আ-উ-ট! আ-উ-ট! আ-উ-ট! প্রথম বলেই ইন্দ্রপতন। উইকেটরক্ষক জেফ দুঁজোর দস্তানায় প্রাণ জমা দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন ক্রিকেট-সম্রাট সুনীল মনোহর গাওস্কর। সোনা ঝরা রোদের এই শীতের সকালে কাতারে কাতারে দর্শক এখনও আসন পাওয়ার প্রতীক্ষায়। তার আগেই সিংহাসনচ্যুত তাঁদের অধীশ্বর। স্তম্ভিত ইডেন উদ্যান। বাকরুদ্ধ ক্রিকেটের নন্দনকানন। লক্ষ লক্ষ হৃদয়ের কল্লোল নিমেষে বদলে যাচ্ছে প্রিয়জন হারা হাহাকারে...
ইডেনে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট ম্যাচ। প্রথম দিন। সময়টা আশির দশকের গোড়া।
দিন শুরু করেছিলেন বোলার ম্যালকম মার্শাল। ও প্রান্তে ব্যাট হাতে সুনীল গাওস্কর।
প্রথম বল। খেলতে গিয়ে মিস করলেন গাওস্কর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দর্শক শুনলেন তারস্বরে চিৎকার। হা-উ-জ দ্যা-ট! আম্পায়ারের আঙুল তোলার অপেক্ষা না করে প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটা দিলেন সুনীল।
কমেন্ট্রি বক্সে কমল ভট্টাচার্য
তার পরই বেতার তরঙ্গে ভেসে এল চিকন গলায় ওই ধারাভাষ্য।
এই অননুকরণীয় বিবরণ কার, বলতে এক মুহূর্ত সময় নেবেন না, এমন বাঙালি আজও অসংখ্য। হ্যাঁ, অজয় বসু।
’৭৬-এর ইডেন। ভারত বনাম ইংল্যান্ড। একনাথ সোলকারের ঢিমে লয়ের ব্যাটিং-এ বিরক্ত গোটা মাঠ।
তাঁর এক হাত দূরে সিলি পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ইংরেজ অধিনায়ক টনি গ্রেগ।
হঠাৎ এগিয়ে এলেন তিনি। সোলকারের কাছ থেকে ব্যাটটা চেয়ে ‘শ্যাডো’ করে দেখিয়ে দিলেন কী ভাবে স্ট্রোক খেলতে হয়। হাসিতে ফেটে পড়ল ইডেন। তাতেও সোলকারের হেলদোল হল না।
পরে ইংল্যান্ডের ইনিংস। এ বার শুরু গ্রেগের ঠুকঠুকানি। তাতে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়ানো সোলকার একই কাণ্ড করলেন।
পরের বলেই বাউন্ডারি মারলেন গ্রেগ। তার পরই দূর থেকে সবাই দেখলেন, গ্রেগ সোলকারকে কী যেন বলছেন!
তখন না ছিল স্টাম্প ক্যামেরা, না বাইশ গজে লুকোনো মাইক্রোফোন। তাতে কী! গ্রেগ-সোলকারের মধ্যে কী চলছিল— কমেন্ট্রি বক্সে বসেই তার কাল্পনিক অথচ অদ্ভুত মুচমুচে সংলাপ বলে গেলেন ধারাভাষ্যকার।— “গ্রেগ বললে, বাপু সোলকার, মাস্টারমশায়ের তো শেখানোটা কাজ। কিন্তু ছাত্রকেও তো তেমন হতে হবে। কাজের কাজটা তো তাকেই করতে হয়। তোমায় শিখিয়ে কাজ হয়নি। দেখো আমি কেমন করে দেখালাম।”
ধারাভাষ্যকার কে? বলতে লাগে না তা’ও। কমল ভট্টাচার্য।
আর তৃতীয় জন?
তাঁর বণর্না ছিল অনুপুঙ্ক্ষ। সামনে ঘটে চলা প্রতিটি দৃশ্যের একটি পলও যেন বাদ দেওয়ার নয়।
পুষ্পেন সরকার।
... “ক্লাব হাউস প্রান্তে প্রস্তুত কপিলদেব। দৌড় শুরু। উইকেটের গা ঘেঁষে ডেলিভারি... গুডলেন্থ বল। বাঁ পা বলের কাছে নিয়ে ব্যাটে-প্যাডে এতটুকু ফাঁক না রেখে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেললেন জাভেদ মিঁয়াদাদ। বল চলে গেল কপিলের কাছে। এ বলেও কোনও রান হল না। রান যা ছিল তাই। দু উইকেটে হারিয়ে পাকিস্তান...!”
বাংলা ধারাভাষ্যের ত্রয়ী। এঁদের সকালটা অবশ্যম্ভাবী শুরু হত অজয় বসুকে দিয়ে।
ষাটের দশক থেকে কমপক্ষে তার পরের পঁচিশ-তিরিশ বছর কখনও শহরের টেস্ট ম্যাচে দিনের প্রথম ডেলিভারির বাংলা ধারাবিবরণী অন্য কারও গলায় শোনা যায়নি।
কিন্তু কেন?
“আসলে সেটা ওঁরা তিন জন মিলেই ঠিক করেছিলেন। আজীবন যার নড়চড় হয়নি। অসাধারণ বোঝাপড়া ছিল ওঁদের,” শ্যামবাজারে বহুকালের পৈতৃক বাড়ির দোতলার অগোছালো ঘরের খাটে বসে বলছিলেন কমলবাবুর ছেলে শ্রীকান্ত ভট্টাচার্য।
তিনজনেই পরবর্তী কালে কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া ভাষ্যকার। অথচ আশ্চর্য, প্রথম যখন ধারাভাষ্যের প্রস্তাব এসেছিল প্রায় উড়িয়েই দিয়েছিলেন কমলবাবু।
কী ভাবে এসেছিল প্রস্তাব?
“বাবা তত দিনে কর্মকর্তা হিসেবে সিএবিতে এরিয়ান ক্লাবকে রিপ্রেজেন্ট করে ফেলেছেন। ক্লাবের ক্রিকেট টিমের কোচও হয়েছেন। অজয়কাকু আবার যুগান্তরে খেলার পাতায় নিয়মিত লেখালেখি করছেন। পরে বাবাও যুগান্তরে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। তবে মার্কেটিং বিভাগে। অজয়কাকু তো বহু দিন যুগান্তরের স্পোর্টস এডিটরও ছিলেন,” বলছিলেন শ্রীকান্ত।
কমেন্ট্রি বক্সের ‘উত্তমকুমার’ অজয় বসুর সঙ্গে সহযোগী কমল
তাঁর কথায়, দু’জনেই শত ঘোষ অর্থাৎ যুগান্তরের অন্যতম মালিক প্রফুল্লকান্তি ঘোষের বন্ধুস্থানীয়। কারও এক জনের কাছে আকাশবাণী থেকে প্রস্তাবটা আসে যুগান্তর অফিসে। সম্ভবত দু’জনের মধ্যে যাঁর কাছে প্রস্তাবটা প্রথম এসেছিল, তিনি-ই অপর জনকে খবরটা দেন। তবে পুষ্পেন সরকার বেশ কিছু দিন পর ওই দলে যোগ দিয়েছিলেন।
সে-সময়ের পোড়খাওয়া ক্রীড়া সাংবাদিকদের কাছে গল্পটা অবশ্য একটু অন্যরকম।
সে ১৯৫৯-৬০ সালের কথা। ইডেনে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার পঞ্চম টেস্ট। তার আগে আকাশবাণী ঠিক করল এ ম্যাচের ধারাবিবরণী দেওয়া হবে বাংলাতে।
কমলবাবু তখন ময়দানে তো বটেই রেডিয়োর অনেকের কাছেই চেনামুখ। আকাশবাণীর তখনকার প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ মুস্তাফি প্রস্তাব পাড়লেন ওঁর কাছে।
শুনেই কমলবাবু ‘না’ করে দেন। ওঁর যুক্তি, ক্রিকেটে এমন সব শব্দ আছে, যার কোনও বাংলা হয় না। এ দিকে মুস্তাফি নাছোড়। — “কেন হবে না, অবশ্যই হবে।”
এ বার অজয় বসুর সঙ্গে কথা বলেন কমলবাবু। অজয়বাবুও সব শুনে বলেন, “না হওয়ার তো কিছু নেই।”
তাই শুনে কমলবাবু নড়েচড়ে বসলেন। এ দিকে হাতে মাত্র এক সপ্তাহ।
পর দিনই রেডিয়োর সঙ্গে চুক্তি করেন ওঁরা। তারপর দুজনে মিলে সোজা চলে যান এরিয়ান মাঠে। সেখানেই ধারাভাষ্যর মকশো করেন। তখনই ঠিক হয়ে যায়, মাঠ, আশপাশ ইত্যাদি নিয়ে বলবেন অজয় বসু। আর ক্রিকেটের টেকনিক্যাল দিক নিয়ে বলবেন কমল ভট্টাচার্য।
ইতিহাসের মুখবন্ধ এমনই।
প্রথম ম্যাচেই দুর্দান্ত শুরু। জনপ্রিয়তা উঠল তুঙ্গে। আর তাঁদের ধারাভাষ্যের ইনিংস যত গড়াতে থাকল তত দেখা গেল, অবিস্মরণীয় সব বাক্যবন্ধ জুড়তে জুড়তে ওঁরা ক্রিকেটটাকে বাড়ির অন্দরমহলে নিয়ে চলেছেন। দিনকয়েকের মধ্যেই বাংলা জনপ্রিয় গানের কলির পাশাপাশি পাড়ার রকে, গেরস্থের সদরে গুনগুন করে জমে উঠল অজয় বসুর ‘ইডেনের গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ’, ‘সবুজ মখমলের মতো ঘাস’ কিংবা কমল ভট্টাচার্যর ‘পিছনের পায়ে ভর করে ব্যাক খেলেছেন’, ‘ব্যাটস্ম্যান দৌড়ে রান চুরি করে নিলেন’-এর মতো ভূরি ভূরি সব বাক্য।
মাইক হাতে পুষ্পেন সরকার (প্রথম সারিতে বাঁ দিকে থেকে দ্বিতীয়) পিছনের সারিতে অপেক্ষায় কমল ভট্টাচার্য (বাঁ দিক থেকে তৃতীয়)
“আসলে এ রকম কথাগুলো বাবা বা অজয়কাকু খুব যে ভেবেচিন্তে বলতেন তা কিন্তু নয়। মনে আছে, বাবা এক বার ঘরোয়া আড্ডায় এমনও বলেছিলেন, ‘পিছিয়ে এসে ব্যাক খেলেছে’ বলে আমি নিজেই পরক্ষণে বুঝতে পেরেছিলাম কথাটা একটু হাস্যকর হয়ে গেল। কিন্তু যখন দেখলাম তার পরের কয়েক দিনেও কেউ তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্চ্য করলেন না, উল্টে কেউ কেউ এ’ও বললেন তাঁরা নাকি অন্য রকম মজা পেয়েছেন, তখন ভাবলাম, ব্যাপারটা বেশ খেয়েছে!” এত বছর পর ফাঁস করলেন প্রয়াত কমল ভট্টাচার্যের ষাটোর্ধ্ব ছেলে।
যাঁর ক্রিকেট-ফুটবল, দু’টো খেলারই অনেক বার ধারাবিবরণী দিয়েছেন অজয়-কমল-পুষ্পেন, সেই চুনী গোস্বামী বলছিলেন, “এঁদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, ক্রিকেট খেলাটাকে বাঙালির রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দিতে পারা। কমলদা-অজয়দার বাংলা কমেন্ট্রি শুনে বাঙালি বাড়ির গিন্নিরাও ক্রিকেটটা শিখে ফেলেছিল।”
বাংলা ধারাভাষ্যের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের তুলনা করতে গিয়ে চুনী এ বার বললেন, “কমলদার ছিল ওঁর মিষ্টি স্বভাবের মতোই মিষ্টি ধারাবিবরণী। মেয়েদের মধ্যে অজয়দার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল কমলদার কমেন্ট্রি। আমি এ রকম অনেক পরিবারকে চিনি, জানি।”
চুনী গোস্বামীর মনে আছে, ১৯৬৯-৭০-এর রঞ্জি সেমিফাইনালে মহীশূর ম্যাচে বাংলা দলের ম্যানেজার হয়ে গিয়েছিলেন কমল ভট্টাচার্য। দলে ছিলেন চুনী। তখন আরও বেশি করে ওঁর কোমল স্বভাবের ছোঁয়া পেয়েছিলেন উনি।
চুনীর কথায়, তাঁর স্বভাবের সঙ্গে কোথায় যেন মিলে যেত ওঁর বলাটাও। আটপৌরে, ঘরোয়া। সাধারণ বাঙালি বাড়িতে যে ভাবে বাবা-কাকা, মা-জেঠিমা, ভাইবোন নিজেদের মধ্যে কথা বলে, কমল ভট্টাচার্যর কমেন্ট্রি ছিল অনেকটা সেই ধাঁচের। কমলবাবুর জীবন জুড়ে ছিল বৈঠকী-পনা, অনাড়ম্বর মেঠো ভঙ্গি। সেই স্বাদও মিশে যেত তাঁর ধারাভাষ্যে।
এ মত কখনওই অস্বীকার করার নয়। ১৪/এ মোহনলাল স্ট্রিট। কমলবাবুর ডেরা। যে ডেরায় আড্ডা, গানবাজনা, ছুটির দিনের সকালে চুটিয়ে তাস খেলা ছিল নিত্যকার ব্যাপার। এ বাড়ি থেকে অজয় বসুর বাগবাজারের গ্যালিফ স্ট্রিটের বাড়ি ছিল খুব কাছে। দু’জনের প্রায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল একে অন্যের বাড়ি। বরং পুষ্পেন সরকারের বাড়ি ‘খেলাঘর’ বেশ দূরে। বারাসত।
‘কমলদা’র বাড়ির তাসের আড্ডায় মাঝে মাঝেই দেখা যেত পঙ্কজ রায়কে।
ইডেনে টেস্ট খেলতে এলে মুস্তাক আলি, লালা অমরনাথ একবার না একবার ও বাড়ি ঢুঁ মারতেনই। পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ও যে কত বার আড্ডা দিয়েছেন সেখানে, গুনে শেষ করা যাবে না। আর আসতেন গানের জগতের মানুষেরা!
লেন হাটনের আপ্যায়নে সান্ধ্য-আড্ডার সেই আসর
কমলবাবুর ছিলেন আরও দুই ভাই। সুরকার নির্মল ভট্টাচার্য আর গীতিকার অনিল ভট্টাচার্য। ওঁরা মোহনলাল স্ট্রিটের বাড়িতেই থাকতেন। ওঁদের কাছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র থেকে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, ধনঞ্জয়-পান্নালাল, সতীনাথ-উৎপলা, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র— কে না আসতেন! বাড়িতে হামেশাই গানের আসর বসত। এই মজলিশি আবহাওয়াটা কি কমল ভট্টাচার্য বয়ে বেড়াতেন তার সংলাপে? হয়তো তাই।
যে জন্য হয়তো’বা মাঠে হঠাৎ একটা কুকুর ঢুকে গেলেও তাঁর বলার আওতায় চলে আসত, “বিশ্বনাথ ব্যাট উঁচিয়ে সারমেয়টিকে বললে, অনেক তো ছোটাছুটি করলে, এ বার আমায় একটু দৌড়তে দাও।” ঠিক এ ভাবেই তাঁর ধারাভাষ্যে ঢুকে পড়ত মাথার ওপর দিয়ে গোঁ গোঁ করে চলে যাওয়া উড়োজাহাজ, আকাশে লাট খাওয়া কোনও ঘুড়ি কিংবা ঘাসের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলা একটা পাখি।
চুনী গোস্বামী বলছিলেন, “তুলনায় অজয় বসু অভিজাত, ভারিক্কি। বেছে বেছে শব্দ বলতেন। যে জন্য অনেক সময় কারও কারও কাছে একটু খটমট লাগত অজয়দার ধারাবিবরণী। তেমনি আবার অনেকের মুখে এ-ও শুনেছি, অজয় বসুর বাংলা ভাষার ওপর যা দখল, যে রকম সাহিত্যপ্রবণ মানসিকতা ছিল, তাতে কমেন্ট্রি লাইনে না গেলে হয়তো সাহিত্যিক হতেন!”
ঠিক একই রকম কথা বলছিলেন নীলিমেশ রায়চৌধুরী। বাংলা ধারাবিবরণীর তিন মহাতারার সঙ্গেই মাইক ‘শেয়ার’ করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। বলছিলেন, “আজও মনে পড়ে তিরানব্বইয়ে হিরো কাপ ফাইনালে অজয়দার সঙ্গে ধারাভাষ্য দেওয়া।”
নীলিমেশের মতে, “অজয়দার ভাষার ওপর দখল ছিল যে কোনও বাংলা ভাষাবিদের মতোই। এত বিকল্প শব্দের ভাণ্ডার ছিল ঝুলিতে! জায়গা মতো ঠিক শব্দটা ব্যবহারে জুড়ি ছিল না।”
তার সঙ্গে বিচিত্র সব ঘটনার অনুষঙ্গ জুড়ে অদ্ভুত সব মোচড়। ষাটের দশকের এমনই এক ধারাবিবরণী যেমন অনেক প্রবীণ সাংবাদিকের কানে আজও বাজে।
ইংল্যান্ড টেস্ট খেলছে ইডেনে। এমএল জয়সীমার ব্যাটের দাপটে ছত্রখান ইংরেজ-আক্রমণ। সেঞ্চুরির একেবারে কাছে এসে বিশাল ছক্কা হাঁকালেন জয়। ধারাভাষ্যে অজয় বসু। বললেন, “শুনেছি কাল আগুন লেগেছিল ইডেনে গ্যালারির কোনও এক অংশে। আজও আগুন। তবে এ দিন আর গ্যালারিতে নয়, আগুন লেগেছে জয়সীমার ব্যাটে।” আসলে আগের দিনই খড়ের ছাউনি দেওয়া গ্যালারিতে আগুন ধরেছিল। অজয় বসু তাকেই ধার করে জুড়ে দিলেন তাঁর ভাষ্যে।
এই ‘ত্রয়ী’র দলে পুষ্পেন সরকার ইউনিক ছিলেন তাঁর পরিসংখ্যান দেওয়ার ক্ষমতায়।
সব মিলিয়ে এই ত্রিবেণী সঙ্গমে যা দাঁড়িয়েছিল, তা হল— টেস্টের কোনও বড় টেকনিক্যাল ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার পড়লে কমেন্ট্রি বক্সে অজয় বসুর বাঁধাধরা কথা ছিল, ‘কমলদা, মাইকটা ধরুন’। আবার ম্যাচের বিশেষ আবহের জমকালো বর্ণনা দেওয়ার সময় এলেই কমল ভট্টাচার্য সব সময় বলতেন, ‘অজয়, এ বার তোমার পালা।’ আর কেউ সেঞ্চুরিতে পৌঁছলে বা পাঁচ উইকেট নিলে সেই সময় অবশ্যম্ভাবী মাইকটা চলে যেত পুষ্পেন সরকারের কাছে। সেই সেঞ্চুরিয়ান বা স্টার বোলারের স্ট্যাটিক্সটিক্স ওঁর চেয়ে বেশি ভাল তখন আর কে গড়গড় করে মাইকে বলে চলবেন!
তিন জনেরই একটা অভ্যাস ছিল। সতীর্থ ধারাভাষ্যকার কোনও ভুল করে ফেললে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নিজে দায়িত্ব নিয়ে সেটা সামলে দেওয়া। “কমলজ্যেঠু হয়তো অন্যমনস্কতায় এক জন অফস্পিনারকে লেগস্পিনার বলে ফেলেছেন, পাশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে নিজের মাইক টেনে নিয়ে আমার বাবা সামলে দিয়েছেন, ‘ও লেগস্পিনটা করলেও খুব খারাপ করত না বোধহয়, কী বলেন কমলবাবু!’ আবার কখনও বাবা হুড়োহুড়িতে স্কোয়ার লেগকে লেগ স্লিপ বলে বসেছেন, কমলজ্যেঠু সঙ্গে সঙ্গে হাতের মাইক ‘অন’ করে বলে উঠেছেন, ‘অজয়, ওটা সত্যিই স্কোয়ার লেগ, না লেগ স্লিপ এখান থেকে বোঝা একটু মুশকিল!’ এতটাই বোঝাপড়া আর ‘ফেলোফিলিং’ ছিল ওঁদের মধ্যে কমেন্ট্রির সময়,” বলছিলেন অজয়-কন্যা।
এ নিয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে ওঁদের উদার সংবেদনশীল মনের গল্প শোনালেন শ্রীরূপা বসু। বেসরকারি ম্যাচে ভারতের মহিলা ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন শ্রীরূপা। আবার ধারাভাষ্যও দিয়েছেন বেশ কয়েক বছর।
শ্রীরূপা বলছিলেন, “আমাকে তো অনেকে ভাবতেন অজয় বসুর মেয়ে! উনি বসু, আমিও বসু। এমনকী ময়দানের অনেকে আমাকে বলতেন, ‘তুমি তো অজয় বসুর মেয়ে!’ সেই মানুষের সঙ্গে আমি একসঙ্গে কমেন্ট্রি করেছি যেমন, তেমনি অজয়দা আমার খেলা ক্রিকেট ম্যাচেরও ধারাবিবরণী দিয়েছেন। কমলদা, পুষ্পেনদার সঙ্গেও ধারাবিবরণী দিয়েছি। এ রকম অনেক বার হয়েছে, পেছন থেকে ওঁদের কেউ না কেউ আমাকে কোন পজিশনে কে ফিল্ড করছেন, প্রম্পট্ করে গিয়েছেন। ওঁরা কোনও নতুন ধারাভাষ্যকারের দিকে এতটাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।”
কাজের প্রতি অসীম দরদ, প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, মমতা না থাকলে কি এতটা সম্ভব? “টেস্ট ম্যাচের দিনগুলো বাবাকে দেখতাম রোজ রাতে শোওয়ার আগে এক গ্লাস উষ্ণ গরম জলে অল্প নুন ফেলে গার্গল করতে। সকালে উঠেও একই রুটিন। অজয়কাকু নাকি সারা দিনের কমেন্ট্রির পর বাড়ি এসে গরম জলে গার্গল করার পর মুখে এক টুকরো যষ্টিমধু অনেকক্ষণ পুরে রাখতেন। পুষ্পেনকাকু কোল্ড ড্রিঙ্কসের ভক্ত ছিলেন। কিন্তু ইডেন টেস্টের সপ্তাহটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের ধার মাড়াতেন না”, জানালেন শ্রীকান্ত।
নেশাভাঙ যে তাঁরা করতেন না, তা নয়, অজয়বাবু আর কমলবাবু সিগারেট, মদ দু’টোই খেতেন। পুষ্পেন সরকার মদ না খেলেও ধূমপান করতেন। কিন্তু কোনও দিন কাউকেই কেউ বাড়াবাড়ি করতে দেখেননি।
এক বার লেন হাটন ইংল্যান্ড টিমের সঙ্গে কোনও এক কর্তা হিসেবে ইডেন টেস্টের সময় শহরে এসেছিলেন। অনেক বয়স তখন। শ্রীকান্ত বলছিলেন, “বাবা আর অজয়কাকাকে টেস্টের বিশ্রামের দিন তাঁর হোটেলে আসার জন্য নেমন্তন্ন করেন উনি। বলেছিলেন, ‘খেলার দিন আসতে বলছি না। সারা দিন মাইক হাতে বকবক করে নির্ঘাত ক্লান্ত থাকবে তোমরা।’ তো হাটনের পাশে মদের গ্লাস হাতে বাবার ছবি এখনও আমাদের বাড়িতে আছে।”
মাঠচরা প্রবীণদের কেউ কেউ বলেন, ওঁদের কমেন্ট্রি বক্সে ঢুকতে দেখলে মনে হত, খেলার ধারাবিবরণী দিতে নয়, যেন মন্দিরে উপাসনায় চলেছেন তিন পূজারি! কেমন ছিল তাঁদের সেই ‘মন্দির’?
কমেন্ট্রি বক্সটা ছিল এখনকার ক্লাবহাউসের একেবারে উল্টো দিকে। এখন যেখানে ইডেনের ইলেকট্রনিক জায়ান্ট স্কোরবোর্ড, ষাট-সত্তরের দশকে সেখানে ছিল হাতে চালানো স্কোরবোর্ড। আর ঠিক তার তলায় ছিল কাঠের পাটাতনের ওপর লোহা দিয়ে বানানো কমেন্ট্রি বক্স। কমেন্ট্রি রুম-টুম তখন স্বপ্নের অতীত।
পুরনো রঞ্জি স্ট্যান্ড ছিল যেটা, তার নীচের গেট দিয়ে কমল ভট্টাচার্য, অজয় বসু, পুষ্পেন সরকার ইডেনে ঢুকতেন। “এক বার আমি বাবার সঙ্গে সেখান দিয়ে ঢুকছি। বাবার একটু পিছনে পড়ে গিয়েছিলাম বোধহয়, গেটে পুলিশ আমাকে আটকাল। বাবা পুলিশকে বললেন, ‘এ আমার ছেলে।’ উত্তরে খানিকটা অবাক হয়ে সেই পুলিশকর্মী বাবাকে বলেছিলেন, ‘কমলদা আপনার ক’টা ছেলে? এর মধ্যেই তো আরও দু’টো ছোকরা নিজেদের কমল ভট্টাচার্যের ছেলে পরিচয় দিয়ে মাঠে ঢুকে গিয়েছে!’ ছেলে-বুড়ো সবার কাছে ‘কমলদা’র এতটাই জনপ্রিয়তা ছিল!” গড় গড় করে বলে চললেন শ্রীকান্তবাবু।
খেলা-পাগল বাঙালির কাছে মহাত্রয়ীর জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি ছিল যে, ধারাভাষ্য ঘিরে একবার ঐতিহাসিক বিতর্কও থামানো হয় সেই জনপ্রিয়তাকে ভর করেই। বিতর্কের মূলে বাংলার বিখ্যাত প্রবীণ ক্রিকেটার কার্তিক বসু। সে বার রেডিয়োয় তিনি বিশেষজ্ঞের ভূমিকায়।
আটাত্তর সাল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট হার বাঁচাতে শেষ দিন চায়ের পর দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছে। ক্রিজ কামড়ে পড়ে আছেন ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক আলভিন কালীচরণ। এমন একটা সময় অজয়বাবু মাইক হাতে কার্তিক বসুর কাছে জানতে চাইলেন, ‘‘কী বুঝছেন কার্তিকবাবু, এই অবস্থায় আর কতটা প্রতিরোধ দিতে পারবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ?”
উত্তরে সহভাষ্যকার, আপামর রেডিও শ্রোতা এমনকী আকাশবাণীর প্রোডাকশনের লোকজনদের চোখ প্রায় কপালে তুলে দিয়ে কার্তিক বসু বলে দেন, “শালা কালীচরণটা যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ ভারতের আশা নেই।”
ব্যস, আকাশবাণীতে পরের পর অভিযোগের ফোন। এটা কী ভাষা! কেন এ রকম এক জনকে বাঙালির হৃদয়ের কমেন্ট্রি টিমের সঙ্গে বসতে দিয়েছেন? যত বিখ্যাত প্রাক্তন ক্রিকেটারই হন না কেন তিনি!
অজয়-কমল যুগলবন্দিও তখন যেন খানিকটা বেসামাল। “পর দিন অজয়কাকু আর বাবা উত্তেজনার বশে যে যার মাইক নেওয়ার বদলে একসঙ্গে একটাই মাইকে পরের কয়েক মিনিট কমেন্ট্রি করেছিলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বোঝাতে যে, কার্তিক বসু কথাটা গুড স্পিরিটে বলেছেন। কোনও খারাপ সেন্সে নয়।”
পড়তি ফর্মের বিষেন সিংহ বেদীকে কটাক্ষ করেও একবার বেশ উৎপটাং কথা বলে ফেলেছিলেন কার্তিক বসু। “বেদীর আঙুলে আর কিছু নেই। ওই আঙুল দিয়ে সন্ধ্যাহ্নিক করা যেতে পারে। বল আর ঘুরবে না।” আবার বিতর্ক। সে বারও ওই একই কায়দায় সামাল দেন ওই অজয়-কমল জুটিই।
নজিরের পর নজির, একের পর এক সাফল্য এঁদের যে কী উচ্চতায় নিয়ে গেছে! ওঁদের আগমন, উত্থান, বিদায় নেওয়ার মাঝে মাঠ-ময়দানে বহু বহু রেকর্ড ভেঙেছে। গড়েছে। কিন্তু এঁদের তৈরি রেকর্ডগুলো যেন আদি-অনন্তের। এমনই এক প্রসঙ্গ উঠতে কমল-তনয় আরেক অদ্ভুত কীর্তির কথা তুললেন।— বাবা-ছেলে একসঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটের ধারাভাষ্য দেওয়ার নজিরও বোধহয় প্রথম বাংলা কমেন্ট্রিতেই (নাকি এটাই একমাত্র নজির! খোঁজ নেওয়া যেতে পারে।)। এ ঘটনার মুখরাটাও ওঁদের মতোই স্মৃতির মধ্যে কম উজ্জ্বল নয়।
কী রকম? কমল-পুত্র শ্রীকান্তের মুখেই শোনা যাক। “আমি যে কলকাতা আকাশবাণীতে বাংলা ধারাবিবরণীর জন্য অডিশন দিয়েছি বাবা জানতেনই না। এক দিন স্টেশন ডিরেক্টর নাকি একটা ক্যাসেট দেখিয়ে বাবাকে বলেছিলেন, শ্রীকান্ত নামের একটা ছেলে, আপনাদের শ্যামবাজারের দিকেই থাকে, ভাবছি একে পরের ম্যাচের বাংলা কমেন্ট্রি টিমে রাখব। বাবা নাকি বলেছিলেন, ‘এই শ্রীকান্ত কি মোহনলাল স্ট্রিটে থাকে?’ উত্তরে ‘হ্যাঁ’ শুনে ফের বাবা নাকি বলেন, বাড়ির নম্বর কি ১৪/এ? তাতেও ‘হ্যাঁ’ শুনে বাবা বলেছিলেন, তা হলে এই শ্রীকান্ত আমার ছেলে। তার পর নাকি স্টেশন ডিরেক্টরের চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। ‘আপনি এতক্ষণ সেটাই বলেননি?’ বলে নাকি বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ভদ্রলোক।”
তবে আসল মজাটা এর পরে। “ম্যাচের দু’দিন আগে থেকে বাড়িতে আমি আর বাবা রীতিমতো রিহার্সাল দিয়েছিলাম কী ভাবে কমেন্ট্রিতে আমরা বাবা-ছেলে নিজেদের মধ্যে কথা বলব।”
বাবাকে যে সেদিন ছেলের ডাকনাম ভুলতে হয়েছিল! আর ছেলেকেও তাঁর বাবাকে নাগাড়ে বলে যেতে হয়েছিল ‘কমলবাবু’!
কঠিন পিচে দুরন্ত পেস বোলার সামলানোর মতো এ’ও কি কম কঠিন কাজ!
http://www.anandabazar.com/supplementary/patrika/%E0%A6%87%E0%A6%A1-%E0%A6%A8-%E0%A6%89%E0%A6%A6-%E0%A6%AF-%E0%A6%A8-%E0%A6%A5-%E0%A6%95-%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A6%9B-1.109464
No comments:
Post a Comment