রাতের ট্রেন।
গন্তব্য বহরমপুর।
সংবর্ধনা নিতে চললেন ঋত্বিককুমার ঘটক। সঙ্গে তাঁর সহকারী সুনীল দত্ত, গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কবি পূর্ণেন্দু পত্রী। শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরার আগে, মিনার্ভা হোটেলে সন্ধ্যা-আহ্নিকে বসেছেন ঋত্বিক। বজ্রের মতো গর্জমান।
‘‘দাঁড়াও হে, দাঁড়াও! সবটা শুনে যাও। দু’পেগ একসঙ্গে নিয়ে আসবে। দু’ পেগ!’’ 
‘‘সোডা?’’
‘‘না হে না, আমার নাম ঋত্বিককুমার ঘটক! সোডা দিয়ে কখনও মদ খাই না। যাও, যাও জলদি নিয়ে এসো! জলদি!’’
দু’পাত্তর চড়তেই চোখ লাল। গাড়ি ছুটল শিয়ালদার দিকে। যাত্রাসঙ্গী পূর্ণেন্দু জানাচ্ছেন, ট্রেনে উঠেই ঋত্বিক তাঁর ময়লা পাঞ্জাবিটা খুলে মেঝেতেই দু’পা ছড়িয়ে বসলেন। ঢোলা পায়জামা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে শুরু হল ফের মদ্যপান। সহকারী কিছু একটা বলতেই গলা চড়ল তাঁর! দাউ দাউ জ্বলে উঠলেন!
‘‘কেন রে শুয়োর! আমার কী দোষ?’’
‘‘হাতে টাকা পেলেই তো আপনার অন্য চেহারা। মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা... জীবনে কিছু তো কম পাননি। কত লোক আপনার পিছনে টাকা ঢালতে রাজি, যদি সুস্থ থাকেন। সে তো থাকবেন না।’’
‘‘কে আমাকে টাকা দেবে শুনি? তোদের ওই বেঙ্গলি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি? মরে গেছে!’’
‘‘মাধবী মুখার্জি ডিস্ট্রিবিউটরদের দোরে দোরে ঘুরে বেড়ায়নি আপনার জন্য? বিশ্বজিৎ প্রোডিউসার, সকলে রাজি ছিল। সেই আপনি বিশ্বজিৎবাবুকে স্ক্রিপ্টটা পর্যন্ত শোনালেন না। বম্বেতে শক্তিদার অনুরোধ ফেরালেন। কেন? না, শ্যুটিং-এ মদ খাওয়া যাবে না।...হিন্দিতে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ হল না! রাজেশ খন্নার অফারও ফিরিয়ে দিলেন! ছিঁড়ে উড়িয়ে দিলেন স্ক্রিপ্ট।... বলুন, মিথ্যে কথা বলছি? জবাব দিন! বলুন?’’
সুনীলের কথা শুনে শিশুর মতো হাসছেন ঋত্বিক! আর হাসতে হাসতেই রেলগাড়ির কামরায় অন্যদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলছেন, ‘‘হারামজাদা সব জেনে ফেলেছে!’’
তাঁর উচ্ছ্বল হাসি একটু একটু করে ভেঙে ভেঙে মিশে যাচ্ছে রাতের রেলগাড়ির ঝমঝম শব্দে। কামরার পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে পথের হাওয়া। ‘লাথি ছোড়াছুড়ি, খিস্তি, ঠাট্টা’— সবই ঠিক ছিল, গোল বাধল টিটাগড়ে। দু’জন রেলপুলিশ উঠতেই যেন আগুনে ঘি পড়ল! চিৎকার করে উঠলেন ঋত্বিক, ‘‘এখানে কী? ফার্স্ট ক্লাস কামরায় উঠেছ কেন? শালারা জানে না, চোর-ডাকাত কোথায় থাকে? জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা হচ্ছে? নামো। নামো এখুনি! নইলে লাথি মেরে নামাব। আবার বন্দুক!... ঋত্বিক ঘটকের নাম শুনেছ? শোনোনি। তোদের বাবা কে আছে, তাকে গিয়ে বল যে আমি আছি এই গাড়িতে। বুঝলি...!’’

পূর্ণেন্দু লিখছেন, ‘‘হ্যাঁচকা টানে বন্দুক দুটো ছিনিয়ে নিলেন তাদের কাছ থেকে। ...ঠিক কোন মুহূর্তে যে রক্তপাতের ঘটনা ঘটবে, আমরা শুধু তারই অপেক্ষায়। আমরা অনুনয় করি। চুপ করুন। নেমে যাবে পরের স্টেশনে। আমাদের কথায় তাঁর কান নেই। ...আমাদের দিকে তাকান চোখে-ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি মাখিয়ে।... হাতে গেলাস। টলমলে লাল জল। টলমল ঋত্বিক ঘটকও। হাসিটাও টলমলে জলের ঢেউ। বিজয়ীর হাসি!’’
না, সেদিন কোনও রক্তপাত হয়নি!
খাকি দুটো ‘নুন-গেলা জোঁকে’র মতো চুপটি করে নেমে গিয়েছিল পরের এক স্টেশনে!
আর তাদের নামবার সময় ঋত্বিক খেলনা লাঠির মতো বন্দুক দুটো ছুড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে ফের ডুবলেন লালজলে। তাঁর চাহনি বাইরের নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে। হাওয়ায় হাওয়ায় এলোমেলো তাঁর চুল। কত কথা মনে পড়ছে আজ। পদ্মা, হাওড়বিল, কাশবনের কথা, রাজশাহী-পাবনার গল্প। বিএ পরীক্ষা দিতে এসে বহরমপুরের দেশভাগের দীর্ণ দিনকাল!

‘‘ভবা? এই ভবা... বড় গাঙে চলল মাল্লারা, ঘাটে যাবি?’’
‘‘কে! কে ডাকে!’’
চমকে ওঠেন ভবা। রেলগাড়ির জানলায় মাথা রেখে কোথায় যেন ভেসে যান! ছলাৎ ছল ঘাটের সামনে এসে দাঁড়ান। স্মৃতির ভিটে ভারেঙ্গা।
দেখেন, কবেকার যমুনা নদী দিয়ে পাবনার গ্রামে পালতোলা নৌকো ভিড়ছে। আশ্বিনের উদাস দুপুর। এক নদী নৌকো। তাঁর মনে পড়ছে, একবার কোজাগরীর আগের রাতে আবছা বিলে সারারাত লগি ঠেলেছিলেন। সারারাত! ‘শেষ রাতে দাঁতে দাঁত লাগা হিমে সে এক অদ্ভুত হতাশার অনুভূতি।’
ঢাকা শহরে শিশিরভেজা হেমন্তে তাঁর জন্ম। বাবা সুরেশচন্দ্র ছিলেন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মী। মা ইন্দুবালা। ঋত্বিক নয় ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন অষ্টম। তিনি এবং তাঁর পরের বোন সাত মিনিটের ছোট, প্রতীতি দেবী। ছোটটির সঙ্গে কত খেলনাবাটি! স্ম়ৃতি যেন আত্ম-হারা পাখি।
‘‘যাস না ভবা, ভবা শোন... ভবা!’’
ছেলেবেলায় ঠিক যেন ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-র কাঞ্চন ছিল সে। বাঁধন-ছেঁড়া একরোখামি।
প্রথমে ময়মনসিংহের মিশন স্কুলে। তারপরে কলকাতার বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে ক্লাস থ্রিতে। কিন্তু স্কুল পালানো ছেলে, তার কি ক্লাসঘরে মন টেকে! সই জাল করে স্কুল থেকেও উধাও সে! মন যে তার নাটকে। ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে সে-ই সাজত চাণক্য। বয়স গড়াতে গড়াতেই ডায়েরির পাতা ভরল গোপন প্রেমের কবিতা। সেই দেখে ম্যাডক্স স্কোয়ারের ছেলের দল খুব খ্যাপাত তাকে।
একদিন যুদ্ধ শুরু হল!
কলকাতা ছেড়ে চলল ভবা। ঠিকানা রাজশাহীতে, ডাকঘর ঘোড়ামারা। একবার পাবলিক লাইব্ররির মাঠে ‘ডাকঘর’ হল। নির্দেশক সে-ই।
কিন্তু ক্রমেই বাতাসে বারুদের গন্ধটা বাড়ছে। ক্রমে অস্থির সে চারপাশের ঘটনায়। তাঁর নিজের কথায়, সে ‘এক বিড়ম্বিত কাল।’
দেশ স্বাধীন হল। ঠিক পরের বছর, ভবা ইংরেজি অনার্সের ছাত্র। তার তখন নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই, বের করল কাগজ, ‘অভিধারা’। তাঁর মনে পড়ে, বহরমপুরে কৃষ্ণনাথ কলেজে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল।
তখন থেকেই কাঁটাতারে রক্তাক্ত তাঁর বুক। হাঁটতে হাঁটতে লালবাগ, খোশবাগ ছাড়িয়ে দূরে দূরে কোথায় যে চলে যেতেন। মর্মদাহে কেবলই বলে, ‘বাংলারে কাটিবারে পারিছ, কিন্তু দিলটারে কাটিবারে পার নাই!’

‘‘ঋত্বিকদা, দুই বাংলার ভাগ নিয়ে আপনার সব ছবিতেই বড্ড মাতামাতি!’’
‘‘মাতামাতি! বাংলাকে ভেঙে চুরমার করে দিল, আর মাতামাতি! বিক্ষুব্ধ সময়ে মুজরো করব? এটা বদমাইসি! আমি ওই শুয়োরের বাচ্চা...! চাই, খুব বেশি করে চাই দু’ বাংলার সংস্কৃতিকে এক ফ্রেমে আঁটতে। তাতে তোমরা মাকর্সবাদীই বলো আর যাই বলো। প্রতিবাদ করাটা দরকার। কিন্তু শালা বুঝল না কেউ।’’
নেশায় চুরমার ঋত্বিক! একে একে নিঃশেষ অমৃতের বোতল!
জায়গাটা খালাসিটোলা নয়, অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন ক্লাব। ‘যুক্তি-তক্কো-গপ্পো’র পরে নতুন ছবি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিক। ঋত্বিক বলছিলেন ‘সে বিষ্ণুপ্রিয়া’ নামে একটি ছবি করতে চান। তার মাঝে দেশভাগ প্রসঙ্গ এসে পড়ায় বাধল তুলকালাম!
‘‘এ দেশের কমিউনিস্টরা...!’’
‘‘শুয়োরের বাচ্চা! সব শালা অশিক্ষিতের দল। কেউ কিছু বোঝে না। ও সব ছাড়ো। ছবির গল্পটা শোনো।’’
বিপদ তখনও ঢের বাকি। ঋত্বিকের উত্তেজিত হয়ে স্টোরি লাইন বলার ফাঁকে হল্লা করতে করতে মঞ্চে প্রবেশ করলেন ত্রয়ী। শক্তি-সুনীল-সন্দীপন!
অদূরে বসে প্রমাদ গুনলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। ছিলেন তুষারবাবুও। তাঁর স্মৃতি বলছে, মদ্যপান করতে করতে হঠাৎ উঠে পড়লেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সকলের পিঠ চাপড়ে ঋত্বিকের ছবির প্রশংসা আদায় করতে শুরু করলেন। একসময় ঋত্বিকের কাছে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলেন। রেগে গিয়ে উঠে পড়লেন ঋত্বিক!
মুহূর্তে থমথমে পানশালা!
ঋত্বিক বললেন, ‘‘মদ খেয়ে হুল্লোড় করা ব্যাপারটা আমার একদম বরদাস্ত হয় না। এতে নেশাটা চটে যায়!’’
টালমাটাল পায়ে বাইরে গাড়িতে বসতেই গাড়ি ছুটল ময়দানের দিকে। নেশার ঝোঁকে এলোমেলো বকছেন। ময়দানি হাওয়ায় মুঠো ছুড়ে বলছেন, ‘‘প্রতিবাদ করাটা দরকার। কিন্তু শালা বুঝলো না কেউ। সব ভেঙে গেল। দেশ। দল... সব!’’
ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার অনুষ্ঠানে, ১৯৬৪
ভিক্টোরিয়ার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ভবা। একপায়ে চটি। একটু পরেই বেন্টিক স্ট্রিটে তুষারবাবু চটি কিনতে নিয়ে যাবেন। এসপ্ল্যানেডের মো়ড়ে বসে পড়ে ফের মদ খেতে চাইবেন ভবা। ... জ্যোৎস্নায় চারপাশ ধবধবে। একটা নিভন্ত বিড়িকে ধরিয়ে চাইলেন পরীর দিকে।
তাঁর মনে পড়ছে কলকাতার বিক্ষুব্ধ সময়! একদিকে এমএ ক্লাস চলছে, অন্য দিকে গণনাট্য। কখনও বসন্ত কেবিন। সেখানে বসেই সে গল্প-নাটক শোনাচ্ছেন সুহৃদ বিজন ভট্টাচার্য, কুমার রায়দের। একসময় মনে হল, ‘‘গল্পটা inadequate।’’ নিজেই লিখছেন, ‘‘আমার তখন টগবগে রক্ত, immediate reaction চাই। সেই-সময়ে হল ‘নবান্ন’। ‘নবান্ন’ আমার সমস্ত জীবন-ধারা পাল্টে দিল।... আমি নাটকের দিকে ঝুঁকে পড়লাম!’’
বসন্ত কেবিন থেকে বেরিয়ে হাঁটছেন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে হাজরা।
ছোট্ট চায়ের দোকানটায়। সেখানেই যে রোজ আড্ডা জমছে। ওরা বলে, ‘প্যারাডাইস কাফে।’ কয়েকটা ভাঙা চেয়ার-টেবিল, কাপ-প্লেট। ঘন ঘন চা খেতে খেতে কথা বলছেন একবগ্গা ঋত্বিক। শুনছেন সলিল চৌধুরী, ঋষীকেশ মুখোপাধ্যায়, তাপস সেন, মৃণাল সেন। সিগারেট নয়, ঋত্বিকের ব্র্যান্ড লাল সুতোর বিড়ি। বলতেন, ‘আমরা আগুনখেকো আঁতেল।’
‘নবান্ন’ দেখার পরেই তাঁর সঙ্গে যোগ বাড়ল প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের। কিন্তু কোথাও যেন স্বস্তি মিলছে না। মনে হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে যেতে হবে! ছবি করতে হবে!
‘‘কিন্তু গল্প কার? তোমার গল্প মানেই তো সেই দেশভাগ, ক‌লোনি আর দাঙ্গা।’’
সহযোদ্ধাদের কথায় খেপে যান ভবা, ‘‘অশিক্ষিতের মতো কথা বোলো না। ছবিতে গল্পের যুগ শেষ হয়ে গেছে, এখন এসেছে বক্তব্যের যুগ।’’
‘‘সেই তো ওপার বাংলা থেকে ছিন্নমূল মানুষের...!
রুক্ষ রাগি মুখে হঠাৎ উঠে পড়েন ঋত্বিক। আড্ডা ছেড়ে যেতে যেতে বলেন, ‘‘শুয়োরের দল। বাংলার আবার এপার-ওপার কি রে!’’

লেকের ধার। দুপুর। নিভৃত পূর্ণদাস রোডে পাশাপাশি হাঁটছে দু’জন। 
জলের কাছে পা ছড়িয়ে বসে ঋত্বিক। হাঁটু পর্যন্ত তোলা পাজামা। জলে দুলছে তাঁর ছায়া। বাংলা খাচ্ছেন। পাশে আরেকটা বোতল গড়াগড়ি। তাঁকে ঘিরে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়রা। কেউ একজন বসে থাকতে থাকতে একসময় বলেন, ‘‘ঋত্বিকদা আমরা তাহলে একটু...’’
‘‘খাও।’’
দু’ঢোঁক খেতেই ঋত্বিক বললেন, ‘‘আমার কিন্তু টিবি!’’
বেশিক্ষণ কথা বললে কাশি হয়। কাশলে মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে। রুমালে মুখ মুছে নেন। তবু জনতার কী অপূর্ব মুগ্ধতা! সঞ্জয় লিখছেন, ‘‘ওটাই খাওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি। ওটা তখন ঋত্বিক ঘটকের মদ এবং সেটা হচ্ছে প্রসাদ।’’
‘‘ইউনিভার্সিটিতে বার্গম্যানের একটা রেট্রোস্পেকটিভ হচ্ছে ঋত্বিকদা। যাবেন?’’
‘‘বার্গম্যানের পুরোটাই চালিয়াতি, একশোভাগ জোচ্চুরি। আন্তোনিওনির স্টাইলটা ধ্রুপদী। যাকগে, যা বোঝো না তা নিয়ে তোমরা ফ্যাচফ্যাচ কোরো না। শোনো, আরও আট-দশ বছর বাদে লোকে আমার ছবি নেবে। আমার ছবি পাগলের মতো খুঁজবে। তোমরা দেখে নিও!’’
এমন শিবতুল্য ভবাকে তাঁর শিষ্যরা চেনে। তারা শ্রদ্ধা করে। ভবা লেকের গহনে তাকিয়ে নিজের লেখা কবেকার লাইনগুলো ভাবেন। ‘‘মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।/ এইভাবে,/ পৃথিবীর ইতিহাস বারবার/ বদলে গেছে,/ তবুও মানুষ, সবসময় বেঁচেছে। মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।’’
লেকের জলে ছায়াময় দুপুর দেখতে দেখতে তাঁর মনে পড়ে লেকভিউ রোডে ‘জ্বালা’-র অভিনয়।
সে সময় শহরে পর পর ৩১টা আত্মহত্যার খবর!
‘পিপলস এজ’ কাগজে রিপোর্ট করতে গিয়ে তাঁর সে কি ছটফটানি। ‘সুইসাইড ওয়েভ ইন ক্যালকাটা’ রিপোর্টাজ লিখেও শান্তি নেই। মনে হল, এভাবে নয়। লিখলেন, বিষাদময় ‘জ্বালা।’ তবু জ্বালা জুড়োল কই! আজীবন নীলকণ্ঠ হয়েই রইলেন!
লেকের জলে ছায়ারা দীর্ঘ হচ্ছে।
ছেঁড়া কাঁথা পরে পাগলের ভূমিকায় অভিনয়-স্মৃতির সংলাপ ভেসে এল হাওয়ার চিৎকারে, ‘‘জ্বালা আমারও কম নয়। ব্যথা আমারও আছে। ধোঁয়াচ্ছে! জানলে ধোঁয়াচ্ছে...!’’ অস্থির হয়ে, একটা লাল সুতোর বিড়ি ধরান ঋত্বিক।
দমকা কাশির সঙ্গে সঙ্গে রক্ত ওঠে কেবল। সুখটান দিয়ে প্রথম ছবি ‘ছিন্নমূল’-এর কথা ভাবেন। মনে পড়ে শোভার মুখটা।

শিলং পাহাড়ের এক মেয়ের প্রেমে পড়ছেন ভবা!
ও দিকে ভিতরে ভিতরে ছটফটানি বেড়েই চলেছে। উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে লিখলেন ‘দলিল।’ সেন্ট্রাল স্কোয়াডের প্রযোজনায় মঞ্চস্থ করলেন। গণনাট্যের কনফারেন্স যোগ দিতে ‘দলিল’ নিয়ে পাড়ি দিলেন বোম্বে। সেখানেই দেখা!
একুশ বছরের দাম্পত্যের স্মৃতিসুধায় সুরমা লিখছেন, ‘‘একটা ভিড়ের দৃশ্যে সমীরণ দত্তের অনুরোধে একটুখানি অভিনয় করে দিয়ে আসি। রোগা, লম্বা চেহারার মানুষটি আমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে আসেন।’’ ঘনিষ্ঠতা বাড়ল শহরে ফিরে। 
ঋত্বিক তখন মা, দিদিদের সঙ্গে বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে। আর সুরমা শিলং থেকে কলকাতায়, এমএ পড়তে মামার বাড়িতে।
ভবা রোজ সুরমাকে পড়ায়। বই কিনে দেয়। লেনিন, মার্ক্স, প্লেখানভ! ভবার কথায় যুক্তি, প্রত্যয়, ‘বিসর্জন’-এর রিহার্সালে অপর্ণার চরিত্রটি দেখিয়ে দিতে দিতে গহন চোখে চোখ রেখে বলা, ‘যবে বসে আছি ভরা মনে—/ দিতে চাই, নিতে কেহ নাই!’
সব যেন ওলোটপালোট করে দিল সুরমার। প্রেমে পড়ল সেও!
একদিন তাঁর খুব মনখারাপ। পড়তে পড়তে বলছিলেন দু’বছর জেলের কথা, ছেলেবেলায় মাকে হারানোর কথা। ভবার হাতে মায়ের লেখা ডায়েরি তুলে দিলেন। পাতা উল্টে চোখে জল ভবার!
সেই প্রথম নিবেদন! ‘‘লক্ষ্মী! আমি তোমার জন্য সব করব।’’
মুগ্ধতায় অপলক দু’জন! দেরি হয় রিহার্সালে। দু’জনের ঘনিষ্ঠতার নানা কথা ওড়ে হাওয়ায়। বাড়ির নিষেধ, গণনাট্যের গুঞ্জনের তোয়াক্কা না করে স্কোয়াড বদলে নেন সুরমা। রোজ ঋত্বিকের বাড়িতে যান পড়তে। ফিরতি পথে ভবা বলেন হাওড়বিলের গল্প, ময়মনসিংহ আর রাজশাহীর কথা। ‘বেদেনী’র কথা।
সন্ধেরাতের গলিপথে হাঁটতে হাঁটতে একদিন বাঁশির শোক আর তানপুরার জলধ্বনি।
‘‘বেকার যুবকের ঘর বাঁধার স্বপ্নের ছবি ছিল ‘নাগরিক।’ গাঁটের কড়ি খরচ করে আমরা তুললাম জানো। ভূপতি নন্দী বাড়িটা মর্টগেজ দিল। কে যেন প্রভিডেন্ট ফান্ড ভাঙল। শেষ রক্ষা হল না! ছবির গল্পে ছিল রামু নামে এক যুবক। সে রোজ ঘরের একটি ক্যালেন্ডারের ছবির দিকে তাকিয়ে দেখে, আর রাতে দূরে এক বেহালাবাদকের ছড় টানার শব্দ শুনে ঘুমিয়ে পড়ে।’’
‘‘কাগজে খুব বিজ্ঞাপন দেখেছি। মুক্তি পেল না কেন?’’
‘‘হা হা হা! হয়তো পাবে কখনও! শুনেছ পার্টি আমার বিরুদ্ধে ওয়ান ম্যান কমিশন বসিয়েছে। কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত তার মেম্বর!’’
‘‘জানি। সে দিন ‘নীচের মহল’ নাটকের রিহার্সাল থেকে ফিরছি, মামি বলল। পার্টি তোমাকে এক্সপেলড করবে! উমানাথদা, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, মমতাজ আহমেদ খান সকলে নাকি তোমার বিরুদ্ধে চার্জের সমর্থন জানিয়েছে!’’
‘‘তারপরও তুমি...!’’
‘‘দেরি হয়ে যাচ্ছে চলো।’’
‘‘লক্ষ্মী!’’
‘‘কমরেড জ্যোতি বসু তোমার পক্ষে। কিন্তু এই পার্টি, আইপিটিএ, তেইশটা চার্জ কোনও কাজ করতে দেবে না! নতুন দল করো। গ্রুপ থিয়েটার!’’
‘‘লক্ষ্মী! তুমি কি আসবে? তোমাকে পেলে জীবনটা গুছিয়ে আরম্ভ করব!’’
‘‘আসব!’’
গলির বাঁকে অন্ধকারে ওরা হারিয়ে যায়। হাওয়ার হল্লায় ওদের দু’জনের কথা আর উপকথন আর শোনা যায় না! শূন্যে পাক খেয়ে ওড়ে ভবার বিড়ির ধোঁওয়া! ভবা কিছুতেই যেন স্বস্তি পান না। শান্তি নেই কোথাও! উৎপলের পরিচালনাতে ‘বিসর্জন’ করেছিলেন। রঘুপতি।
লক্ষ্মীকে এগিয়ে দিয়ে ফিরতি পথে গলির অন্ধকারই যেন হয়ে ওঠে রস্ট্রাম।
ভবা বলেন, বলে চলেন, ‘‘পাষাণ ভাঙিয়া গেল জননী/ আমায় এ বার দিয়েছ দেখা প্রত্যক্ষ/ প্রতিমা। জননী অমৃতময়ী!’’

‘সংঘাত অনিবার্য।’ এ পক্ষ, ও পক্ষ ভাগ হয়ে গিয়েছে। জর্জ ওদের কথা শোনে।
এক শনিবার, সন্ধেয় গোপন মিটিং, ঋত্বিক হাজির দুপুর তিনটেতেই। অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন। মাথার চুল মুঠো করে ধরা। একবার এই মোড়া, একবার ওই মোড়া। জর্জ আর থাকতে না পেরে বললেন, ‎‘‘আঃ! স্থির হইয়া বোসো না।’’ 
‘‘সবাই আসবে তো!’’
‘‘খবর পাইছে হক্কলে, আইবে কিনা কইতে পারি না।’’
‘‘সেইটাই প্রধান সমস্যা। বুঝলা, কেউ কারও মনের ভিতরটা জানে না।’’ একই কথা বার বার বলতে বলতে মাথা ঝাঁকাচ্ছেন ঋত্বিক। মোড়ায় বসে, পা-টা তুলে দিয়েছে খাটের ওপর। শীর্ণ, শিরা-ওঠা পায়ে কাদার ছোপ। অস্থিরভাবে পায়ে আঙুল নাড়তে নাড়তে সে বলেই চলেছেন, ‘‘ভাঙনের জয়গান, বুঝলে... ভাঙনের জয়গান! আমি একটু পার্কে ঘুরে আসি। মুক্ত বাতাস দরকার। অন্ন চাই, প্রাণ চাই, চাই মুক্ত বায়ু!’’ ঝোলা কাঁধে উঠে দাঁড়ান ঋত্বিক। জর্জ জানেন ওই ঝোলায় কী আছে!
বললেন, ‘‘মুক্ত বায়ু, না বোতল-বদ্ধ তরল! আমি সব জানি। আমার ঘরে হেই সব চলবো না। তুমি যাও, পার্কে বইস্যা যা খুশি করো।’’
মিটিং ভন্ডুল! সাড়ে সাতটার সময় ঋত্বিক ফিরলেন। টালমাটাল। কোনওমতে টাল সামলে জর্জকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘মিটিং হইল না? ডিসিশান দাও, দুই বছর এপাশ-ওপাশ ভালো লাগে না। ডিসিশান চাই... কোন পক্ষে যাব, কোন দলে? বলো, বলো?’’
জর্জ চলে যেতে বলেন ঋত্বিককে। তাঁর গলা কেঁপে ওঠে। ঋত্বিক চলে যান।
গলির আলো-অন্ধকারে দীর্ঘ চেহারাটা হারিয়ে যায়। ঘাড় কাত করে তার চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে থাকেন জর্জ। পিছনে পড়ে থাকে ১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের জর্জের একলা ঘর। একটু পরে হারমোনিয়ামের সামনে বসেন জর্জ। গেয়ে ওঠেন শ্রাবণের গান, ‘‘আমার যে দিন, ভেসে গেছে। চোখের জলে, আমার যে দিন...!’’

কোথায় যাবেন ভবা এখন?
তৃপ্তি থেকে আকণ্ঠ পান করে পথের রোদ-ছায়ায় হাঁটছেন। ভবানীপুরের জগুবাজারের সামনে হাঁটতে হাঁটতে পা টলছে তাঁর। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে কিনলেন দুটি পদ্মফুল। ‘‘কী করবি ভবা?’’
হাসেন ভবা। কাঁধের ঝোলায় ফুলগুলি যত্নে ভরে রাখতে রাখতে বলেন, ‘‘লক্ষ্মীকে দিতে হবে, পদ্মের মতো যার মন তাকেই ত দেব!’’
প্রথম প্রেমের চিঠিতে লক্ষ্মীকে লিখছেন, ‘‘মাসিক একটা আয়ের সংস্থান করা প্রথম কর্তব্য। নইলে জীবনে স্নিগ্ধতা আসবে না।’’ কখনও লিখছেন, ‘‘...আমাকে অ্যাট অল কোন মেয়ের ভাল লাগে কি করে- আমার নোংরা পা, বিড়ি ও হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে বসাসমেত। ... আমি তোমার মোটেই উপযুক্ত নই, মিছিমিছি তোমাকে ডোবাচ্ছি। ‘লক্ষ্মী’ মহিলাটি জলে পড়লেন।’’
দু’জন ঠিক করলেন বিয়ে করবেন! পরস্পরকে জানার সেই চিঠিতেই জানাচ্ছেন পার্টির খবর, উৎপলের খবর, গীতা ঘটকের ‘সাঁকো’-র রিহার্সালে আসার খবর। বোম্বে থেকে চাকরির সুখবর এল তখনই। সলিল চৌধুরী তার করলেন ঋত্বিককে। ফিল্মিস্তানের চাকরি হল ভবার। ১৯৫৫-র বৈশাখে হল বিয়েও!
বোম্বেতেই ‘মধুমতী’র শুটিং-এ আলাপ দিলীপকুমারের সঙ্গে।
জমিয়ে আড্ডা জুহু বিচে বলরাজ সাহনির বাড়িতে। কিন্তু স্বস্তির জীবন যে ভবার নয়!
বিমল রায়ের ‘মধুমতী’ ও ঋষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘মুসাফির’-এর চিত্রনাট্য লিখতে লিখতেই সুরমাকে লিখছেন, ‘‘দশটা-পাঁচটা গিয়ে বসে থাকতে হবে। ... দাঁতে দাঁত চেপে শুধু পয়সার জন্য এখন চেষ্টা করা।... দেখো লক্ষ্মী এ জীবন আমাদের নয়। ... এসব ছেড়ে দেব। এ হবে না!’’
ছেড়ে দিলেন চাকরি!
ফের বেকার! কলকাতায় ফিরে আবার হাত দিলেন ছবিতে। সুবোধ ঘোষের কাহিনি অবলম্বনে ‘অযান্ত্রিক’। চরিত্র বলতে জগদ্দল আর বিমল। ঝরঝরে একটি শেভ্রোলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নেতারহাট, রাঁচি, ঝরিয়ার রুখা-শুখা প্রকৃতির মাঝে। ছবির সঙ্গীত করলেন আলি আকবর খান। স্মৃতি থেকে সুরমা লিখছেন মিউজিকের রেকর্ডিং-এর কথা। ‘‘বিরাট অর্কেষ্ট্রা, অনেক লোকজন। আছেন আলি আকবর খান, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিশিরকণা ধরচৌধুরী।... পরিচালক ও আলি আকবর খান মাঝে মাঝে একটু একটু মদ্যপান করছেন। শেষ রাতে নেশা কমলেও কাজের বিরতি নেই। ভোর হয়ে আসে!’’
ছবি মুক্তি পেল, উচ্ছ্বসিত দর্শক!
জীবনে সেই প্রথম সংবর্ধনা পেলেন ঋত্বিক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জনপ্রিয় হল পরের বছর শিবরাম চক্রবর্তীর ছোটগল্প অবলম্বনে তাঁর ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবিও। খালেদ চৌধুরীর আঁকা পোস্টার-হোর্ডিং এখনও কলকাতার স্মৃতির আকাশে। 
গল্পের ঋত্বিক 
আর পাঁচজন বাঙালির মতো প্রেমের কবিতা দিয়েই ঋত্বিকের লেখালিখির হাতেখড়ি। প্রথম গল্প বের হয় ‘গল্পভারতী’তে। সেটা ১৯৪৭ সাল। আর সে বছরই ‘অভিধারা’ নামে একটি কাগজ বের করলেন তিনি। পর পর গল্প লেখেন সেই নিজের কাগজেই। নাটক-উপন্যাস লিখলেন আরও পরে। সে সময় তাঁর গল্প প্রকাশ হয় ‘দেশ’, ‘অগ্রণী’, ‘শনিবারের চিঠি’-তে। তাঁর নিজের দাবি, ৫০টি গল্প লিখেছিলেন। তারমধ্যে উল্লেখ্য ‘চোখ’, ‘কমরেড’, ‘গাছ’, ‘অয়নান্ত’, ‘আকাশগঙ্গা’ প্রভৃতি। বেশিরভাগ গল্পেই এসেছে দেশভাগ, কাঁটাতার, দুই বাংলার বিক্ষুব্ধ সময়ের কথা। আছে প্রেমও। কোনও কোনও গল্প নিছক কবিতাও। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘চারপাশে যে সমস্ত খারাপ বদমাইশি অত্যাচার ইত্যাদি দেখেছি তার রাজনৈতিক জীব হিসাবে সোচ্চার প্রতিবাদ করার ইচ্ছে থেকেই গল্প লেখায় আরজ্ এসেছিল সেই ছোট বয়সেই।’’ আর কাঁচা বয়সের গল্প পড়েই নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ঋত্বিককে ‘শক্তিমান নবীন লেখক’ বলেন।

‘‘নীতাকে বাঁচিয়ে রাখো!’’
‘‘নীতা বেঁচে কী করবে! ওকে মেরে ফেলতেই হবে!’’
রোজ শিলং পাহাড়ের উপর ঝগড়া চলছে ছবির প্রযোজক মহেন্দ্রজি আর পরিচালক ঋত্বিকের। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-এর পরে ফের ক্ষয়িষ্ণু জীবনের কাছে ফিরে এলেন ঋত্বিক। ছিন্নমূল‌ মানুষের কলোনিতে ফের তাঁর ক্যামেরা আঁতিপাঁতি ধরল ক্ষয়-জীবন।
শক্তিপদ রাজগুরুর কাহিনি নিয়ে ‘চিত্রকল্প’-এর প্রযোজনায় শুটিং শুরু করলেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’র।
একদিন শুটিং-এ বেশ রাত। চারদিক শুনশান। ক্যামেরা রোল করছে। নীতার কাশি হচ্ছে। কাশির গমকে গমকে রক্ত বের হচ্ছে। ঋত্বিক নির্দেশ দিচ্ছেন সুপ্রিয়াকে, ‘দু’ তিন স্টেপ এগিয়ে আয়। আকাশের দিকে তাকা। বাঁদিকে মুখটা ফেরা। চোখ ডান দিকে।’ হঠাৎ একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। ঋত্বিক চিৎকার করে উঠলেন কাট! তারপর, সুপ্রিয়াকে বললেন, ‘‘ছেমরি আজ প্যাক-আপ। বাড়ি যা।’’
শেষ হল ‘মেঘে ঢাকা তারা’র কাজ। ছবি সেন্সর হচ্ছে। বোর্ডের সদস্য তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবি দেখে বেরিয়ে ঋত্বিককে বললেন, ‘‘মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা ছাড়া কী আর ছবি হয় না?’’
একবগ্গা ঋত্বিক। তাঁর উত্তর, ‘‘আপনার কাছে যা বাস্তব, তা হয়তো আমার কাছে নয়।’’ এর পরেই নিজের গল্প নিয়ে করলেন ‘কোমল গান্ধার।’ সেখানে ঘুরে ফিরে ভৃগু আর অনসূয়ার গল্পে বললেন নিজের দীর্ণ জীবনের কথাই। ছবি মুক্তি পেলে, চূড়ান্ত সমালোচিত হল ঋত্বিকের বামপন্থী বন্ধুদের কাছে! পার্টি সমালোচনা করল ‘সুবর্ণরেখা’-ও! বলা হল, ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে ‘বুর্জোয়া নৈরাশ্যবাদ প্রচার করা হয়েছে।’ হতাশায় ভেঙে পড়লেন ভবা, শুরু হল দিনভর নেশা।
সুরমা লিখছেন, ‘‘সুবর্ণরেখা মুক্তি লাভ করল না। তখন থেকে শুনতাম আমি মারা যাব। মাইকেল মধুসূদন, প্রমথেশ বড়ুয়া, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই মারা যাব। কেন এই মৃত্যু? আমি তা জানি না।’’ কখনও সুরমাকে বলছেন, ‘‘লক্ষ্মী, আমি মরে যাব। আর দু’বছর!’’
কখনও বলছেন, ‘‘এক বছর!’’

পঁয়ষট্টি থেকেই সারা দিনমান ডুবে থাকেন চোলাই মদে। তার আগে যখন ‘বগলার বঙ্গদর্শন’ করছেন, সকলেই ভবাকে নিয়ে খুব চিন্তিত। তিনি যাতে কালীঘাটের পোটোপাড়ায় চোলাইয়ের ঠেকে যেতে না পারেন কিংবা ভবানীপুরের গাঁজা পার্কে, সকলেরই খেয়াল সেদিকে। পুণায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে যখন পড়াবার ডাক এল, ভেবেছিলেন নতুন করে শুরু করবেন। সেও আর হল না!
সুরমা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাবার কাছে শিলং-এ গেলেন।
বম্বে থেকে তাঁকে লিখছেন, ‘‘এখানে সম্মান, বাঁধা মাইনে এবং মনের মতো কাজ। ... ইন্দিরা গান্ধীও অনেক কিছু করেছে আমার জন্যে, গিয়ে বলব।’’ ভাইস প্রিন্সিপ্যালও হলেন। নেশার খপ্পরে সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল!
চূড়ান্ত অস্বাভাবিকতা নিয়েই চাকরি ছেড়ে একদিন শিলং-এ হাজির। শ্বশুরমশাইকে বললেন, সুরমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। হাজারটা টাকা দিতে! নাগাড়ে ১৭ ঘণ্টা ধরে ‘পণ্ডিতমশাই’-এর গল্প লিখে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। হ্যালিউসিনেশন! ভবাকে ভর্তি করা হল হাসপাতালে। সেই চরম সময়ে পাশে ছিলেন উত্তমকুমার, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তম ‘বনপলাশীর পদাবলী’ করবার জন্য টাকা দিলেন।
কিন্তু ভবার যে আর কোনও কাজে মন নেই। এখন তাঁর বিটোফেনের সিম্ফনি শোনার দিন। একের পর এক রেকর্ড বেজে চলেছে। কখন আব্বাসউদ্দিন শুনছেন, কখনও শচীনকর্তা। আর প্রায়ই রবি‌ঠাকুর।
‘‘রাস্তায় ঋত্বিকবাবু অজ্ঞান হয়ে গেছেন! মুখের ভিতরে একটা টাকার নোট!’’
সুরমার সেদিন কলেজের শেষ ক্লাস। ছুটতে ছুটতে খবর দিল দুটি ছেলে। চারদিক অন্ধকার দেখলেন সুরমা! পাগলের মতো ছুটছেন তিনি। ভবাকে ভর্তি করা হল হাসপাতালে। ভবা তখন দাড়ি রাখছেন। অসংলগ্ন কথা বলছেন,
‘‘দশটা টাকা হবে ডাক্তার? না খেলে সুস্থ হব কী করে! একটু তো খেতেই হবে, নাকি। পারছি না বিশ্বাস করুন। কাজ করতে পারছি না। মাথা কাজ করছে না তো! একটু বাইরে যেতে দিন!’’ নেশা থেমে রইল না !
তুষারবাবুকে বলেছিলেন হাসপাতালে বাংলা মদ জোগাড়ের গোপন কাহিনি।
‘‘কেমনভাবে জোগাড় করতেন?’’
‘‘খুব সোজা। পায়খানার দেওয়ালের দুটো ইট সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। সেখানে হেড সুইপার এক বোতল মদ রেখে যেত। আর খাওয়ার পর আবার ইট লাগিয়ে দিতাম।’’
‘‘টাকা কে জোটাত!’’
‘‘কিছু ভিজিটর তো আসত নাকি! তারা ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করত। কিছু টাকাও রেখে যেত। সে সময় উত্তম আর রমাও এসেছে।’’
‘‘রমা মানে সুচিত্রা সেন?
‘‘ইয়েস স্যার। সুচিত্রা সেন। এর আগে তাঁর বালিগঞ্জ সাকুর্লার রোডের বাড়িতে ছবির বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর উত্তমের ইচ্ছে ছিল টলস্টয়ের রেজারেকশন অবলম্বনে একটি ছবি করা। তাই তারা চাইছিল আমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হই আর ছবি করি। কাজ করি।’’
কাজ করেছিলেন। একটু সুস্থ হয়েই গোবরার হাসপাতালে বসেই ঋত্বিক ‘কুমারসম্ভব’-এর অষ্টম সর্গ নিয়ে পড়লেন। আবার লিখলেন ‘সেই মেয়ে!’ হাসপাতালে নাটকটি অভিনয়ও করালেন অন্য রোগীদের দিয়ে, নিজেও অভিনয় করলেন!
কিন্তু ছাড়া পেয়েই, ‘লক্ষ্মী, টাকা দাও। দশটা টাকা। এই শেষ!’

শেষ পর্যন্ত আর পেরে উঠলেন না সুরমা!
’৬৯-এ কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান দিল। এর পরে তাঁর মদ্যপানের মাত্রা যেন বেড়ে গেল। খালাসিটোলায় নিত্যসঙ্গী সন্তোষকুমার ঘোষ, সমরেশ বসু।
আমরা শুনি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-র অবিকল সেই বিচ্ছেদ সংলাপের প্রতিধ্বনি।
‘‘কোনও জিনিসের দরকার আছে নাকি?’’
‘‘শুধু বই ও রেকর্ডগুলো থাক!’’
‘‘বই ও রেকর্ডগুলো রেখে গেলেই বিক্রি করে মদ খাওয়া হবে। তাই ওগুলো দেব না। ছেলের জন্য যত্ন করে রাখব। বড় হয়ে পড়বে ও শুনবে।’’
‘‘তা হলে শুধু পাখাগুলো থাক।’’
সুরমা লিখছেন, ‘‘আমি রাজি হই। যদিও জানতাম, চলে গেলেই বিক্রি করে মদের বোতল আসবে।... চলে আসার সময় কী আকুল দৃষ্টি! তবু, এসে ট্যাক্সিতে উঠি। কী করব, আমি মা! তিনটি ছেলেমেয়েকে তো আমাকে রক্ষা করতেই হবে।’’
৭১-এর ১ জানুয়ারি সংসার দু’ভাগ হয়ে গেল। স্কুলে চাকরি নিয়ে সাঁইথিয়া চলে গেলেন সুরমা!
একা হয়ে গেলেন ভবা!
একা!

মাস পাঁচেক পরে বোম্বে থেকে সাঁইথিয়ায় চিঠি এল পঁচিশে বৈশাখ। ‘‘আসছি। চার পাঁচদিন জ্বালাব। না, শান্তিনিকেতনে থাকব। একবার করে দেখে যাব। তারপর রামপালান পালাব। চিরকালের মতো। দেখি, পারি কিনা।’’ চিঠির শেষে লিখলেন, ‘‘ঘৃণা-ঋত্বিক!’’
সেই পালালেন!
গোছানোই ছিল সুটকেস।
নতুন জামাকাপড়, নতুন সাবান, তোয়ালে। শেভিং সেট। সবার উপর কালো জহরকোট। সেটা পরেই যুক্তি তক্কোতে শুটিং করেছিলেন। সুরমা বার বার নিষেধ করতেন, ওই কোট আর না পরতে। শুনে সে কি প্রচণ্ড অট্টহাসি!

এখনও যেন হাসছেন।
জহরকোটের উপর হাত রেখে হেসে ওঠেন। বলেন, ‘‘লক্ষ্মী তো আমার মারা যাওয়া সহ্য করতে পারে না, তাই জহরকোটটি দেখতে পারে না।’’
‘‘প্লিজ আর খাবেন না!’’ নিষেধ করেন ডাক্তার। বেপরোয়া ঋত্বিক!
‘‘হয়নি, কিছু হয়নি। আরও একটু চাই।’’

হাসপাতালের বেডে শুয়ে সারাক্ষণ স্মৃতির পথে হাঁটেন ভবা। সতত পোড়েন স্মৃতির ধূপে! ‘‘যখন ‘জ্বালা’ লিখেছিলাম, তখন জানতাম না কাশির সঙ্গে রক্ত কেমন করে ওঠে... আর আজ! আর বাঁচতে চাই না। এই শুয়োরের বাচ্চার দেশে বেঁচে লাভ কি?’’
নাগাড়ে কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে ওঠেন! কখনও রক্তবমি।
এমন অসুস্থতা সঙ্গে নিয়েই করলেন শেষ দুটো ছবি। জলে ভিজে, রোদে পুড়ে ওপারে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, আর এপারে ‘যুক্তি-তক্কো-গপ্পো।’ কিন্তু ধকল নিতে পারলেন না আর!
ঢাকা থেকে দুঃসংবাদ এল ঋত্বিক অসুস্থ। চিন্তিত কলকাতা। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন সত্যজিৎ রায়। মৃণাল সেন নিজে গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিলেন। ফিরলেন। তার পর একদিন বাংলাদেশে মুক্তি পেল ‘তিতাস একটি নদীর নাম।’ ভবা তখন হাসপাতালে।
জানলার বাইরে হাতছানি দিয়ে কে যেন তাকে বার বার ডাকে। হাত ধরে নিয়ে যায় আদিগন্ত পদ্মার চরে। জল ঠেলে ঠেলে নৌকো টেনে চলেছে পটনা-বাঁকীপুর-মুঙ্গেরের মাল্লারা। উদাস, রোগজর্জর ভবা দেখছে, ইলশাগুঁড়ি প্রথম বর্ষায় কেমন খুশিতে মাতোয়ারা মাঝি-মাল্লারা। জলমাখানো হাওয়ায় ভেসে তারা সুর ছাড়ে। ভবা পাগল সুরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে স্টিমারের ছাদে। দোল খায় মাতাল নদীর দাপটে। কান পেতে সে শোনে ‘এঞ্জিনের ধস-ধস, সারেঙ্গের ঘণ্টি, খালাসির বাঁও না মেলা আর্তনাদ!’

একটু সুস্থ হলেই বেরিয়ে পড়ছেন হাসপাতাল থেকে।
তখন রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে এক দোকানির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। খুবই অসুস্থ। তবু ছুটলেন তথ্যচিত্র তুলতে শান্তিনিকেতনে। রামকিঙ্কর।
গোটা গোটা দিন যায়। কিঙ্করের সঙ্গে বাংলা মদে ডুবে দু’জনে শিল্পের গভীর তত্ত্ব আলোচনা করেন।
ছবি এগোয় রয়ে সয়ে! ফের হাসপাতাল। সুরমার সঙ্গে সাঁইথিয়ায় গিয়ে দেখা করে এলেন। সেই শেষ দেখা!
গলির মুখে মিলিয়ে যাচ্ছে কালো জহরকোট, ল্যাকপেকে–লম্বা শরীরটা। যেতে যেতে নিজের মনেই বলছেন, ‘‘লক্ষ্মী! টাকা থাকবে না। কাজটাই থেকে যাবে। তুমি দেখে নিয়ো, আমি মারা যাওয়ার পর, সবাই আমাকে বুঝবে!’’

উনিশ দিনেই সব শেষ!
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ভবা। চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসছে চরাচর।
ঝাপসা পদ্মার বাঁধ, মেঘনার চর, ভৈরব বাজার। কবে যেন লিখেছিলেন, ‘‘বুড়িগঙ্গা, বহুদিন তোর কোলে মাথা রাখিনিকো!’’
মৃণাল সেন খবর পাঠালেন সুরমাকে। কলকাতার হাওয়ায় ছড়াল শোকসংবাদ। পিজির সামনে অগণিত মানুষের ঢল। কেউ রবিঠাকুর ধরল, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি, ভাঙল ঝড়ে।’ ভবার প্রিয় গান!
স্টুডিয়োপাড়া হয়ে শবযাত্রা এগিয়ে চলল ঘাটের দিকে।

ঋণ: ‘ঋত্বিক’ ও ‘ঋত্বিক পদ্মা থেকে তিতাস’ সুরমা ঘটক, ‘কবিতীর্থ’ ঋত্বিক ঘটক সংখ্যা, ‘ঋত্বিক ঘটক’ সম্পাদক রজত রায়, ‘জর্জ’ বাসব দাশগুপ্ত, ‘টপ্পা ঠুংরী’ পূর্ণেন্দু পত্রী, ‘ঋত্বিকদা, সলিলদা’ তুষার তালুকদার, ‘ঋত্বিকতন্ত্র’ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, ‘১৬টি সাক্ষাৎকার’