষশেষে শুধুই ভিড়। বারে জ্যাজ, ব্লুজ, হাওয়াইয়ান, ক্যাবারে সবই  এখন  নিছক  ধুলো-মাখা স্মৃতি। গান আর নেই!                         


https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/these-cabaret-dancers-were-people-s-attraction-once-in-the-new-year-s-eve-1.732181?ref=archive-new-stry                         

কবরে মৌলবি, স্তোত্র পাঠে পণ্ডিতমশাই (Memoirs by Tarun Majumdar)

কবরে মৌলবি, স্তোত্র পাঠে পণ্ডিতমশাই

এ রকমই ছিল আমার ছেলেবেলা। অঙ্কের স্যর জসিমউদ্দিন আহমেদ নিজে থাকতেন সরস্বতী পুজোর তদারকিতে। চাঁদনি রাতে দেখলাম, ট্রেন মিস করে নির্জন প্ল্যাটফর্মে বসে আপন খেয়ালে একের পর এক গান গেয়ে চলেছেন স্বয়ং আব্বাসউদ্দিন।

Tarun Majumdar
তরুণ মজুমদার
 
Tarun Majumdar

শৈশব: ছোটবেলায় টালিগঞ্জে মামার বাড়িতে বেড়াতে এসে তোলা ছবি

ছেলেবেলা কাকে বলে? কোন সুর জলতরঙ্গের মতো টুংটাং বেজে ওঠে শব্দটা শুনলেই? নিজের কথা বলতে পারি। আমার কাছে ছেলেবেলার ছবি মানেই গোবেচারা আঁকাবাঁকা একটা নদী— করতোয়া— জীবনে কোনও দিন বন্যা এনে সব কিছু ভাসিয়ে দেওয়ার দম্ভ যে দেখাতে পারেনি। তারই এক পাশে, উঁচু পাড়ের ওপর সাজানো-গোছানো বগুড়ার ছোট্ট একটা শহর। রাস্তায় ধুলো, খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে ইশকুলে যাতায়াতই রেওয়াজ। জায়গাটা মুসলমানপ্রধান হলেও এই তথ্যটির আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে বলে ছেলেবেলায় কোনও দিনই মনে হয়নি। বাড়ির কর্তা— মানে আমার বাবা— স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে বেশির ভাগটাই জেলে জেলে। আমার অভিভাবকত্বের ভার ছিল প্রতিবেশী বয়স্কদের ওপর। তাঁদের স্নেহ, তাঁদের শাসনে বড় হতে হতে এক দিন আবিষ্কার করলাম, এঁদের অধিকাংশই মুসলমান।
ইশকুলেও একই অবস্থা। অঙ্কের স্যর জসিমউদ্দিন আহমেদ ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন বরাবর। সরস্বতীপুজোয় চেয়ার পেতে বসে সব কিছুর খবরদারি করতেন। ফাইনাল পরীক্ষার আগে অঙ্কে-কাঁচা ছেলেদের, যেমন আমি— জোর করে পাকড়ে নিজের বাড়ি এনে শাসন, তর্জন আর স্নেহ দিয়ে রগড়ে রগড়ে কিঞ্চিৎ ভদ্রস্থ করে তোলার চেষ্টা করতেন। বদলে ‘সম্মানদক্ষিণা’ কথাটা তোলার মতো হিম্মত কারও ছিল না।
ইশকুলের শিক্ষকদের মধ্যে দু’জন— সংস্কৃতের পণ্ডিতমশাই আর আরবির মৌলবি সাহেব— সব থেকে কম মাইনে পেতেন সম্ভবত। সেই জন্যেই, কী করে জীবনযুদ্ধে কোনও রকমে টিকে থাকা যায় তার টেকনিক নিয়ে শলা-পরামর্শ করতে করতে নিবিড় বন্ধুত্ববন্ধনে জড়িয়ে নিয়েছিলেন নিজেদের। হেঁটে হেঁটে বহু দূর থেকে ইশকুলে আসতেন তাঁরা, খালি পায়ে। এঁদের প্রাক্তন ছাত্ররা, কেউ এখন উকিল, কেউ অফিসার, কেউ বা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী— হয়তো টাঙা চড়ে উলটো দিকে চলেছেন। এঁদের দেখামাত্র গাড়ি থামিয়ে কাছে এসে প্রণাম বা কদমবুসি জানাতেন। আশীর্বাদ পেয়ে আর দিয়ে যে যার আবার নিজের পথে।
এক ভরা শ্রাবণে ইশকুলে গিয়ে খবর পেলাম, আগের রাতেই মৌলবি সাহেব হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছেন। একটু পরেই তাঁর দেহ এসে পৌঁছবে। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁকে গোর দেওয়া হবে ইশকুল-মাঠের শেষ প্রান্তে উঁচু ঘাসজমিতে। জায়গাটা শহরের শেষ সীমানা ছাড়িয়ে, যার পর অবারিত ধানখেত আর দূরে দূরে ছোট ছোট গাঁ।
কবর খোঁড়া হল। মৌলবি সাহেবকে শুইয়ে দেওয়ার পর আপনজনেরা কয়েক মুঠো করে মাটি ফেলবেন তার ওপর। মাটি চাপানো শেষ হলে আর ফিরে দেখতে নেই নাকি। এটাই প্রথা। অতএব, আমরা সবাই উলটোমুখো হাঁটা শুরু করলাম। এমন সময় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অজয়— ডানপিটেমিতে যে বরাবরই ফার্স্ট বয়, চাপা গলায় বলল, ‘‘দূর, কী হবে ফিরে তাকালে? কচু হবে।’’
বলে, সে ফিরে তাকাল। সেই সঙ্গে আমিও। যে দৃশ্য দেখতে পেলাম তা না দেখলে আমার ছেলেবেলার সোনার ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটাই অদেখা থেকে যেত।
আকাশ জুড়ে থরে থরে কালো পাশবালিশের মতো মেঘের সারি অনেক নীচে নেমে এসেছে। হাওয়া দিচ্ছে শনশন। একটু আগে হয়ে-যাওয়া বৃষ্টির ফোঁটা ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে ঘাসজমির লম্বা লম্বা ঘাসের ডগা থেকে। যেখানে মৌলবি সাহেবকে রেখে আসা হল সেখানে আর কেউ নেই এখন। শুধু এক জন ছাড়া। আমাদের পণ্ডিতমশাই।
হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে তাঁর খাটো উত্তরীয়টা। পইতেটা আঙুলের ডগায় তুলে, আমাদের দিকে পিছন ফিরে, তিনি কী যেন বলে চলেছেন তাঁর সদ্যপ্রয়াত বন্ধুকে। ভাল করে কান পাতলে বোঝা যায়—
‘আকাশস্থ নিরালম্ব বায়ুর্ভূত নিরাশ্রয়
অত্র স্নাত্বা ইদং পীত্বা স্নাত্বাপীত্বা সুখি ভবেৎ।’
ধুলোয় ছড়ানো শল্‌মা-চুমকির মতো এমন কত সব চকচকে ছবি, আমার ছেলেবেলা।
শহরে দু-দু’টো সিনেমা-হল। ‘উত্তরা’ আর ‘মেরিনা’। ‘মেরিনা’ আবার বিশাল একটা পার্কের ঠিক মাঝখানটায়, চার দিকে ফুলের মেলা। ছবি আসত নিউ থিয়েটার্স আর বম্বে টকিজ-এর। সেই সঙ্গে চার্লি চ্যাপলিনের।
চার্লির ছবি মানেই অফুরন্ত মজা। কিন্তু শুনতাম, এ সব ছবির পিছনে নাকি দুর্দান্ত সব ‘হাই থট’ লুকনো থাকে। শহরে মনোয়ার বলে একটা লোক ছিল। খুন-জখম জাতীয় ব্যাপারে খুবই সুনাম তার। সে-ই প্রথম বলেছিল আমাকে, ‘‘চাল্লির ছবি বোঝা অত সোজা না। বাড়িৎ গিয়া ভাব।’’
এ বার সেই ছোট্ট শহরটার দুর্গাপুজোর কথা। এ-পাড়া ও-পাড়া মিলে পুজো হত বেশ কয়েকটা। কিন্তু আমাদের প্রধান আকর্ষণ সাবেকি দত্তবাড়ির দুই তরফের দু’টো জমকালো পুজো। সদ্য-পাওয়া নতুন জুতোজোড়ার কল্যাণে দু’পায়ে বড় বড় ফোস্কা নিয়ে এ-পুজো ও-পুজো করে বেড়াচ্ছি সর্ব ক্ষণ। নহবতখানা থেকে সানাইয়ের সুর। পথের দু’পাশে হল্লাদার মেলা। চরকি থেকে শুরু করে ‘দিল্লি দেখো বোম্বাই দেখো’-র উঁকি-মারা বাক্স, জিলিপি-গজা-রসগোল্লার দোকান। কাঠের বারকোশে স্তূপীকৃত খুরমার পসরা। চুলের ফিতে, কাচের চুড়ি, সোহাগ-আয়না। আদমদিঘির তাঁতিদের বোনা শাড়ি-গামছা। বাদুড়তলার কুমোরদের গড়া রকমারি পুতুল, ঘাড়-দোলানো বুড়োবুড়ি।
শাখাপ্রশাখা: নীচের সারিতে বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়, শিশু তরুণ মজুমদার। ডান দিকের শিশুটি তাঁর ভাই অরুণ মজুমদার। তার উপরের সারিতে একেবারে বাঁ দিকে মা সুনীলা, (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়) ঠাকুমা গিরিবালা। তারও উপরের সারিতে (বাঁ দিক থেকে চতুর্থ) বাবা বীরেন্দ্রকুমার মজুমদার
বড় তরফের নাটমন্দিরে কত রকম যে অনুষ্ঠান! বাইরে থেকে বড় বড় ওস্তাদদের আনাগোনা। বড়ে গোলাম আলি, তারাপদ চক্রবর্তী, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়, তুলসী লাহিড়ী। লখনউ ম্যরিস কলেজের সোনার মেডেল পাওয়া ছাত্র, অতুলপ্রসাদ সেনের প্রিয় শিষ্য পাহাড়ী সান্যাল (পরবর্তী কালে আমার পাহাড়ীদা) এক বার এসে ‘কে তুমি নদীকূলে বসি একেলা’ গেয়ে মফস্‌সলি শ্রোতাদের এমন মনোহরণ করেছিলেন যে পর পর তিন বার একই গান গেয়ে তবে তাঁর রেহাই।
এক দিন হত আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। শহরের ‘চ্যাংড়াপ্যাংড়া’দের, অর্থাৎ ছোটদের জন্য। বড়দের নাটক নামত নবমীর রাতে। বঙ্গে বর্গি, পিডব্লিউডি, তটিনীর বিচার। রিহার্সাল দিতে দিতে গলার বারোটা। গিন্নিরা তটস্থ। ঘন ঘন তুলসীর পাতা দেওয়া চা, গোলমরিচ-তালমিছরির ক্বাথ পাঠাতে পাঠাতে হয়রান। হে মা দুগ্‌গা, মান যেন থাকে।
বিজয়ার বিকেলে করতোয়ার পাড়ে লোকারণ্য। ডবল-নৌকো জুড়ে তার ওপর দেবী ভেসে বেড়াচ্ছেন এ দিক থেকে ও দিক, ও দিক থেকে এ দিক। সন্ধে হল তো হাউই, তুবড়ি, রংমশাল। নিরঞ্জনের পর ঘাট থেকে শুরু হয়ে গেল প্রণাম, কোলাকুলি, আশীর্বাদের পালা।
একটু দূরেই রেলের ব্রিজ। সকাল-সন্ধেয় দু’জোড়া ট্রেনের গুমগুম শব্দে যাতায়াত। তার পর সব চুপচাপ।
এক কোজাগরী রাতের কথা বলি। শহর ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা তফাতে রেলের প্ল্যাটফর্ম। আমার সেই ডানপিটে বন্ধু অজয় হঠাৎ এসে বলল, ‘‘চল, ইস্টিশনটা ঘুরে আসি।’’
‘‘এখন?’’
‘‘তো?’’
‘‘সে যে অনেকটা পথ। মাঝখানে ওই জলাটা। সাপের বাসা একেবারে...’’
‘‘কিচ্ছু হবে না। চল তো। ফুটফুটে জোছনা, দেখবি কেমন মজা।’’
সাপের ভয়ে কাঁটা হয়ে মজা দেখতে দেখতে শেষ অবধি পৌঁছনো গেল। ছোট্ট প্ল্যাটফর্ম, বড় বড় শিরিষের ছায়ায় ঝিমোচ্ছে। কাছে পৌঁছতেই একটা আওয়াজ কানে এল। আওয়াজ নয় ঠিক। বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে ভেসে আসা একটা খালি গলার গান: ‘ঘরবাড়ি ছাড়লাম রে, নদীর চরে বাসা রে—’
এই জনহীন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে শুধু ঝিঁঝিঁ আর কটকটি ব্যাঙের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই থাকবার কথা নয়, সেখানে গান গায় কে?
গুটিগুটি কাছে আসতেই থই পাওয়া গেল। অদূরে মাল ওজন করার যন্ত্রটার ওপর পিছন ফিরে বসে এক ভদ্রলোক জ্যোৎস্না-ধোওয়া জলার দিকে চেয়ে আপনমনে গেয়ে চলেছেন। পরনে ধুতি-শার্ট, ওপরে সুতির ইংলিশ কোট।
প্রৌঢ় স্টেশনমাস্টারমশাই তাঁর ঘরের দরজার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে আমাদের শব্দ করতে বারণ করেন। একটু পরে, গায়কের গান শেষ হলে, কাছে এসে
তিনি ফিসফিসিয়ে বলেন, ট্রেন ফেল করেছেন ভদ্রলোক। গিয়ে পা ছুঁয়ে প্রণাম করো। আব্বাসউদ্দিন আহমেদ সাহেব!
এই স্টেশন, এই প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আরও একটা স্মৃতি আছে। সেটা মজার।
আমাদের ইশকুলের পুরনো অঙ্ক স্যর হরলালবাবু রিটায়ার করার পরে তাঁর জায়গায় নতুন এক জন এলেন। রোগাপটকা, মাথায় খাটো, রোদে-ঝলসানো ফরসা গায়ের রং। সব সময় কেমন যেন আনমনা, কী যেন ভাবেন সর্বদা। নাম মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা ডাকতে শুরু করলাম ‘মণি স্যর’ বলে। আগের অঙ্ক স্যর হরলালবাবুর মতো হাঁকডাক নেই। কেউ তাঁকে দেখে ভয় পায় না। শহর থেকে খানিক দূরে ইস্টিশনের কাছে গোটা কয়েক টালি-ছাওয়া ঘর— তারই একটায় ভাড়াটে হয়ে উঠেছেন। অজয় এক দিন এসে বলল, ‘‘চল, স্যরের ডেরাটা একটি ভিজিট মেরে আসি।’’
গিয়ে দেখি, বিচিত্র ব্যবস্থা। একটা খাটিয়া, একটা ট্রাঙ্ক আর একটা হারমোনিয়াম— ব্যস, সংসার বলতে এই। না ওঁর বউ, না ছেলেপুলে। স্টেশনে যে লোকটা পান-বিড়ি, চা-শিঙাড়া বিক্রি করে সেই রামটহল, রামটহল মিশি। সে জানাল, মাস্টারজি নাকি এই রকমই। বিয়ে-থা করেননি। বাড়িতে কোনও উনুন নেই। মাসচুক্তিতে দু’বেলা খাবার পাঠায় রামটহলই। মাস্টারমশাইয়ের ঘরের চাবি, মাসমাইনের টাকা, সবই নাকি থাকে ওর কাছে।
‘‘আজিব আদমি!’’ রামটহল বলে।
কিন্তু কী করে কী করে অজয় আর আমার সঙ্গে স্যরের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। খুব কাছের সম্পর্ক। মনে আছে, সেটা শ্রাবণ মাস। ক’দিন ধরে ঝমঝম করে তুমুল বৃষ্টি। চতুর্থ দিন সন্ধেয় হঠাৎ মেঘের ফাটল দিয়ে চাঁদ উঁকি দিল। নরম জ্যোৎস্নায় ভেসে গেল চারদিক।
অজয় আর আমি চলেছি ইস্টিশনের দিকে বেড়াতে। পৌঁছে দেখি হুলস্থুল কাণ্ড। স্টেশনমাস্টার মশাই, রামটহল আর ট্রলিম্যানরা ঘিরে আছে মণি স্যরকে। মণি স্যর কাঁদো কাঁদো হয়ে বলছেন, ‘‘ও রে! কী হবে এখন? আমি যে কথা দিয়ে কথার খেলাপ করে ফেললাম। এক নিরীহ ভদ্রলোককে এমন বিচ্ছিরি বিপদে ফেলে দিলাম!’’
‘কথার খেলাপ’, ‘নিরীহ ভদ্রলোক’, ‘বিচ্ছিরি বিপদ’— একটা কথারও মানে পরিষ্কার হল না আমাদের কাছে। শেষ পর্যন্ত এর-ওর মুখ থেকে শুনলাম ঘটনাটা।
দিন পাঁচেক আগে সকালের ডাউন ট্রেনটা সবে এসে দাঁড়িয়েছে প্ল্যাটফর্মে, এমন সময় মাঝবয়েসি এক ভদ্রলোক, কাঁচাপাকা চুল, গাড়ি থেকে নেমে একেবারে হইচই করে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কাঁদেন আর বুক চাপড়াতে থাকেন।
কী ব্যাপার? 
জানা গেল, বাড়ি ওঁর চার ইস্টিশন পরে, আদমদিঘিতে। সামনে মেয়ের বিয়ে। গয়না গড়াতে দিয়েছিলেন কলকাতায়। পাত্রপক্ষের খাঁই অনেক। শুধুমাত্র মেয়ে, ওর শ্যামলা রং সত্ত্বেও, দেখতে ভাল বলে এই বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছেন, কমের ওপর দিয়ে। ‘কম’ মানে মেয়েটির বাবার যথাসর্বস্ব।
সেই গয়না নিয়ে ফিরছিলেন ট্রেনে, সারা রাত সাবধানে আগলাতে আগলাতে। ভোরের দিকে একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। সেই ফাঁকে ওঁর গয়নার বাক্স উধাও।
কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ভদ্রলোক এক সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান প্ল্যাটফর্মে। জল, বাতাস, এ সব দিয়ে জ্ঞান ফেরানো হলে ভদ্রলোক বলেন, তিনি আর ফিরবেন না আদমদিঘিতে। কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবেন নিজের একমাত্র মেয়ের সামনে! তার চেয়ে বরং লাইনে গলা দিয়ে মরবেন।
কান্নাকাটি, হা-হুতাশ, বুক চাপড়ানো— সবই মণি স্যর দেখছিলেন চোখের সামনে। এমন সময় হঠাৎ নাকি এগিয়ে এসে বলেন, ‘‘কী জাত আপনারা?’’
‘‘বামুন। চক্কোত্তি। আদমদিঘির বিশ্বনাথ চক্কোত্তি।’’
‘‘মেয়ের বয়েস?’’
‘‘এই একুশ পেরোবে সামনের মাসে।’’
‘‘দেখুন, রাজি হওয়ার কথা নয় আপনার। বিশেষ, যখন অমন পাত্রী। তবু যদি একান্ত মনে করেন, আমিও বামুন, মণিময় বাঁড়ুজ্যে, কম মাইনের মাস্টার এক জন। আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে পারি। ম্যাচিংটা ভাল হবে না। কিন্তু বিয়েটা তো হবে।’’
‘‘দেনাপাওনা?’’
‘‘নট এ সিঙ্গল পাইস। এই এরা সবাই সাক্ষী।’’
ভদ্রলোক, বলা বাহুল্য, হাতে চাঁদ পান। বিয়ের তারিখ, লগ্ন, এ সব জানিয়ে পরের ট্রেন ধরেন। মণি স্যর কথা দেন, সময়ের আগেই পৌঁছে যাবেন।
আজই সেই রাত। লগ্ন রাত দশটায়। আদমদিঘি যাওয়ার শেষ ট্রেন ছেড়ে গিয়েছে অনেক আগেই। এখন উপায়?
হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। স্টেশন মাস্টারমশাইকে বলি, ‘‘এক কাজ করলে হয় না?’’
‘‘কী?’’
‘‘আপনি যদি একটা ট্রলির ব্যবস্থা করে দেন, ট্রলিম্যানরা তো এখানেই আছে, সেই ট্রলি চেপে স্যর যদি বিয়ে করতে চলে যান? পনেরো-কুড়ি মাইল তো রাস্তা। ঠিক পৌঁছে যাবেন।’’
সবাই সমস্বরে ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’’ বলে ওঠেন।
অতঃপর ট্রলি। বরবেশে মণি স্যর। বরযাত্রী বলতে তিন জন। অজয়, আমি আর রামটহল। হাওয়া দিচ্ছে। মেঘ সরে যাচ্ছে ক্রমশ। তারই ছায়া পড়েছে দু’পাশের খোলা মাঠে জমা জলের বুকে। কচি কচি ধানচারা যেখানে হাওয়ায় দুলছে।
কাহালু, তালোড়া, নসরতপুর পেরিয়ে আদমদিঘি।
আমরা চলেছি মাস্টারমশাইয়ের বিয়ে দিতে।

https://www.anandabazar.com/supplementary/rabibashoriyo/childhood-memories-of-indian-film-director-tarun-majumdar-1.732193?ref=archive-new-stry